Md. Abdullah Saeed Khan

ডাক্তারের পড়ালেখা, প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশ

মেডিকেলের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীগুলো কেমন ধরনের? অধিকাংশ নন-মেডিকেল ব্যক্তিদের এ ব্যপারে কোন ধারনাই নেই। বিশেষ করে পরিবারে বা আত্মীয়দের মধ্যে একজন ডাক্তার না থাকলে ডাক্তারদের পড়াশোনা সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই জানেন না। অনেকেই জানে ডাক্তারদের পড়তে হয়, সারাজীবন পড়তে হয়। কিন্তু সেই পড়ালেখার এক্সটেন্ট কতটুকু। তাদের ডিগ্রী কখন শুরু হয়, কখন শেষ হয় সে সম্পর্কে জানা নেই।

তাই ভাবলাম এ বিষয়ে একটু লিখি। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে নেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডাক্তারদের পড়ালেখা পদ্ধতির একটু ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশে আমরা কিভাবে পড়ি? আমরা সকলেই জানি ডাক্তারদের স্নাতক ডিগ্রী পাঁচ বছরের। পাঁচ বছর পর একজন মেডিকেল ছাত্র নামের শেষে ডাক্তার শব্দটি লাগানোর যোগ্যতা অর্জন করেন। এই পাঁচটি বছরকে তিনটি প্রোফেশনাল পরীক্ষায় ভাগ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় বেসিক সাবজেক্টগুলো পড়তে হয়। যে-সে পড়া না, বিস্তারিত পড়া। প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি পড়তে হয়। দ্বিতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্যাথোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলোজি, ফরেনসিক মেডিসিন এবং কমিউনিটি মেডিসিন পড়তে হয়। এরপর তৃতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় পড়তে হয় মেডিসিন, সার্জারী এবং গাইনি ও অবস্টেট্রিকস (এই তিনটি সাবজেক্টের যতটুকু একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানের জানা প্রয়োজন ততটুকু)।

এম.বি.বি.এস. পরীক্ষায় পাশ করলেই একজন ছাত্র পৃথকভাবে চিকিৎসা দেয়ার লাইসেন্স পেয়ে যায় না। তাকে এক বছর ইন্টার্ণশিপ শেষ করতে হয় (মেডিসিনে, সার্জারি ও গাইনি প্রত্যেকটিতে চারমাস করে)। ইন্টার্ণশিপ শেষ করলে মূলত আসল পড়া শুরু হয়। অর্থাৎ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তে হয়। একজন ইচ্ছে করলে এম.বি.বি.এস ডিগ্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে। বর্তমানে ‘সিম্পল’ এম.বি.বি.এস বলে যে জনমুখে একটি ‘টার্ম’ চলে এসেছে। সেটি কি তা করতে দিবে? পাঠক লক্ষ্য করুন, একজন অনার্সের ছাত্রের চারবছরে স্নাতক শেষ হচ্ছে। আর একজন ডাক্তারের চিকিৎসা দেয়া লাইসেন্স পেতেই সময় লাগছে ছয় বছর।

যাই হোক, বাংলাদেশে ডাক্তাররা প্রধানত দুধরনের পোস্ট-গ্র্যাড ডিগ্রী নিতে পারেন। Fellow of College of Physicians and Surgeons (সংক্ষেপে এফসিপিএস), আরেকটি হলো Doctor of Medicine(এমডি) অথবা Master of Surgeon (এমএস)। তবে এর বাইরে কিছু কিছু বিষয়ে ডিপ্লোমা করার সুযোগ আছে এবং বেসিক সাবজেক্টগুলোতে এমফিল করার ও এপিডেমিওলজিতে এমপিএইচ করার সুযোগ আছে। স্নাতোকত্তোর পর্যায়ে এসেই একজন ডাক্তার কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন সেটি ঠিক করতে হয়।

