সম্ভাব্যতা বা প্রবেবিলিটি শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সাধারনের ভাষায় সম্ভাব্যতা বলতে বুঝায়- আমি কোন একটি কাজ করব কি করব না, কোথাও যাবো কি যাবো না, এ ধরনের অনিশ্চয়তামূলক ভাব প্রকাশ। গানিতিক ভাষায় সম্ভাব্যতার অর্থ কাছাকাছি হলেও এটাকে সুনির্দিষ্ট সাংকেতিক ভাষায় প্রকাশ করা হয়। চলুন সম্ভাব্যতার একেবারে সরল কিছু উদাহরণ থেকে এ সম্পর্কে ধারণা নেই।
সম্ভাব্যতা:
একটি লুডুর গুটি কোটে এলোপাতাড়ী ভাবে ফেললে যে কোন একটি সংখ্যা পড়ার সম্ভাবনা = ১/৬
দুটি গুটি লুডুর কোটে এলোপাতাড়ী ভাবে ফেললে যে কোন দুটি সংখ্যা একত্রে পড়ার সম্ভাবনা = ১/৬ * ১/৬ = ১/৩৬ = ১/৬^২
তিনটি গুটি কোটে এলোপাতাড়ী ভাবে ফেললে যে কোন তিনটি সংখ্যা একত্রে পড়ার সম্ভাবনা = ১/৬ * ১/৬ * ১/৬ = ১/৩৯৬ = ১/৬^৩
তিনটি গুটি ফেললে একটিতে ‘১’, দ্বিতীয়টিতে ‘২’ এবং তৃতীয়টিতে ‘৩’ পড়ার সম্ভাব্যতা = ১/৩৯৬ = ১/৬^৩
একইভাবে, তিনটি গুটি ফেললে একটিতে ‘২’, দ্বিতীয়টিতে ‘৩’ এবং তৃতীয়টিতে ‘৬’ পড়ার সম্ভাব্যতাও = ১/৩৯৬ = ১/৬^৩
অর্থাৎ, আপনি তিনটি ছক্কার সংখ্যাকে নির্দিষ্টভাবে বলে দিলেও সম্ভাব্না একই এবং তা ১/৩৯৬ তথা ১/৬^৩।
লক্ষ্যনীয় এখানে ‘^’ চিহ্ন দিয়ে ‘টু দি পাওয়ার’ বুঝানো হচ্ছে। এবং মজার বিষয় হল আপনি ছক্কার সংখ্যা এভাবে ‘n’ সংখ্যক বাড়াতে থাকেন, তাহলে যে কোন একটি সংখ্যার পড়ার সম্ভাব্যতা হবে ১/৬^n।
লটারীর টিকিট:
ধরুন, ১০ জন ব্যক্তির একটি গ্রুপ তৈরী করার হয়েছে এবং ১ জনকে উক্ত গ্রুপের লিডার হিসেবে মনোনীত করা হবে। এ প্রেক্ষিতে প্রতিটি ব্যক্তিকে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত ৯ টি অংক এবং একজনকে ‘০’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে, অর্থাৎ মোট দশটি অংক। এবার, ১০টি কাগজে নাম্বারগুলো লিখে লটারী করা হলো এবং একটি কাগজ উঠানো হল। তাহলে, যে কোন একটি সংখ্যা আসার সম্ভাবনা কত? উত্তর: ১/১০।
এরকম যদি ১০০ জন ব্যক্তির মধ্যে লটারী করা হয়, যে কোন একজনের ওঠার সম্ভাবনা = ১/১০ *১/১০ = ১/১০০। এক্ষেত্রে ‘০১’ চিহ্নিত ব্যক্তির কাগজটি ওঠার সম্ভাব্যতা যা ‘৫৬’ নম্বর ব্যক্তিটির কাগজ ওঠার সম্ভাব্যতাও তাই =১/১০০।
মনে করুন, আপনি গুলিস্তান থেকে একটি লটারীর টিকিট কিনেছেন এই আশায় যে আপনি ১,০০,০০,০০০ (এক কোটি) টাকা পাবেন। ধরুন, লটারীর মধ্যে অঙ্কিত সংখ্যাটিতে মোটি দশটি নাম্বার আছে। যেমন: ১৩৪৫৭৮৯৬০২ । প্রশ্ন হলো যদি লটারী সম্পন্ন করার দিন কোন কারচুপি না হয় এবং সম্পূর্ণ এলোপাতাড়ীভাবেই যে কোন একটি সংখ্যা তোলার সম্ভাবনা থাকে আপনার এই নাম্বারটি লটারীতে ওঠার সম্ভাবনা কত?
