ক্যান্সারের যম

ক্যান্সারের যম
একটি ক্যান্সার কোষ ও লিম্ফোসাইটের ত্রিমাত্রিক চিত্রায়ন

একটা শহরের কথা। এই শহরে মানুষের কাছে অস্ত্র রাখার অনুমতি আছে। একদিন একটা লোক কিছু অস্ত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে সে একটা গাড়ি ছিনতাই করলো এবং বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে একজন মানুষকে হত্যা করলো। তার বিরুদ্ধে এলাকার পুলিশ প্রথম স্তরের সতর্কতা জারি করলো। কিন্তু লোকটা সতর্কতা পরোয়া করে না। সে রাস্তায় বেরিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে মানুষ মারতে শুরু করলো। তার বিরুদ্ধে সরাসরি তৃতীয় স্তরের সতর্কতা জারি করা হল। পুলিশ তাকে ধাওয়া করতে শুরু করলে সে গুলি করে পুলিশকে মেরে ফেললো। সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে চার নম্বর স্তরের ইমারজেন্সি জারি হল এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে দেশব্যাপী সতর্কতা জারি হল। তাকে ধরতে দেশের স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সকে দায়িত্ব দেয়া হল। এরপর উক্ত সন্ত্রাসী গ্রেনেড লাঞ্চার বের করে আক্রমণ শুরু করলে দেশের নিরাপত্তা সতর্কতা পাঁচ স্টার এ উন্নীত হল এবং তার বিরুদ্ধে আর্মি নামানো হল।

যারা ছোট বেলায় গ্র্যান্ড থেফট অটো (জিটিএ) খেলেছেন তাদের হয়তো ঘটনাটি পরিচিত মনে হতে পারে। জিটিএর ভার্চুয়াল জগতে এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু, বিষয় সেটা না। বিষয়টি হল কোনও দেশে যখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হয় উক্ত দেশ কয়েক ধাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। প্রথমে লোকাল পুলিশ ঘটনা আমলে নেয়। তাতে কাজ না হলে স্পেশাল বাহিনী কাজে লেগে পরে। তাতেও কাজ না হলে আর্মিকেই নামিয়ে দেয়া হয়। অধিকন্তু, প্রতিটি বাহিনীর কিছু শাখা থাকে। কারও কাজ সরাসরি আক্রমণ, কারও কাজ তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দাগিরি এবং কারও কাজ গোপনে আক্রমণ।

তো আমাদের শরীরেও এরকম কয়েক ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী আছে। শরীরে যখন কোনও জীবাণু প্রবেশ করে, প্রথম ধাপে এগিয়ে আসে প্রবেশপথের নিরাপত্তা প্রহরী জাতীয় কিছু কোষ। এদের মধ্যে আছে ম্যাক্রোফাজ, নিউট্রফিল ও ন্যাচারাল কিলার সেল। আবার, এই কোষগুলো যদি একা সামলাতে না পারে নেমে আসে ‘টি’ সেল নামক বিশেষ বাহিনী। ‘টি’ সেলের কয়েকটি শাখা আছে। কারও কাজ সরাসরি আক্রমণ, কারও কাজ শত্রুকে চিনতে সাহায্য করা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ম্যাসেজ পাঠানো এবং কারও কাজ হচ্ছে কোল্যাটারাল ড্যামেজ চেক দিয়ে রাখা।

সাহায্যকারী ‘টি’ সেল আবার হেডকোয়ার্টারে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে বিশেষায়িত ‘বি’ সেল বাহিনীকে ডেকে পাঠাতে পারে। ‘বি’-সেল বাহিনীর কাজ হল শত্রুবাহিনীর দুর্বল জায়গা কে চিহ্নিত করে বিশেষ অস্ত্র তৈরি ও আক্রমণ। এছাড়াও ‌বি-সেল বাহিনীর একদল কোষ উক্ত দুর্বল জায়গার তথ্য ধারণ করে রাখে যেন ভবিষ্যতে একই শত্রু আবার আক্রমণ করলে ক্ষতি হওয়ার আগেই মূলোৎপাটন করা যায়।  

অপরাধী বিভিন্ন রকম হতে পারে। কারও শক্তি বেশী, কারও অর্থ বেশী, কারও আবার অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। কোন শত্রু শরীরে প্রবেশ করলে প্রথমে শরীরের বর্ডার-গার্ডরা তাকে ধরে এবং তার বিশেষ কোন চিহ্ন থাকলে খুঁজে বের করে । এরপর উক্ত চিহ্ন নিজস্ব কিছু চিহ্নের সাথে ট্যাগ করে উপরতলায় পৌঁছে দেয়। এরপর উপরতলার নিরাপত্তারক্ষীরা উক্ত চিহ্ন ও আভ্যন্তরীণ ট্যাগ দেখে শত্রুকে চিহ্নিত করে।  

এই যে নিজস্ব ট্যাগ বা সাইনের কথা বললাম একে বলে MHC অণু। ‘টি’-সেল সাধারণত তার ঝিল্লীতে থাকা টি-সেল রিসেপ্টর (TCR) নামক এক রাডার দিয়ে MHC অণুকে চিনে নেয়। শরীরে যখন কোন জীবাণু ঢুকে,  প্রথমে বর্ডার-গার্ড কোষেরা তাকে ধরে এবং তার যন্ত্রাংশ ভেঙ্গেচুরে তাকে চিহ্নিত করা যায় এরকম একটা অণু বের করে নিয়ে আসে এবং ঐ অণুটাকে MHC-নামক হাতের সাহায্যে টি-সেল-এর কাছে এগিয়ে দেয়। টি-সেলও হাত (TCR) বাড়িয়ে অণুটিকে চিনে নিয়ে বাহিনীর অন্যদের কাছে বিভিন্ন রকম সংকেত পাঠাতে থাকে যেন তারা একটিভ হয় এবং জীবাণুটিকে মারার ব্যবস্থা শুরু করে।  কোষগুলো চোখ না থাকায় তাদের হাত দিয়ে স্পর্শ করে চিনে নিতে হয়। এ কারণে বর্ডারে কোষেরাও যেমন দুই হাত বাড়ায়, ঠিক তেমনি টি-সেলও দুই-হাত বাড়িয়ে দেয়। এক হাত দিয়ে স্পর্শ করে চিনে নেয় বর্ডারের হাতকে এবং আরেক হাতে চিনে নেয় শত্রুর পরিচায়ক অণুকে।

বুঝতেই পারছেন বিভিন্ন রকম শত্রুকে চিনতে বিভিন্ন রকম হাতের প্রয়োজন হয়। মানব শরীরের যে অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, কৃমি প্রবেশ করে তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য সুনির্দিষ্ট  পদ্ধতিতে শরীরের নিরাপত্তা-কর্মীরা কাজ চালিয়ে যায়। প্রাথমিক নিরাপত্তা প্রহরী কোষ যখন বিভিন্ন ধরনের জীবাণুকে আভ্যন্তরীণ বাহিনীর কাছে উপস্থাপন করে তখন সাধারণত সংশ্লিষ্ট জীবাণুর বহিরাবরণের কিছু অণুকে পরিচায়ক হিসেবে নিয়ে আসে।

কিন্তু, শত্রু যদি দেশের ভিতর থেকে মাথা চারা দিয়ে উঠে তাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? বলছিলাম টিউমার বা ক্যান্সারের কথা। টিউমার বা ক্যান্সার হল শরীরের অবস্থিত কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন। যখন কোথাও ক্যান্সার হয় ক্যান্সার কোষগুলো কিছু বিশেষ চিহ্ন প্রকাশ করে। আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা বাহিনী তখন চিহ্নগুলো চিনে নিয়ে আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, প্রতিরক্ষা বাহিনীর লক্ষ্য রাখতে হয় যেন নিজের শরীরের নিরপরাধ কোষগুলো নিরাপদে থাকে। এই করতে গিয়ে একটা সমস্যা হয়ে যায়। টিউমার যেহেতু নিজের দেহের কোষ থেকেই হচ্ছে প্রতিরক্ষা বাহিনী অনেক সময় টিউমার কোষকে নিজের কোষ মনে করে এড়িয়ে যায়। ফলে টিউমার লুকিয়ে লুকিয়ে মহীরুহে পরিণত হয়।   

সাধারণত টি-সেল বাহিনী নির্দিষ্ট চিহ্নের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট টিউমারকে আক্রমণ করতে পারে। যেমন: স্তন ক্যান্সারের সময় নির্দিষ্ট কিছু চিহ্ন বা মার্কার ক্যান্সার কোষের বহিরাবরণে প্রকাশ পায়। স্তন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে যে টি-সেল বাহিনী তৈরি হয় তা কেবল উক্ত ক্যান্সার কোষের বিপরীতেই কাজ করতে পারে। তবে সম্প্রতি একদল গবেষক ক্যান্সারের বিরুদ্ধে শরীরের নিরাপত্তা (ইমিউনিটি) নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন ‘টি-সেল’-এর এমন কিছু হাত (TCR) যা সব ধরনের ক্যান্সার কোষকে চিনতে পারে। কিন্তু, কিভাবে? তারা আবিষ্কার করলেন যে প্রতিটি ক্যান্সার কোষ MR1 নামক MHC-জাতীয় এক প্রকার অণু তাদের বহিরাবরণে বাড়িয়ে দেয় যা MHC-এর মত ক্যান্সারের আভ্যন্তরীণ কোন অণুকে পরিচায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে।  এই MR1-সংশ্লিষ্ট অণুকে নতুন TCR নির্ণয় করতে পারে। আশার বিষয় হল এই কাজ করতে গিয়ে টি-সেলগুলো শরীরের সাধারণ কোষের কোন ক্ষতি সাধন করে না।

যদিও গবেষণাটি প্রাথমিক পর্যায়ে তথাপি আশার কথা হল এটি প্যান-ক্যান্সার চিকিৎসা আবিষ্কারের সম্ভাবনার খুলে দিয়েছে। প্যান-ক্যান্সার বলতে বুঝচ্ছি এমন একটি চিকিৎসা যা সব ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে, তা-ও আবার শরীরের অন্যান্য কোষের কোন প্রকার ক্ষতি না করেই। আমরা সবাই জানি, ক্যান্সারের চিকিৎসায় এখন যে কেমোথেরাপি ব্যবহার হয় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশী। সে হিসেবে এটি আমাদের জন্য বড়ই আশা জাগানিয়া সংবাদ।

কে জানে হয়ত খুব শীঘ্রই আমরা ‘ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন’ ব্যবহার করে ক্যান্সারের যম আবিষ্কার করতে যাচ্ছি। ইন শা আল্লাহ।


বিবলিওগ্রাফি:

  • Crowther MD, Dolton G, Legut M, Caillaud ME, Lloyd A, Attaf M, et al. Genome-wide CRISPR-Cas9 screening reveals ubiquitous T cell cancer targeting via the monomorphic MHC class I-related protein MR1. Nat Immunol. 2020;

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *