পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা মানুষকে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ব্যপারে বার বার তাকিদ দিয়েছেন। একই সাথে তিনি মানুষের অন্তরে স্রষ্টা সম্পর্কে ফিতরাহ দিয়েছেন। বুদ্ভিমত্তা ও ফিতরাহ ব্যবহার করে একজন মানুষ তার স্রষ্টাকে সহজেই চিনতে পারে। এ কারণে তিনি কোন কোন জায়গায় মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন। কোথাও মানুষের নিজের গঠনের ব্যপারে চিন্তা করতে বলেছেন। আবার কোন জায়গায় ছোট-বড় বিভিন্ন প্রানীর উপমা টেনে উক্ত প্রাণীর সৃষ্টিশৈলী নিয়ে গবেষণা করে সত্য সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনিত হতে উৎসাহিত করেছেন। কোরআনের শুরুর দিকে সুরা বাকার ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ এরকম একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে বলছেন-
“অবশ্য আল্লাহ লজ্জা করেন না মশা বা তার চেয়ে তুচ্ছ কোন জিনিসের দৃষ্টান্ত দিতে ৷ যারা সত্য গ্রহণকারী তারা এ দৃষ্টান্ত –উপমাগুলো দেখে জানতে পারে এগুলো সত্য, এগুলো এসেছে তাদের রবেরই পক্ষ থেকে, আর যারা (সত্যকে) গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় তারা এগুলো শুনে বলতে থাকে , এ ধরনের দৃষ্টান্ত –উপমার সাথে আল্লাহর কী সম্পর্ক ?” (১)
চলুন মশার গঠন নিয়ে ভেবে দেখি এতে আমাদের জন্য কি চিন্তার উপাদান আছে।
দৈনন্দিন জীবনকে দূর্বিষহ করার জন্য মশার মত ছোট প্রাণীই যথেষ্ট। আর্থোপোডা গোত্রের এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি ডেংগু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি প্রাণঘাতী রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। ফলে আমাদের প্রতি সন্ধ্যার রূটিন হয় মশা থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় উপকরণ ব্যবহার করা। অধিকন্তু, প্রতিদিনের অসংখ্য অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে আমাদের সাবকনসাশ ব্রেইন চমৎকারভাবে ইগনোর করতে পারে। এ কারণে আমরা মনে করি মশা নিয়ে আলাদা ভাবে ভাববার কি আছে?
কিন্তু, বিজ্ঞানীরা সবকিছু ভিন্নভাবে চিন্তা করেন। তারা মশার গঠন ও জীবনপ্রণালী থেকে শুরু করে মশা কিভাবে রক্তচুষে এবং কিভাবে উড়ে বেড়ায় তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন।
যে কোন উড্ডয়নশীল প্রাণীর জন্য একটা বড় বিষয় হল তার এরোডাইন্যামিক্স। অর্থাৎ কিভাবে সে মাটিতে বসা থেকে উড়তে শুরু করে, কিভাবে সে বাতাসে উড়ে বেড়ায় এবং কিভাবে সে উড়ন্ত অবস্থা থেকে অবতরণ করে। আমরা জানি পাখিদের উড়ার কৌশল নিয়ে গবেষণা করতে করতেই উড়োজাহাজের আবিস্কার হয়েছে।
পাখির তুলনায় কিটপতঙ্গের উড্ডয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল কিটপতঙ্গ পাখা ঝাপটে বাতাসে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে। এ ধরনের উড়াকে বলে হোভারিং। এর বাইরেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া, পাশে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের উড্ডয়ন আছে যা আমরা প্রতিদিনই দেখি।
আমাদের হাত পা নাড়াচারা করতে যেমন অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট মাংসপেশী লাগে। কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও উড়ার জন্য মাংসপেশী প্রয়োজন। কিছু কিছু কীটের পাখার জন্য আলাদা মাংসপেশী আছে এবং কিছু কীটের ক্ষেত্রে উক্ত মাংসপেশী থাকে বুকে। এদের ক্ষেত্রে পাখাদ্বয় পিঠে লাগানো থাকে। মাংসপেশীর সংকোচন ও প্রসারনের মাধ্যমে বক্ষপিঞ্জরের সংকোচন ও প্রসারন হয়। ফলে সংযুক্ত পাখাদ্বয় ঝাপটাতে থাকে। (২) আমাদের আলোচ্য মশা শেষের উল্লিখিত পদ্ধতিতে উড়ে বেড়ায়।
