এক.
প্রচণ্ড মন খারাপ লাগছে শৈবালের। মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। মেডিকেল থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই ওর বাবা মারা যায়। ফলে স্কুল পড়ুয়া ছোট দুই বোন এবং মা-সহ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ওর ওপর। একটা পার্টটাইম জব করে এবং দুটো টিউশনি করে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া এবং সংসারের খরচ বহন করার চেষ্টা করে। তারপরও মাস শেষে হাতে টাকা থাকে না অনেক সময়। তাই মাঝে ইচ্ছে না থাকলেও ঋণ নিতে হয়ে।
এ জমানায় কেউ টাকা ধার দিতে চায় না। আর ধার দিবেই বা কি করে? ও যাদেরকে চেনে তাদের সবারই খুব হিসেব করে চলতে হয়। তবে যারা বেহিসেবী খরচ করে তারা ধার দেয় সুদে।
গতকাল রাতে একজন পাওনাদারের সাথে কথা ফোনে কাটাকাটি হয়েছে শৈবালের। লোকটা টাকা ফেরৎ দেয়ার সময় হবার আগেই টাকা চেয়ে বসেছে। এদিকে মাসের শেষ সময় চলছে। ও কোথা থেকে টাকা দেবে? এইসব ভেবে রাতের ঘুমটা ভাল হয়নি। তাই সকাল থেকেই মেজাজটা খিটখিটে হয়ে আছে শৈবালের। কেমন যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। পৃথিবীর সবকিছুকেই অসহ্য মনে হচ্ছে ওর। প্রতিদিনের রূটিন মত আজকেও সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছে । কিন্তু, ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে নাস্তা রেডী হয়নি। মা’র সাথে রাগ করে বাসা থেকে না খেয়েই বের হয়ে যায়।
‘ওই খালি, যাবা?’
‘কই মামা?’
‘ঢাকা মেডিকেল।’
‘যামু।’
‘ভাড়া কত?’
‘পঞ্চাশ টাকা?’
‘পঞ্চাশ টাকা মানে? মগের মুলুক পাইছো? আজিমপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল পঞ্চাশ টাকা?’
‘মামা, যে জ্যাম দেখছেন? পঞ্চাশ টাকা না গেলে পুশাইবো না।’
শৈবালের মেজাজ আরও গরম হয়ে যায়। ও রিকশায় না উঠে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটার সময় এলোমেলো ভাবনা আসতে থাকে মনে। ভাবে- কেন এত গরীব হলাম? বাবার এ সময়েই মৃত্যু হল কেন? আল্লাহ কেন আমাদের এত কষ্ট দিলেন? ওর সম্পদশালী বন্ধুদের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে পলাশীর দিকে আসার সময় ওর চোখের সামনে হঠাৎ একটা মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সিডেন্ট করে। মোটর সাইকেলটা সামনের একটি রিকশায় জোড়ে ধাক্কা দেয়। ফলে রিকশাটা উল্টে যায়। রিকশাচালক এবং যাত্রীরা দূরে ছিটকে পড়ে। মোটর সাইকেল আরহী প্রচণ্ড বেগে সামনে গিয়ে আছড়ে পড়ে। সাথে সাথে তাদের সাহায্য করার জন্য মানুষজন জটলা পাঁকাতে শুরু করে । শৈবাল দ্রুত কাছে দৌড়ে যায়।
রিকশাচালক এবং যাত্রী অপেক্ষাকৃত কম আঘাত পেয়েছে। তারা উঠে দাড়িয়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। ঐদিকে মোটর সাইকেল আরোহীর নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। শৈবাল সাথে সাথেই পালসটা চেক করার জন্য সামনে আগায়। দেখে পালস এখনও চলমান। সে আরেকজন ব্যক্তির সহায়তায় লোকটাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মেডিকেলে ভর্তি করার পর লোকটার আত্মীয়সজনের নাম্বার যোগার করে তাদের খবর পাঠানো হয়। তারা হাসপাতালে আসলে শৈবাল ওর ওয়ার্ডে ক্লাস করার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। শৈবালের যে ওয়ার্ডে ক্লাস আছে সেখানে যাবার পথে পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যেতে হয়। ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওর চোখে পড়ে একজন মা পরম যত্নে তার শিশুকে আগলে রেখেছে। শিশুটির খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। তাকে অক্সিজেন দেয়া আছে এবং বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। শিশুটিকে মা তার কোলে নিয়ে বুকের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসিয়ে রেখেছে। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে রাজ্যের ঘুম এসে যাচ্ছে তার চোখে। কিন্তু বাচ্চাকে খেয়াল রাখতে গিয়ে সে ঘুমাতে পারছে না।
হঠাৎ করে ওর মা’র কথা মনে পড়ে। আজকে সকালে রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলো ও। অনুশোচনায় চোখে পানি চলে আসে ওর। ভাবতে থাকে আজকের দূর্ঘটনার শিকাড় ওই হতে পারতো। কিন্তু, আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ভাবতে ভাবতেই দেখে নিউরোসার্জারী বিভাগে তরুণ একটি ছেলে অসুস্থ হয়ে এলোমেলো বকছে। তাকে ঘিরে ডিউটি ডাক্তাররা রাউণ্ডে আলোচনা করছে। ও শুনতে পেলো ছেলেটার সাবঅ্যারাকনয়েড হিমোরেজ হয়েছে। রোগটা কি শৈবাল জানে। কারও কারও মাথার রক্তনালীতে এক ধরনের অস্বাভাবিক বর্ধিকাংশ থাকতে পারে। যাকে বলা হয় এনিউরিজম। অনেক সময় এগুলো ফেটে ব্রেইনের ভিতরে রক্ত জমা হয়। তরুণ বয়সেও এই রোগ হতে পারে।
শৈবাল উপলব্ধি করে এই রোগটি ওরও হতে পারতো। শুধু তাই না। এই যে অগনিত কঠিন রোগ সম্পর্কে ও পড়ছে এগুলোর যে কোনটি ওর হতে পারতো। শৈবাল বুঝতে পারে যে আসলে সে ভালো আছে। অন্য অনেকের চেয়ে ভালো আছে সে। মনটা ভালো হয়ে যায়। মনের গভীর থেকে প্রশান্ত চিত্তে বলে ওঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’!
দুই,
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আস্তে করে মায়ের রুমে যায় শৈবাল। সালাম দিয়ে ঢোকার অনুমতি নেয়। ছলছল চোখের মায়ের মুখের দিকে তাকায় একবার । চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারে না। মা’র পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিছু বলতে পারে না।
মা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘কেঁদো না বাবা। ধৈর্য্য ধরো। আল্লাহ সব সহজ করে দিবেন।’