বই: Darwin’s Doubt
লেখক: Stephen C. Meyer, PhD
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪৯৮
প্রকাশনার তারিখ: 18th June, 2013
প্রকাশ করেছে: HarperCollins Publishers
ওয়েব লিংক: http://www.darwinsdoubt.com/
ডারউইন যখন প্রথম তার থিওরী প্রদান করেন তখন তার থেকে শতগুনে যোগ্য একজন সমসাময়িক প্যালেওন্টোলজিস্ট লাওইস আগাসিজ ফসিল রেকর্ডের আলোকে ডারউইনের হাইপোথিসিসকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ডারউইন যেহেতু তার তত্ত্বের আলোকে জীবের উৎপত্তির একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন এবং যেহেতু পশ্চিমা বিশ্বে চার্চের সাথে বিজ্ঞানের যুদ্ধ চলছিল, ডারউইনের এই মতবাদ পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক না হয়েও পরবর্তীতে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
ডারউইন কৃত্রিম সংকরায়ণের উপর পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলেন প্রজাতিতে যে ভ্যারিয়েশন হয় সেগুলো প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হতে পারে এবং যথেষ্ট সময় দিলে তা নতুন প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। তার এই প্রকল্পের বিপরীতে তিনি ফসিল রেকর্ডকেও দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফসিল রেকর্ডে দুটো সমস্যা তার দৃষ্টিতেই বাঁধা মনে হচ্ছিল:
১. ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোসন, এবং
২. গ্র্যাজুয়্যাল ইভলিউশনের জন্য ফসিল রেকর্ডে গ্র্যাজুয়্যাল ফসিল এভিডেন্সের অভাব।
তিনি এ দুটো ব্যাখ্যার অপূর্ণতার জন্য দায়ী করেছিলেন তৎকালীন ফসিল রেকর্ডের অপূর্ণতাকে। কিন্তু গত ১৫০ বছরের ফসিল অভিযান এই অপূর্ণতাকে সমাধান করেনি বরং আরও তীব্র করেছে।
ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোসন হল জিওলজিকাল টাইম স্কেলে খুব ক্ষুদ্র একটি সময় (৫৩০ মিলিয়ন বছর থেকে ৫২০ মিলিয়ন বছর পূর্বে) যখন ভূস্তরে প্রাণীজগতের প্রায় ২০টি পর্বের (Phylum) একত্রে আগমন ঘটে। লক্ষ্যণীয় প্রাণীজগতের শ্রেণীবিন্যাসের যে ছয়টি স্তর আছে তার মধ্যে Phylum বা পর্ব হল উপরে। এরপর যথাক্রমে Class, Order, Family, Genus, Species. একটি স্পিসিসের সাথে আরেকটি স্পিসিসে গাঠনিক পার্থক্য খুবই কম। এমনকি শুধু রঙের পার্থক্য ও রিপ্রোডাকটিভ আইসোলেসনের কারণে একটি স্পিসিস আরেক স্পিসিস থেকে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু শ্রেণীবিন্যাসের ক্রমে যত উপরের দিকে উঠা যায় ততই প্রাণীদের গাঠনিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে পর্ব ও শ্রেণী পর্যায়ে প্রাণীদের স্পষ্টভাবে আলাদা করা যায়। পর্বগুলোর পার্থক্য হলো তাদের সম্পূর্ণ পৃথক ‘Body Plan’। ডারউইনিয়ান পদ্ধতি সঠিক হলে ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোসনের আগে প্রি-ক্যামব্রিয়ান পিরিয়ডে (এডিয়াকারান পিরিয়ড) পর্যায়ক্রমিক জটিলতর ‘বডি প্ল্যানের’ অনেক ফসিল পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রিক্যামব্রিয়ান স্তরে এ ধরণের ফসিল এভিডেন্স নেই। আছে শুধু এককোষী জীব এবং স্পঞ্জ জাতীয় প্রাণীর ফসিল।
