আপনি একটি লাল গোলাপকে লাল বলছেন, আমিও লাল বলছি। কিন্তু আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে আপনি ও আমি লাল বলতে একই রং বুঝছি? হতে পারে আপনি যেটাকে লাল বলছেন, আমি সেটাকে নীল দেখছি কিন্তু যেহেতু আমি নীলকেই ছোট থেকে লাল বলতে শিখেছি সেহেতু আমি আপনার দেখা লালটাকে লাল-ই বলছি, যদিও তা প্রকৃতপক্ষে আমার সাপেক্ষে নীল এবং আপনার সাপেক্ষে লাল।
অন্য কথায়, আপনি রঙটাকে যেভাবে উপলব্ধি করছেন আমি হয়ত ঠিক সেভাবে উপলব্ধি করছি না। কিন্তু যেহেতু ছোট থেকে আমরা একটি নির্দিষ্টভাবেই বিষয়টাকে উপলব্ধি করতে শিখেছি সেহেতু আমাদের Interpretation কার্যত Same থাকছে।
আমাদের উপলব্ধি যে একই নয় তা আমাদের চোখের সামনেই স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল যেভাবে সাহিত্যকে উপলব্ধি করেছেন, লাডউইক ভ্যান বেথোভেন বা ওলফ্যাঙ এমাদিওস মোজার্ট যেভাবে মিউজিককে উপলব্ধি করেছেন, লিউনার্দো দ্য ভিনসি বা ভিনসেন্ট ভ্যান গগ যেভাবে আর্টকে উপলব্ধি করেছেন তাদের মত আমরা কি উপলব্ধি করতে পারি?
প্রশ্ন হল, উপলব্ধি কি জিনিস?
উপরের থেকে আমরা দেখলাম উপলব্ধি একটি আপেক্ষিক বিষয়। এটা ব্যাক্তি সাপেক্ষ।
আপনি একজন জন্মান্ধের কথা চিন্তা করুন। আপনি কি কখনও বলতে পারবেন সে কিভাবে পৃথিবীকে উপলব্ধি করে??? এমনকি আপনি এখন অন্ধ হয়ে গেলেও পারবেন না। কেননা আপনি প্রত্যেকটি বস্তুর একটি ভিসুয়্যাল ইমেজ অলরেডি উপলব্ধি করেছেন।
এবার ধরি আপনি দাড়িয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে আছেন। আপনি যদি এ অবস্থায় হাটতে চেষ্টা করেন আপনি হাটতে পারবেন। কারণ আপনার পায়ের তলার কিছু সেন্সরি নার্ভ আছে যা আপনার পজিশনের সেন্স আপনার ব্রেইনে পাঠাচ্ছে। ধরুন আপনার সেই সেন্সরি নার্ভ ইন্ডিং গুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এবার ভাবুনতো, আপনি যদি চোখ বন্ধ করে এ অবস্থায় হাটতে চান আপনার কাছে কি মনে হবে? ইন ফ্যাক্ট আপনি হাতরে বেড়াবেন। যদি আপনার আশে পাশে কোন বাঁধা যেমন চেয়ার টেবিল না থাকে তাহলে আপনার কাছে মনে হবে আপনি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেন।
ধরি আপনি হঠাৎ একটি দেয়ালে বাধা প্রাপ্ত হলেন। (আপনি চোখ বন্ধ করেই আছেন) কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন যে আপনি দেয়ালে বাধা প্রাপ্ত হয়েছেন? আপনি বুঝলেন কারণ আপনার স্কিনে, Pressure এবং Touch সেন্স করার জন্য প্যাসিনিয়ান করপাসল ও ফ্রি নার্ভ ইন্ডিং আছে। ধরুণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে আপনার এই নার্ভইন্ডিংগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এবার আবার সেই সিনারিওতে ফিরে যান। এবার চিন্তা করে দেখুনতো আপনি হাটছেন চোখ বন্ধ করে।
কি ভাই? কি মনে হল? হ্যা, এবার আপনার মনে হবে আপনি শূণ্যে আছেন। এ অবস্থায় আপনি যদি আঘাত পান বা দেয়ালে আটকেও যান আপনি কিছুই বুঝতে পারবেন না। ইন ফ্যাক্ট, আপনি যে হাটছেন সেটাই মনে হবে না। যদিও আরেকজনের সাপেক্ষে আপনি অবস্থান পরিবর্তন করছেন। কারণ সে সেটাকে ওভাবেই উপলব্ধি করছে।
এবার আপনি চোখ খুলে বসুন। এক চোখ বন্ধ করে সামনে দেখুন। আপনার কি মনে হয় আপনি থ্রি ডাইমেনশনাল কিছু দেখছেন? মনে হতে পারে, কারণ আপনি অলরেডি দুচোখ দিয়ে সেটি দেখেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল এক চোখ দিয়ে আপনি টু ডাইমেনশন দেখতে পান। থ্রি ডাইমেনশন তখনই হয় যখন দুচোখে দেখা ছবিদুটো ব্রেনের অভ্যন্তরে ওভারল্যাপ হয়। ইনফ্যাক্ট দূরত্বের যে উপলব্ধি আপনি করেন তা এ দুটো চোখ দিয়ে দেখার কারণে। একটি চোখ দিয়ে দেখলে, ক্যামেরার মত আপনার পৃথিবীটাও দ্বিমাত্রিক হয়ে পড়ত। (মানুষের চোখের এই বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করেই কিন্তু ত্রিমাত্রিক চশমার সৃষ্টি)
এবার আরেকটু কঠিন বিষয়ে যাই। আপনার কি মনে হয়? ‘সময়’ কি জিনিস? আপনার ধারণা সময় সামনে এগোচ্ছে। অথচ, এর কারণ হল পরপর দুটো ইমেজের মধ্যে প্রসেসিং হতে ব্রেইনে সৃষ্ট গ্যাপ থেকেই আপনার মাঝে ‘সময়’ এর ধারণার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সময় সামনে এগোয় বলে আপনি পরপর দুটো ঘটনা দেখেন না বা বরং আপনার সামনে পরপর দুটো ঘটনা হয় বলেই আপনি মনে করেন সময় এগোচ্ছে। এটাবোঝা সহজ হল মুভির উদাহরণ দিয়ে। মুভিতে আপনার চোখের সামনে ০.১ সেকেন্ডের ব্যাবধানে দুটো ইমেজ প্রবাহিত করা হচ্ছে ফলে আপনার মনে হচ্ছে সময় সামনে এগোচ্ছে।
এবার আসি আসল প্রশ্নে। আপনি মুভিটাকে বলছেন স্থির কিছু ইমেজের সমষ্টি। যা একটির পর একটি প্রবাহিত হয়ে আপনার সামনে সামনে সময়ের একটি অবাস্তব ধারণা সৃষ্টি করছে। কিন্তু আপনি বলছেন বাস্তবে আপনি যে পৃথিবীকে দেখছেন সেটা ‘বাস্তব’।
কিন্তু এটা যে আপেক্ষিক নয় তা আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন?