উত্তর: ১/১০ * ১/১০ * ১/১০* ১/১০* ১/১০* ১/১০* ১/১০* ১/১০* ১/১০* ১/১০ এর মধ্যে একবার
= অর্থাৎ, ১/১০০,০০,০০,০০০-এর মধ্যে একবার
= অর্থাৎ, ১০০ কোটি বারের মধ্যে একবার।
এই সংখ্যাটাকে যদি আমরা পাওয়ারে প্রকাশ করি= ১০^১০। সুতরাং,আপনার লটারীতে জেতার সম্ভবনা ১০^১০-মধ্যে একবার।
মজার বিষয় হলো,আপনার সাথে অন্য যে কয়জন কিনেছে তাদেরও জেতার সম্ভবনা একই।
প্রোবেবিলিটি রিসোর্স:
উপকরণ
এখন, ধরুন, আপনি নাছোড় বান্দা আপনার লটারীতে জিততেই হবে, সেক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? আপনাকে একাধিক লটারী কিনতে হবে। আপনি যদি একশটি লটারী সংগ্রহ করেন আপনার সম্ভব্যতা বেড়ে দাড়াবে-
= ১/১০^১০ + ১/১০^১০ +……+ ১/১০^১০ (এভাবে ১০০টি ১/১০^১০)
= ১০০/ ১০^১০
= ১/ ১০^৮
অর্থাৎ, আপনার জেতার সম্ভাবনা বেড়ে দাড়ালো ১ কোটি বাড়ে একবার। কিন্তু এখনও সংখ্যাটা অনেক বড়। তাই আপনি ভাবলেন যে আপনি আপনার যেতার সম্ভাবনা আরও বাড়াবেন। এরকম করতে করতে আপনি যদি নিশ্চিতভাবেই জয়ী হতে চান আপনাকে ১০০ কোটির লটারীর কপিই কিনতে হবে। কেননা সেক্ষেত্রে আপনার জেতার সম্ভাব্যতা দাড়াবে = ১০^১০ / ১০^১০ = ১।
লটারীর দাম এক টাকা করে হলেও আপনার কিনতে খরচ পড়বে ১০০ কোটি টাকা। ১০০ কোটি টাকা খরচ করে ১ কোটি টাকা জিততে চেষ্টা করার কোন বোকা লোক কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এবার চিত্রটি আপনি একটু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করুন। ধরুন, আপনি অগাধ টাকার মালিক। আপনি ১ কোটি টাকা কাউকে লটারীর মাধ্যমে দিতে চান। আপনি ১০০ কোটি লটারীর টিকিট ছাপিয়েছেন বিলি করার ইচ্ছায়। আপনি নিশ্চিত হতে চান যে একজন ব্যক্তির কাছে টাকাটা পৌছুবেই। কিন্তু, কিভাবে নিশ্চিত হবেন? উত্তর: আপনাকে ১০০ কোটি মানুষের কাছেই টিকিট পৌছানো নিশ্চিত করতে হবে। কেননা সেক্ষেত্রে যে কোন একজনের হাতে প্রত্যাশিত টিকিটটি পৌছবেই। ধরুণ, আপনি সব টিকিট বিলি করেছেন কিন্তু একটি বাকি আছে। সেক্ষেত্রে-ও সম্ভবনা থেকে যাবে যে উক্ত বাকী টিকিটই বিজয়ী হবে।
এই যে একশ কোটি লটারীর টিকিট বা একশ কোটি টিকিট ক্রেতা এদেরকে গানিতিক পরিভাষায় বলা হয় ‘প্রোবেবিলিটি রিসোর্স’। অর্থাৎ, আপনি কোন একটি এলোপাতড়ী প্রক্রিয়ায় একটি ঘটনা ঘটার সম্ভবনা বাড়াতে পারবেন সংশ্লিস্ট প্রোবেবিলিটি রিসোর্স বাড়ানোর মাধ্যমে। যেমনটা আমরা উপরে দেখেছি।
