বর্তমানে ফলের দোকানগুলোতে সারা বছর জুড়েই প্রায় সব ফল পাওয়া যায়। অথচ, ১৫-২০ বছর আগেও বিষয়টি এরকম ছিলো না। আমাদের ছোটবেলায়, যখন রেফ্রিজারেটর এত সহজলোভ্য ছিল না, মৌসুমের ফল মৌসুমেই খেতে হত। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন অনেক ফলই সংরক্ষণ করা যায়। আবার, বিজ্ঞানীগণ সংকরায়ণ ও জেনেটিক টেকনোলজি ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম ফলের জাত তৈরী করছেন যা আকারে ও স্বাদের ভিন্ন। কি চমৎকার তাই না?
প্রতিটি ফলের মূলত দুটি অংশ থাকে। বীজ ও ফলত্বক। ফলের খোসা হল বহিঃত্বক। যে অংশটি আমরা খাই সে হল মধ্যত্বক। বীজের সাথে লেপ্টে থাকে অন্তঃত্বক। প্রজাতি ভেদে ফলের বিভিন্ন অংশে থাকে বিভিন্ন আকর্ষণীয় রঙ। ফলের বীজ অন্যান্য অংশ থেকে কোন শক্তি গ্রহন করে না। তাহলে, ফলের মধ্যত্বকে নানা ধরনের সুমিষ্ট খাদ্যদ্রব্য থাকার রহস্য কি?
এর উত্তর আমরা সবাই হয়ত জানি। অন্যান্য প্রাণী যখন উদ্ভিদের এই ফলগুলো খেয়ে শক্তি ও ভিটামিন আহরণ করে, তখন সে জেনে না-জেনে বীজ ছড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে হয় নতুন গাছ। এভাবে উদ্ভিদ তার জেনেটিক ক্রমধারা বিশ্ব চরাচরে বজায় রাখে। কিন্তু, দাড়ান! উদ্ভিদ কিভাবে জানল বীজের চারপাশের সুমিষ্ট মধ্যত্বক তৈরী করে প্রাণীজগতের প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দিতে হবে? কিভাবে সে বুঝল যে চলাফেরা করতে পারে এমন জীব তার বীজকে জমিনে ছড়িয়ে দিতে পারবে?
ফলের মধ্যে বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের যে সন্নিবেশ থাকে তা অতুলনীয়। এটি একদিকে শক্তি সরবরাহ করে, অন্যদিকে পুষ্টির যোগান দিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলের মধ্যে থাকে নানার রকম এন্টাই অক্সিডেন্ট, ফাইটোইস্ট্রোজেন এবং এন্টাই ইনফ্লামেটরী অণু। তাই ডায়েটারী গাইডলাইনগুলো সম্ভব হলে প্লেটের অর্ধেক ফল বা সবজি দিয়ে ভরতে বলেন (1)। গাছগুলো কিভাবে এই কম্পোজিশন ঠিক করল? খুবই অসামান্য এই প্রশ্নটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণের ব্যস্ততায় হারিয়ে যায়।
ফলের রঙ নিয়েই একবার ভেবে দেখুন না। আমরা জানি, আলো কোন তলে পড়লে উক্ত তলে শোষিত হবার পর যে অংশ প্রতিফলিত হয় তা তলের রঙ হিসেবে দেখা দেয়। সুতরাং, ফলের ত্বকে বিন্যস্ত অনুগুলোকেও এমন হতে হবে যেন তা নিদির্ষ্ট মাত্রার আলোকে প্রতিফলিত করে উপযুক্ত হিউ, টেক্সচার, এবং শার্পনেস তৈরী করতে পারে। একবার কি চিন্তা করেছেন কিভাবে ফুল ও ফলের রঙ এত নিখুঁত মিশ্রন তৈরী করে?
অন্যদিকে ফলের বীজটি হয় এমন যে খোলসে আবৃত অবস্থায় অধিকাংশ প্রানীর খাদ্যনালী তা হজম করতে পারে না। গাছগুলো কি বীজ তৈরীর আগে প্রাণীদেহের ফিজিওলজি নিয়ে রিসার্চ করে নিয়েছে?
ফলবান উদ্ভিদ কি নিজে তার জেনেটিক প্রোগ্রামে উক্ত পরিকল্পনা তৈরী করেছে? কার পরিকল্পনায় ফলের মাধ্যমে এই পারস্পরিক উপকারের আয়োজন? কার ইচ্ছেয় উদ্ভিদ ও প্রানীর এই চমৎকার বাস্তুতন্ত্র (ইকোসিস্টেম)?
“অতএব মানুষ একবার লক্ষ্য করুক তার খাদ্যের দিকে। আমরা (কিভাবে তাদের জন্য) বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকি। অতঃপর ভূমিকে ভালভাবে বিদীর্ণ করি। অতঃপর তাতে উৎপন্ন করি খাদ্য-শস্য। আঙ্গুর ও শাক-সবজি, যায়তূন ও খর্জুর, ঘন পল্লবিত উদ্যানরাজি এবং ফল-মূল ও ঘাস-পাতা”। (সুরা আবাসা, আয়াত ২৪ – ৩১)
ভোরের আকাশে আলোর আভা দেখা দেয়ার পূর্বমূহুর্তে শুরু হয়ে যায় পাখিদের কলকাকলী। কি সুমধুর সেই কণ্ঠ! যুগে যুগে পাখির ডাক মোহিত করেছে কত না কবিদের। জন্ম দিয়েছে কত শত কবিতার! পাখির অপরুপ গঠন এবং শরীরে রঙের মোহনীয় বিন্যাস অনেক শিল্পীর চিত্রকল্পে ঠাই করে নিয়েছে। আবার, পাখি সংক্রান্ত বিজ্ঞান জন্ম দিয়ে একটি স্বতন্ত্র শাখার।
আমরা অধিকাংশ মানুষ হয় পাখিদের বৈজ্ঞানিক গঠন নিয়ে আগ্রহী নই। ওটা বিজ্ঞানীদের কাজ। কিন্তু, জানালের পাশে বসে অপূর্ব সুরে ডাকতে থাকা পাখি নিয়ে কখনও ভাবনার গভীরে হারিয়ে যাই নি এমন মানুষ হয়তো নেই। হয়ত পড়ন্ত বিকেলে কমলাভ-লাল আকাশে নীড়ে ফিরতে থাকা পাখিদের দেখে শিহরিত হয়েছি। ডানা মেলে নির্দ্বিধায় ভেসে বেড়ানো পাখিগুলোকে দেখে হয়েছি ইর্ষান্বিত।
কিন্তু, কখনও কি ভেবে দেখেছি কিভাবে পাখিগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়? কেন তারা তাদের শরীরের ভারে পড়ে যায় না? কেন এক লাফে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে যেতে পারে অনিমেষে?
বিজ্ঞানীরা আমাদের জন্য কিছু উত্তর বের করে এনছেন। তারা দেখেছেন যে সকল পাখি উড়তে পারে তাদের হাড়গুলো অন্য প্রাণীদের তুলনায় ফাঁপা। ফলে পাখির শরীর হালকা হয়।
অন্যদিকে পাখির ডানার গঠণও উড্ডয়নের জন্য যথাযথ। আপনি কখনও কবুতর বা ময়ুরের পালকের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালে দেখবেন প্রতিটি পালকে একটি লম্বা কাঠির মত অংশ (শ্যাফট) থেকে নারকেল গাছের পাতার মত ছোট ছোট লম্বা অনেকগুলো অংশ (বার্ব) বেড়িয়ে গেছে। বার্বগুলো পরস্পর সমান্তরালে থাকে। প্রতিটি বার্ব থেকে সমকোণে আরও ক্ষুদ্র কাঠির মত বার্বিউল বের হয়ে আসে যার মধ্যে আবার কাঁটার মত হুক থাকে। একেকটি বার্বকে বার্বিউল সহ দেখতে চিরুনীর মত লাগে। আপনি যদি দুটি চিরুনীর দাতগুলো একটিকে আরেকটির ভেতর প্রবেশ করান, কি হবে বলুন তো? এরা পরস্পর সংলগ্নভাবে আটকে যাবে। পাখির বার্বগুলোও এভাবে একটির সাথে আরেকটি আটকে থাকে। ফলে তাতে বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। কি অসাধারণ তাই না?
পাখির মসৃণ গঠনও পাখির ওড়ার জন্য সাহায্য করে। এমনকি শক্ত জোয়ালের পরিবর্তে চঞ্চুর উপস্থিতি ওড়ার জন্য উপকারী। পাখির বুকের প্রশস্ত হাড় (স্টার্নাম) পাখার মাংসপেশী শক্তভাবে লেগে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়।
পাখি যখন উড্ডয়নের জন্য ডানা ঝাপটাতে থাকে তখন পাখাগুলো একবার নিচে এবং আরেকবার উপরে যায়। নিচে চাপ দেয়ার সময় পাখির প্রশস্ত পাখা উপরিতলের বাতাস নিচের তুলনায় দ্রুত প্রবাহিত হয় । ফলে, পাখার উপরস্থিত বাতাসের চাপ কমে যায় এবং নিচের বাতাসের চাপে পাখি উপরে উঠতে থাকে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা মানুষকে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ব্যপারে বার বার তাকিদ দিয়েছেন। একই সাথে তিনি মানুষের অন্তরে স্রষ্টা সম্পর্কে ফিতরাহ দিয়েছেন। বুদ্ভিমত্তা ও ফিতরাহ ব্যবহার করে একজন মানুষ তার স্রষ্টাকে সহজেই চিনতে পারে। এ কারণে তিনি কোন কোন জায়গায় মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন। কোথাও মানুষের নিজের গঠনের ব্যপারে চিন্তা করতে বলেছেন। আবার কোন জায়গায় ছোট-বড় বিভিন্ন প্রানীর উপমা টেনে উক্ত প্রাণীর সৃষ্টিশৈলী নিয়ে গবেষণা করে সত্য সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনিত হতে উৎসাহিত করেছেন। কোরআনের শুরুর দিকে সুরা বাকার ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ এরকম একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে বলছেন-
“অবশ্য আল্লাহ লজ্জা করেন না মশা বা তার চেয়ে তুচ্ছ কোন জিনিসের দৃষ্টান্ত দিতে ৷ যারা সত্য গ্রহণকারী তারা এ দৃষ্টান্ত –উপমাগুলো দেখে জানতে পারে এগুলো সত্য, এগুলো এসেছে তাদের রবেরই পক্ষ থেকে, আর যারা (সত্যকে) গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় তারা এগুলো শুনে বলতে থাকে , এ ধরনের দৃষ্টান্ত –উপমার সাথে আল্লাহর কী সম্পর্ক ?” (১)
চলুন মশার গঠন নিয়ে ভেবে দেখি এতে আমাদের জন্য কি চিন্তার উপাদান আছে।
দৈনন্দিন জীবনকে দূর্বিষহ করার জন্য মশার মত ছোট প্রাণীই যথেষ্ট। আর্থোপোডা গোত্রের এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি ডেংগু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি প্রাণঘাতী রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। ফলে আমাদের প্রতি সন্ধ্যার রূটিন হয় মশা থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় উপকরণ ব্যবহার করা। অধিকন্তু, প্রতিদিনের অসংখ্য অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে আমাদের সাবকনসাশ ব্রেইন চমৎকারভাবে ইগনোর করতে পারে। এ কারণে আমরা মনে করি মশা নিয়ে আলাদা ভাবে ভাববার কি আছে?
কিন্তু, বিজ্ঞানীরা সবকিছু ভিন্নভাবে চিন্তা করেন। তারা মশার গঠন ও জীবনপ্রণালী থেকে শুরু করে মশা কিভাবে রক্তচুষে এবং কিভাবে উড়ে বেড়ায় তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন।
যে কোন উড্ডয়নশীল প্রাণীর জন্য একটা বড় বিষয় হল তার এরোডাইন্যামিক্স। অর্থাৎ কিভাবে সে মাটিতে বসা থেকে উড়তে শুরু করে, কিভাবে সে বাতাসে উড়ে বেড়ায় এবং কিভাবে সে উড়ন্ত অবস্থা থেকে অবতরণ করে। আমরা জানি পাখিদের উড়ার কৌশল নিয়ে গবেষণা করতে করতেই উড়োজাহাজের আবিস্কার হয়েছে।
পাখির তুলনায় কিটপতঙ্গের উড্ডয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল কিটপতঙ্গ পাখা ঝাপটে বাতাসে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে। এ ধরনের উড়াকে বলে হোভারিং। এর বাইরেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া, পাশে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের উড্ডয়ন আছে যা আমরা প্রতিদিনই দেখি।
আমাদের হাত পা নাড়াচারা করতে যেমন অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট মাংসপেশী লাগে। কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও উড়ার জন্য মাংসপেশী প্রয়োজন। কিছু কিছু কীটের পাখার জন্য আলাদা মাংসপেশী আছে এবং কিছু কীটের ক্ষেত্রে উক্ত মাংসপেশী থাকে বুকে। এদের ক্ষেত্রে পাখাদ্বয় পিঠে লাগানো থাকে। মাংসপেশীর সংকোচন ও প্রসারনের মাধ্যমে বক্ষপিঞ্জরের সংকোচন ও প্রসারন হয়। ফলে সংযুক্ত পাখাদ্বয় ঝাপটাতে থাকে। (২) আমাদের আলোচ্য মশা শেষের উল্লিখিত পদ্ধতিতে উড়ে বেড়ায়।
মশার প্রায় স্বচ্ছ ও ক্ষুদ্র দুটো পাখা আছে, যা সুনির্দিষ্ট ব্যাসাল গঠন দিয়ে থোরাক্সের সাথে লাগানো থাকে। সুনির্দিষ্ট বললাম এই জন্য যে অন্যান্য কীটপতঙ্গের তুলনায় মশার পাখার বেজ এ গঠনের পার্থক্য আছে (৩)।
কীট পতঙ্গ উড়ার সময় পাখা সামনে পিছনে এবং উপরে নিচে এমনভাবে ঝাপটায় যাতে পাখার সামনের দিকের এজ (Edge) বাতাসে এক ধরনের ভর্টেক্স তৈরী করে। যাকে বলা হয় লিডিং এজ ভর্টেক্স। এই ভর্টেক্স পাখা ও শরীরের নিচে গিয়ে কীটের শরীরকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখে। কিন্তু, মশা পাখা এমনভাবে ঝাপটায় যে পাখার সামনে লিডিং এজ ভর্টেক্স এর পাশাপাশি তৈরী হয় পাখার পিছনের দিকে ট্রেইলিং এজ ভর্টেক্স (৪)।
ফলে মশাকে ভেসে থাকতে অনেক দ্রুত পাখা ঝাপটাতে হয়। একটা মশা প্রতি সেকেন্ডে ১৬৫ থেকে ৫৮৭ বার পাখা ঝাপটাতে পারে (৩)। এই কারণেই মশা কানের কাছে ঘুরতে থাকলে আমরা ভো ভো শব্দ পাই ও বিরক্ত হই। মশার পাখার শব্দ আমাদের কাছে বিরক্তিকর লাগলেও মশার নিজের কোর্টশিপের (স্ত্রী-মিলন) জন্য এটি জরুরী। এমনকি কোর্টশিপের সময় মশার তার পাখার ঝাপটানোর ফ্রিকোয়েন্সী নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে শব্দের টোন পরিবর্তন করে (৫)।
প্রিয় পাঠক এবার চিন্তা করে দেখুন একটা মশাকে শুধুমাত্র উড়ার সক্ষমতা দেয়ার জন্য কতগুলো জিনিস জানতে হবে- বাতাসের ফিজিক্স, মশার পাখার বিস্তৃতি কতটুকু হওয়া যাবে, পাখা ঝাপটানোর স্পিড কতটুকু হতে হবে, পাখার ঝাপটানোর দিক কেমন হওয়া চাই, পাখার ঝাপটানোর জন্য থোরাক্সের মাংসপেশী কতটুকু হতে হবে, প্রতিটা ঝাপটার সময় পাখায় অক্সিজেন সরবারহ নিশ্চিত করতে হবে, ইত্যাদি। এই ভাবে যেতে থাকলে লিস্টটা অনেক বড় হবে। এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল সবগুলো গঠন ও ফাংশন একটার সাথে আরেকটা অতপ্রত ভাবে জড়িত হয়ে একটি কমপ্লেক্স সিস্টেম দাড় করিয়েছে।
পরিস্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে এই গঠনের পিছনের সুনির্দিষ্ট ডিজাইন ও পরিকল্পনা আছে। কোন এলপাতাড়ি ও অন্ধ প্রক্রিয়ায় মশার উড্ডয়ন ক্ষমতা উদ্ভব হয়নি।
একটা মশা মানুষকে কুপোকাত করে দিতে পারে। অথচ, আমরা নিজেরা আল্লাহর দেয়া জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা ব্যবহার করে আমাদের স্রষ্টার নিয়মাতকে অস্বীকার করি। নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে ভুলে যাই।
ধরুন, আপনি বোটে করে সমুদ্র ভ্রমণে বেরিয়েছেন। পথিমধ্যে বোটের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে। ওদিকে আপনি পান করার জন্য যতটুকু পানি নিয়ে এসেছেন তা শেষ হয়ে গেছে। আপনার কাছে সফট ড্রিংকস আছে। কিন্তু, তাতে কি আপনার তৃষ্ণা মিটবে? আপনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন যে জীবনে পানির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।
মানুষের একটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে যে বিষয়গুলো কোন প্রকার কষ্ট ছাড়াই প্রতিদিন উপভোগ করছে সেগুলো তার মনে কখনও ভাবনার উদ্রেক করে না। যেমন আমরা সবসময় দেখি কোন জিনিস উপর থেকে ফেললে নিচে পড়ে। কিন্তু, কেন পড়ে সেই বিষয়ে আমাদের কোন কৌতুহল জাগ্রত হয় না। যারা একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করে তারা পর্যবেক্ষণলব্ধ ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ খুঁজে পায়।
পানি হচ্ছে মহান আল্লাহর এমন একটি নেয়ামত যার গুরুত্ব আমরা সচরাচর উপলব্ধি করি না। তাই আসুন আজকে আমরা একটু পানি নিয়ে ভাবনার জগতে ডুব দেই।
আনবিক পর্যায়ে দুটি হাইড্রোজেন অ্যাটোম এবং একটি অক্সিজেন অ্যাটোমের সমন্বয়ে তৈরী হয় পানি। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দুটিই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বায়বীয় অবস্থায় থাকে। অথচ, এই দুটোর সমন্বয়ে তৈরী হয় অসাধারণ এক তরল যার উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে আছে সমগ্র জীবজগত। মানবদেহের প্রায় সত্তর শতাংশ হল পানি।
পানির অনেকগুলো ইউনিক বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্যান্য তরল পদার্থের নেই। Michael Denton তার বই Nature’s Destiny: How the Laws of Biology reveals Purpose in the Universe-এ পানির বেশ কিছু ‘ইউনিক’ তথা স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেছেন। চলুন এ রকম কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নিই।
পদার্থের একটা সাধারন নিয়ম হল উত্তপ্ত করলে প্রসারিত হয় এবং ঠান্ডা করলে সংকুচিত হয়। পানির ক্ষেত্রেও এ রকম হয়। তবে অন্যান্য পদার্থকে ঠান্ডা করতে থাকলে সেগুলো সংকুচিত হতে হতে একটা সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গিয়ে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। উক্ত তাপমাত্রাকে বলা ‘ফ্রিজিং পয়েন্ট’। পানির একটি ‘ইউনিক’ বৈশিষ্ট্য হল পানি যেই তাপমাত্রায় (শুন্য ডিগ্রী সেলসিয়াস) গিয়ে বরফে পরিণত হয় ঠান্ডা করতে থাকলে পানি সেই পর্যন্ত সংকুচিত হয় না। বরং চার ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত সংকুচিত হওয়ার পর প্রসারিত হতে শুরু করে এবং বরফে পরিনত হওয়ার সময় হঠাৎ অনেক বেশী প্রসারিত হয়। পানির এ বৈশিষ্ট্যের কারণে অত্যন্ত ঠাণ্ডা এলাকায় পুকুর বা লেক বা মেরুঅঞ্চলের সমুদ্রে পানি উপরিতলে বরফে পরিনত হলেও নিচে তরল হিসেবে থাকে। ফলে, গভীরের বসবাসরত সামুদ্রিক জীবগুলো বরফে পরিণত হয় না এবং বেঁচে থাকে। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, পানিও তো পদার্থ। তাহলে কেন এটা অন্যান্য পদার্থের মত ‘ফ্রিজিং পয়েন্ট’ পর্যন্ত সংকুচিত হয় না?
কোন পদার্থ যখন তরল থেকে বায়োবীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয় তখন পরিবেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপগ্রহন করে। একে বলে ‘ল্যাটেন্ট’ হিট। পৃথিবীতে যত তরল আছে তার মধ্যে পানির ‘ল্যাটেন্ট’ হিট সবচেয়ে বেশী। এই গরম কালে আপনি আপনার রুমে কিছু কাপড় ভিজিয়ে রেখে দেখুন। ধীরে ধীরে রুমটা অনেক ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কারণ কাপড়ের উপরিস্তর থেকে পানির অনু জলীয়বাস্প হয়ে উড়ে যাওয়ার সময় পরিবেশ থেকে তাপ শোষন করে নিয়ে যায়। পানির এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে পৃথিবীর আবহাওয়া খুব দ্রুত তাপমাত্রা পরিবর্তন হত। ছোট ছোট লেক বা নদী খুব দ্রুত উধাও হয়ে যেত আবার উদয় হত। অন্যদিকে জীবজগতের শারিরীক তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রন সুশৃংখলভাবে সম্ভব হচ্ছে পানির এই বৈশিষ্ট্যের কারণে।
কোন পদার্থের তাপমাত্রা এক ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বাড়ানোর জন্য যতটুকু তাপ দেয়া দরকার তাকে বলে ‘থারমাল ক্যাপাসিটি’। পানির থার্মাল ক্যাপাসিটিও অন্যান্য সব পদার্থের চেয়ে বেশী। এইটাও পানির একটি ‘ইউনিক’ বৈশিষ্ট্য। কেন? এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে শীতকাল ও গরমকালে তাপমাত্রার পার্থক্য আরও প্রকট হত। আমরা উপরে জেনেছি মানুষের শরীরের প্রায় সত্তরভাগ পানি। পানির তাপমাত্রা এক ডিগ্রী বাড়াতে যদি অল্প তাপ দিলেই হত তাহলে অতিদ্রুত কোষের অন্ত:স্থ তাপমাত্রা বেড়ে যেত। ফলে কোষের ভিতরের গাঠনিক উপাদানগুলোর গঠন নষ্ট হয়ে যেত। জীবের গঠনের একাগ্রতা (ইনটেগ্রিটি) বিনষ্ট হত।
পানির আরেকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল পানির তাপ পরিবহন ক্ষমতা অন্যান্য সাধারণ তরল থেকে চারগুন বেশী। পানির এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে কোষের ভিতরে তাপমাত্রার সমসত্ব বিস্তৃতি সম্ভব হতো না।
অন্যদিকে বরফের তাপ পরিবহন ক্ষমতা কম। এ কারণে মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের উপরিভাগ বরফ হয়ে গেলেও নিচের অংশ বরফ হয় না যা জলস্থ জীবের বেঁচে থাকার জন্য জরুরী।
যে কোন তরলের উপরের স্তরে একটা পৃষ্ঠটান (সারফেস টেনশন) থাকে। পানির পৃষ্ঠটান অনেক বেশী। যার ফলে মাটির তলদেশে গাছপালার মূল পানির সরবরাহ বজায় থাকে। অন্যান্য তরল পদার্থের মত পানির পৃষ্ঠটান থাকলে পৃথিবীতে বড় কোন বৃক্ষ থাকত না। পানির এই পৃষ্ঠটানের কারণে পাথরের মধ্যস্থিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্র ও ফাটলগুলোতে পানি জমা হয় এবং এই পানি যখন ঠাণ্ডা হয়ে যায় তখন পাথর ভেঙ্গে যায় এবং পাথরে জমা হওয়া খনিজ পদার্থ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। যার মাধ্যমে পানি পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপরে আমরা পানির যে ফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানলাম জীবজগতের গঠনে এগুলো কোন উপকারেরই আসত না যদি না পানির রাসায়নিক গঠনও স্বতন্ত্র হত। পানিকে বলা হয় সার্বজনীন দ্রাবক। কারণ পানি অসংখ্য রাসায়নিক পদার্থকে দ্রবিভূত করতে পারে। পানি সার্বজনীন দ্রাবক না হলে জীবকোষের অসংখ্য রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্ভব হতো না এবং পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের বিস্তৃতি সমান হতো না।
পানির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এটি বেশ সক্রীয় (রিএকটিভ) রাসায়নিক পদার্থ। তবে বিভিন্ন অ্যাসিড বা ক্ষারের মত এত বেশী সক্রীয় না। যদি হত, তাহলে যে কোন পদার্থ পানিতে দেয়া মাত্রই মিশে যেত এবং কোন জৈবিক বৈশিষ্ট্য গঠন করা সম্ভব হতো না।
যে বৈশিষ্ট্যের জন্য পদার্থের আঠালো ভাবটা তৈরী হয় তাকে বলে সান্দ্রতা বা ভিসকোসিটি। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন তরল পদার্থের মধ্যে পানির সান্দ্রতা সবচেয়ে কম। শুধুমাত্র কিছু গ্যাসীয় পদার্থের (যেমন: হাইড্রোজেন) তরল অবস্থায় পানির চেয়ে কম সান্দ্রতা থাকে। মজার বিষয় হল পানির সান্দ্রতাও অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ সীমায় নির্ধারণ করা হয়েছে। পানির সান্দ্রতা যদি তরল হাইড্রোজেনের মত কম হত কোষের ভিতরস্থ কোন ধরনের আনুবিক্ষনিক গঠনকে ধরে রাখা সম্ভব হত না। আবার, পানির সান্দ্রতা বেশী হলে মাছ বলে কিছু থাকত না, পানিতে নৌকা চালানো সম্ভব হত না, সাতার কাটা যেত না। এমনকি, কোন আনুবিক্ষনীক জীব বা কোষের আভ্যন্তরীন ক্ষুদ্রাঙ্গের পক্ষে পানিতে চলাফেরা করা সম্ভব হত না।
ব্যাপন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রনে সান্দ্রতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। পানির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পদার্থ খুব দ্রুত ব্যাপন প্রক্রিয়ায় অল্প দূরত্বে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। কোষের ভিতর এবং বাহিরে বিভিন্ন উপাদানের আদান প্রদান নির্ভর করে ব্যাপন প্রক্রিয়ার উপর। পানির সান্দ্রতা দশগুন বেশী হলে ব্যাপন হার দশভাগ কমে যেত। ফলে কোন অনুজীব ব্যাপন প্রকিয়ায় খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করতে পারত না।
কৈশিক জালিকার মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নালী দিয়ে রক্ত প্রবেশ করার জন্য যে ধরনের সান্দ্রতা থাকা দরকার পানির সান্দ্রতাও ঠিক ততটুকুই ভারসাম্যপূর্ণ। সান্দ্রতা বেশী হলে কৈশিক জালিকায় রক্ত সঞ্চালনের জন্য হার্টের অনেক বেশী প্রেসার দিতে হত ফলে এমন কোন রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া তৈরীই সম্ভব হত না যা সফলভাবে কাজ করে।
বরফের সান্দ্রতাও পৃথিবীতে জীবন ধারনের জন্য নিয়ন্ত্রিত। বরফের সান্দ্রতা পানির সান্দ্রতার তুলনায় ১০^১৬ গুন বেশী। বরফের সান্দ্রতা কয়েক ভাগ কম হলে বরফপিণ্ড কর্তৃক পাহাড়ের মাটি ভেঙ্গে প্রকৃতিতে মিনারেল ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হতো না। অন্যদিকে সান্দ্রতা বেশী হয়ে গ্রানাইটের কাছাকাছি হলে মেরু অঞ্চলে পানির প্রবাহ থাকতো না, বিশাল বরফের স্তর থাকতো এবং পৃথিবীতে পরিমিত পরিমাণ তরল পানিই থাকতো না।
পানির ঘনত্বও জীবন গঠনের জন্য যথার্থ। পানির ঘনত্ব বর্তমানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী হলে জীবের ওজন বেশী হত, আকার আকৃতি অনেক ছোট হত এবং মানুষের মত সোজা মেরুদণ্ডী দ্বিপদী প্রানীর অস্তিত্ব সম্ভব হত না। শুধু তাই না ঘনত্ব বেশি হলে কার্বনভিত্তিক সকল জীব জলরাশির উপরের স্তরে ভেসে বেড়াতে হতো, ডুবতে পারতো না। অন্যদিকে ঘনত্ব কম হলে সিসার বলের মত পানির তলদেশে ডুবে যেত।
জীবনকে নিশ্চিত করার জন্য পানির এই সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর সংখ্যা এখানেই শেষ নয়। আবহাওয়ার চক্র নিয়ন্ত্রনের পানির বিভিন্ন ফিজিক্যাল ও কেমিকাল বৈশিষ্ট্যগুলোর ঠিক যতটুকু ‘টিউনিং’ হওয়া দরকার ঠিক ততটুকুই টিউনিং করা আছে।
সুতরাং, আমরা বুঝতে পারছি কেন পানির অপর নাম জীবন।
আপনার কি ধারণা পানির এই সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো একা একাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে তৈরী হয়ে গেছে? নাকি পানিকে এইভাবে পরিকল্পনা করেছেন কোন পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান স্বত্তা যিনি জীবন তৈরীর জন্য পানির প্রয়োজনীয় গঠন সম্পর্কে জানেন?
এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে বসুন। একবার ভাবুনতো এই যে মাটি খুড়লেই আপনি ভুগর্ভস্থ পানি পেয়ে যাচ্ছেন কেন এবং কোথা থেকে এই পানি আসল? পানির যে বৈশিষ্ট্যের জন্য মাটির গভীরে বা পাথরের ফাঁকে পানি জমে থাকছে সেই বৈশিষ্ট্য কার রহমতে সৃজিত হল? চিন্তা করে দেখুনতো, এই পানির স্তর যদি আরও নিচে নেমে যেত তাহলে কি আপনি বেঁচে থাকতে পারতেন?
“বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদেরকে সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা?” (সুরা মূলক্, আয়াত নং-৩০)
গত ১৩/০৭/২০২২ তারিখে নাসার James Webb Space Telescope দিয়ে তোলা মহাশূণ্যের প্রায় ধূলিকনার সমান একটি অংশের ছবি প্রকাশিত হয়। উক্ত স্থিরচিত্রে ধরা পড়েছে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের অসংখ্য নক্ষত্ররাজী ও ছায়াপথের ছবি।
একটা বিশেষায়িত দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাশূন্য পর্যবেক্ষণ করছেন। এতে বিভিন্ন ছায়াপথ থেকে আসা আলো ধরা পড়েছে। কিন্তু, তারা কিভাবে পরিমাপ করছেন যে কোন্ ছায়াপথ কত দূরে অবস্থান করছে? কিভাবে তারা হিসেব করলেন ৪.৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বের নক্ষত্র থেকে আসা আলো দূরবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ছে?
সহজ কথায়, পৃথিবী থেকে একটি নক্ষত্রের দূরত্ব কিভাবে হিসেব করা হয়?
এটি বিজ্ঞানীরা করেন দুটো উপায়ে।
এক, পৃথিবীর কক্ষপথের দূরত্ব এবং পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান নক্ষত্রের কোণ এর সাহায্য নিয়ে জ্যামিতিক উপায়ে। এ প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা পৃথিবী কক্ষপথের এক প্রান্তে পৌছার পর নক্ষত্রের সাথে পৃথিবীর কোণ হিসেব করেন এবং ৬ মাস পর আরেক প্রান্তে গেলে উক্ত নক্ষত্রের কোণ আবার হিসেব করেন। এভাবে পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে নক্ষত্রের যে স্থানিক বিচ্যুতি তৈরী হয় (Parallax) তার সাহায্যে নক্ষত্রটি থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হিসেব কসে বের করা যায়। তবে এই ধরণের হিসেব সম্ভব হয় শুধুমাত্র পৃথিবী থেকে ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তারকাসমূহের ক্ষেত্রে।
দুই, পৃথিবী থেকে ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তারকার ক্ষেত্রে অনুরূপ সরাসরি দূরত্ব মাপার কোন পদ্ধতি নেই। ফলে বিজ্ঞানীরা আলোর উজ্জ্বলতার পরিমাপ হিসেব করে দূরত্ব নির্ণয় করেন। মজার বিষয় হলো তারকার কালার স্পেকট্রাম উক্ত তারকার উজ্জ্বলতার একটি ভালো নির্দেশক। তারকার রঙের সাথে উজ্জ্বলতার এ সম্পর্ক বের করা হয়েছে পৃথিবী থেকে সরাসরি দূরত্ব পরিমাপযোগ্য তারকার উপর গবেষণা করে।
দূরবর্তী ছায়াপথের উজ্জ্বলতা অনেক কম হয়। তবে ছায়াপথ সমূহের Gravitational Lensing এর কারণে, দূরবর্তী ছায়াপথ সমূহের আলো উজ্জ্বলতা একেবারে শূণ্য হয়ে যায় না।
অন্যদিকে ছায়াপথ (Galaxy) বা নক্ষত্রপুঞ্জের রং-থেকে আবিস্কার হয়েছে যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে। ডপলার ইফেক্টের কারণে একটি গতিশীল বস্তু আপনার থেকে যত দূরে যাবে, উক্ত বস্তু থেকে নি:সৃত তরঙ্গের দৈর্ঘ তত বাড়তে থাকবে। ফলে আলোর ক্ষেত্রে তা লাল আলো বা ইনফ্রারেড আলোতে পরিণত হবে। এ ঘটনাকে বলে Redshift । বিজ্ঞানী স্লাইফার প্রথম আবিস্কার করেন যে দূরবর্তী ছায়াপথ গুলো থেকে আসা আলোর রেড-শিফট হয়েছে। বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দেখান যে গ্যালাক্সীগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তথা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে।
মজার বিষয় হল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণজনিত এই রেড শিফট তারকার নিজস্ব গতির ফলে হয় না। বরং, তারকাররাজীর মধ্যবর্তী শূণ্যস্থানের সম্প্রসারণের ফলে হয়। কোন একটি তারকা থেকে নি:সৃত আলো পৃথিবী পর্যন্ত সম্প্রসারমান স্পেস দিয়ে আসতে গিয়ে রেড-শিফট হয়ে যায়।
বিজ্ঞানী হাবল আরও দেখান যে কোন একটি ছায়াপথের দূরে সরে যাওয়ার গতি উক্ত ছায়পথ থেকে পৃথিবীর দূরত্বের সমানুপাতিক। সম্প্রসারমান মহাবিশ্বের কোন কোন জায়গায় সম্প্রসারণের গতি আলোর গতির সমান বা তার বেশী। ফলে উক্ত জায়গা থেকে কোন আলো আমাদের কাছে কখনও পৌছে না। একে বলে Cosmic Event Horizon । ইভেন্ট হরাইজনের অন্তর্গত মহাবিশ্ব হচ্ছে ’দৃশ্যমান’ মহাবিশ্ব। আমরা জানিনা এই ইভেন্ট হরাইজনের পরে মহাবিশ্বের কোনো অংশ আছে কি নেই? বা কতটুকু আছে।
প্রিয় পাঠক, একবার চিন্তা করে দেখুনতো যেই মহাবিশ্ব এত বিশাল, এত বিস্তৃত! সেই মহাবিশ্বের স্রষ্টার ক্ষমতার বিশলতা কত বেশী?
সুবহানআল্লাহ!
“যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আসমান। রহমানের সৃষ্টিতে আপনি কোনো খুঁত দেখতে পাবেন না; আপনি আবার তাকিয়ে দেখুন, কোনো ত্রুটি দেখতে পান কি?” (সুরা মূলক ৬৭, আয়াত- ৩).
“আর আসমান আমরা তা নির্মাণ করেছি আমাদের ক্ষমতা বলে এবং আমরা নিশ্চয়ই মহাসম্প্রসারণকারী।” (সুরা আল যারিয়াত ৫১, আয়াত-৪৭)
“মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি অবশ্যই বড় বিষয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।” (সুরা গাফির ৪০, আয়াত-৫৭)
“আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহ্র স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে, ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি , আপনি অত্যন্ত পবিত্র, অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।’” (সুরা আল ইমরান ৩, আয়াত-১৯০,১৯১).
নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য রচিত ‘কাজের লোক’ কবিতাটি মুখস্ত করে করে আমরা নব্বই-এর শিশুরা ছোট থেকে বড় হয়েছি। যখন কয়েক ক্লাস উপরে উঠেছি তখন জেনেছি যে মৌমাছি এক ফুল থেকে আরেক ফুলে মধু আহরণ করে বেরায়। আবার এই কাজ করতে গিয়ে তারা এক ফুলের রেণু আরেক ফুলে নিয়ে পরাগায়ন করে। যার পরিণতিতে আমরা পাই ফল, আর গাছ পায় বীজ ছড়িয়ে দেয়ার উপায়।
কখনও কি আমাদের মনে কৌতুহল জাগেনি যে মৌমাছি কিভাবে মৌচাক থেকে ছড়িয়ে পড়ে ফুলের খোঁজে? কিভাবে ফুল চিনে নেয়? কিভাবেই বা মৌচাকে ফিরে আসে দলবদ্ধ ভাবে? কেনই বা মৌচাকে মধু জমা করতে থাকে?
হয়ত আমরা এগুলো দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তাই প্রশ্ন জাগে না। কিন্তু নিরিবিলি কিছুক্ষণ বিষয়টি নিয়ে ভাবলে আগ্রহ না জন্মে উপায় নেই।
Bee Movie নামে একটি চমৎকার এনিমেশন মুভি আছে। কাহিনীটা এরকম যে মৌমাছি জাতির একজন তরুণ পড়াশোনা শেষ করে মধু তৈরীর কারখানায় জয়েন করবে। কিন্তু সে যখন জানতে পারে যে মধু তৈরীর কারখানায় একজন কর্মচারীর সারাজীবন একই কাজ করতে হবে তখন তার বিষয়টি ভালো লাগে না। পাশাপাশি মৌমাছিদের একটি নিয়ম হল তারা মানব জাতির সাথে কথা বলতে পারবে না। কিন্তু, সে এই রুলটা ভেঙ্গে ফলে। সে সুবাদে তার একজন মানব সঙ্গীও জুটে যায়। এরপর দু’জনে মিলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকে। এক সময় আবিস্কার করে যে মানুষ তাদের আহরিত মধু কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলছে। সে বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে মামলা করে এবং মামলায় জিতে যায়। ফল স্বরুপ আহরিত মধু জমতে জমতে একসময় অতিরিক্ত হয়ে যায়। মৌমাছির কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রকৃতিতে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরী হয় তার ফলে নেমে আসে খড়া। ধীরে ধীরে সব গাছ শুকিয়ে যেতে থাকে। সবুজ প্রকৃতি হয়ে পড়ে নিথর ও নির্জীব।
মুভিটি ২০০৭ সালে মুক্তি পেলেও মৌমাছির গুরুত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এইতো বছর কয়েক আগে। মৌমাছিকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবিত প্রজাতি হিসেবে। (১) কিন্তু কেন? কারণ পৃথিবীর কৃষিশিল্পের সত্তর শতাংশ ফসল আসে মৌমাছির সুবাদে।
মৌমাছি রস আহরণ করতে ফুলে বসে । ফুলের মধ্যে পরাগরেণু এমনভাবে লেগে থাকে যেন রস আহরণের সময় পরাগরেণু মৌমাছির গায়ে লেগে যায়। উক্ত মৌমাছি আরেকটি ফুলে গিয়ে বসলে পরাগায়ন ঘটে। এরপর ফুল থেকে তৈরী হয় ফল। উক্ত ফল পুনরায় অন্য কোন প্রাণীর শক্তি যোগান দেয়ার পাশপাশি বীজটিকেও অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। কি চমৎকার মিথস্ক্রিয়া?
মৌমাছি ফুলের রস সংগ্রহ করে মধু আকারে মৌচাকে জমা করতে থাকে। যতটুকু তাদের প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশী। ফলে উক্ত মধু আমরা সংগ্রহ করতে পারি। যাতে আছে নানাবিধ উপকারী খাদ্য উপাদান।
কতই না সুন্দর এই পারস্পরিক উপকারের জাল। ফুল কি জানত তাকে পরাগরেণু ছড়িয়ে দিতে মৌমাছির আশ্রয় নিতে হবে? পরাগরেণুর আঠালো গড়ন সংশ্লিষ্ট গাছের জেনেটিক গঠনে কিভাবে তৈরী হল? মৌমাছি কি নিজে জানে যে সে কিভাবে পুরো পৃথিবীর এত উপকার সাধন করছে? নাকি সকল জীবের স্রষ্টা আল্লাহ তাকে পথ দেখিয়ে দেন?-
“অতঃপর সর্বপ্রকার ফল থেকে আহার কর এবং আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথ সমূহে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙ এর পানীয় বের হয়। এতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।” সুরা আন নাহল, আয়াত- ৬৯।
আজকের তারিখের প্রেক্ষিতে অনেকেই নতুন ভাবে Palindrome(প্যালিনড্রোম) শব্দটির সাথে পরিচিত হয়ে গেলেন। বাংলায় একে অর্থ করলে হয় ‘দ্বিমুখী শব্দ’। যেমন আজকের তারিখ-
০২০২২০২০ (০ – ২ – ০ – ২ – ২ – ০ – ২ – ০)
অর্থাৎ, দুই দিক থেকে পড়লে একই তারিখ পাচ্ছেন। এবার দেখুন নিচের শব্দগুলি-
নবজীবন (ন – ব – জী – ব – ন)
নিধুরাম রাধুনি (নি – ধু – রা – ম – রা – ধু – নি)
শব্দগুলো যেদিক থেকেই পড়ুন অর্থ এই থাকে। বাংলায় দ্বিমুখী শব্দ তৈরীতে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন দাদাঠাকুর খ্যাত শরৎচন্দ্র পন্ডিত। তার লেখা একটি কবিতার লাইন এরকম-
‘রাধা নাচে অচেনা ধারা’
কি মজার বিষয় তাই না?
গনিতেও এরকম প্যালিনড্রোমের অসংখ্য উদাহরন আছে। যেমন – ১ দিয়ে তৈরি সমসংখ্যক অঙ্কের দুটি সংখ্যার গুণফল সবসময় প্যালিনড্রোমিক হবে (১)। উদাহরণ, ১১x১১=১২১ ১১১x১১১=১২৩২১ ১১১১x১১১১=১২৩৪৩২১ ১১১১১x১১১১১=১২৩৪৫৪৩২১
এবার চলুন কিছু ইংরেজী প্যালিনড্রোমের উদাহরণ দেখি-
mom (m – o – m)
madam (m – a – d – a – m)
গিনেস বুক আব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী ইংরেজীতে সবচেয়ে বড় প্যালিনড্রোমিক ওয়ার্ড (২) হচ্ছে –
DETARTRATED (D – E – T – A – R – T – R – A – T – E – D)
শব্দটির অর্থ হল জৈব যৌগ ‘tartrate’ অপসারণ করা হয়েছে ।
ইংরেজ কবি জেমস্ লিনডন-এর কবিতা ‘Doppelgänger’ হল সবচেয়ে বড় পরিচিত প্যালিনড্রোমিক কবিতা (৩)। এটি অবশ্য শব্দের গঠনের দিক দিয়ে দ্বিমুখী না। বরং, চরণের বিন্যাসের দিক দিয়ে দ্বিমুখী। যেমন কবিতাটির শুরু, মধ্য ও শেষের কিছু চরণ লক্ষ্য করুন-
Entering the lonely house with my wife I saw him for the first time ……… ……… I puzzled over it, hiding alone, Watching the woman as she neared the gate. He came, and I saw him crouching Night after night. Night after night He came, and I saw him crouching, Watching the woman as she neared the gate. ……. ……. I saw him for the first time, Entering the lonely house with my wife
কবিতাটি যে চরণ দিয়ে শুরু হয়েছে শেষও হয়েছে সেই চরণ দিয়ে। চরণগুলো ঠিক মাঝখানে এসে উল্টে গিয়েছে। যেন আয়নায় নিজের প্রতিফলন।
সুতরাং প্যালিনড্রোমের ব্যবহার যদি খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে করা যায় এবং তাতে এক ধরনের সাহিত্যিক বোধ জুড়ে দেয়া যায় তা হয়ে ওঠে চমৎকার শিল্পকর্ম। কোন লেখক যদি তার লেখায় এমনভাবে প্যালিড্রোমের ব্যবহার করেন যে তিনি যেই প্রেক্ষাপট থেকে আলোচনা করছেন তা প্রকাশ্যে বা গোপনে ফুটে ওঠে, বিষয়টা কেমন হবে বলুনতো? একটা দ্বিমুখী শব্দ তৈরী করাই তো কঠিন। তার ওপর আবার এমন শব্দাবলী খুঁজে বের করা যা কোন গভীর অর্থ ধারণ করে এবং সে শব্দাবলীর বাক্যের অর্থপূর্ণ স্থানে সন্নিবেশ করা কতটা শিল্পাচাতুর্য্য হতে পারে চিন্তা করে দেখুনতো?
বুঝাতে পারিনি বোধ হয়। চলুন একটি উদাহরণ থেকে বুঝে নেই।
আল্লাহ আজ্জা ও জাল্লা কুরআনুল কারীম-এর সুরা ইয়াসীনে সায়ত্রিশ নং আয়াত থেকে চল্লিশ নং আয়াত পর্যন্ত দিন ও রাত্রীর আবর্তণ এবং সূর্য ও চাঁদের চলনপথ ও পরিণতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। চল্লিশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন –
“ সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনতে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকই (তার) কক্ষ পথে ভেসে বেড়ায়।“
কি? কিছু দেখতে পেলেন? চলুন এবার আরেকটু কাছে গিয়ে দেখি। আয়াতের শেষাংশে লক্ষ্য করুন-
وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ
এবার নিচের অংশটুকু দেখুন।
كُلٌّ فِي فَلَكٍ
এই অংশটুকুর অর্থ হল- ‘প্রত্যেকেই কক্ষপথে’। ভাল মত দেখলে বুঝতে পারবেন ‘ইয়া’ অক্ষরকে কেন্দ্র করে ‘ক্বাফ, ‘লাম’ ও ‘ফা’ প্যালিনড্রোমে জড়িয়ে আছে-
كُ لٌّ فِ ي فَ لَ كٍ
এবং, এর ঠিক পর পরই যে শব্দটি আছে তা হল- ইয়াসবাহু’ন। যার অর্থ ‘ভেসে বেড়ানো বা সাতার কাটা বা ঘুরা’। মজার বিষয় হল শব্দটি শুরু হয়েছে ‘ইয়া’ দিয়ে। অর্থাৎ, শেষের শব্দটির ‘ইয়া’ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে পূর্ব শব্দত্রয়ে ‘ইয়া’-কে কেন্দ্র করে যে প্যালিনড্রোম তৈরী হয়েছে তা একটি অর্থ বহন করে (নিচের ছবি)। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা যেন দেখিয়ে দিচ্ছেন নক্ষত্ররাজী কিভাবে তাদের কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায়।
কু’রআন আসার আগে আরবী সাহিত্যের রথি মহারথীরা দ্বিমুখী শব্দ তৈরী করতো। সেগুলো হত অর্থহীন কিছু শব্দ বা বাক্য। কিন্তু, কোরআনের শব্দ গাঁথুনি লক্ষ্য করুন। কি সুন্দর! সুবহানাল্লাহ। কু’রআনীক প্যালিনড্রোমের এরকম আরেকটি উদাহরণ হল সুরা মুদ্দাসসির-এর তৃতীয় আয়াত (দ্বিতীয় ছবি)।
নিশ্চয়ই এই কু’রআন আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। সুতরাং, চলুন আমরা কু’রআন পড়ি এবং কু’রআনের আলোয় জীবনকে আলোকিত করি।
… পরিশিষ্ট: কু’রআনুল কারীমের এরকম আরও কিছু সাহিত্যিক মাধুর্য্য সম্পর্কে জানতে পড়ুন ভাই আবদুল্লাহ আল মাসুদের ‘কোরআন বোঝার মজা’ (৪)। এ বইটি এবার বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও ‘Linguistic miracle of Quran’ লিখে Google বা YouTube-এ অনুসন্ধান করলে পেয়ে যাবেন এ রকম অনেক মজার তথ্য। যেমন দেখুন এখানে (৫, ৬)।
বাচ্চাদের ভূতের গল্পে ভূত মানুষের গন্ধ দিয়ে মানুষকে চিনে নেয়। তবে, বাস্তবে ভূত না থাকলেও একটা ক্ষুদ্র প্রাণী মানুষকে খুঁজে বের করে তার গন্ধ দিয়ে। আর তা হল আমাদের অতি পরিচিত ‘মশা’।
আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী মশা সুযোগ পেলেই ত্বকে বসে শুঁড়টা প্রবেশ করিয়ে আরাম করে রক্ত সেবন করতে থাকে। কখনও কি ভেবে দেখেছেন মশা কিভাবে আমাদের খুঁজে পায়? কিভাবে সে বুঝে যে এই প্রাণীর ত্বকে বসতে হবে এবং ইঞ্জেকশনের মত শুঁড়টা গেঁথে দিতে হবে?
মশার মাথা ও সবুজ রঙ্গের গন্ধগ্রহনকারী স্নায়ু, উৎস
মশা মূলত তার লক্ষ্যবস্তুকে খুঁজে বের করে উক্ত লক্ষ্যবস্তু নিঃসৃত গন্ধ শুঁকে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো কার্বন ডাই-অক্সাইড, পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, মানুষের পায়ের গন্ধ, এবং ল্যাকটিক এসিড হল মশার মূল আকর্ষণ। মানুষ প্রতিদিন যে শত শত গন্ধকণা (odorous molecules) পরিবেশে ত্যাগ করে তার একটা অংশ মশা খুঁজে নেয়। মশা এই কাজটা করে তার অ্যান্টেনা ও মুখে অবস্থিত প্রায় ১০০ বা তার বেশী (প্রজাতিভেদে) রিসেপটর দিয়ে। এই রিসেপ্টরগুলোকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ওডোরেন্ট রিসেপ্টর (OR)। (১)
ওডোরেন্ট রিসেপ্টর কিভাবে কাজ করে? সহজ ভাষায় রিসেপটরগুলোর কাজ হল তালা ও চাবির মত। একটা তালা যেমন সুনির্দিষ্ট গঠনের চাবি ছাড়া খুলে না। ঠিক একইভাবে একটি নির্দিষ্ট ওডোরেন্ট রিসেপ্টর একটি সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের সাথে বন্ধন তৈরী করলেই কেবল এক্টিভেট হয়। এই যেমন এডিস মশার কথা চিন্তা করুন। এডিস মশার বিশেষত্ব হল মানুষকে কামড় দেয়া। এটি মানুব নিঃসৃত গন্ধকণাগুলোর মধ্যে sulcaton নামক একটি গন্ধকণার প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে আকৃষ্ট হয়। এই গন্ধকণাটি মানবদেহ থেকে অনেক বেশী পরিমানে বের হয় (২)। ফলে উক্ত গন্ধকণাকে চিনে নিয়ে এডিস মশা মানব ত্বকে এসে কামড় বসিয়ে দেয়।
একটি রাসায়নিক কণা যখন ওডোরেন্ট রিসেপ্টরের সাথে পরিপূরকভাবে লেগে যায়, তখন তৎসংশ্লিষ্ট কোষে বিশেষ তড়িৎরাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু হয় যার মাধ্যমে প্রাণীটির স্নায়ুতন্ত্রে সিগন্যাল পৌছে (৩)। তবে ওডোরেন্ট রিসেপ্টরের ঠিক মত কাজ করার জন্য রিসেপ্টরের সাথে ওডোরেন্ট কো-রিসেপ্টর (Orco) নামক আর এক ধরনের সুনির্দিষ্ট প্রোটিন আছে যা মশার ‘নাক’-এ নির্দিষ্ট পরিমানে ও স্থানে থাকতে হয়। সিগন্যাল তৈরী হওয়ার মাধ্যমে মশা তার নিকটবর্তী পরিবেশ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে।
মজার বিষয় হল আমরা মশা তাড়াতে যে ওষুধগুলো ব্যবহার করি এগুলো কাজ করে মশার গন্ধ নেয়ার ক্ষমতাকে বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে। এই প্রেক্ষিতে মশার কবল থেকে রক্ষা পেতে নতুন এবং আরও কার্যকরী উপায় বের করতে চলছে বিস্তর গবেষণা (৪)।
সম্মানিত পাঠক, একবার চিন্তা করে দেখুনতো মশার মধ্যে মানুষের গন্ধ নির্ণয় করার ক্ষমতা কিভাবে আসল? এটা কি কোন এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ায় (random process) একা একাই আসা সম্ভব? নাকি এটা কোন বুদ্ধিমান স্বত্তার কাজ যে জানে যে গন্ধে কি কি অণু আছে, যে জানে যে কিভাবে উক্ত অণুর পরিপূরক গঠনযুক্ত রিসেপ্টর তৈরী হতে হবে, যে জানে যে কিভাবে উক্ত রিসেপ্টরের মাধ্যমে স্নায়ুতন্ত্রে তড়িৎরাসায়নিক প্রক্রিয়ার সূচনা করতে হবে, যে জানে যে উক্ত স্নায়ুতন্ত্র কিভাবে কাজ করে?
“নিশ্চয় মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ। আর সে নিজেই (নিজের কাজ-কর্মের মাধ্যমে) এ বিষয়ের সাক্ষী। আর ধন-সম্পদের প্রতি অবশ্যই সে খুবই আসক্ত।” [সূরা আদিয়াত ১০০, আয়াত ৬-৮]
রেফারেন্স:
১. Shen HH. How do mosquitoes smell us? The answers could help eradicate disease. Proc Natl Acad Sci U S A. 2017;114(9):2096–8.
২. McBride CS, Baier F, Omondi AB, Spitzer SA, Lutomiah J, Sang R, et al. Evolution of mosquito preference for humans linked to an odorant receptor. Nature. 2014;515(7526):222–7.
৩. Ha TS, Smith DP. Insect Odorant Receptors: Channeling Scent. Cell. 2008;133(5):761–3.
৪. Potter CJ. Stop the biting: Targeting a mosquito’s sense of smell. Cell . 2014;156(5):878–81.
আপনি কি কখনও আপনার ত্বকের গঠন সম্পর্কে চিন্তা করেছেন? আপনার ত্বক হচ্ছে বাইরের অসংখ্য জীবানু ও ক্ষতিকর প্রভাবক থেকে সুরক্ষাদানকারী প্রাথমিক অঙ্গ। ত্বকের সুশৃংখল গঠনের কারণে আপনার শরীরে সহজে কোন জীবানু প্রবেশ করতে পারে না। আমাদের ত্বক প্রধানত দুই ধরনের লেয়ার নিয়ে গঠিত। বাইরের দিকের লেয়ারকে বলে এপিডার্মিস এবং ভিতরের দিকে লেয়ারকে বলা হয় ডার্মিস। আমাদের ত্বকের যত স্নায়ু ও রক্তনালী আছে তা থাকে ডার্মিস লেয়ারে। সুতরাং, একটা মশা যখন আমাদের ত্বকে বসে তার মুখটা ঢুকিয়ে দেয়, তখন তাকে রক্তপানের জন্য ডার্মিস লেয়ারে মুখ প্রবেশ করাতে হয়।
কিন্তু, ডার্মিস পর্যন্ত প্রবেশ করতে হলেতো মশাকে এপিডার্মিস লেয়ার অতিক্রম করে যেতে হবে। এপিডার্মিস লেয়ার মূলত চার ভাগে (বা পাঁচ ভাগে) বিভক্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বাইরের লেয়ারকে বলা হয় স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম। স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম এক ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত যাকে বলে কেরাটিনাইজড কোষ। কেরাটিনাইজড কোষের বিশেষত্ব হল এতে কেরাটিন নামক এক বিশেষায়িত প্রোটিন অনেক বেশী পরিমানে থাকে। কোষগুলো একটার ওপর আরেকটা এমন ভাবে লেপ্টে থাকে এবং পাশাপাশি এত শক্ত ভাবে যুক্ত থাকে যে এই লেয়ারকে সহজে ভেদ করা যায় না।
মানব ত্বকের গঠন
আপনাকে যদি বলা হয় যে, আপনি একটি সুতা নিন এবং আপনার ত্বকের ভেতর প্রবেশ করান। আপনি কি প্রবেশ করাতে পারবেন? পারবেন না, তাই না? কিন্তু, একটা মশা কিভাবে সুতার চেয়েও হালকা শুঁড়টাকে আপনার ত্বকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে? কখনও ভেবে দেখেছেন। এই অতিক্ষুদ্র শুঁড়টাকে প্রবেশ করানোর সময় তো বেঁকে যাবার কথা? এবং আসলে হয়ও তাই। কিন্তু, মশা তার শুঁড়ের অতি বিশেষায়িত গঠনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করে।
চলুন একটু দেখে নেই কেমন সেই শুঁড়ের গঠন। মশার শুঁড়ের ভিতরে থাকে ধারালো সূচের মত একটি গঠন । এটি মূলত ছয়টি প্রায় একই রকম দেখতে সূচের সমন্বয়ে গঠিত। একে তুলনা দেয়া যায় হাইপোডার্মিক নিড্ল-এর সাথে। আপনারা নিশ্চয়ই সিরিঞ্জ দেখেছেন। সিরিঞ্জের সূচটা যেরকম ধারালো, মশার শুঁড়ের ভিতরের সূচটা দেখতে হুবুহু একই রকম। খালি চোখে অবশ্য আপনি তা দেখতে পারবেন না। মশার শুঁড়ের এই সূচের মত ধারালো গঠন দেখতে আপনাকে অত্যন্ত শক্তিশালী অতিআণুবীক্ষনীক মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করতে হবে।
হাইপোডার্মিক নিডল
তো মশা যখন আপনার ত্বকে বসে তার শুঁড়টা ঢুকাতে শুরু করে অধিকাংশ সময় তার শুঁড়টা বেকে যায়। বাঁকা হয়ে মশা উড়ে গিয়ে আরেকটা স্পট খুঁজে বের করে যেখানে সে শুঁড়টাকে সোজাভাবে ত্বকে প্রবেশ করাতে পারবে। শুঁড় প্রবেশ করারনোর সময় ভিতরে অবস্থিত সূচের দুটো অংশ ত্বকে প্রবেশ করাতে সাহায্য করে। এরপর শুঁড়টা ত্বকের উপরের লেয়ারে হালকা প্রবেশ হয়ে স্থির হলে পরে মশা রক্তশোষনকারী ফ্যাসিকলটাকে ধীরে ধীরে প্রবেশ করাতে শুরু করে। এরপর সূচটা যখন রক্তের সন্ধান পায় তখন মশা স্থির হয়ে রক্ত পান করতে থাকে (১)। শুঁড় প্রবেশ করার পর সূচের অন্য দুটো অন্য দুটো অংশ কোষগুলোকে সরিয়ে ধরে রাখে যাতে রক্ত শোষনে কোন বাঁধা সৃষ্টি না হয়। এই সময় অন্য আরেকটি সূচের মাধ্যমে মশার এক ধরনের কেমিক্যাল নি:সৃত করতে থাকে যার ফলে রক্ত প্রবাহ অব্যহত থাকে।
মশার শুঁড় ও সূচ (প্রবোসিস ও ফ্যাসিকল)
বিস্ময়ের বিষয় হল মশা ত্বকে সূঁচ প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াতে অত্যন্ত কম বল (Little Force) ব্যবহার করে । এটা সম্ভব হয় সূঁচটির অত্যন্ত ক্ষুদ্র, সূক্ষ্ণ ও সুনির্দিষ্ট গঠন এবং মশার সূঁচ প্রবেশ করানো দক্ষতার কারণে (২)।
পাঠক চিন্তা করে দেখুন মশাকে তার শুঁড় মানুষের ত্বকে প্রবেশ করাতে হলে কি কি করতে হবে? প্রথমত, ত্বকের গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ কৈশিকরক্তনালীগুলো কোন লেয়ারে থাকে তা জানতে হবে। এপিডার্মিস লেয়ারে প্রবেশ করাতে হলে তাকে কতটুকু ফোর্স দিতে হবে তা জানতে হবে। কতটুকু গভীরে প্রবেশ করতে হবে তার উপর নির্ভর করবে তার সূঁচের দৈর্ঘ্য। সূঁচের মত ধারালো সাকশন মেশিন দরকার সেটা জানতে হবে এবং এভাবে লিস্ট করতে থাকলে হয়ত কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলা যাবে।
আপনাদের কি ধারণা মশা একা একা এটা চিন্তা করে বের করে এই গঠন বানিয়ে নিয়েছে। নাকি ‘অন্ধ’ প্রকৃতি (blind nature)-র এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ায় এই গঠন একা একা তৈরী হয়েছে? নাকি এই গঠনের পিছনের আছেন অতি বুদ্ধিমান কোন স্বত্ত্বা যিনি একই সাথে উভয়েরই সৃষ্টিকর্তা?
তবুও কি আমরা স্রষ্টার অনুগত হব না?
রেফারেন্স:
১. Ramasubramanian MK, Barham OM, Swaminathan V. Mechanics of a mosquito bite with applications to microneedle design. Bioinspiration and Biomimetics. 2008;3(4).
২. Kong XQ, Wu CW. Mosquito proboscis: An elegant biomicroelectromechanical system. Phys Rev E – Stat Nonlinear, Soft Matter Phys. 2010;82(1):1–5.
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা মানুষকে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ব্যপারে বার বার তাকিদ দিয়েছেন। একই সাথে তিনি মানুষের অন্তরে স্রষ্টা সম্পর্কে ফিতরাহ দিয়েছেন। বুদ্ভিমত্তা ও ফিতরাহ ব্যবহার করে একজন মানুষ তার স্রষ্টাকে সহজেই চিনতে পারে। এ কারণে তিনি কোন কোন জায়গায় মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন। কোথাও মানুষের নিজের গঠনের ব্যপারে চিন্তা করতে বলেছেন। আবার কোন জায়গায় ছোট-বড় বিভিন্ন প্রানীর উপমা টেনে উক্ত প্রাণীর সৃষ্টিশৈলী নিয়ে গবেষণা করে সত্য সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনিত হতে উৎসাহিত করেছেন। কোরআনের শুরুর দিকে সুরা বাকার ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ এরকম একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে বলছেন-
“অবশ্য আল্লাহ লজ্জা করেন না মশা বা তার চেয়ে তুচ্ছ কোন জিনিসের দৃষ্টান্ত দিতে ৷ যারা সত্য গ্রহণকারী তারা এ দৃষ্টান্ত –উপমাগুলো দেখে জানতে পারে এগুলো সত্য, এগুলো এসেছে তাদের রবেরই পক্ষ থেকে, আর যারা (সত্যকে) গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় তারা এগুলো শুনে বলতে থাকে , এ ধরনের দৃষ্টান্ত –উপমার সাথে আল্লাহর কী সম্পর্ক ?” (১)
চলুন মশার গঠন নিয়ে ভেবে দেখি এতে আমাদের জন্য কি চিন্তার উপাদান আছে।
দৈনন্দিন জীবনকে দূর্বিষহ করার জন্য মশার মত ছোট প্রাণীই যথেষ্ট। আর্থোপোডা গোত্রের এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি ডেংগু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি প্রাণঘাতী রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। ফলে আমাদের প্রতি সন্ধ্যার রূটিন হয় মশা থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় উপকরণ ব্যবহার করা। অধিকন্তু, প্রতিদিনের অসংখ্য অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে আমাদের সাবকনসাশ ব্রেইন চমৎকারভাবে ইগনোর করতে পারে। এ কারণে আমরা মনে করি মশা নিয়ে আলাদা ভাবে ভাববার কি আছে?
কিন্তু, বিজ্ঞানীরা সবকিছু ভিন্নভাবে চিন্তা করেন। তারা মশার গঠন ও জীবনপ্রণালী থেকে শুরু করে মশা কিভাবে রক্তচুষে এবং কিভাবে উড়ে বেড়ায় তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন।
যে কোন উড্ডয়নশীল প্রাণীর জন্য একটা বড় বিষয় হল তার এরোডাইন্যামিক্স। অর্থাৎ কিভাবে সে মাটিতে বসা থেকে উড়তে শুরু করে, কিভাবে সে বাতাসে উড়ে বেড়ায় এবং কিভাবে সে উড়ন্ত অবস্থা থেকে অবতরণ করে। আমরা জানি পাখিদের উড়ার কৌশল নিয়ে গবেষণা করতে করতেই উড়োজাহাজের আবিস্কার হয়েছে।
পাখির তুলনায় কিটপতঙ্গের উড্ডয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল কিটপতঙ্গ পাখা ঝাপটে বাতাসে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে। এ ধরনের উড়াকে বলে হোভারিং। এর বাইরেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া, পাশে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের উড্ডয়ন আছে যা আমরা প্রতিদিনই দেখি।
আমাদের হাত পা নাড়াচারা করতে যেমন অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট মাংসপেশী লাগে। কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও উড়ার জন্য মাংসপেশী প্রয়োজন। কিছু কিছু কীটের পাখার জন্য আলাদা মাংসপেশী আছে এবং কিছু কীটের ক্ষেত্রে উক্ত মাংসপেশী থাকে বুকে। এদের ক্ষেত্রে পাখাদ্বয় পিঠে লাগানো থাকে। মাংসপেশীর সংকোচন ও প্রসারনের মাধ্যমে বক্ষপিঞ্জরের সংকোচন ও প্রসারন হয়। ফলে সংযুক্ত পাখাদ্বয় ঝাপটাতে থাকে। (২) আমাদের আলোচ্য মশা শেষের উল্লিখিত পদ্ধতিতে উড়ে বেড়ায়।
মশার প্রায় স্বচ্ছ ও ক্ষুদ্র দুটো পাখা আছে, যা সুনির্দিষ্ট ব্যাসাল গঠন দিয়ে থোরাক্সের সাথে লাগানো থাকে। সুনির্দিষ্ট বললাম এই জন্য যে অন্যান্য কীটপতঙ্গের তুলনায় মশার পাখার বেজ এ গঠনের পার্থক্য আছে (৩)।
কীট পতঙ্গ উড়ার সময় পাখা সামনে পিছনে এবং উপরে নিচে এমনভাবে ঝাপটায় যাতে পাখার সামনের দিকের এজ (Edge) বাতাসে এক ধরনের ভর্টেক্স তৈরী করে। যাকে বলা হয় লিডিং এজ ভর্টেক্স। এই ভর্টেক্স পাখা ও শরীরের নিচে গিয়ে কীটের শরীরকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখে। কিন্তু, মশা পাখা এমনভাবে ঝাপটায় যে পাখার সামনে লিডিং এজ ভর্টেক্স এর পাশাপাশি তৈরী হয় পাখার পিছনের দিকে ট্রেইলিং এজ ভর্টেক্স (৪)।
মশাকে ভেসে থাকতে অনেক দ্রুত পাখা ঝাপটাতে হয়। একটা মশা প্রতি সেকেন্ডে ১৬৫ থেকে ৫৮৭ বার পাখা ঝাপটাতে পারে (৩)। এই কারণেই মশা কানের কাছে ঘুরতে থাকলে আমরা ভো ভো শব্দ পাই ও বিরক্ত হই। মশার পাখার শব্দ আমাদের কাছে বিরক্তিকর লাগলেও মশার নিজের কোর্টশিপের (যৌনমিলন) জন্য এটি জরুরী। এমনকি কোর্টশিপের সময় মশার তার পাখার ঝাপটানোর ফ্রিকোয়েন্সী নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে শব্দের টোন পরিবর্তন করে (৫)।
প্রিয় পাঠক এবার চিন্তা করে দেখুন একটা মশাকে শুধুমাত্র উড়ার সক্ষমতা দেয়ার জন্য কতগুলো জিনিস জানতে হবে- বাতাসের ফিজিক্স, মশার পাখার বিস্তৃতি কতটুকু হওয়া যাবে, পাখা ঝাপটানোর স্পিড কতটুকু হতে হবে, পাখার ঝাপটানোর দিক কেমন হওয়া চাই, পাখার ঝাপটানোর জন্য থোরাক্সের মাংসপেশী কতটুকু হতে হবে, প্রতিটা ঝাপটার সময় পাখায় অক্সিজেন সরবারহ নিশ্চিত করতে হবে, ঝাপটানো ফ্রিকোয়েন্সী নিয়ন্ত্রনে নিউরোনাল সিগন্যাল কত ফ্রিকোয়েন্সীতে জেনারেট করতে হবে, ইত্যাদি। এই ভাবে যেতে থাকলে লিস্টটা অনেক বড় হবে। এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল সবগুলো গঠন ও ফাংশন একটার সাথে আরেকটা অতপ্রত ভাবে জড়িত হয়ে একটি কমপ্লেক্স সিস্টেম দাড় করিয়েছে।
পরিস্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে এই গঠনের পিছনের সুনির্দিষ্ট ডিজাইন ও পরিকল্পনা আছে। কোন এলপাতাড়ি ও অন্ধ প্রক্রিয়ায় মশার উড্ডয়ন ক্ষমতা উদ্ভব হয়নি।
একটা মশা মানুষকে কুপোকাত করে দিতে পারে। অথচ, আমরা নিজেরা আল্লাহর দেয়া জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা ব্যবহার করে আমাদের স্রষ্টার নিয়মাতকে অস্বীকার করি। নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে ভুলে যাই।
৩. Snodgrass RE. The Anatomical Life of The Mosquito. Smithson Misc Collect. 1959;139(8):65–6.
৪. Bomphrey RJ, Nakata T, Phillips N, Walker SM. Smart wing rotation and trailing-edge vortices enable high frequency mosquito flight. Nature [Internet]. 2017 Mar 29 [cited 2019 Jun 11];544(7648):92–5. Available from: http://www.nature.com/doifinder/10.1038/nature21727
৫. Arthur BJ, Emr KS, Wyttenbach RA, Hoy RR. Mosquito ( Aedes aegypti ) flight tones: Frequency, harmonicity, spherical spreading, and phase relationships . J Acoust Soc Am. 2014;135(2):933–41.