বিবর্তনবাদীরা বিবর্তনের উদাহরণ দিতে গিয়ে এমন কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করেন যেগুলোকে মাইক্রোইভলুশন বলা যায়। কোন সন্দেহ নেই যে, ন্যাচারাল সিলেকশন এবং মিউটেশনের মধ্য দিয়ে মাইক্রোইভলুশন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দৃশ্যমান উদাহরণগুলো থেকে মাইক্রোইভলুশন ক্রমে ক্রমে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ম্যাক্রোইভলুশন করে- এই সিদ্ধান্তে আসা যাবে কি-না? চলুন, কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করি।
প্রথমেই জেনে নিই মাইক্রোইভলুশন এবং ম্যাক্রোইভলুশন কী? নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে আগেরটি ছোট ছোট পরিবর্তনকে বুঝায় এবং পরেরটি বড় পরিবর্তনকে বোঝায়। (সে হিসেবে আমরা এ প্রবন্ধে মাইক্রোইভলুশনকে ছোট-বিবর্তন এবং ম্যাক্রোইভলুশনকে বড়-বিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করব।)
এককোষী ও বহুকোষী জীবের সাপেক্ষে এ দু’টো প্রক্রিয়ার উদাহরণে পার্থক্য আছে। এককোষী জীব যেমন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তনের উদাহরণ হল: ব্যাকটেরিয়ায় ড্রাগ রেজিস্টেন্স তৈরী, এইচআইভি কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন-এর আগমন। অন্যদিকে, এককোষী জীবে বড়-বিবর্তনের উদাহরণ হবে, ফ্ল্যাজেলামবিহীন ব্যাকটেরিয়াতে ফ্ল্যাজেলার আগমন, কিংবা একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেকটি প্রজাতির (তথা ভিন্ন বাহ্যিক গঠনের) ব্যাকটেরিয়া তৈরী।
প্রসঙ্গত, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের তথা এককোষেী জীব ও বহুকোষী জীব যাদের যৌন প্রজনন হয় না তাদের ক্ষেত্রে ‘প্রজাতি’ চেনা হয় গাঠনিক আকার, আকৃতি, কোষপ্রাচীরের আনবিক উপাদানের সাদৃশ্য ও গ্লাইকোক্যালিক্স এবং ফ্ল্যাজেলামের উপস্থিতি (ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে) ইত্যাদি উপায়ে। বহুকোষী জীবের মধ্যে যাদের যৌন প্রজনন হয় তাদের ক্ষেত্রে ‘প্রজাতি’ চেনা হয় ‘যৌন প্রজনন’ করতে পারার যোগ্যতার ভিত্তিতে, অর্থাৎ উক্ত জীব সমগোত্রীয় যে জীবগুলোর সাথে যৌন প্রজনন করতে পারে তাদের নিয়ে তৈরী করে একটি ‘প্রজাতি’।
কিন্তু, বহুকোষী প্রাণীর ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তনের উদাহরণ হল: বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে ক্ষুদ্র পরিবর্তন। যেমন: গায়ের রং এবং ডিজাইন, পশমের পরিমাণ, চোখের মনির রঙ, উচ্চতা, মাংসপেশীর তারতম্য, কণ্ঠ ও সুরের ধরণ ইত্যাদি। অন্যদিকে, বহুকোষী প্রাণীর ক্ষেত্রে বড়-বিবর্তনের উদাহরণ হল: স্পঞ্জ-এর ক্ষেত্রে নিডোসাইট নামক কোষের আগমন, সরিসৃপে পাখার আগমন, মাছের পাখনা থেকে পা-এর আগমন ইত্যাদি।
মজার ব্যপার হল, এককোষী জীব, যেমন: ব্যাকেটিরিয়ার ক্ষেত্রে মাইক্রোইভলুশন প্রজাতির পরিবর্তন করছে না, বরং নতুন স্ট্রেইন তৈরী করছে। অন্যদিকে, যৌন প্রজননের ভিত্তিতে প্রজাতির সংজ্ঞার ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তন দিয়েই প্রজাতি বা উপপ্রজাতি তৈরী হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় বিবর্তনবাদীদের উপস্থাপিত প্রজাতি (তাদের মতে, আসলে হবে উপ-প্রজাতি) তৈরীর (যাকে স্পেশিয়েশন বলে) সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিয়ে। ক্যালিফোর্নিয়ার সালামান্দার সার্কেল দিয়ে প্রজাতির (উপ-প্রজাতি) উদ্ভব ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
ছবিসূত্র: http://rosarubicondior.blogspot.com/2012/01/ring-species-evolution-in-progress.html
উপরের ছবিটিতে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সালামান্দার প্রজাতি Ensatina eschschoitzi-এর ৭টি উপপ্রজাতি যুক্তরাস্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী স্যান জাওকিন ভ্যালির আশেপাশে বাস করে। উপ-প্রজাতিগুলোর মূল পার্থক্য তাদের গায়ের রঙ-এর নকশা (প্যাটার্ন) এবং সম্ভবত ফেরোমোন। সালামান্দারের গায়ের রং-এর নকশা পরিবর্তন হয় হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন-এর মাধ্যমে। সহজ কথায়, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরী হওয়ার এক পর্যায়ে এক জোড়া ক্রোমোজামের মধ্যে ক্রসিংওভার নামক একটি ঘটনা ঘটে। এ প্রক্রিয়ায় জিনোমের কিছু সুনির্দিষ্ট অংশের আদান প্রদান এবং পুনঃবিন্যাস হয়। মনে রাখা দরকার, এ প্রক্রিয়াটি কিছু বৈশিষ্ট্যে ভ্যারিয়েশন তৈরী করতে প্রাণীর কোষে নির্মিত সুনিয়ন্ত্রিত একটি প্রক্রিয়া। যদিও রিকম্বিনেশন হচ্ছে র্যাণ্ডমভাবে, কিন্তু তা হচ্ছে একটি নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যে।
বিবর্তনবাদীদের ইন্টারপ্রিটেশন অনুযায়ী, এভাবে সৃষ্ট ভ্যারিয়েশনের মাধ্যমে ভ্যালীর উত্তরে অবস্থিত Ensatina eschschoitzi picta উপ-প্রজাতিটি দক্ষিণ দিকে এসে এমন দুটো উপ-প্রজাতি Ensatina eschschoitzi klauberi এবং Ensatina eschschoitzi eschschoitzii–তে পরিণত হয়েছে, যারা পরস্পর যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না। সালামান্দার প্রজাতি যৌনক্রিয়ার জন্য বিপরীত লিঙ্গ বাছাই করতে সাধারণত ফেরোমোন নামক শরীর থেকে নিঃসৃত বিশেষ গন্ধ উৎপাদনকারী পদার্থ ব্যবহার করে। (এছাড়া, কোন কোন প্রজাতি স্পর্শ এবং কোন কোন প্রজাতি দৃষ্টি-সম্বন্ধীয় সূত্র তথা ভিজুয়্যাল কিউ ব্যবহার করে থাকে)। সে হিসেবে Eschschoitzi klauberi এবং Ensatina eschschoitzi eschschoitzii উপ-প্রজাতি দুটোতে ক্রসিং ওভারের মধ্য দিয়ে রং এবং ফেরোমোনের যথেষ্ট পার্থক্য হয়ে যাওয়ায় তারা প্রজাতির সংজ্ঞানুযায়ী আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। (আবার, এ-ও হতে পারে যে তাদের রিপ্রোডাকশন না করার কারণ আচরণগত।)
পাঠক, লক্ষ্য করে দেখুন, এখানে কার্যত ছোট-বিবর্তন সংঘটিত হল এবং ছোট বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি প্রজাতি (উপ-প্রজাতি) দুটো প্রজাতিতে (উপ-প্রজাতিতে) পরিণত হল। অন্যদিকে, এককোষী জীবে নতুন প্রজাতি আসতে হলে এর মূল গঠনের মধ্যে পরিবর্তন আসতে হবে।
বিবর্তনবাদীরা ছোট-বিবর্তনের উপরোক্ত উদাহরণগুলো থেকে বলতে চাচ্ছে যে, মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে এই ধরণের ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো একত্রিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন গঠনের বড়-বিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব? আমরা উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখলাম, এককোষী জীব এবং বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে প্রজাতির সংজ্ঞা ভিন্ন হওয়ায় বিষয়টি পৃথকভাবে বিবেচনা করতে হবে। (আলোচনার সুবিধার্তে ধরে নিচ্ছি বহুকোষী জীব মাত্রই যৌন প্রজনন করে এবং ভাইরাস এককোষী জীবের মত আচরণ করে)।
পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে পাঠকের জন্য একটি চিন্তার খোড়াক দেয়া যাক। ধরুন, আপনি সমুদ্রতীরে আছেন। তীরে হাটার সময় আপনি লক্ষ্য করলেন দূরে বালুর একটি স্তুপ তৈরী হয়েছে। আপনি স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা করবেন ওখানে কেউ একজন বালুর স্তুপ জমা করে রেখেছে অথবা হঠাৎ কোন ঘূর্ণায়মান বায়ুর প্রবাহ ওদিকে দিয়ে যাওয়ায় স্তুপ তৈরী হয়েছে। আপনি ইচ্ছে করলে ভাবতে পারতেন যে, সমুদ্রের ঢেউ ধীরে ধীরে বালু জমা করতে করতে স্তুপ তৈরী করেছে। কিন্তু আপনি তা ভাবলেন না। কেন? কারণ, আপনি দেখছেন সমুদ্রের ঢেউ অনেকটা জায়গা জুড়ে আসছে। অতএব, ঢেউয়ের কারণে বালুর বিন্যাস হলে তীরে ঘেষে অনেকখানি জায়গা জুরে হতো। অতঃপর, আপনি যখন বালুর স্তুপটির আরও কাছে গেলেন, আপনি দেখতে পেলেন ওখানে বালুর স্তুপ নয় বরং বালু দিয়ে ঘরের মত তৈরী করা হয়েছে। এ অবস্থায় আপনার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত হবে যে, এটি একজন দক্ষ মানুষ নির্মান করেছে, ঘুর্ণায়মান বায়ুর কারণে এটি তৈরী হয়নি। আপনাকে কেউ যদি জোড় করেও বলে যে কোটি কোটি বছরের ব্যবধানে আস্তে আস্তে এই ঘর তৈরী হয়েছে, তারপরও আপনি বিশ্বাস করবেন না। এমনকি, এর পক্ষে যদি পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানী এক হয়ে যায় তারপরও আপনি তার বিপরীতে একা থাকবেন। কারণ, বালুর ঘরটির বৈশিষ্ট্য হলো এটি অনিয়মিত (ইরেগুলার) আকৃতিসম্পন্ন এবং এই ইরেগুলারিটি এলোমেলো তথা র্যাণ্ডম নয়, সুনির্দিষ্ট ও সুশৃংখল। অর্থাৎ, সমুদ্রের ঢেউ এবং এ জাতীয় যে কোন জিনিস যা কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম বা সূত্র মেনে চলে সেগুলো ক্রমে ক্রমে একটি নিয়মিত গঠন (Order) তৈরী করতে পারে, কিন্তু অনিয়মিত সুশৃংখল গঠন (Organization) তৈরী করতে পারে না। আবার, র্যাণ্ডম প্রক্রিয়া হয়ত এলোমেলো জটিল গঠন (Complexity) তৈরী করতে পারে, কিন্তু অনিয়মিত সুশৃংখল ও জটিল গঠন (Organized Complexity) তৈরী করতে পারে না। যত সময়ই দেয়া হোক না কেন, সমুদ্র তীরে বালু জমে একা একা ঘর তৈরী হবে না। শীতলস্থানে পানি একা একা ঠাণ্ডা হয়ে বরফ হলেও কোটি বছরেও বরফের ভাস্কর্য তৈরী হবে না। ঠিক একই ভাবে, র্যাণ্ডম মিউটেশন ও ন্যাচারাল সিলেকশনের কাজ করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানলেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যত সময়ই অতিবাহিত হোক না কেন তা বড়-বিবর্তন ঘটাতে পারে না।
আমরা জানি, AIDS রোগের জন্য দায়ী HIV ভাইরাস এবং Flu রোগের জন্য দায়ী Influenza ভাইরাস এন্টিভাইরাল ঔষধ এবং মানুষের শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে পারে এ ধরণের স্ট্রেইন দ্রুত তৈরী করে। বিবর্তনবাদীরা এ ঘটনাকে বিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে প্রচার করেন। দুটি ভাইরাসের ক্ষেত্রেই মিউটেশনের মধ্য দিয়ে এ ধরণের পরিবর্তন আসে। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, মিউটেশন হয় মূলত জিনোমের এমন একটি জায়গায় যা সংশ্লিষ্ট অনুটির গাঠনিক অখণ্ডতাকে নষ্ট করে না। এ ধরণের জায়গাকে বলে ‘হাইপার ভ্যারিয়েবল’ রিজিওন। যেমন: ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বেলায় এ ধরণের মিউটেশন হয় হিমাগ্লুটিনিন নামক অণুর হাইপারভ্যারিয়েবল রিজিওনে। কিন্তু একই অণুর অন্যান্য রিজিওনে মিউটেশন হলে গাঠনিক অখণ্ডতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভাইরাস আক্রমন করতে পারে না, তথা অকার্যকর হয়ে পড়ে। Jewetz, Melnick ও Adelberg তাদের Medical Microbiology বইয়ে হিমাগ্লুটিনিন (HA)-এর গঠন সম্পর্কে বলছেন:
The HA molecule is folded into a complex structure. Each linked HA 1 and HA 2 dimer forms an elongated stalk capped by a large globule. The base of the stalk anchors it is the membrane. Five antigenic sites on the HA molecule exhibit extensive mutations. These sites occur at regions exposed on the surface of the structure, are apparently not essential to the moleule’s stability, and are involved in viral neutralization. Other regions of the HA molecule are conserved in all isolates, presumably because they are necessary for the molecules to retain its structure and function. [১]
অর্থাৎ, মিউটেশন যদি গঠনের এমন জায়গায় হয় যেখানে মিউটেশন হলে ভাইরাস তার ইনফেকটিভিটি তথা আক্রমণ করার ক্ষমতা না হারিয়েও টিকে থাকতে পারে তখনই কেবল ভাইরাস উক্ত মিউটেশনের মধ্য দিয়ে রেজিসটেন্ট স্ট্রেইন তৈরী করতে পারবে। অথচ, আমরা উপরে জেনেছি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে প্রজাতি সংজ্ঞায়িত হয় আকার, আকৃতি, গাঠনিক উপাদানের সাদৃশ্য দ্বারা। অর্থাৎ, ভাইরাসকে ভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত করতে হলে তাকে ত্রিমাত্রিক গঠন পরিবর্তন করতে হবে। অন্যদিকে, যে মিউটেশনগুলো গঠনকে পরিবর্তন করে দেয় সেগুলো ভাইরাসকে অকেজো করে ফেলে। ফলে, ভাইরাস ভিন্ন আকৃতি তৈরী করার জন্য বাঁচতে পারবে না।
এইডস ভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এইডস ভাইরাসের জিনোমে পাঁচটি হাইপারভ্যারিয়েবল রিজিওন আছে। এ কারণেই দেখা যায়- র্যাণ্ডম মিউটেশন সব জায়গায় টোলারেট করতে পারলে, ভাইরাসে রিপ্রোডাকশন রেট বেশী হওয়ায় এইডস ভাইরাস এতদিনে পরিবর্তন হয়ে অন্য ভাইরাস হয়ে যেত, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং এর গাঠনিক অখণ্ডতা রক্ষা করে উচ্চমাত্রার ভিন্নতা তৈরীর ক্ষমতা (স্ট্রাকচারাল প্লাস্টিসিটি) থাকায় একটার পর একটা ড্রাগ রেজিসটেন্ট স্ট্রেইন তৈরী করে যাচ্ছে।
উপরোক্ত ছবিতে দেখা যাচ্ছে এইচআইভি ভাইরাসের গ্লাইকোপ্রোটিন-১২০ প্রোটিনের পাঁচটি হাইভ্যারিয়েবল রিজিওন (V দিয়ে চিহ্নিত) এবং ৫টি অপরিবর্তনশীল তথা কনস্টেন্ট রিজিওন (C দিয়ে চিহ্নিত)। ছবিসূত্র: http://jvi.asm.org/content/78/7/3279.full
এই উদাহরণ দুটো থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, মিলিয়ন বছর সময় দিলেও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বা এইডস ভাইরাস অন্য ভাইরাসে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমাদের সিদ্ধান্তকে আরো পোক্ত করে এমন ভাইরাসের উদাহরণ যেগুলোকে বৈশ্বিকভাবে নিশ্চিহ্ন ঘোষণা করা হয়েছে। ৮-ই মে ১৯৮০ সালে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গ্যানাইজেশন স্মল পক্সকে নিশ্চিহ্ন ঘোষণা করেছে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হল? উত্তর: স্মল পক্সের জিনোমে হাইপারভ্যারিবেল রিজিওন নামে কোন স্থান ছিল না। ফলে স্মল পক্সের বিপরীতে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করে একে বিলুপ্ত করে দেয়া গেছে। বিবর্তন একে রক্ষা করতে পারেনি। ঠিক একইভাবে ইয়েলো ফিবার, পোলিও, মিজেলস ইত্যাদি ভাইরাসের বিপরীতে একবার ভ্যাক্সিনেশন করলে পুরো জীবন তা প্রোটেকশন দিতে পারে। কারণ, এই ভাইরাসগুলোর জিনোমেও এমন কোন রিজিওন নেই, যা গাঠনিক একাগ্রতা ঠিক রেখে ইনফেকভিটি মেইনেটেইন করতে পারবে।
ছবিসূত্র: http://textbookofbacteriology.net/resantimicrobial_3.html
ব্যাকেটেরিয়া বিভিন্নভাবে ড্রাগ রেজিসটেন্ট স্ট্রেইন তৈরী করতে পারে। সংক্ষেপে এগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: ১. ড্রাগটিকে কোষ থেকে বের করে দেয়া, ২. ড্রাগটিকে এনজাইমের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া এবং ৩. ড্রাগটি কোষের যে স্থানে (তথা টার্গেটে) বন্ধন তৈরীর মাধ্যমে কাজ করে সে স্থানটিতে আকৃতির পরিবর্তন সাধন করা। প্রথম দুটি পদ্ধতি সংঘটিত করার জন্য যে এনজাইমগুলো কাজ করে, সেগুলোর প্রয়োজনীয় জেনেটিক তথ্য থাকে প্লাজমিডে। লক্ষ্যণীয়, প্লাজমিড ব্যাকটেরিয়ার মূল জেনেটিক এলিমেন্ট থেকে পৃথক এবং ব্যাকটেরিয়া গঠনে কোন প্রভাব না ফেলে কাজ করতে পারে। তৃতীয় পদ্ধতিটি সংঘটিত হয় মিউটেশনের মাধ্যমে। যদি মিউটেশনের ফলে টার্গেট এনজাইমে এমন ধরণের পরিবর্তন আসে যা এনজাইমের মূল কাজকে অক্ষত রেখে ওষুধের সুনির্দিষ্ট আনবিক লক্ষ্যস্থলে সামান্য পরিবর্তন আনে তাহলে ওষুধটি আর কাজ করতে পারে না। কিন্তু, মিউটেশন যদি মূল এনজাইমের গঠন ও কর্মক্ষমতাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয় তাহলে ব্যাকটেরিয়াটি ধ্বংস হবে এবং ড্রাগ রেজিস্টেন্ট স্ট্রেইন তৈরী হবে না। ব্যাকটেরিয়াতে যেকোন এনজাইমের ফাংশন মূলত ‘অপটিমাম’ হয়। অর্থাৎ, এনজাইমটি খুব বেশী কাজও করে না আবার একেবারেই কম কাজও করে না। মিউটেশনের মাধ্যমে যে এনজাইমটি তৈরী হচ্ছে তা মূল এনজাইমটির মত কাজে দক্ষ হয় না। ফলে, ব্যাকটেরিয়ার ড্রাগ রেজিস্টেন্স স্ট্রেইন ওয়াইল্ড টাইপ স্ট্রেইন থেকে দুর্বল তথা কম ফিটনেস ফাংশন যুক্ত হয়।
প্রথম দুটো প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া যে রেজিসটেন্ট জিন ব্যবহার করছে তা মূলত এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ছিল। ব্যাকটেরিয়ার একটি বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। এ প্রক্রিয়ায় একটি ব্যাকটেরিয়া অন্য ব্যাকটেরিয়া থেকে জিনোম সংগ্রহ করতে পারে। এভাবেই মূলত উপরোক্ত দু’ধরণের রেজিসটেন্ট জিন এক ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেক ব্যাকটেরিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু উক্ত জিনগুলো কীভাবে উদ্ভব হল, তা এই প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারে না। অন্যদিকে, তৃতীয় প্রক্রিয়াটিকে প্রকৃত নিও-ডারউইনিয়ান প্রক্রিয়া বলা যায়। কারণ, মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যে স্ট্রেইন তৈরী হচ্ছে, ওষুধ-যুক্ত পরিবেশে তা প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিবর্তনের এই উদাহরণ থেকে কি ব্যাকটেরিয়ার আকার, আকৃতি ও আনবিক গঠনে কোন পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়? উত্তর: না। কারণ, গাঠনিক আকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেলে ব্যাকটেরিয়া তার গাঠনিক একাগ্রতা হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর রিপ্রোডাকশন যদি না করতে পারে সে পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তিত গঠন প্রবাহ করবে কীভাবে? নতুন প্রজাতি-ই বা গঠন করবে কীভাবে?
অর্থাৎ, ছোট-বিবর্তনের এই উদাহরণ থেকে বড়-বিবর্তনকে ইনফার করা যাচ্ছে না। তদুপরি, আমরা যদি ব্যাকটেরিয়া ফ্ল্যাজেলামের কথা চিন্তা করি, ফ্ল্যাজেলামে প্রায় চল্লিশটি ভিন্ন ধরণের প্রোটিন থাকে, তাহলে উপরোক্ত চল্লিশটি প্রোটিনের জিন সুনির্দিষ্টভাবে জিনোমে বিন্যস্ত হতে হবে। এই পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়াশীল প্রোটিনযুক্ত গঠনটির একটি প্রোটিনের অবর্তমানে সে তার কাজ সঠিকভাবে করতে পারবে না। অর্থাৎ ফ্ল্যাজেলামকে কাজ করতে হলে পুরোপুরি একসাথে আসতে হবে। কিন্তু, উপরের মিউটেশনের উদাহরণ থেকে আমরা দেখেছি, মিউটেশন শুধু ইতোমধ্যে বিদ্যমান জেনেটিক তথ্যকে কিছুটা ওলটপালট করতে পারে। কিন্তু, নতুন জেনেটিক তথ্য যোগ করতে পারে না।
এছাড়াও, ব্যাকটেরিয়া যেহেতু খুব দ্রুত রিপ্রোডাকশন করতে পারে, সেহেতু ব্যাকটেরিয়াতে মিউটেশনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনগুলোও দ্রুত হবে। যদি প্রতি এক ঘন্টায় একটি রিপ্রোডাকশন হয়েছে ধরা হয়, এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লক্ষ ব্যাকটেরিয়ার জেনারেশন তৈরী হয়েছে। মানুষের রিপ্রোডাকটিভ স্কেলে যা প্রায় ১০ মিলিয়ন বছরের ইকুইভ্যালেন্ট। অথচ, এই দীর্ঘ সময়ে ব্যাকটেরিয়াগুলোর প্রজাতি পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ, নতুন প্রজাতি আসেনি। [২] রিচার্ড লেনস্কি ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ ইভলুশন এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন। ১৯৮৮ সাল থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত ৫০০০০ জেনারেশন পার হয়েছে। ই. কোলাই-এর বিভিন্ন স্ট্রেইন তৈরী হয়েছে কিন্তু ই. কোলাই প্রজাতি পরিবর্তিত হয়ে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হয়নি। [৩]
ছবিসূত্র: http://geneed.nlm.nih.gov/topic_subtopic.php?tid=142&sid=149
বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে আমরা উপরে দেখেছি যে, প্রজাতির সংজ্ঞা গঠনের উপর নির্ভর করে না। ফলে, ছোট পরিবর্তনও প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারে। একই সাথে আমরা এও দেখেছি যে, প্রজাতির জিনোমে যে ভ্যারিয়েশনগুলো হয়, তা ইতোমধ্যে বিদ্যমান তথ্যের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে জেনেটিক রিকম্বিনেশনের মধ্য দিয়ে। এছাড়াও মিউটেশনের মধ্য দিয়ে ভ্যারিয়েশন তৈরী হতে পারে। তবে সেটি হয় কোন একটি বৈশিষ্ট্য নষ্ট হওয়ার মাধ্যমে। যেমন: একটি নির্দিষ্ট অ্যামাইনো এসিড পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের সাধারণ হিমোগ্লোবিন পরিবর্তন হয়ে হিমোগ্লোবিন এস তৈরী হয়। হিমোগ্লোবিন এস-এর বৈশিষ্ট্য হল এটি সুনির্দিষ্ট ট্রিগার পেলে কাঁচির মত আকৃতি ধারণ করে পাতিত হয় এবং সাথে উক্ত হিমোগ্লোবিনযুক্ত লোহিত রক্ত কণিকাগুলোর আকৃতিও কাঁচির মত হয়ে যায়। ফলে লোহিত রক্ত কণিকাগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। মানবদেহের স্প্লিনের কাজ হল অকেজো রক্ত কণিকাকে গ্রহণ করে নষ্ট করে ফেলা। অন্যদিকে, ম্যালেরিয়া জীবাণু তার জীবনচক্রের একটি পর্যায় অতিক্রম করে লোহিত রক্ত কণিকায়। এমতাবস্থায় লোহিত রক্তকণিকাগুলো মারা যাওয়া অর্থ হলো ম্যালেরিয়ার জীবাণু মারা যাওয়া। এভাবে, যে সকল সিকল সেল এনেমিয়া ট্রেইটের রুগীদের জিনোমে হিমোগ্লোবিন এস-এর একটি অ্যালিলি থাকে তারা ম্যালেরিয়ার জীবাণুর বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রাকৃতিক রেজিসটেন্স তৈরী করে এবং সাধারণ মানুষদের তুলনায় বেশী বেঁচে থাকে এবং রিপ্রোডাকশন করতে পারে। কিন্তু, স্পষ্টতই সিকল সেল এনেমিয়া পরিবর্তিত পরিবেশে রুগীদের সামান্য উপকার করতে পারলেও, সাধারণ মানুষদের তুলনায় এরা প্রকৃতপক্ষে কম যোগ্য (ফিট)।
ছবিসূত্র: http://www.cddep.org/sites/cddep.org/files/malaria-life-cycle.jpg
তবে বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে বড়-বিবর্তন হতে হলে ব্যাখ্যা করতে হবে সম্পূর্ণ নতুন একটি বৈশিষ্ট্যের আগমন। যেমন: পাখির ডানা। পাখির ডানা আসতে গেলে আসতে হবে পাখির ডানার সুনির্দিষ্ট গঠন, যেমন: পালক; ডানার সাথে সংশ্লিষ্ট মাংসপেশী, রক্তসংবাহী নালী, নার্ভের জাল ও তার সাথে মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন এবং পাখার গতি ও দিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যালগরিদম। স্বাভাবিকভাবেই, এগুলো আসার অর্থ হল জিনোমে সুনির্দিষ্ট ও সুশংখলভাবে নতুন জেনেটিক তথ্য আসা। সুতরাং, বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তনের যে উদাহরণ আনা হচ্ছে, যত সময়ই অতিবাহিত হোক না কেন তা উপরোক্ত সুনির্দিষ্ট জেনেটিক তথ্যের সমাগম ব্যাখ্যা করতে পারে না। অর্থাৎ এই ধরণের ছোট-বিবর্তন কোটি বছর ধরে হলেও বড়-বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম।
পাঠক, আমরা উপরের দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে কয়েকটি জিনিস বুঝতে পারলাম। এক, প্রজাতির সংজ্ঞা এককোষী জীব এবং বহুকোষী জীব যা যৌন প্রজনন করে তা-র ক্ষেত্রে ভিন্ন। দুই, ছোট-বিবর্তন এককোষী জীবে প্রজাতি তৈরী করে না বরং একই প্রজাতির বিভিন্ন স্ট্রেইন তৈরী করে, অন্যদিকে বহুকোষী জীবে উপ-প্রজাতি তৈরী করে। সে হিসেবে একজন বিবর্তনবাদী যদি বলে বিবর্তন প্রজাতি তৈরী করছে তাহলে তার বক্তব্য মিথ্যা হবে না, তবে অস্পষ্ট হবে। তিন, ছোট-বিবর্তন প্রকৃতপক্ষে বড়-বিবর্তনের পক্ষে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করে না। ছোট-বিবর্তন শারীরিক গঠনের উপাদানে না হলে বড় পরিবর্তন আসার মাধ্যমে নতুন প্রজাতি আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু, ছোট-বিবর্তন শারীরিক উপাদানে হলে প্রজাতির মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বা কম-কর্মক্ষম প্রজাতি তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। অথচ, প্রাকৃতিক নির্বাচন শুধু অধিকতর যোগ্য প্রজাতিকে নির্বাচিত করে। সে হিসেবে কম-কর্মক্ষম প্রজাতি প্রতিকূল পরিবেশে আপাত সুবিধে দিলেও পুরো পপুলেশনের সাপেক্ষে কোন উত্তম ভ্যারিয়েশন প্রবাহ করতে পারছে না। এ কারণে, কোটি কোটি বছর পার হলেও এগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আগমন ঘটাতে সক্ষম নয়।
সর্বশেষ কথা হল, বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা ছোট-বিবর্তনের উদাহরণ এনে ‘কোটি বছরের’ ধোঁয়াটে আবেদন দিয়ে বড়-বিবর্তনকে সত্য ধরে নিচ্ছেন এবং প্রচার করছেন। কিন্তু আদৌ এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ আছে কি না সেই বিশ্লেষণে গেলে তারা ব্যাখ্যাকে স্পষ্ট করছেন না। বরং, বিবর্তনবাদকে সত্য ধরে নিয়ে করা রিসার্চ দেখিয়ে তারা তত্ত্বটিকে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এর পেছনের উদ্দেশ্যটি কি বৈজ্ঞানিক? না-কি আদর্শিক?
রেফারেন্স:
[১] Jewetz, Melnick, Adelberg; Medical Microbiology, 23rd edition, Chapter 39, Orthomyxoviruses; Page 540 [Emphasis Added]
Leave a Reply