আপনি যে রঙ দেখছেন, যে দূরত্ব উপলব্ধি করছেন, যে শব্দ শুনছেন, যে গন্ধ, স্বাদ, ব্যাথা, স্পর্শ, চাপ, কম্পাঙ্ক অনুভব করছেন, এমনকি যে সময় উপলব্ধি করছেন তার সবইতো আপনার ব্রেইনে সৃষ্ট অনুভূতি। বস্তুত ব্রেইনে এগুলো ইলেকট্রোকেমিক্যাল গ্র্যাডিয়েন্টরুপে প্রবাহিত হয়ে উপলব্ধির সর্বশেষ কেন্দ্রগুলোতে যাচ্ছে। অন্য কথায় এগুলো আপনার ব্রেইনে সৃষ্ট ‘Illusion’। আপনি বলছেন চলার সময় আপনি সামনে এগোচ্ছেন। অথচ হয়ত আপনি স্থিরই আছেন, বরং সবকিছু আপনাকে ছেড়ে পিছনে যাচ্ছে। আর আপনি চলবেনই বা কিভাবে? যে ত্রিমাত্রিক জগৎ আপনি আছেন, তাতো আপনার দুচোখের কারণে। ‘Space’ ও ‘time’ তো আপনার ব্রেইনে সৃষ্ট ধারণা মাত্র।
যদি তাই না হয় তাহলে ঘুমের সময় আপনি স্বপ্নে এত কিছু উপলব্ধি করেন কিভাবে? অথচ এ সময় আপনার শরীর বিছানায় ঠিকই স্থির হয়ে আছে। উপরন্তু আপনি স্বপ্ন দেখছেন পৃথিবীর পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে খুবই অল্প সময়, কিন্তু স্বপ্নে আপনি বিশাল সময় পার করে দিচ্ছেন। কার্যত আপনার ব্রেইনের নির্দিষ্ট সেন্টারগুলোতে যদি কম্পিউটার জেনারেটেড নির্দিষ্ট মাত্রার ইলেকট্রোকেমিক্যাল সিগন্যাল তৈরী করা যায়, আপনার মনে হবে আপনি বাস্তব জগতেই আছেন। (ম্যাট্রেক্স মুভিটার কথা মনে পড়ছে কি?)
অনেকে চিন্তিত যে মৃত্যুর পর কবরের জীবন আবার কিভাবে হয়? কবর খুড়ে তো আমরা কঙ্কাল দেখি। তাহলে কবরে শাস্তি বা পুরস্কার কিভাবে সম্ভব? (এরা আসলে ‘এক চোখ’ দিয়ে দেখে।) অথচ আমার মৃত্যুর সাথে সাথেই আমার জন্য সৃষ্ট পৃথিবীর স্থায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। কার্যত এর পর পরই হয়ত আমি ‘Reboot’ হই বারযাখের জীবনে। (আল্লাহই ভাল জানেন)
আমিই সময়ের অধীন কারণ আমার সামনে আমার জগতকে প্রবাহিত করা হয়। আল্লাহ সময়ের অধীন নন, কারণ তার সামনে সম্ভাব্য সকল জগত তৈরী আছে একই সাথে। (আল্লাহই ভাল জানেন)
কে এই উপলব্ধি করে? হ্যা, উপলব্ধি করে আমাদের অন্তর্গত একটি সত্ত্বা যাকে বস্তুগত মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, গনিত দিয়ে প্রকাশ করা যায় না এবং জৈবিক চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। আমাদের ভাষায় একে আমরা বলি ‘আত্মা’।
আমার ব্রেইনের ভেতরের যে ‘আমি’ উপলব্ধি করছে সে আমার আত্মা বই কিছু নয়। অথচ, বস্তুবাদীরা আত্মাকে ম্যাটেরিয়াল টার্মে এক্সপ্লেইন করতে না পেরে তা অস্বীকার করার জন্য নানাবিধ বিভ্রান্তিকর ও স্ববিরোধী তত্ত্ব দাড় করাতে থাকে।
‘আত্মা’ হল আল্লাহর আদেশ। এর বেশী কিছু আল্লাহ আমাদের জানার তৌফিক দেন নি।
“এরা তোমাকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করছে৷ বলে দাও, “এ রূহ আমার রবের হুকুমে আসে কিন্তু তোমরা সামান্য জ্ঞানই লাভ করেছো৷” (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত ৮৫)
তাহলে এবার বলুন আপনার আমার সকল প্রচেষ্টা যদি শুধুমাত্র এই ইলিউসরি টেস্টিং প্লেসে টেম্পোরারি সুখানুভূতির জন্য হয়, আমরা হাশরের ময়দানে দাড়িয়ে আল্লাহর কাছে কি জবাব দেব????