এমডি বা এমএস ডিগ্রীদুটোর সময়সীমা পাঁচ বছর। তবে এই ডিগ্রীগুলোর সিট সংখ্যা সীমিত, সবগুলো মেডিকেল কলেজে হয় না। তাই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়। তবে ভর্তি পরীক্ষায় বসার শর্ত হলো ইন্টার্ণশিপের পর একবছর অতিবাহিত করতে হবে। যদিও ডিগ্রীগুলো করাকালীন একজন বেসরকারী ডাক্তারের হাসপাতালে সেবা দিতে হয়, সে এর বিনিময়ে কোন সম্মানী পায় না। বরং ভর্তির সময় ও পরীক্ষার সময় মোটা অংকের টাকা তাকেই দিতে হয়। সরকারী ডাক্তার এ সেবার বিনিময়ে বেতন পায়- যে বেতন সে একজন প্রথমশ্রেনীর কর্মচারী হিসেবে পেয়ে থাকে (প্রায় বিশ হাজার টাকা মাসে)। তবে সরকারী ডাক্তারদের উক্ত ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে বসতে পারে দুবছর উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স-এ কাটানোর পর। সুতরাং সে হিসেবে একবারে পাশ করতে পারলে একজন ডাক্তারের স্নাতক ও স্নাতকত্তোর ডিগ্রী অর্জন করতে লাগছে ১২ বছর(বেসরকারী) এবং ১৪ বছর (সরকারী)।এটা হলো ন্যূনতম হিসেব। (উল্লেখ্য এই ডিগ্রীতে ভর্তির আগে এবং ডিগ্রী করাকালীন একজন ডাক্তারকে তার এমবিবিএস-এর বেসিক সাবজেক্টগুলোর ছয়টি পুনরায় পড়তে হয়।)

এফসিপিএস ডিগ্রীর সময়সীমা চার বছর। কিন্তু এই ডিগ্রীটিতে এতই কঠিন পরীক্ষা হয় যে এক-দুবারে পাশ না করা্টাই নিয়ম। ফলে এই ডিগ্রী শেষ করতে পাঁচ থেকে দশ বছর লেগে যায়। ডিগ্রিটি দেয় বিসিপিএস নামক একটি প্রতিষ্ঠান। শর্ত হলো এফসিপিএস ফার্স্ট পার্ট করে ডিগ্রীতে প্রবেশ করতে হবে। এ সময় তাকে ফার্স্ট পার্ট করার জন্য বেসিক সাবজেক্ট এবং সে যে সাবজেক্টে এফসিপিএস করতে সেটি পড়তে হয়। তিন বছর একজন এফসিপিএস ডিগ্রীধারী ডাক্তারের সুপারভিশনে ট্রেইনিং করতে হবে, এক বছর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্লাস করতে হবে এবং সম্পূর্ণ নিজ খরচে ও নিজ দায়িত্বে একজন সুপারভাইজার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে একটি ডেসারটেশন করে সাবমিট করতে হবে। একবছর ক্লাসের স্থলে কেউ এক বছর একটি ‘পেইড’ পোস্টে ট্রেনিং করতে পারে। হ্যা, একজন এমবিবিএস ডাক্তার তার ইন্টার্ণশিপ শেষে মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ট্রেনিং-এ ঢুকতে পারবে। এই যে ট্রেনিং যারা করছে, এরাই সেই নটোরিয়াস ‘অনারারী’ মেডিকেল অফিসার তথা অবৈতনিক মেডিকেল অফিসার। ‘বৈতনিক’ ট্রেনিং তারাই করতে পারে যারা সরকারী চাকুরী করছে এবং উপজেলায় দু-বছর পার করে এসেছে। তবে এ ধরনের বৈতনিক বা পেইড পোস্টগুলোর সংখ্যা কম। ফলে ঘুষ দেয়ার যোগ্যতা, মামুর জোড় বা রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া এ পোস্ট পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে পোস্টগুলো যদি হয় ঢাকার কোন মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে, তাহলেতো কথাই নেই। যাই হোক, একজন এফসিপিএস পার্ট দুই পরীক্ষায় বসতে পারবে উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণে। সুতরাং, এভাবে একজন ডাক্তারের ভাগ্য ভালো থাকলে জীবনের ন্যূনতম ১০ বছর(বেসরকারী) অথবা ১২ বছর(সরকারী) পার হচ্ছে।