ক্যামব্রিয়ান নিয়ে ডারউইনের এই সন্দেহ গত ১৫০ বছরের ফসিল রেকর্ডের আবিস্কার, প্রি-ক্যামব্রিয়ান ফসিল না থাকার বিভিন্ন ব্যাখ্যার (যেমন: আর্টিফ্যাক্ট হাইপোথিসিস) ব্যর্থতা এবং জেনেটিক্স ও মলিকিউলার বায়োলজির বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির আলোকে আরো প্রকট হয়ে ডারউইনবাদের জন্য ‘সন্দেহ’ থেকে ‘বিপরীত’ এভিডেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কেন এবং কীভাবে তা হলো সেটা নিয়েই, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ফিলোসফি অব সায়েন্সে ডক্টরেট স্টিফেন সি. মায়ার তার বই ‘Darwin’s Doubt’ লিখেছেন।
বইটিতে একদিকে যেমন ডারউইনবাদের সাথে ফসিল এভিডেন্সের অসংলগ্নতা নিয়ে তথ্য-ভিত্তিক আলোচনা আছে, তেমনি জেনেটিক্সের সাথে ডারউইনবাদের আধুনিক সংকরণ নিও-ডারউইনিজমের ব্যর্থতা নিয়েও আলোচনা আছে।
প্রসঙ্গত, ডারউইন যখন প্রথম মতবাদ দেন, তখন তিনি জিন ব্যাপটিস্ট লামার্কের তত্ত্ব থেকে কিছু ধারণা তার চিন্তায় ঢুকিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল প্রজাতিতে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রয়োজনে বৈশিষ্ট্যে কিছু বংশানুক্রমে সঞ্চালনযোগ্য (হেরিটেবল) পরিবর্তন সূচিত হয় এবং প্রাকৃতিকভাবে তা নির্বাচিত হয়ে ধীরে ধীরে প্রজাতিতে পরিবর্তন আসে। কিন্ত গ্রেগ্রর জোহানস মেন্ডেল যখন দেখালেন জীবের ভিতর জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো জিন হিসেবে থাকে এবং বিভিন্ন জিন থাকার কারণে বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নতা তৈরী হয়। তখনও মিউটেশন আবিস্কার হয়নি। ফলে ডারউইনবাদ প্রাথমিকভাবে সমস্যায় পড়ে যায়। কিন্তু যখন মিউটেশন আবিস্কার হয় এবং দেখা যায় মিউটেশন প্রজাতির জিনে ক্ষতি সাধন করতে পারে তখন ডারউইনবাদকে জেনেটিক্সের সাথে মিশিয়ে নতুন সিনথেসিস করা হয় ১৯৪২ সালে, যার নাম নিও-ডারউইনিজম। এতে নেতৃত্ব দেন আর্নেস্ট মায়ার, থিওডসিয়াস ডবঝানস্কি, থমাস হাক্সলি প্রমুখ। নিও-ডারউইনিজমের মূল কথা- র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে প্রজাতিতে ভ্যারিয়েশন তৈরী হয় এবং ন্যাচারাল সিলেকশনের মধ্য দিয়ে ফেবরেবল ভ্যারিয়েশন বাছাই হয়। এভাবে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে একটি প্রজাতি আরেকটি প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।