সময়
কিন্তু, আপনার অনেক বয়স হয়ে গেছে। আপনার হাতে সময় খুব কম। ধরে নিলাম, আপনি চান একশ কোটি লটারী নিজ হাতে বিলি করতে এবং আপনি কম্পিউটারে বসে এটি করতে চাচ্ছেন। এখন আপনি কোন বিশ্রাম না নিয়ে যদি প্রতি মিনিটে একটি করে বিলি করেন সময় লাগবে,
= ১০০ কোটি মিনিট = প্রায় ১ কোটি ৬৬ লক্ষ ঘন্টা = প্রায় ৬ লক্ষ ৯৪ হাজার দিন = প্রায় ১ হাজার ৯০২ বছর।
আপনি প্রতি সেকেন্ডে একটি বিলি করলে সময় লাগবে,
= ১০০ কোটি সেকেন্ড = প্রায় ১ কোটি ৬৬ লক্ষ মিনিট = প্রায় ২ লক্ষ ৭৭ হাজার ঘন্টা = প্রায় ১১ হাজার ৫৭৪ দিন = ৩১ বছর
আপনি প্রতি সেকেণ্ড ১০০টি বিলি করলে সময় লাগবে,
= ১ কোটি সেকেন্ড = প্রায় ১ লক্ষ ৬৬ হাজার মিনিট = প্রায় ২ হাজার ৭৭৭ ঘন্টা = প্রায় ১১৫ দিন = ০.৩১ বছর প্রায়
অর্থাৎ, সময়ও একটি প্রবেবিলিটি রিসোর্স।
সুতরাং, প্রোবেবিলিটি রিসোর্স তিন ধরনের: উপকরনের সংখ্যা, ঘটনাটি ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় সময় (ইভেন্ট টাইম) এবং এভেইলেবল সময়।
সার্বজনিন সম্ভাব্যতার সীমা
এতক্ষণ আমরা দেখলাম সম্ভাব্যতার রিসোর্স কি কি ধরনের হতে পারে। এবার চলুন হিসেব করা যাক সার্বজনিন সম্ভাব্যতার সীমা।
প্রথমে জেনে নিই সার্বজনিন সম্ভাব্যতার সীমা বলতে কি বুঝায়? সার্বজনিন সম্ভাব্যতার সীমা বলতে বুঝায় কোন ঘটনা (যেমন: কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া) ঘটার জন্য যে সকল প্রোবেবিলিটি রিসোর্স আছে গানিতিক ভাবে তা সর্বচ্চো কত পর্যন্ত হতে পারে। চলুন উপরের লুডুর গুটির বিষয়টি নিয়ে নিয়ে চিন্তা করি। মনে করুন আপনি একটি গেমস খেলছেন যেখানে আপনাকে বলা হল: আপনাকে লুডুর গুটি ফেলতে হবে এবং যদি ছয়টি ছয় একসাথে পড়ে অথবা একই ক্রমে পড়ে তাহলে আপনি একটি গিফট পাবেন। ধরি, আপনাকে লুডুর গুটির সংখ্যা বেঁধে দেয়া হয়নি এবং আপনাকে যত সময় ইচ্ছে গুটি ফেলার অধিকার দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আপনি দুইভাবে ছয়টি ছয় এক সাথে বা এক ক্রমে ফেলতে পারবেন।
- প্রথমত আপনি যদি ৬^৬ তথা ৪৬,৬৫৬-টি গুটি একসাথে ফেলেন তাহলে এর মধ্যে নিশ্চিত ভাবেই ছয়টি ছয় পাবেন।
