বিজ্ঞানের একটি অন্তঃর্নিহিত সীমাবদ্ধতা হল ‘Problem of Induction’। বিজ্ঞান কাজ করে অনুমিতি (Assumptions)-এর উপর ভিত্তি করে। কিন্তু, বিজ্ঞানবাদীরা বিজ্ঞান যে ‘অনুমিতি’ নির্ভর তা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়।
একটু খুলে বলি। ধরুন, আপনি পরীক্ষা করে দেখতে চান কাকের রং কি। যেই ভাবা সেই কাজ। আপনি ১০০০ হাজার কাক র্যানডমলি বাছাই করে পর্যবেক্ষণ করলেন। আপনি দেখলেন কাকের রং কালো। আপনি সিদ্ধান্তে আসলেন যে কাকের রং কালো। কিন্তু, ‘কাকের রং কালো’ এই সিদ্ধান্তটি কি ১০০% সত্য (Fact)। উত্তর হচ্ছে: না। কারণ, আপনার বন্ধু যদি কয়েকবছর পর ঘটনাক্রমে একটি সাদা কাক আবিস্কার করে ফেলে তাহলে ‘কাকের রং কালো’ সিদ্ধান্তটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বিজ্ঞানীদের কাজ হল পর্যবেক্ষনলব্ধ তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে একটি তত্ত্ব (Theory) দাড় করানো। উক্ত তত্ত্বের কাজ দুটো: একটি হল বর্তমান তথ্য উপাত্তের একটি কার্যকরী ব্যাখ্যা দেয়া এবং দ্বিতীয়টি হল উক্ত তত্ত্বের আলোকে প্রেডিকশন করা যে মহাবিশ্বের অদেখা জায়গাগুলো ‘যদি একই রকমের নিয়ম মেনে থাকে’ তাহলে একই রকম তথ্য পাবার কথা।
উক্ত ‘একই রকমের নিয়ম মেনে থাকে” বাক্যটি হচ্ছে আমাদের অনুমিতি যা হয়ত পরবর্তী পর্যবেক্ষণে সত্য নাও হতে পারে।
সুতরাং মহাবিশ্বের (মানে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীবজগৎ সহ) কোন অংশ আমরা কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং কতটুকু পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি, আমাদের প্রকল্প (Hypothesis) এবং তত্ত্ব তার উপর নির্ভর করে।
যেমন টলেমীর জিওসেন্ট্রিক মডেল (তথা পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরে) ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর ছিলো যতক্ষন পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য উক্ত মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল। কিন্তু, যখনই নতুন পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য উক্ত মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না তখন কোপারনিকাসের হেলিওসেন্ট্রিক মডেল (তথা সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরে) এসে জায়গা করে নিলো।
আরেকটা মজার বিষয় হল হাতে থাকা তথ্যকে অনেক সময় একাধিক মডেল বা প্রকল্প দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু, এর মধ্যে কোন প্রকল্পটি গ্রহন করা হবে তা নির্ভর করছে উক্ত প্রকল্পটির ‘ব্যাখ্যা শক্তি’ (explanatory power) -এর উপর। যে প্রকল্পটি আহরিত তথ্যের সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবে এবং যেটি তুলনামূলক সহজ, রীতি হলো সেটি গৃহীত হবে।
বিজ্ঞানী মহলে Occam’s Razor বলে একটি কথা আছে। যার বক্তব্য হচ্ছে- যখন কোন পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করতে একাধিক প্রতিযোগী প্রকল্প দাড় করানো হয় তখন সে প্রকল্পটি গ্রহন করতে হবে যেটি সর্বনিম্ন সংখ্যক ‘অনুমিতি’ নির্ভর তথা ‘সহজ’। তার মানে এই নয় যে অন্যান্য প্রকল্প ভুল। বরং, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি এজন্য গ্রহন করা হচ্ছে যে এটি বৈজ্ঞানিকভাব তুলনামূলক সহজে পরীক্ষা (test) করা যাবে।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কখনও শতভাগ সত্যের নিকটে পৌছতে পারে না। কারণ, বিজ্ঞান নির্ভর করে মানুষের ‘পর্যবেক্ষণ’ সীমার উপর।
‘বিবর্তনবাদ’ ফসিল এভিডেন্স ও স্পিসিস-এর জিওগ্রাফিক লোকেশনের একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু, একটা ব্যাকটেরিয়ার ফ্ল্যাজেলা কিভাবে ‘বিবর্তনের’ মাধ্যমে তৈরী হল তা বিজ্ঞানমহলে প্রচলিত কোন বিবর্তনের ম্যাকানিজম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সুতরাং, যারা বিবর্তনবাদকে শতভাগ সত্য (Fact) বলে দাবী করে, তারা তা করে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এই বিশ্বাস যে, বিজ্ঞান মানুষকে শতভাগ সত্যের দিকে নিয়ে যায়। আর, যারা বিবর্তনবাদকে শুধমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের বিনয়ের সাথেই মেনে নেয় যে নতুন এমন অনেক পর্যবেক্ষন থাকতে পারে যা ‘বিবর্তনবাদ’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
লক্ষ্যণীয় ‘Observation’ তথা পর্যবেক্ষণ হচ্ছে জ্ঞান আহরনের একটি মাধ্যম মাত্র। মানুষের জ্ঞান অর্জনের আরও অনেক মাধ্যম আছে । ‘Epistemology’ তথা জ্ঞানতত্ত্ব হল দর্শনের একটি শাখা যা মানুষের জ্ঞান আহরনের মাধ্যম এবং মানুষের বিশ্বাস-এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন (Justification) নিয়ে আলোচনা করে।
শেষ করছি একটি প্রশ্ন রেখে। পাঠক ভেবে দেখুনতো মানুষের জ্ঞান আহরনের আরও কি কি মাধ্যম আছে?
Leave a Reply