ডিপ্লোমা ডিগ্রীগুলোর ভ্যালুয়েশন কম।(তার মানে এই না যে ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারীরা একেবারে কম দক্ষ) এগুলো করতে সময় লাগে দুই বছর। ইন্টার্ণশিপের এক বছর পর পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়। এম ফিল ডিগ্রীগুলো তিন বছর। ডিগ্রী শেষে মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা মেডিকেল কলেজের টিচার হতে পারে। তবে বায়োকেমিস্ট, প্যাথোলজিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্টরা ল্যাবে কাজ করতে পারে।লক্ষ্যনীয় বাংলাদেশে পারতপক্ষে কোন রিসার্চ এক্টিভিটি নেই বিধায়, ডক্টরেট(পিএইচডি) ডিগ্রী করার সুযোগ নেই বললেই চলে। সুতরাং এমফিল বা ডিপ্লোমা করলেও লাগছে যথাক্রমে ১০ বছর বা ৯ বছর (বেসরকারী) এবং ১২ বছর  বা ১১ বছর (সরকারী)।

শুধুমাত্র মাস্টার ইন পাবলিক হেল্দ বা এমপিএইচ ডিগ্রীর সময় দেড় থেকে দুই বছর। ইন্টার্ণশিপের পরে একবছর পার করে পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়। এ ডাক্তাররাও সাধারনত সরাসরি চিকিৎসা সেবা দেন না। বরং নিপসম বা বিভিন্ন মেডিকেলে কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের টিচার হন। অথবা বিভিন্ন এনজিও-তে রিসার্চ ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করেন। এদেরও সময় লাগছে ৯ বছর (বেসরকারী) বা ১০ বছর (সরকারী)।

সুতরাং এই যে একজন ব্যক্তি যাকে অনেকে কসাই বলে উপাধি দিচ্ছেন, স্নাতক-লেভেলে প্রবেশের পর থেকে (আনুমানিক বিশ বছর বয়স)প্রায় ৯ থেকে ১৪ বছর ধরে তার শুধুমাত্র কর্মজীবনের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের সময় একজন বেসরকারী ডাক্তারকে (মনে রাখা দরকার অধিকাংশ ডাক্তারই বেসরকারী) ৩ থেকে ৬ বছর বিনা বেতনে খাঁটতে হয়। কিন্তু নিজের জীবনতো চালাতে হবে। সবার পারিবারিক ব্যকগ্রাউণ্ডতো তাকে এ সময়টিতে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতে পারে না। কারো আবার নিজের পরিবারকেই সাপোর্ট দিতে হয়। এ সময়ে অনেকেই হাসপাতালে সপ্তাহে ন্যূনতম ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় দেবার পাশাপাশি বাইরে কোন ক্লিনিকে বা হাসপাতালে ৪৮ ঘন্টা সময় দেন। অর্থাৎ এ সময় তার সপ্তাহে প্রায় ৯৬ ঘন্টা ঘরের বাইরে সেবা দিয়ে যেতে হয়। অথচ এ সময় তার বেতন সর্বনিম্ন ১২ হাজার থেকে সর্বচ্চো ৩০ হাজার (হাসপাতাল ও যোগ্যতা ভেদে)। গড়ে ২০ হাজার ধরলে তার বেতন ঘন্টা প্রতি ৫০ টাকার মত। সাথে যাচ্ছে প্রচণ্ড মানসিক ও শারিরীক পরিশ্রম।

লক্ষ্য করে দেখুন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন অনার্স বা মাস্টার্স করে বেরিয়ে বেসরকারী ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলে বেতন ৩৫০০০ থেকে ৪০০০০ হাজার টাকায় শুরু হয়।(আমি যতটুকু দেখেছি)অথচ একজন ডাক্তার অনার্স করে বেরিয়ে বেসরকারী মেডিকেলে গড়ে ২৫০০০ টাকার মত বেতনে টিচার হিসেবে জয়েন করতে পারে। এটাকি বৈষম্য নয়?

যাইহোক ডিগ্রীর কথা বলতে গিয়ে বেতনের কথা চলে এলো। হাজার হোক ডাক্তাররা হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। তাদেরও বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। উদ্ভিদের মত তাদের খাদ্য শরীরে সংশ্লেষ হয় না।

সর্বশেষ আপডেট: ২২/০৫/২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top