Md. Abdullah Saeed Khan

মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন: আদৌ কি সম্ভব? (পর্ব ২)

বিবর্তনতত্ত্বের পপুলারাইজারদের মতে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন হবার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কেননা ম্যাক্রোইভলুশন না হলে আমরা আজ এখানে বসে আলোচনা করছি কিভাবে? ম্যাক্রোইভলুশনের কারণেই তো মানুষ এসেছে, তাই না?

কিন্ত, একাডেমিয়াতে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যারা বিবর্তনের ম্যাকানিজমের সমালোচনা করেন, তাদের সকল একাডেমিক ডিবেটগুলো মূলত এই জায়গাটাতেই।

বস্তুত, The Third Way  গ্রুপটি তৈরী হয়েছে এমন একদল বিজ্ঞানী নিয়ে যারা ইভুলশনারী সিনথেসিস (নিও-ডারউইনিজম)-এর বর্ণীত ম্যাকানিজম (র‍্যানডম মিউটেশন, ন্যাচারাল সিলেকশন, জেনেটিক ড্রিফট, জিন ফ্লো, হিচহাইকিং, ননর‍্যানডম মেটিংপ্রভৃতি)-কে অপর্যাপ্ত মনে করেন।

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন প্রবক্তা এবং কয়েকজন ইনডিভিজুয়াল রিসার্চারদের গবেষণা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রস্তাবিত কোন ম্যাকানিজমই মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন ঘটাতে পারে না। (এজন্য এরা মেইনস্ট্রিমে ঘৃণীত বা ক্রিয়েশনিস্ট হিসেবে ধীকৃত হন বা এড হোমিনেম এর শিকার হন।)

আসলে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের অনেকগুলো হার্ডল আছে। যা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। এর আগে এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ পোস্ট লিখেছিলাম।

মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন: আদৌ কি সম্ভব?

আগের প্রবন্ধে অল্প কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। অদ্য প্রবন্ধে আরও কিছু বিষয় সন্নিবেশিত হল।
পপুলেশন জেনেটিক্সের পর্যায়ে কিছু গবেষণা আছে যা মাইক্রোইভলুশন থেকে ম্যাক্রোইভলুশন হওয়ার হার্ডলগুলোকে প্রকাশ করেছে। যেমন, ওয়েটিং টাইম প্রবলেম। একটি  গবেষণা (1) দেখিয়েছে যে মাত্র ৫টি নতুন নিউক্লিওটাইড হোমিনিন ম্যাক্রোইভলুশনের মধ্য দিয়ে হোমিনিন পপুলেশনে যোগ হতে প্রায় ২ বিলিয়ন বছর লাগে। অথচ, ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে পুরোনো হোমিনিন এসেছে মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন বছর আগে।

আগে মনে করা হতো মিউটেশন প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি র‍্যানডম। কিন্তু, জেমন শ্যাপিরো(2) দেখিয়েছেন যে, ব্যাকটেরিয়ার ভিতর কঠিন পরিবেশে এডাপ্ট করার জন্য কতগুলো প্রক্রিয়া ইনবিল্ট আছে। ফলে ব্যাকটেরিয়া নতুন কোন পরিবেশে এলে তার ‘নির্দিষ্ট’ কিছু জেনেটিক রিজিওনে ‘র‍্যানডম মিউটেশন জেনারেটিং’ প্রক্রিয়া এক্টিভেট করে। যেন অভিনব পরিবেশে সে খাপ খাওয়াতে পারে। অর্থাৎ, আদতে এই প্রক্রিয়াটি র‍্যানডম না। বিষয়টার সাথে ভার্টিব্রেট জীবের ইমিউন সিস্টেমের পদ্ধতিগত মিল আছে।

জিন ডুপ্লিকেশন হল নতুন ফাংশন যুক্ত জিন তৈরীর একটি কার্যকর উপায়। কিন্তু, জিন ডুপ্লিকেশনের মাধ্যমে যদি এমন কোন এডাপটেশনের প্রয়োজন হয় যেখানে দুই বা ততোধিক অ্যামাইনো এসিড দরকার হবে। অর্থাৎ, একাধিক পয়েন্ট মিউটেশনের দরকার হবে। সেক্ষেত্রে উক্ত এডাপটেশনটি জিনোমে ফিক্স হতে যে পরিমাণ অর্গানিজম দরকার তার সংখ্যা অনেক বেশী ১০ (3)। অর্থাৎ, ব্যাকটেরিয়া জাতীয় এককোষী প্রাণী ছাড়া অন্য কোন প্রাণীতে এই ধরনের পরিবর্তন আসা প্রায় অসম্ভব।