এরপর ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমস ওয়াটসন আবিস্কার করেন- ডিএনএ। আবিস্কার হয় কম্পিউটার যেমন বাইনারী নাম্বারে কোড ধারণ করে, ঠিক তেমনি ডিএনএ প্রোটিন গঠনের তথ্য কোড হিসেবে ধারণ করে। এডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থায়ামিন এই চার ধরণের নাইট্রোজেন বেজ দিয়ে গঠিত হয় ডিএনএ কোড। প্রতি তিনটি নিউক্লিওটাইড একটি এমাইনো এসিডকে কোড করে। জীবে প্রাপ্ত প্রোটিন গঠিত হয় ২০ ধরণের এমাইনো এসিড দিয়ে। অন্যদিকে ৪টি নিউক্লিওটাইড ৩টি পজিশনে মোট ৪^৩ তথা ৬৪ রকমে বসতে পারে। সুতরাং দেখা গেল, একেকটি এমাইনো এসিড একাধিক নিউক্লিউটাইড কম্বিনেশন দিয়ে কোড হতে পারে।
সময়ের সাথে সাথে জানা যায় মিউটেশন হলো নিউক্লিওটাইড সাবস্টিটিউশন, ইনসারশন, ডিলেশন ইত্যাদি ধরণের। মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যদি এমন একটি নিউক্লিওটাইড সাবস্টিটিউশন হয় যে এমাইনো এসিড অপরিবর্তিত থাকে তাহলে প্রোটিনের গঠনে কোন পরিবর্তন হবে না। এ কারণে একই কাজ সম্পাদনকারী প্রোটিনের জেনেটিক কোডে পার্থক্য থাকতে পারে। এবং প্রজাতিভেদে ব্যাপারটা এরকমই পাওয়া যায়। এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে ‘মলিকিউলার ক্লক’ বা ‘ফাইলোজেনেটিক স্টাডি’। অর্থাৎ একটি প্রোটিন যা একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে, বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে উক্ত প্রোটিনটির জেনেটিক কোডে ভিন্নতা ও মিল হিসেব করা হয়। এরপর মিউটেশনের হার ইত্যাদির আলোকে দেখা হয় যে দুটো সমজাতীয় প্রজাতির কত বছর আগে পরস্পর থেকে পৃথক হয়েছে। (বিস্তারিত বইটিতে আছে।)
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যদি বিবর্তনের মাধ্যমে প্রজাতি এসে থাকে তাহলে বিভিন্ন জিন নিয়ে ফাইলোজেনেটিক স্টাডি করলে সমজাতীয় মলিকিউলার ট্রি পাওয়ার কথা, অথচ বিভিন্ন মলিকিউলার ইভোলিউশনারী বায়োলজিস্ট বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন প্রোটিন, বিভিন্ন পর্বের একই ধরণের জিন নিয়ে গবেষণা করে যে ‘ট্রি’গুলো দাঁড় করিয়েছেন তাতে ইভোলিউশনারী টাইমিং-এর কোন কনগ্রুয়েন্ট পিকচার নেই। এই বিষয়টি খুব সুন্দর চিত্রের আলোকে Darwin’s Doubt বইটিতে লেখক দেখিয়েছেন।
প্রোটিন গঠিত হয় ২০ ধরণের এমাইনো এসিড দিয়ে এবং প্রোটিনের গঠন খুবই স্পেসিফিক। ধরা যাক, দুটো এমাইনো এসিড পরস্পর পেপটাইড বণ্ড দিয়ে যুক্ত হবে। তাহলে সম্ভাব্য সমাবেশ হতে পারে, ২০x২০ তথা ৪০০ ধরণের। তিনটি হলে ২০x২০x২০ তথা ৮০০০ ধরণের, ৪টি হলে ২০^৪ = ১৬০০০০ ধরণের। অথচ, কোষের ভিতর ছোট আকৃতির একটি কার্যকরী (ফাংশনাল) প্রোটিন গড়ে ১৫০টি এমাইনো এসিডের সমন্বয়ে তৈরী হয়। সুতরাং ১৫০ ঘরে বিন্যাস হবে ২০^১৫০ তথা ১০^১৯৫ ধরণের। যার মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক বিন্যাসই কার্যকরী প্রোটিন গঠন করতে পারে। এই সংখ্যাটা কত বড় তা বুঝানোর জন্য বলা যায়, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে ১০^৮০টি মৌলিক কণা আছে এবং আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১০^১৬ সেকেণ্ড। সুতরাং র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে কি প্রোটিন আসা সম্ভব?
