#বিবর্তনকথন_৫: নাল হাইপোথিসিস, অল্টারনেট হাইপোথিসিস ও ডারউইনিয় বিজ্ঞান

বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি তথা রিসার্চ মেথডলজির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হল- আপনি যখন নতুন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে চান আপনাকে একটি ‘গবেষণা প্রশ্ন’ তথা রিসার্চ কোয়েশ্চেন দাড় করাতে হবে। এরপর উক্ত প্রশ্নের আলোকে আপনি একটি ‘প্রকল্প’ তথা ‘হাইপোথিসিস’ তৈরী করবেন। কিন্তু, রিসার্চ শুরু করার আগেই আপনি উক্ত প্রকল্পকে সত্য ধরে নিয়ে এগুবেন না। বরং, আপনার ডিফল্ট হাইপোথিসিস হবে ‘নাল হাইপোথিসিস’ এবং  আপনার হাইপোথিসিসকে বলবেন- ‘বিকল্প তথা অল্টারনেট হাইপোথিসিস’। অত:পর, আপনার অনুসন্ধান লব্ধ উপাত্তের পরিসংখ্যান থেকে যদি দেখেন যে যে ‘নাল হাইপোথিসিস’-কে বাতিল করা যায় ‘অল্টারনেট হাইপোথিসিস’ গ্রহণ করবেন।

কি? জার্গন বেশী হয়ে গেল? চলুন কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি।

ধরুন, আপনি গবেষণা করে দেখতে চান যে ধুমপানের সাথে ফুসফুস ক্যান্সারের কোন সম্পর্ক আছে কি না? কারণ, আপনি লক্ষ্য করেছেন যে ধুমপায়ী ও অধুমপায়ী নির্বিশেষে সবারই ফুসফুসের ক্যান্সার হচ্ছে। এজন্য আপনি একটি রিসার্চ কোয়েশ্চেন দাড় করালেন- ধুমপান কি ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী? এই প্রশ্নের আলোকে আপনার হাইপোথিসিস হল-

(ক)  ধুমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

এই হাইপোথিসিসকে পরীক্ষা করতে আপনাকে ধরে নিতে হবে যে-

(খ) ধুমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী নয়।

বিজ্ঞানের পরিভাষায় (খ) হল নাল হাইপোথিসিস এবং (ক) হল অল্টারনেট হাইপোথিসিস।  এবার আপনি একদল ক্যান্সোরের রোগী  এবং সমবয়সী ও সমলিঙ্গের আরেকদল সাধারণ মানুষ নিয়ে তাদের মধ্যে ধুমপানের অনুপাত পরীক্ষা করবেন এবং পরিসংখ্যানের অংক কষে দেখবেন যে নাল হাইপোথিসিস  (খ)-কে বাতিল করা যায় কিনা। যদি করা যায়, তাহলে আপনার অল্টারনেট হাইপোথিসিস (ক) গৃহিত হবে। অর্থাৎ, আপনি উপসংহার টানতে পারবেন যে ধুমপানের সাথে ফুসফুসের ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে কি নেই।

(এই নাল হাইপোথিসিস বাতিল করার পদ্ধতিটিতে সম্ভাব্যতার ব্যবহার আছে,যার সাথে আবার বিবর্তনবাদ ও এবায়োজেনেসিসের সম্পর্ক আছে- যে বিষয় অন্য সময় লিখব ইন শা আল্লাহ)  

কিন্তু, প্রশ্ন হল আমি গবেষণায় ‘অল্টারনেট হাইপোথিসিস’ ধরে নিলে সমস্যা কি?

উত্তর: সমস্যা আছে। সমস্যা হল এটি গবেষণাকে বায়াসড করে দিবে।

কিভাবে?

কিভাবে ‘বায়াস’ করে তার উত্তর জানতে চলুন আমরা একটি মসজিদ থেকে ঘুরে আসি। মনে করুন আপনি ‘গ’ মসজিদে গিয়ে ওযু খানায় ভুল করে মানিব্যাগ ফেলে এসেছেন। একজন সহৃদয় ব্যক্তি আপনার মানিব্যাগটি পেয়ে মসজিদের ইমামকে দিয়েছেন। জামাত শেষ হলে ইমাম মাইকে ঘোষণা দিলেন যে ওযুখানায় একটি মানিব্যাগ পাওয়া গিয়েছে, যারা মানিব্যাগ সে যেন উপযুক্ত প্রমান দিয়ে নিয়ে যায়। নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে আপনি দেখলেন যে তার কাছে আপনি ছাড়াও আর একজন পরিপাটি ও সুদর্শন ব্যক্তি ‘ঘ’ মানিব্যাগটির দাবী করছে। এমতবস্থায় ইমামের ‘হাইপোথিসিস’ কি হবে? ইমাম যদি ‘ঘ’ সাহবের বেশভূষা থেকে ধরে নেন যে মানিব্যাগটা ‘ঘ’ সাহেবের, তাহলে উনি বায়াসড হয়ে গেলেন। ঠিক একই ভাবে যদি তিনি ধরে নেন মানিব্যাগটি আপনার তাহলেও উনি বায়াসড হয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় তিনি মনে মনে ধরে নেবেন যে মানিব্যাগটি ‘গ’ বা ‘ঘ’ কাররই নয়, অর্থাৎ ‘নাল হাইপোথিসিস’। কিন্তু, তার মনে দুটি অল্টারনেট হাইপোথিসিস থাকবে- এক,  মানিব্যাগটি ‘গ’-এর এবং দুই, মানিব্যাগটি ‘ঘ’-এর।   এরপর যে ব্যক্তি মানিব্যগটির বৈশিষ্ট্যগুলোর সর্বচ্চো সঠিক বর্ণনা দিতে পারবেন, (যেমন: ওযু খানায় কোন দিকটাতে বসেছিলেন, মানিব্যাগের রং কি, কয়টি পকেট আছে, কি কি জিনিস ছিল, কত টাকা ছিল ইত্যাদি)  তাকে তিনি মানিব্যাগটি ফেরত দিবেন।

চলুন আরেকটি উদাহরণ দেখে আসি কোর্ট থেকে। একজন ‘ব্যক্তিকে’ চুরির অপরাধে বিচার করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় জাজ যদি উক্ত ব্যক্তিই চোর ধরে নেন তাহলে সম্ভাবনা থাকে যে তিনি একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়ে দিবেন। কিন্তু, তিনি যদি ধরে নেন যে উক্ত ব্যক্তি চোর নয় (নাল হাইপোথিসিস) একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে। জাজ যদি উপযুক্ত তথ্য-প্রমানের আলোকে দেখেন যে এই ব্যক্তি চোর না হয়ে পারে না, তাহলে তিনি নাল হাইপোথিসিস বাতিল করে সিদ্ধান্ত নিবেন যে উক্ত ব্যক্তি চোর (অল্টারনেট হাইপোথিসিস) এবং শাস্তি দিবেন।

আশা করি, উপরোক্ত উদাহরণগুলো থেকে পাঠক ‘নাল হাইপোথিসিস’ ও ‘অল্টারনেট হাইপোথিসস’ এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন।

একটি কার্যকারণের পিছনে যদি একাধিক অল্টারনেট হাইপোথিসিস থাকে। তখন আমি কোন্ অল্টারনেট হাইপোথিসসটি গ্রহণ করবো তা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট হাইপোথিসিসটির পক্ষে উপস্থাপিত প্রমানের সংখ্যা ও কোয়ালিটির উপর।

একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পিছনে প্রমাণ প্রধানত  দুই ধরনের হয়- এক্সপেরিমেন্টাল ও অবজারভেশনাল। একটি করে উদাহরণ দিয়ে বোঝাই।

বিজ্ঞানী রিচার্ড লেনস্কি ও তার দল ব্যাকটেরিয়াতে বিবর্তনের প্রমাণ দেখার জন্য একটি ‘লং টার্ম ইভল্যুশন এক্সপেরিমেন্ট’ চালাচ্ছেন।

এবার চলুন আমরা দেখি বিজ্ঞানী ডারউইন কিভাবে তার বই-এ ‘বিবর্তনবাদ’-কে প্রজাতির আবির্ভাবে প্রমানিত তথা ডিফল্ট হাইপোথিসিস হিসেবে উপস্থাপন করছেন।          ডারউইন তার বই-এর প্রথমে আর্টিফিসিয়াল সিলেকশন, জিওগ্রাফীক ডিস্ট্রিবিউশন, হোমোলজি এবং ভেস্টিজিয়াল অর্গান নামক কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রজাতির উৎপত্তি ব্যাখ্যাতে তার হাইপোথিসিস ‘বিবর্তনবাদ’-কে প্রমানিত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *