গত বছর আমি আল বালাগ একাডেমি, লন্ডনের একটি অনলাইন উইকলি কোর্সে এনরোল করি- এথেইজম এবং ইসলাম। সেখানে ইসলাম এবং বিবর্তনবাদ নিয়ে একটি ক্লাস ছিল। ক্লাসটি নিয়েছিলেন ড. শোয়েব আহমেদ মালিক। ক্লাসটিতে তিনি সংক্ষেপে বিবর্তন নিয়ে মুসলিম চিন্তকদের অবস্থান সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেছিলেন। আমার আজকের এই পোস্ট-এ সেই ক্লাসে নেয়া আমার কিছু নোটের ভিত্তিকে আলোচনা করতে চাই।
চলুন প্রথমে একটু ড. মালিক সম্পর্কে জেনে নেই। ড. মালিক University of Nottingham থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিরিয়াং-এ পিএইচডি করার পর যায়েদ ইউনিভার্সিটিতে নাচারাল সায়েন্স বিভাগে এসিসটেন্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন। সম্প্রতি উনার ইন্টারেস্ট ফিলোসফী অব সায়েন্স এণ্ড রিলিজিয়ন-এর দিকে ডাইভার্ট হয়। রিসেন্টলি তিনি ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ থেকে ফিলোসফি অব সায়েন্স-এ আরেকটি মাস্টার্স শেষ করেছেন এবং পিএইচডি-র জন্য এনরোলড হয়েছেন। এ বছর ইসলাম ও বিবর্তনবাদের উপর একটি বিশদ বই – Islam and Evolution: Al-Ghazali and the Modern Evolutionary Paradigm-এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট লিখে শেষ করেছেন যা আগামী বছর রোলেজ থেকে পাবলিশ হবে ইন শা আল্লাহ।
(https://www.facebook.com/shoaib.a.malik.18)
এখন মূল আলোচনায় আসি। ড. মালিক তার ক্লাসে বলেছিলেন বিবর্তনবাদ নিয়ে মুসলিম চিন্তকদের প্রায় ২৭টি ভিন্ন রকম অবস্থান আছে। তবে, ব্রডলি মুসলিম চিন্তকদের অবস্থানকে তিনটি মূল ভাগে ভাগ করা যায়- রিজেকশন, এক্সেপটেন্স, এবং পার্সিয়াল এক্সেপটেন্স। সাধারণ হিসেবে প্রায় ৩৫% বিবর্তনবাদকে রিজেক্ট করেন, ৩৫% এক্সেপ্ট করেন এবং ৩০% -এর অবস্থান মর্ধবর্তী।
তবে, এই তিন দলের অবস্থান নির্ভর করে মূলত দুটি বিষয়ের উপর-
(১) বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সম্পর্কে চিন্তকের পড়াশোনা এবং কনভিকশন
(২) জীবজগত সম্পর্কে ইসলামী নলেজ সোর্স -কোরআন এবং হাদিসের বক্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান এবং চিন্তক তা কিভাবে নিচ্ছেন
তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল (৩) ‘মানুষের বিবর্তন’।
বস্তুত, এই প্রশ্নে এসেই বিবর্তনবাদের পার্সিয়াল এক্সেপটেন্স গ্রুপটি তৈরী হয়েছে। কারণ, কোরআন ও হাদীসে অন্যান্য জীবের সৃষ্টি সম্পর্কে ‘explicit’ বক্তব্য না থাকলেও আদম (আ)-এর সৃষ্টির ব্যাপারে ‘explicit’ বক্তব্য আছে। তবে ভ্যারিয়েশন তৈরী হয়েছে উক্ত বক্তব্যের ইন্টারপ্রিটেশনের উপরে।
যারা বিবর্তনবাদকে পুরোপুরি গ্রহন করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিন্তক হল –
১. ড. রানা দেজানী,
২. ড. নিধাল আহমেদ, এবং
৩. ড. ইসরার আহমেদ।
এদের মতে বিবর্তনবাদের সত্যতা সন্দেহ করার সুযোগ নেই, এবং সবাই একমত যে মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টির ব্যপারে ইসলামের বক্তব্যও বিবর্তনবাদ গ্রহনে কোন বাধা দেয় না।
তবে কোরআনের মানব সৃষ্টি সম্পকির্ত কথার ব্যপারে তাদের চিন্তা বিভিন্ন। ড. দেজানীর মতে, এই বক্তব্য গুলো ‘রূপক’ তথা Matephorical। ড. আহমেদের মতে কোরআনে আয়াতগুলো বিভিন্ন ভাবে অর্থ করা এবং ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। ড. ইসরার আহমেদের মতে দুনিয়াকে দুটি ভাগে পৃথক করা যায়- খালক এবং আমর। কোরআনে মানুষকে একবার ইনসান এবং একবার বাশার হিসেবে সন্মোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ, মানবজাতির দুটোর স্বত্ত্বা আছে। একটি দৈহিক এবং আরেকটি স্পিরিচুয়েল। মানবদেহ বিবর্তনের মাধ্যমেই এসেছে, তবে তাদের মধ্যে রূহ ইনস্টল করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং, বিবর্তনবাদের সাথে ইসলামের বাহ্যত কোন কনফ্লিক্ট নেই।
যারা বিবর্তনবাদকে সোজাসুজি (outright) রিজেক্ট করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিন্তক হলেন-
১. ড. সায়্যেদ হুসাইন নাসর
২. শায়েখ নুহ কেলার
৩. হারুন ইয়াহিয়া (গং)
এদের মধ্যে বিবর্তন রিজেক্ট করার ধরন এবং কারণে ভিন্নতা আছে। ড. নাসর বিবর্তনকে অস্বীকার করেন purely metaphysical কারণে। তার মতে প্রতিটি সৃষ্টি জীবের স্বত্ত্বা সুনির্দিষ্ট এবং এগুলোকে এই ফর্মেই পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং, বিবর্তন হবার সুযোগ নেই।
শায়েখ কেলার অন্যান্য জীবের বিবর্তনের ব্যপারে সন্দেহে থাকলেও মানুষের বিবর্তনকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। কারণ, তার মতে কোরআনের সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো আক্ষরিক, স্পষ্ট এবং এগুলোকে রূপক ভাবার সুযোগ নেই। তিনি আরও মনে করেন আদম (আ)-কে আক্ষরিকভাবেই বেহেশতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে।
হারুন ইয়াহিয়া (এবং মূলত তার অধীনে কাজ করা চিন্তকরা) বিবর্তনের উপস্থাপিত প্রমানকে মিথ্যা মনে করেন নতুবা প্রমানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে তাদের অধিকাংশ সন্দেহের ভিত ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্টাই-ইভুলিউশনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত।
যারা বিবর্তনকে আংশিকভাবে গ্রহণ করে তাদের মধ্যে আছেন-
১. শায়েখ ইয়াসির কাদি
২. ডেভিড সলোমোন জালাজেল
৩. হুসাইন আল জিসর
এদের মধ্যে মধ্যে প্রথম দু’জন বিবর্তনবাদের এর উপস্থাপিত প্রমানের বিষয়ে কনভিন্সড। তন্মধ্যে শায়েখ কাদি’র মতে কোরআনের মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য নেই। তবে, আদম(আ) হচ্ছে মিরাকুলাসলি ক্রিয়েটেড। তবে আদমের আগ পর্যন্ত হোমিনিন গোত্র বিবর্তনের মাধ্যমেই এসেছে। আদম (আ)-এর মাধ্যমে আধুনিক হোম স্যাপিয়েন্স সূচনা হয়েছে।
সলোমোন জালাজেলের মতে হোমো স্যাপিয়েন্স তথা মানুষের বিবর্তনের ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। কারণ প্রমাণ অনেক কনভিন্সিং। আবার কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আদম (আ)-কে মিরাকুলাসলি সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য কথায় তার full form-এ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু, কিভাবে আদম (আ) এবং হোম স্যাপিয়েন্স একইভূত হয়ে গেল সে বিষয়ে কোরআন এবং হাদীস থেকে কিছু জানা যায় না, অতএব এ ব্যাপারে ‘তাওয়াক্কুফ’ অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ, এ বিষয়ে ডেভিল সলোমোন তার পড়াশোনার আলোকে কোন ‘মন্তব্য না করার’ অবস্থান নিয়েছেন।
হুসাইন আল জিসর উনবিংশ শতাব্দীর একজন মুসলিম চিন্তক। তার চিন্তাটা একটু ভিন্ন ধরনের। বিবর্তনবাদীদের উপস্থাপিত প্রমাণ এবং উপস্থাপনের ধরনের বিষয়ে তার প্রশ্ন আছে। তার কাছে প্রমাণ সমূহ ‘inadequate’। তদুপরী বিবর্তনবাদকে যে বস্তুবাদের মোড়কে পরিবেশন করা সেই বস্তুবাদকে তিনি রিজেক্ট করেন। তবে তিনি এই ব্যাপারে নমনীয় যে বিবর্তনবাদ যদি যথেষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা স্থিত হয় তাহলে বিবর্তনবাদ গ্রহন করা যেতে পারে। অন্যথা বিবর্তনবাদ ততদিন পর্যন্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। বস্তুত, হুসাইন আল জিসর-ও মনে করতেন যে কোরআনে সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনা সরাসরি ‘as it is’ সৃষ্টির ব্যাপারে কোন স্পষ্ট বক্তব্য দেয় না।
এই ছিলো মোটামুটি আমার গৃহীত নোটের সারসংক্ষেপ।
এখন এই পজিশনগুলোর মধ্যে আমি নিজেকে কোন গ্রুপে মনে করি? আমি মনে করি আমার পজিশন অনেকটাই হুসাইন আল জিসর-এর চিন্তার কাছাকাছি। বিবর্তনবাদের ম্যাক্রোইভল্যুশনের পক্ষে উপস্থাপিত প্রমাণাদি আমি যতটুকু নিজে পড়েছি তাতে কনভিন্সড নই।
তবে আমি এখনও পড়ছি। যদি কখনও দেখি ‘ম্যাক্রো’ বিবর্তনবাদের উপস্থাপিত প্রমাণ যথেষ্ট কনভিন্সিং আমারও বিবর্তন মেনে নিতে সমস্যা নেই। বস্তুত, এটা আমার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসেও কোন বাধাও সৃষ্টি করবে না। কারণটা, লেখক আরিফ আজাদের বিবর্তন সম্পর্কিত রিসেন্ট পোস্টটের একটা কথাকে কোট করে বলতে চাই। আরিফ লিখেছেন –
“আল্লাহ গোটা মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। ধাপে ধাপে। একইভাবে তিনি যদি প্রাণীজগতকেও ধাপে ধাপে সৃষ্টি করে থাকেন, যা বিবর্তনে বলা হয়ে থাকে, তা মেনে নিতেও আমাদের অসুবিধে থাকার কথা নয়।“
অর্থাৎ, দার্শনিক বিবেচনায় আল্লাহ তার সৃষ্টিকে যে কোন উপায়ে সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি চাইলে প্রথম কোষের মধ্যেই বিবর্তিত হবার ম্যাকানিজম তৈরী করে দিতে পারেন। তিনি চাইলে হোমো স্যাপিয়েন্স পর্যন্ত বিবর্তন ঘটিয়ে এর মধ্যে একজনকে উন্নত বুদ্ধিমত্তা, এবং চেতনা ইনস্টল করে দিতে পারেন। আবার তিনি চাইলে প্রতিটি জীবকে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ভ্যারী করার বৈশিষ্ট্য সহ- সুনির্দিষ্ট ‘এসেন্স বা আর্কিটাইপাল ফর্ম’-এ সৃষ্টি করতে পারেন।
……
হে মুসলিম পাঠক, আপনি নিজেকে কোন দলের মনে করেন?
….
পুনশ্চঃ ইসলামের ব্যাপারে অবিশ্বাসীদের জন্য এই পোস্ট না। কারণ, উপরের আলোচনা থেকে দেখলাম একজন ব্যাক্তি শুধুমাত্র বিবর্তনতত্ত্বের কারণে ইসলামে অবিশ্বাস করবে না। বরং, ইসলামে অবিশ্বাসী হলে সমূহ সম্ভাবনা আছে যে বিবর্তনকে বস্তুবাদের মোড়কে উপস্থাপন করে বিশ্বাসীদের বিভ্রান্ত করতে চাইবে।