মশার প্রায় স্বচ্ছ ও ক্ষুদ্র দুটো পাখা আছে, যা সুনির্দিষ্ট ব্যাসাল গঠন দিয়ে থোরাক্সের সাথে লাগানো থাকে। সুনির্দিষ্ট বললাম এই জন্য যে অন্যান্য কীটপতঙ্গের তুলনায় মশার পাখার বেজ এ গঠনের পার্থক্য আছে (৩)।
কীট পতঙ্গ উড়ার সময় পাখা সামনে পিছনে এবং উপরে নিচে এমনভাবে ঝাপটায় যাতে পাখার সামনের দিকের এজ (Edge) বাতাসে এক ধরনের ভর্টেক্স তৈরী করে। যাকে বলা হয় লিডিং এজ ভর্টেক্স। এই ভর্টেক্স পাখা ও শরীরের নিচে গিয়ে কীটের শরীরকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখে। কিন্তু, মশা পাখা এমনভাবে ঝাপটায় যে পাখার সামনে লিডিং এজ ভর্টেক্স এর পাশাপাশি তৈরী হয় পাখার পিছনের দিকে ট্রেইলিং এজ ভর্টেক্স (৪)।
ফলে মশাকে ভেসে থাকতে অনেক দ্রুত পাখা ঝাপটাতে হয়। একটা মশা প্রতি সেকেন্ডে ১৬৫ থেকে ৫৮৭ বার পাখা ঝাপটাতে পারে (৩)। এই কারণেই মশা কানের কাছে ঘুরতে থাকলে আমরা ভো ভো শব্দ পাই ও বিরক্ত হই। মশার পাখার শব্দ আমাদের কাছে বিরক্তিকর লাগলেও মশার নিজের কোর্টশিপের (স্ত্রী-মিলন) জন্য এটি জরুরী। এমনকি কোর্টশিপের সময় মশার তার পাখার ঝাপটানোর ফ্রিকোয়েন্সী নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে শব্দের টোন পরিবর্তন করে (৫)।
প্রিয় পাঠক এবার চিন্তা করে দেখুন একটা মশাকে শুধুমাত্র উড়ার সক্ষমতা দেয়ার জন্য কতগুলো জিনিস জানতে হবে- বাতাসের ফিজিক্স, মশার পাখার বিস্তৃতি কতটুকু হওয়া যাবে, পাখা ঝাপটানোর স্পিড কতটুকু হতে হবে, পাখার ঝাপটানোর দিক কেমন হওয়া চাই, পাখার ঝাপটানোর জন্য থোরাক্সের মাংসপেশী কতটুকু হতে হবে, প্রতিটা ঝাপটার সময় পাখায় অক্সিজেন সরবারহ নিশ্চিত করতে হবে, ইত্যাদি। এই ভাবে যেতে থাকলে লিস্টটা অনেক বড় হবে। এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল সবগুলো গঠন ও ফাংশন একটার সাথে আরেকটা অতপ্রত ভাবে জড়িত হয়ে একটি কমপ্লেক্স সিস্টেম দাড় করিয়েছে।
পরিস্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে এই গঠনের পিছনের সুনির্দিষ্ট ডিজাইন ও পরিকল্পনা আছে। কোন এলপাতাড়ি ও অন্ধ প্রক্রিয়ায় মশার উড্ডয়ন ক্ষমতা উদ্ভব হয়নি।
একটা মশা মানুষকে কুপোকাত করে দিতে পারে। অথচ, আমরা নিজেরা আল্লাহর দেয়া জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা ব্যবহার করে আমাদের স্রষ্টার নিয়মাতকে অস্বীকার করি। নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে ভুলে যাই।
আমাদের কি একটু বোধোদয় হবে না।
১. আল কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত-২৬
২. Wikipedia. Insect Flight [Internet]. 2019 [cited 2019 Nov 6]. Available from: https://en.wikipedia.org/wiki/Insect_flight
৩. Snodgrass RE. The Anatomical Life of The Mosquito. Smithson Misc Collect. 1959;139(8):65–6.
৪. Bomphrey RJ, Nakata T, Phillips N, Walker SM. Smart wing rotation and trailing-edge vortices enable high-frequency mosquito flight. Nature [Internet]. 2017 Mar 29 [cited 2019 Jun 11];544(7648):92–5. Available from: http://www.nature.com/doifinder/10.1038/nature21727
৫. Arthur BJ, Emr KS, Wyttenbach RA, Hoy RR. Mosquito ( Aedes aegypti ) flight tones: Frequency, harmonicity, spherical spreading, and phase relationships. J Acoust Soc Am. 2014;135(2):933–41.
Leave a Reply