- আপনার যদি একবার ছয় ফেলতে ১ মিনিট সময় লাগে তাহলে আপনি ৪৬,৬৫৬ মিনিট চেষ্টা করলে একবার অবশ্যই ক্রমান্বয়ে ছয়টি ছয় ফেলতে পারবেন।
এখানে ৪৬,৬৫৬-টি গুটি বা ৪৬,৬৫৬ মিনিট হলো প্রবেবিলিটি রিসোর্স।
এখন ধরুন আপনি অতিআনবিক পর্যায়ে একটি ইন্টার্যাকশন ঘটার সম্ভাব্যতা হিসেব করছেন। মনে করি ইন্টার্যাকশনটি ঘটে সবচেয়ে কম সময়ে। ইন্টার্যাকশনটি হবে দুটো পার্টিকেলের (দুটো প্রোটোন বা দুটো নিউট্রন) মধ্যে। তাহলে উক্ত ঘটনাটি ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোবেবিলিটি রিসোর্স কি? এক্ষেত্রে এটির প্রবেবিলিটি রিসোর্স হল-
- কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাব্য সর্বনিম্ন সময় তথা প্ল্যাংক সময় ১০^-৪৩ সেকেন্ড।
- মহাবিশ্বের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অতিবাহিত কাল – ১০^১৭ সেকেন্ড
- দৃশ্যমান মহাবিশ্বের হিসেবকৃত পার্টিকেল সংখ্যা – ১০^৮০
সুতরাং সার্বজনিন সম্ভব্যতার সীমা = ১০^৪৩ * ১০^১৭ * ১০^৮০= ১০^(৪৩+১৭+৮০) = ১০^১৪০।
বিজ্ঞানী David Abel-এর ভাষায় এটি হলো কোয়ান্টাম ওয়ার্ল্ডের কোন ইভেন্ট-এর ইউনিভার্সাল প্লসিবিলিটি ম্যাট্রিক্স (১)। অর্থাৎ, কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা যদি ১০^১৪০-এর মধ্যে একবার হয় এবং উক্ত ঘটনা ঘটার জন্য মহাবিশ্বের সকল পার্টিকেল ও সকল সময় ব্যবহার করার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে ঘটনাটি একবার হলেও ঘটবে। কিন্তু, কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা যদি ১/ ১০^১৪১ হয়, তাহলে মহাবিশ্বের সকল পার্টিকেল ও সকল সময় ব্যবহার করেও উক্ত ঘটনা এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ায় একবার ঘটবে না।
তাহলে পাঠক একবার চিন্তা করে বলুনতো, কোন ঘটনা যদি এলোপাতাড়ি ভাবে একবার হবার সম্ভাবনা ১০^১৬৪ হয় মহাবিশ্বের ইতিহাসে উক্ত ঘটনা এলোপাতাড়ি ভাবে ঘটার আদৌ কি কোন সম্ভাবনা আছে?
অথচ, এর চেয়ে অনেক বেশী অসম্ভাব্য ঘটনা আদিম পৃথিবীতে এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ায় ঘটেছে বলে দাবী করা হচ্ছে। সে সম্পর্কে আমরা জানবো আরেকটি পর্বে। ইন শা আল্লাহ।
রেফারেন্স:
১) Abel DL. The universal plausibility metric (UPM) & principle (UPP). Theor Biol Med Model. 2009;6(1):1–10.
Leave a Reply