ম্যালেরিয়া জীবানু Plasmodium-এ ক্লোরোকুইন রেজিসেন্ট হতে প্রোটিন-প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইটে মিউটেশন লাগে। মাইকেল বিহে তার বাই Edge of Evolution (4)-এ হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, একটি প্রোটিন প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইটে সাইমুলটেনিয়াস মিউটেশন (দুটি মিউটেশন একই সাথে) হতে মিনিমাম অর্গানিজম দরকার ১০২০। ফলে, চারটি সাইমুলটেনিয়াস মিউটেশনের জন্য দরকার ১০৪০ টি ব্যাকটেরিয়া (অর্গানিজম)। যা পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো ব্যাকটেরিয়া তৈরী হয়েছে তার সমান। অর্থাৎ, র‍্যানডম প্রক্রিয়ায় নতুন তথ্য যোগ হওয়া সম্ভব হলেও তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্গানিজম পৃথিবীর ইতিহাসে খুজে পাওয়া যাবে না।

এন গজার এবং ডগলাস এক্স, পরীক্ষা করে দেখেছেন একটি এনজাইমকে ভিন্ন ফাংশনের একটি এনজাইমে পরিণত করতে দরকার কমপেক্ষে সাতটি বা ততোধিক একই সাথে সংঘটিত মিউটেশন (5)। সুতরাং, উপরের প্যারায় বর্ণিত পয়েন্টের সাপেক্ষে বিবেচনা করলে এই ধরনের পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পপুলেশন পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া কঠিন।   

কিন্তু, মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের পথে আরও বড় বাধা হচ্ছে এই আবিস্কার যে একটি জীবের গঠন শুধুমাত্র তার ডিএনএ-তে সন্নিবেশিত তথ্যের উপর নির্ভর করে না। কারণ, ডিএনএ-তে প্রোটিনের গঠন নির্ধারণকারী তথ্য আছে সরলরৈখিক ফর্মে। কিন্তু, এর বাইরে কোষের ডিএনতে আরও কিছু কোড আছে। যেমন: ডিএনএ-র কোন অংশ চালু হবে আর কোনটা চুপ থাকবে তার জন্য এপিজেনেটিক কোড, ডিএনএ-তে থেকে আরএনএ তৈরী হওয়া পর স্প্লাইসিং-এর জন্য স্প্লাইসিং কোড, ডিএনএ-থেকে ম্যাসেঞ্জার আরএনএ-তৈরী হয়ে কোথায় যাবে তার জন্য প্রয়োজনীয় জিপ কোড ইত্যাদি। এগুলো এক ধরনের সরলরৈখিক কোড যা একমাত্রিক। এর বাইরের কোষের গঠন এবং এক কোষ (জাইগোট) থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণী হওয়ার জন্য আরও কিছু স্থানিক (Spatial) কোড আছে- বায়োইলেকট্রিক কোড এবং সুগার কোড। যেগুলো দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক কোড।

বায়োইলেকট্রিক কোড-এর উপর নির্ভর করে এমব্রায়োর গঠন। অর্থাৎ, একটি কোষ থেকে বিভাজিত হতে হতে বহুকোষী প্রাণীতে পরিণত হওয়া সময়, কোষের ঝিল্লীতে তৈরী হওয়া আয়ন চ্যানেল গুলো এক ধরনের বায়োইলেকট্রিক ফিল্ড গঠন করে, যার উপর নির্ভর করছে এমব্রায়োর মাথা থেকে পা পর্যন্ত গঠনের সঠিক অবস্থান। অর্থাৎ, কোথায় মাথা হবে, কোথায় হাত-পা হবে, এগুলোর স্থানিক তথ্য ধারন করে এই বায়োইলেকট্রিক কোড।

