ফেরা

১.

“কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না?”

দুই হাত দিয়ে মাথা চাপড়ে নিজেকে প্রশ্ন করছে রাজু। প্রচণ্ড অনুশোচনা, ভয় ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে নিজেকে নিজে তীরস্কার করছে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে জল। এই পাপ থেকে বার বার ফিরে আসতে চেয়েও আবার নিমজ্জিত হয়ে যায় সে। যতবারই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, ততবারই আত্মগ্লানীতে নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে তার। পবিত্র হয়। স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু, একটা সময় পরে কি যেন হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোন কোন সময় ঘন্টার পর ঘন্টা সে নষ্ট করে দেয় এই ঘৃণ্য পাপকর্মে।

“এটি আমার জীবনীশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে। আমার স্মরণ শক্তি কমে যাচ্ছে।” প্রতিবার তওবার সময় সে নিজেকে বোঝাতে থাকে।

“কোন বই-এ যেন পড়েছিলাম, ব্রেইনের এডিকশন সাইকেল যে নিউরণগুলো দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই আসক্তি চক্র-ই এই পাপের সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া যারা এই জঘন্য পাপাচারকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তারা এটিতে সেচ্ছায় যায় না। কোন বা কোন ভাবে তাদেরকে প্ররোচিত করা হয়। এইতো কয়েকদিন আগেই একজনের ইন্টারভিউ দেখেছিলাম। আরও অনেক কনফেশন ইন্টারনেট ঘুরলেই পাওয়া যায়। তাহলে কেন আমি নিজেকে বিরত রাখছি না।” নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে রাজু।

“কোন একটা ইন্টারভিউতে শুনেছিলাম- যারা বয়:সন্ধি হওয়ার আগেই এই ধরনের শ্লীলতাহীন চিত্র বা চলচ্চিত্রের সম্মুখিন হয় তাদের মধ্যে এই পাপাচারের আসক্তি তৈরী হয়। আমার ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে দু-একবার দুষ্টুমিচ্ছলে দেখাই কি আমাকে এই চক্রাকার গহবরে নিমজ্জিত করেছে তাহলে?” রাজু ভাবে এবং নানাভাবে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, কয়েকদিন পর আবার ব্যর্থ হয় সে।

প্রতিবার আসক্তির চরম আকর্ষণে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার করার চেষ্টা করে। কিন্তু, এরপরও নিজের সাবকনাশাস আকাঙ্খার তীব্রতাকে অবনমিত করতে ব্যর্থ হয়। “কেন বুঝিনা আমি? ওরা বস্তু না। মানুষ। ওদের ভেতর মন আছে, আত্মা আছে। ওরা শুধু শরীর নয়।”

এ যুগে সবার হাতে হাতে এনড্রয়েড ডিভাইস। খুবই স্বল্প খরচে পাওয়া যায় ইন্টারনেট। ফেসবুকে ভাল কোন পোস্ট পড়লেও হঠাৎ ট্রিগার হিসেবে চলে আসে কোন সুন্দর অবয়ব। ইউটিউবে কোন ভাল ভিডিও দেখার সময়, আটোসাটো জামার বিজ্ঞাপন এসে ছোট্ট করে উদ্দীপনা দিয়ে যায়। এরপর আপাত পরিচ্ছন্ন নাটক, নাটক থেকে আধেক পোশাকের সিনেমা, সিনেমা থেকে পাপের সাগরে হাবুটুবু। এরপর অনুশোচনা আর আত্মগ্লানি। এই ভয়ংকর নষ্ট সিকোয়েন্সে রাজুর জীবনটা আজ বন্দী।

“তাহলে কি আমার বিয়ে করা উচিৎ? সেদিন একজন একটা ভিডিওতে বলছিল যে সে বিয়ে করার পর এই জঘণ্য অপরাধ থেকে মুক্তি পেয়েছে।” এই পাপাচার থেকে বের হয়ে আসার একটা পথ খুঁজতে থাকে রাজু। “কিন্তু আমি পড়াশোনা শেষ না করে কিভাবে বিয়ে করবো? একটা ভালো আয়ের উৎস না হলে কিভাবে বাবা-মাকে বলবো? একদিকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছি না। অন্যদিকে বিয়ে করার সুযোগ নেই।” ভেবে কোন কুল কিনারা বের করতে পারে না সে। লজ্জা ও সামাজিক তিরস্কারের অজানা ভয়ে কারও সাথে তার আসক্তির কথা বলতেও পারে না।

এভাবে কতটা সময় চলে যায়। এক রাশ মুক্ত বাতাসের খোঁজে রাজু অন্ধকারে পথ হাতরে বেড়ায়।
…..

২.

একটি সুন্দর মলাটের বই হাতে বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে আছে রাজু। “‘মুক্ত বাতাসের খোঁজে’- আহ কি সুন্দর নাম। আসলেইতো আমি বন্দী। একটি বদ্ধ ও অন্ধকার জগতের গুমোট বাতাসে প্রশ্বাস নিই আমি। কতদিন বুক ভরে স্বচ্ছ বাতাস নেই না।” রাজুর গাল বেয়ে নোনা জল পড়তে থাকে। “এত চমৎকার বই এতদিন কেউ লেখেনি কেন? কেন আগে জানতে পারিনি সিরিয়াল কিলার থেকে রাক্ষুসে ধর্ষক সবাই এই পাপাচারেরই পরিনতি।”

বই থেকে টিপস নিয়ে কাজে নেমে পড়ে রাজু।
-নামাজ পড়া
-রোজা রাখা
-কোরআন বুঝে পড়া এবং তার মজা অনুধাবন করা
-মাথায় নষ্ট চিন্তা আসলে অন্য দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করা
-অশ্লীল সাইটগুলো ব্লক করে রাখা
-নিজেকে প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত রাখা
-লক্ষ্যভিত্তিক রূটিন জীবন যাপন

৩.
চার মাস পর..

অনেকদিন পর রাজু হৃদয়ে শান্তি অনুভব করছে। মনে হচ্ছে যেন এক মুঠো আলো কেউ বুকে ঢেলে দিয়েছে। নি:শ্বাসের সাথে মুক্ত ও পরিস্কার বাতাস আদান-প্রদান হচ্ছে। অনেক সাধনা, অনেক আত্মত্যাগ, অনেক নিয়ন্ত্রণ ও প্রচন্ড মানসিক পরিশ্রমের পর আজ সে মুক্ত।

আজ বেলা ফুরাবার আগে তার মনে হচ্ছে যেন তার জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছে। যে অধ্যায়ে একজন মানবের গল্প নতুন করে বলা হবে।

আজ মনের অবারিত আনন্দে সেজদায় গিয়ে অঝোড় ধারায় কাঁদবে সে। এ কান্না আনন্দের, এ অশ্রু প্রশান্তির।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *