আকাশটা যদি নীল হত!
শিরোনাম পড়ে আপনার মনে হতে পারে আমি কোন সাহিত্য লিখতে বসেছি। কিন্তু না, আমি আসলেই আক্ষেপ করে বলছি। এই দূষিত নগরীর একজন নাগরিক হিসেবে আপনিও হয়ত একমত হবেন।
আপনি যদি ঢাকা শহরের বাইরে, বিশেষ করে পদ্মার ওপারে, নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন তাহলে হয়ত বুঝতে পারবেন কেন আমি এ কথা বলছি। দক্ষিণাঞ্চলে যারা নিজেদের গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করেন, তারা হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে পদ্মা পার হবার সাথে সাথেই আকাশটা কেমন পরিস্কার হয়ে যায়। আবার, উল্টোপথে ঢাকায় আসার সময় আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় যেন নীল আসমান ঘোলাটে ধূসর হয়ে গিয়েছে। আমার চাকুরীর সুবাদে আমি দুই বছরের অধিক টুঙ্গিপাড়া থেকেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।
আমরা দৈনন্দিন ব্যস্ততায় এতটায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি, যে ঢাকা শহরের দূষিত বাতাস আমাদের চিন্তার উদ্রেক করে না। কিন্তু, আপনি চাইলেই চট করে IQ Air-এর ওয়েবসাইট (১) থেকে ঢাকায় বাতাসে দূষণের পরিমাপটা দেখে নিতে পারেন। বাতাসে দূষণ পরিমাপ করা হয় Air Quality Index (AQI)-ব্যবহার করে। অন্যদিকে AQI-পরিমাপ করা হয় বায়ুদূষনের জন্য দায়ী কিছু অণুর ওপর ভিত্তি করে।
যে সকল পদার্থের অতিরিক্ত উপস্থিতি বাতাসকে দূষিত করে, যুক্তরাস্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান United States Environmental Protection Agency (২) তার মধ্যে ছয়টি পদার্থকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হল- কার্বন মনোক্সাইড (CO), সালফার ডাই অক্সাইড (SO2), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2), লেড (Pb), পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5 & PM10), এবং ভূস্তরের ওজন (O3)। এই প্রতিটি পদার্থই মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে থাকলে নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরী হতে পারে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে হাঁচি, কাশি, বুকে চাপ অনুভব করা, শ্বাস কষ্ট, হার্ট ও ফুসফুসে সমস্যা, হার্ট এটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি, ত্বক ও স্কিনের ক্যানসার। বায়ুদূষণ যে শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক ক্ষতি করছে তা নয়, এটি পুরো ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এটি জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর, ফসল ও বনজঙ্গলের ক্ষতি, এসিড রেইন, আবহাওয়া পরিবর্তন প্রভৃতির জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে লেড বাদে বাকি পাঁচটি পলিউট্যান্ট-এর ওপর নির্ভর করে AQI হিসেব করা হয়। AQI এর উপর ভিত্তি করে বাতাসের অবস্থাকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয় (৩)। এগুলো হচ্ছে-
১. ০ – ৫০: ভালো
২. ৫১ – ১০০ : মোটামুটি
৩. ১০১ – ১৫০ : সতর্কতামূলক
৪. ১৫১ – ২০০ : অস্বাস্থ্যকর
৫. ২০১ – ৩০০ : খুব অস্বাস্থ্যকর
৬. ৩০১ – ৫০০ : অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর
ঢাকার বাতাসের কোয়ালিটি প্রায় সবসময়ই ১০০-এর ওপরে থাকে, এমনকি প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে। AQI ১০০-এর বেশী ও ১৫০-এর নিচে থাকলে অধিকাংশ ব্যক্তির জন্য বাতাস হয়ত নিরাপদ। কিন্তু, বয়স্ক ব্যাক্তি এবং শিশুদের জন্য এটি স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে (৪)। বাতাসের এই অস্বাস্থ্যকর পরিণতির মূল কারণগুলো হচ্ছে – কলকারখানার দূষিত বায়ু নিঃসরণ, মোটরযানের ধোঁয়া এবং বিভিন্ন অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ।
তাহলে, আমাদের উপায় কি? ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা বায়ু দূষণের ক্ষতি থেকে বাঁচতে মাস্ক পরে চলাচল করতে পারি। মাস্ক আমাদের সব ধরনের পলুটেন্ট থেকে নিরাপদ রাখতে না পারলেও, PM2.5 এবং PM10 প্রতিরোধ করতে পারে। থাইল্যান্ডের একটি গবেষণা (৫) অনুযায়ী সবচেয়ে ভাল প্রটেকশন দিতে পারে N95 মাস্ক, যা PM2.5 থেকে প্রায় ৯৭.২% প্রটেকশন দেয়। সার্জিকাল মাস্ক PM2.5 থেকে প্রায় ৫৬.৩ – ৮৩.২% প্রটেকশন দেয়। PM10 সাইজে বড় হওয়ায় সার্জিকাল মাস্ক অনেকখানিই প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
বাতাসের AQI ৩০০-এর বেশী হলে Air Quality Alert দেয়ার কথা। সেক্ষেত্রে দরজা, জানালা বন্ধ করে ঘরে অবস্থান করতে হবে। যাদের সামর্থ আছে ঘরে ভাল এয়ার পিউরিফাইয়ার ইউজ করতে পারেন। ঘরের ভেতর কোন কিছু পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
বায়ুদূষণ রোধে পলিসি মেকার পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থপনা, কলকারখানার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ, বিল্ডিং ও অবকাঠামো নির্মানের সময় দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা দরকার। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এখন ব্যাক্তিগত মোটর যানের পরিবর্তে সাইকেল ও ম্যাস ট্রান্সপোর্টকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন মোটরের ধোঁয়া কমছে, অন্যদিকে শরীর চর্চারও অনুশীলন হয়ে যাচ্ছে।
নিজেদের জীবদ্দশায় ঢাকা শহরের সেই সর্বদা পরিচ্ছন্ন নীল আকাশটা কি আবার দেখতে পারব?
রেফারেন্স:
১. https://www.iqair.com/bangladesh/dhaka
২. https://www.epa.gov/criteria-air-pollutants
৩. Rana, Masud & Biswas, Swapan. (2019). Ambient air quality in Bangladesh 2012 – 2018. 10.13140/RG.2.2.14741.17128.
৪. https://www.nytimes.com/article/air-quality-index.html ৫. Arunnart M. Efficiency of Commercial Face Masks in PM2.5 Prevention. Ramathibodi Med J. 2021;44: 11–17. doi:10.33165/rmj.2021.44.2.243402