সুগার কোড নির্ধারণ হয় কোষঝিল্লীতে অবস্থিত গ্লাইকেন দ্বারা। সুগার কোডের কাজ হলো কোষ ঝিল্লীর ‘পোস্ট অফিস’ তৈরী এবং তার পোস্ট কোড নির্ধারণ করা। ঐ যে ডিএনএ থেকে বের হওয়ার আরএনএ যার মধ্যে জিপকোড ট্যাগ করা আছে, সে উক্ত পোস্ট কোডের উপর ভিত্তি করে কোষ ঝিল্লীর নির্দিষ্ট স্থানে যাবে। সুগার কোডের তথ্য বহনকারী কণার বৈশিষ্ট্যের কারণে সুগার কোড ডিএনএ-র জেনেটিক কোড অনেক বেশী জটিল।

এ কারণে শুধু জেনেটিক লেভেলে পরিবর্তন এবং এভাবে সৃষ্ট উপকারী ভ্যারিয়েশনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রোইভলুশন হবার দাবীর সাথে ‘দ্য থার্ড ওয়ে’-সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা একমত হতে নারাজ। এজন্য, তারা অন্যান্য ম্যাকানিজম, যেমন- symbiogenesis, horizontal gene transfer, mobile DNA action এবং epigenetic modification কে আমলে নিয়ে Extended synthesis of Evolution-এর প্রস্তাবনা করেছেন (6)। কিন্তু, এ সব ম্যাকানিজমের সমন্বয়ে একটি Holistic প্রস্তাবনা তারা দিতে চাইছেন। যদি এই প্রস্তাবনা বিবর্তনের একটি সমন্বিত পথপরিক্রমা দেখাতে সক্ষম হয়, তখনই কেবল মাইক্রো থেকে ম্যাক্রোইভলুশন প্রাকৃতিক নিয়মেই সম্ভব বলা যাবে।

বাস্তবে ম্যাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের গবেষণা কঠিন বিধায় কম্পিউটারের সিমুলেশনের মাধ্যমে এর পক্ষে প্রমাণ খোঁজার অনেক চেষ্টা হয়েছে। গবেষকরা বিভিন্ন ইভলুশনারী আলগরিদম তৈর করে দেখাতে চেয়েছেন যে সিম্পল থেকে কমপ্লেক্স অর্গানিজম কিভাবে আসে। এ সম্পর্কিত প্রোগ্রামগুলোর সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক আছে। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, এই প্রোগ্রামগুলোকে যদি প্রথমেই টিউন করে দেয়া হয়, তারা জটিলতার টার্গেট অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু, এদের মধ্যে যদি প্রকৃত অনিশ্চয়তা (True randomness) সেট করা হয়, দেখা যায় যে উক্ত প্রোগ্রামগুলোর কোন কার্যকর বিবর্তন হয় না (7)।  

পরিশেষে বলব, মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের বিষয়টি অমিমাংসীত। বরং, আদৌ কি মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন প্রাকৃতিক উপায়ে হওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে। তবে হ্যা যদি বিষয়টিকে এভাবে ভাবেন যে, Last Universal Common Ancestor অথবা Common Ancestor কোষগুলোতে ইন বিল্ট নিয়ন্ত্রিত এবং সুসংঘটিত বিবর্তন ম্যাকানিজম তৈরী করা ছিল তাহলে হয়ত সময়ে সাথে সাথে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো বিবর্তন ঘটতে পারে। তবে এ ধরনের Complete এবং Hollistic Mechanism-কেউ দিতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই।

তথ্যসূত্র:

  1. https://tbiomed.biomedcentral.com/…/s12976-015-0016-z
  2. https://www.sciencedirect.com/…/abs/pii/0959437X93900038
  3. http://onlinelibrary.wiley.com/doi/10.1110/ps.04802904/full
  4. Behe, Michael. The Edge of Evolution; pp. 143
  5. https://bio-complexity.org/ojs/index.php/main/article/viewArticle/BIO-C.2011.1
  6. https://www.thethirdwayofevolution.com/
  7. এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে এই বইটিতে- Introduction to evolutionary informatics. আর জানা যাবে এই সাইট থেকে – https://evoinfo.org/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top