এই ‘কম্বিনেটরিয়াল ইনফ্লেশন’ নিয়ে প্রথম আগ্রহী হন MIT-র প্রফেসর অব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সায়েন্স মুরে এডেন, ১৯৬০ সালে। ১৯৬৬ সালে তিনিসহ আরো কয়েকজন ম্যাথমেটিসিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানী উইসটার ইন্সটিউট অব ফিলাডেলফিয়ায় একত্রিত হন। তারা প্রোটিনের গঠনের এই কম্বিনেটরিয়াল ইনফ্লেশনকে বিবেচনায় এনে নিও-ডারউইনিজমের সীমাব্ধতাগুলো তুলে ধরেন। তারা দেখান যে র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে একটি প্রোটিনও আসা সম্ভব নয়, সময় এবং রিসোর্সের সীমাব্ধতার কারণে। তবে কনফারেন্সে এই তথ্যটাও উঠে আসে যে প্রোটিনের এই সিকোয়েন্স স্পেসে প্রোটিনগুলোর গঠন যদি কাছাকাছি থাকে তাহলে হয়তো একটি সম্ভাবনা আছে যে নিও-ডারউইনিজম র্যাণ্ডম মিউটেশন দিয়ে প্রোটিনের বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারে। যদিও মুরে এডেন নিজেই এই সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেননি। কারণ, একটি ভাষায় থাকে সিনটেক্স, গ্রামার, কনটেক্সট ইত্যাদি। ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান জেনেটিসিস্টি মাইকেল ডেনটন দেখান, ইংরেজীতে একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বাক্যে বর্ণের সম্ভাব্য সকল কম্বিনেশনের মধ্যে অর্থযুক্ত বাক্যের (তথা সিকোয়েন্সের) সংখ্যা খুবই কম এবং দৈর্ঘ্য যত বড় হয় সংখ্যা ততই কমে যেতে থাকে। তিনি হিসেব করে দেখান ১২টি বর্ণের বাক্যে অর্থযুক্ত শব্দের সম্ভাব্যতা ১০^১৪ এর মধ্যে ১ বার। এভাবে ১০০টি বর্ণের বাক্যে ১০^১০০ এর মধ্যে একবার।
নিও-ডারউইনিস্টরা অবশ্য এ সুযোগটি গ্রহণ করে এবং আশাবাদী থাকে যে সিকোয়েন্সে স্পেসে প্রোটিনের অবস্থান কাছাকাছি হবে। ক্যালিফর্নিয়া ইন্সটিউট অব টেকনোলজি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করার সময় ডগলাস এক্স এ বিষয়টি পরীক্ষামূলক ভাবে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরী অব মলিকিউলার বায়োলজিতে এলান ফার্স্ট এর অধীনে রিসার্চের সুযোগ পেয়ে যান। তিনি ও তার সহযোগিরা ১৫০ এমাইনো এসিডের সম্ভাব্য সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
প্রসঙ্গত প্রোটিন শুধু মাত্র এমাইনো এসিডের চেইন হিসেবে থাকে না। প্রোটিন তিনটি ধাপে ভাঁজ (ফোল্ড) হয়। এদেরকে প্রাইমারী, সেকেণ্ডারী এবং টারশিয়ারী স্ট্রাকচার বলে। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক ফোল্ড সঠিক হওয়ার উপরই এর ফাংশন নির্ভর করে। সকল এমাইনো এসিড সিকোয়েন্স-এ যেমন ত্রিমাত্রিক ফোল্ড হয় না আবার সকল ত্রিমাত্রিক ফোল্ড ফাংশনাল হয় না। ডগলাস এক্স প্রাথমিক ভাবে দেখতে পান যেই সংখ্যক সিকোয়েন্স ফাংশনাল ফোল্ড গঠন করে তাদের সম্ভাব্যতা ১০^৭৪ এর মধ্যে ১ বার। (মহাবিশ্বের বয়স ১০^১৬ এবং মিল্কি ওয়েতে পরমাণু সংখ্যা ১০^৬৫) এর মধ্যে যেই ফোল্ডগুলো কার্যকরী তাদেরকে হিসেবে নিলে সম্ভাব্যতা দাঁড়ায় ১০^৭৭। ডগলাস এক্স দেখেন যে আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের ৩.৪ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১০^৪০। তিনি ধরে নেন যে প্রতিটি ব্যাকটেরিয়াতেই যদি একটি করে নিউক্লিওটাইড সাবস্টিটিউশন হয় (যা কখনোই হয় না) তাহলেও একটি ১৫০ এমাইনো এসিডের চেইনের প্রোটিন আসতে পারবে না। তবে, একটি বিদ্যমান প্রোটিনকে আরেকটি ফাংশনাল প্রোটিনে পরিণত করতে হলে র্যাণ্ডম মিউটেশনের জন্য কাজ কমে যায়। তখন শুধু একটি প্রোটিনকে আরেকটি প্রোটিনে পরিণত করতে কয়টি মিউটেশন লাগবে তা হিসেব করলেই হয়।
পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন এখানে মূল সমস্যাটি হল ডিএনএতে তথ্য যুক্ত করার সমস্যা। নিও-ডারউইনিস্টরা পপুলেশন জেনেটিক্স নামক ডিসিপ্লিন দিয়ে মিউটেশনের মাধ্যমে প্রজাতির জিনে নতুন ইনফরমেশন যুক্ত হওয়ার বিভিন্ন হিসেব নিকেষ কষে থাকেন। লেহাই ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর মাইকেল বিহে এবং ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের ফিজিসিস্ট ডেভিড স্নোক পপুলেশন জেনেটিক্সের উপর ভিত্তি করে একটি প্রোটিনকে আরেকটি ন্যাচারালী সিলেকটেবল প্রোটিনে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় মিউটেশন এবং তা আসতে প্রয়োজনীয় সময় হিসেব করেন। তারা দেখেন যে একটি প্রোটিন-প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইট থেকে আরেকটি প্রোটিন-প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইট আসতে হলে একই সাথে কয়েকটি স্পেসিফিক মিউটেশন লাগবে (কমপ্লেক্স এডাপটেশন) এবং তারা হিসেব করে দেখান যে এর জন্য কমপক্ষে দুই বা ততোধিক মিউটেশন একই সাথে স্পেসিফিক সাইটে হতে হবে। বিহে এবং স্নোক বাস্তবিক উদাহরণের উপর ভিত্তি করে দেখান যে, পৃথিবীর বয়স সীমায় দুটি মিউটেশন একসাথে হতে পারে যদি স্পিসিসের পপুলেশন সাইজ অনেক বড় হয়। কিন্তু দুইয়ের অধিক মিউটেশন একসাথে প্রয়োজন হলে তা পৃথিবীর বয়স সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। অথচ, ডগলাক্স এক্স মলিকিউলার বায়োলজিস্ট এনে গজারকে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে, একটি প্রোটিন আরেকটি ভিন্ন ফাংশনের প্রোটিনে পরিণত করতে নূন্যতম ৫ বা তার বেশী সাইমালটেনিয়াস মিউটেশন তথা নিউক্লিউটাইড সাবস্টিটিউশন লাগবে।
র্যাণ্ডম মিউটেশনের এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে নিও-ডারউইনিস্ট বিজ্ঞানীরা জিনোম ভ্যারিয়েশন তৈরীর অন্যান্য মেকানিজম প্রস্তাব করেছেন। যেমন: জেনেটিক রিকম্বিনেশন, এক্সন শাফলিং, জিন ডুপ্লিকেশন, ইনভারশন, ট্রান্সলোকেশন, ট্রান্সপজিশন ইত্যাদি। স্টিফেন সি. মায়ার তার বইতে প্রত্যেকটি মেকানিজমের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন।
লক্ষ্যণীয়, কোষের ভিতর একটি প্রোটিন একা কাজ করে না। বরং কয়েকটি পরস্পর অন্তঃনির্ভরশীল প্রোটিনের নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করে। আবার ডিএনএতে প্রোটিনের প্রাথমিক গঠনের তথ্য ধারণ করলেও, প্রোটিনগুলো কিভাবে কোষের ভিতর এরেঞ্জ হবে সেই তথ্য কিন্তু ধারণ করে না। এককোষী জীব থেকে বিভিন্ন উচ্চতর প্রাণীর পর্বগুলোকে কীভাবে ভাগ করা করা হয়? উত্তর: কোষের প্রকারের উপর ভিত্তি করে। বহুকোষী জীব অনেক ধরণের কোষ নিয়ে গঠিত হয়। মজার ব্যাপার হলো প্রতিটি কোষই কিন্তু শরীরের পুরো জেনেটিক তথ্য ধারণ করে বলে আমরা এখন পর্যন্ত জানি। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে প্রতিটি কোষের একটি নির্দিষ্ট অংশ সাইলেন্সিং করা থাকে। সাইলেন্সিং-এর কাজ কীভাবে হয়?
এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করতে করতেই নতুন একটি শাখা খুলে গেছে যার নাম এপিজেনেটিক্স। এপিজেনেটিক্সের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে, কোষ যে শুধু ডিএনএ তথ্য ধারণ করে তা-ই নয় বরং কোষের ঝিল্লীর যে সুগার মলিকিউল আছে সেগুলোর পজিশনও খুব স্পেসিফিক। একে বলা হচ্ছে সুগার কোড। সুগার কোড নির্ধারণ করে একটি প্রোটিন তৈরী হওয়ার পর কোষের কোন্ অংশে সে যাবে। একই জীবদেহের কোষগুলোতে এই সুগার কোডটি কপি হয় রিপ্রোডাকর্টিভ সেল উওসাইট থেকে। এটি ডিএনএতে কোড করা থাকে না। আবার মাইক্রোটিউবিউল নামক কোষের ভিতরের যে পরিবহন নেটওয়ার্ক সেটার পরিজশনও ডিএনতে কোড করা থাকে না। সুতরাং একটি বহুকোষী প্রাণীর কোষ ডিফারেনসিয়েশনে এই সুগার কোডও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ শুধু ডিএনএ মিউটেশন দিয়ে এটি ব্যাখ্যা করা যাবে না। অন্যদিকে, জিন সাইলেন্সিং এর কাজটিও হয় ননকোডিং রিজিওনের বিভিন্ন তথ্য এবং হিস্টোন মিথাইলেশন, এসিটাইলেশন ও নিওক্লিওটাইড মিথাইলেশন ইত্যাদির মাধ্যমে। এপিজেনেটিক এই বিষয়গুলো কীভাবে নিও-ডারউইনিজমের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ড. মায়ার খুব সুন্দর ভাবে একটি চ্যাপ্টারে তা আলোচনা করেছেন।
একটি পুংজনন কোষ একটি স্ত্রীজনন কোষকে যখন নিষিক্ত করে তখন জাইগোট গঠিত হয়। এর পর জাইগোটটি বিভাজিত হতে শুরু করে। অনেকগুলো কোষের একটি গুচ্ছ তৈরী করার পর এটি পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন কোষে বিভাজিত হতে থাকে এবং কোষগুলোর সঠিক অবস্থানে, সঠিক সময়ে সুগঠিতভাবে এরেঞ্জ করার কাজটি চলতে থাকে যতক্ষণ না তা পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে পরিনত হয়। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় বিষয়টি কতটা জটিল এবং সুনিয়ন্ত্রিত। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিউট অব টেকনোলজির এরিক ডেভিডসন তার পুরো ক্যারিয়ারকে ব্যয় করেছেন এই ডেভেলপমেন্টাল জিন রেগুলেশনকে বের করতে। তিনি পর্যায়ক্রমিক জেনেটিক নিয়ন্ত্রণের এই হায়ারার্কির নাম দেন ডেভেলপমেন্টাল জিন রেগুলেশন নেটওয়ার্ক। তিনি তার গবেষণায় এও দেখান যে ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন পর্যায়ের মিউটেশনের ফলে কী ভয়াবহ পরিণতি হয়। অথচ কোন হেরিটেবল ভ্যারিয়েশন তৈরী হতে হলে রিপ্রোডাকটিভ কোষেই মিউটেশন হতে হবে।
নিও-ডারউইনিজমের এই সীমাবদ্ধতাগুলো দেখতে পেয়ে অনেক বিজ্ঞানীই নতুন নতুন ইভলিউশনের মডেল দিতে শুরু করেছেন। ফসিল রেকর্ডের সীমাবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে যেমন নাইলস এলড্রেজ এবং স্টিফেন জে গোল্ড ‘পাঙ্কচুয়েটেড ইকুইলিব্রিয়াম’ দাঁড় করিয়েছিলেন, তেমনি ‘পোস্ট-ডারউইনিয়ান ওয়ার্ল্ডে’ অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও অন্যান্য ইভলিউশনারী মডেল প্রস্তাব করেছেন: এভো-ডেভো, সেল্ফঅর্গ্যানাইজেশন মডেল, এপিজেনেটিক ইনহেরিটেন্স, ন্যাচারাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। ড. মায়ার দুটো চ্যাপ্টারে এই মডেলগুলোর সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা দুটো নিয়েই আলোচনা করেছেন।
আমরা যখন কোন সফটওয়্যার দেখি এর পিছনে একজন প্রোগ্রামারের কথা চিন্তা করি, যখন কোন গাড়ি দেখি এর পেছনে একজন বুদ্ধিমান গাড়ি তৈরীকারীর কথা ভাবি। ঠিক তেমনি যখন আমরা বায়োলজিক্যাল সিস্টেমে ডিজাইন দেখতে পাই, স্বাভাবিক ভাবেই একজন ডিজাইনারের কথা মাথায় আসে। সায়েন্টিফিক মেথডলজিতে ‘এবডাকটিভ ইনফারেন্স’ বলে একটি কথা আছে। বায়োলজিক্যাল বিঙ এর ডিজাইনে এই মেথডের প্রয়োগ আমাদের ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের কথাই বলে। কিন্তু ডারউইনিয়ান ওয়ার্ল্ডে কোন্ জিনিসটি এই হাইপোথিসিসকে গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে পাওয়া যায় ‘মেথডলিজক্যাল ন্যাচারালিজম’, যা সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে একটি অঘোষিত নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু মেথডলজিক্যাল ন্যাচারালিজমকে ইউনিফর্মিটারিয়ান রুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নেয়ার সুযোগ আছে কি?
স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিউটের ডাইরেক্টর রিচার্ড স্টার্নবার্গ যিনি ইভলিউশনারী বায়োলজি ও সিস্টেমিক বায়োলজিতে দুটো পিএইচডিধারী যখন স্টিফেন সি. মায়ারের ক্যামব্রিয়ান ইনফরমেশন এক্সপ্লোশন সংক্রান্ত একটি আর্টিকল ওয়াশিংটন বায়োলজি জার্নালে প্রকাশের সুযোগ করে দেন তখন নিও-ডারউইনিস্টরা তাকে ডিফেম করা শুরু করে, তার উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়, তার বিরুদ্ধে মিস-ইনফরমেশন ক্যাম্পেইন চালানো হয়, যতক্ষণ না তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। অথচ তখনও পর্যন্ত ড. মায়ারের আর্টিকলের যৌক্তিক সমালোচনা করে কোন আর্টিকেল জার্নালে ছাপানো হয়নি। এটাকেকি বিজ্ঞান বলে?
ড. স্টিফেন সি. মায়ার তার বইয়ের শেষের দিকে এই বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’কে প্রজাতির উৎপত্তির একটি মডেল হিসেবে কেন বিবেচনা করা যায় তার যুক্তিগুলো উপস্থাপন করার পাশাপাশি, নিও-ডারউইনিস্টদের সমালোচনাগুলোর জবাব দিয়েছেন।
লক্ষ্যণীয়, আমেরিকাতে গভার্নমেন্টের সমালোচনা করা গেলেও ডারউইনিজমের সমালোচনা করা যায় না, ঠিক যেমন আমাদের দেশে ডারউইনিজমের সমালোচনা করা গেলেও গভার্নমেন্টের সমালোচনা করা যায় না।
ইসলামের ইতিহাসে সবসময়ই বিজ্ঞানচর্চার সাথে ধর্ম কেন হারমোনি বজায় রেখেছে তা এই বইটি পড়লে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়।