একটি নিঃশ্বাসের মূল্য

একটি নিঃশ্বাসের মূল্য

“এটি একটি ব্যতিক্রম রোগ। মেডিকেল লিটারেচারের এ ধরণের রোগ সম্পর্কিত কোন ঘটনা এ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি”। হাসপাতালের আই. সি. ইউতে শুয়ে থাকা জাফরের সমস্যা সম্পর্কে এভাবেই ব্যাখ্যা করছিলেন কর্তব্যরত ডাক্তার।

জাফর বুয়েটে ইলেকট্রিকাল ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে। প্রায় সপ্তাহখানিক আগেও সে একজন পূর্ণ সুস্থ মানুষ ছিল। তার অন্যসব বন্ধুদের মত সেও নিয়মিত ক্লাস; ক্লাসের বিরতিতে আড্ডা, খেলাধুলা করে যাচ্ছিল।

সম্প্রতি তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে নতুন একটি প্রজেক্টের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের টার্গেট হল একটি রোবট তৈরী করা যা বাসার বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করবে। এ প্রজেক্ট নিয়ে জাফর টিম লিডার হিসেবে একটু বেশীই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বেশী রাত জেগে গবেষণা রত থাকা ওর অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। তবে গত এক মাসে এজন্য স্বাস্থ্য একটু ভেঙ্গে পড়লেও ওর এত বড় অসুখ হবে তা বোঝা যায় নি।

“আমাদের মস্তিষ্কের কাজ হল আমাদের বিভিন্ন অঙ্গের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা। বিভিন্ন অঙ্গের নিয়ন্ত্রণের জন্য মস্তিষ্ককে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা আছে। যেমন মোটর কর্টেক্স এর কাজ হল আমাদের চলাফেরা, নড়াচড়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপণা তৈরী করে তা বিভিন্ন স্থানের মাংসপেশীতে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রেরণ করা। তেমনি কতগুলো অটোনোমাস সেন্টার আছে যেগুলোর কাজ হল আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাংশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যে ফাংশনগুলো সম্পর্কে আমরা সচরাচর সচেতন নই। যেমন, খাদ্য হজম প্রক্রিয়া, শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃদপিন্ডের স্পন্দন, রক্তনালীর চাপ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি।  শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাপারটি ইন্টারেস্টিং। আমাদের অগোচরে আমাদের ফুসফুস অবিরাম নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রশ্বাস নিচ্ছে ও নি:শ্বাস ফেলছে। যদিও আমরা চাইলে আমাদের শ্বাসকে একটি নিদিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । তবে কোন ব্যাক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়লে এ নিয়ন্ত্রনটি পূর্ণ ভাবে সংলিষ্ট অটোনোমাস সেন্টারের কাছে চলে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত সেন্টারটি বিকল হয়ে না পড়ে ততক্ষন তা আমাদের দেহে প্রয়োজনী অক্সিজেন সরবরাহ করে। বিকল হয়ে পড়লে তখন আর্টিফিসিয়াল ভেন্টিলেশন দিতে হয়।  তবে জাফরের ক্ষেত্রে হয়েছে উক্ত ঘটনাটির ব্যতিক্রম। সে তার শ্বাস প্রশ্বাসের অটোনোমাস কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে। কন্ট্রোল তার নিজের সচেতন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এ কারণেই জাফর যেদিন তার কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে সেদিন আপনারা দেখেছেন সে বিছানায় বড় বড় চোখ করে শুয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ পরপর বড় বড় শ্বাস ফেলছে। আসলে এ সময় তার সকল চিন্তাভাবনা তার শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে চলে গেছে। একমূহুর্ত শ্বাস বন্ধ হলে তার মূর্ছা যাওয়ার কথা। হতে পারে সে এর ঠিক আগ মূহুর্তে অজ্ঞান হয়েওছিল। এবং এরপর যখন জ্ঞান ফিরেছে। সে সাথে সাথে সচেতন হয়ে পড়েছে তার শ্বাস প্রশ্বাস সম্পর্কে”।

“তাহলে এখন, ওকে আই.সি.ইউ সাপোর্ট দিতে হচ্ছে কেন?”

“এ অবস্থায় জাফরকে আই সি ইউ সাপোর্ট দিয়ে কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখার কারণ ওকে চিন্তাভাবনার আড়ষ্টতা তথা এককেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি দেয়া, কেননা আমাদের মন এ বিষয়ে হ্যাবিচুয়েটেড নয়। আরেকটি বিষয় হল ওকে যে কোন মূহুর্তে শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার রিস্ক ও ভয় থেকে অব্যাহতি দেয়া ”।

“এর কি কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই?”

“যেহেতু ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নুতন সুতরাং এটা নিয়ে আমরা বিদেশী ডাক্তারদের একটি টিমের সাথে যোগাযোগ করেছি। এ বিষয়ে আমাদের একটি বোর্ড বসেছিল। বোর্ডের আলোচনার সিদ্ধান্ত হল: এটার কোন মেডিকেশন বর্তমানে নেই। এখন শুধু বাহির থেকে সাপো্র্ট দেয়া আর স্রষ্টার উপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন উপায় নেই। যদি তার অটোনোমাস কন্ট্রোল যেভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোন কারণ ছাড়াই চলে গেছে একই ভাবে যদি স্বয়ংক্রিয় ভাবে ফিরে আসে তবেই কেবল ও বাঁচতে পারবে”।

(হাসপাতালের বেডে জাফর। প্রশ্বাস….. নি:শ্বাস……, প্রশ্বাস….. নি:শ্বাস…., প্রশ্বাস…. নি:শ্বাস……….অবচেতন)

চারিদিকে পুরোপুরি অন্ধকার। দূরে একটু আলো দেখা যাচ্ছে। আমি আলোর কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখি একটি জানালা দিয়ে অন্ধকার ঘরে আলো এসে পড়েছে। আলোর উৎস কি? জানালা দিয়ে ওপাশে তাকালাম। তরুণ বয়সের একটি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে রোবট টাইপের একটি যন্ত্র নিয়ে নাড়াচারা করছে। কি ব্যাপার? ছেলেটি কে? ছেলেটিকে দেখে পলাশের মত মনে হচ্ছে। জানালের পাশে একটি দরজা দেখতে পেলাম। দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। পলাশ আমার দিকে তাকাল। জাফর তুই এসেছিস।  রোবটটি দেখিয়ে বলল, জাফর, দেখ্ তোর দেয়া বুদ্ভিমত আমি রোবটটির পাওয়ার লাইনের একটি কন্ট্রোল রোবটের প্রোগ্রামিং এ যোগ করে দিয়েছি। এখন রোবটটা নিজের প্রয়োজন মাফিক পাওয়ার কম বেশী টানতে পারবে। তবে রোবটটি পুরোপুরি পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করতে পারবে না। বন্ধ করতে চাইলে এলার্ম চালু হয়ে ইমার্জেন্সি পাওয়ার অন হবে। আমি রোবটটিকে কাছে টেনে নিলাম। মনে মনে রোবটটির একটি নাম দিলাম, শুভ। শুভ, তুই জানিস না তুই আমার কত প্রিয়। কত যত্ন দিয়ে আমি তোকে তৈরী করেছি। আমি তোর পাওয়ার সাপ্লাইয়ের তোর একটি স্বাধীন কন্ট্রোল সেট করলাম। তুই পারবি তো তোর নির্ধারিত কাজ করতে।

শুভর সাথে যখন আমি মনে মনে কথা বলছিলাম হঠাৎ পিছনের দিক থেকে একটি বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি একটি বিরাট মাঠ, একদল লোক দৌড়ে মাঠের দিকে ছুটে চলেছে। সবাই সাদা কাফনের কাপর পরা। সবাই কেমন যেন উৎকন্ঠা নিয়ে মাঠে গিয়ে একত্রিত হচ্ছে। দূর থেকে একটি বিয়গলের সুর ভেসে আসছে।

পিছন থেকে পরিচিত কন্ঠের একটি ডাক শুনতে পেলাম। আরে এটা মায়ের কন্ঠ না। মা ডাকছে, জাফর, জাফর। হঠাৎ আসেপাশের সবকিছু যেন শুন্যে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে, কালো হয়ে আসছে। মা, মা, আমাকে ধর আমি তলিয়ে যাচ্ছি।

জাফর চোখ খুলেছে। পাশে তার মা উৎকন্ঠা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। জাফর তার শ্বাস প্রশ্বাসের অটোনোমিক কন্ট্রোল ফিরে পেয়েছে। তার বাইরের সাপোর্টিং রেসপিরেশন অফ করে দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে এভাবে: জাফর অবচেতন হয়ে পড়েছিল। এরই মাঝে হঠাৎ করে ভেন্টিলেশন মেশিন কি একটা ত্রুটি দেখা দেয়। কেউ পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় যখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তখন একটু বাতাস পেলে যেভাবে একজন টান দিয়ে শ্বাস নেয় মেশিন বন্ধ হয়ে গেলে পরে জাফর ঠিক সেভাবে একটি লম্বা টান দিয়ে শ্বাস নিতে শুরু করে। ডাক্তারকে ডাকলে তিনি দেখেন যে জাফরের অটোনমিক কন্ট্রোল ফিরে এসেছে। তিনি অক্সিজেন রেখে বাকি সব খুলে দেন। এর কিছুক্ষন পরেই জাফর তার চেতনা ফিরে পেল।

এখন গভীর রাত। সবকিছু নিরব। জাফর দু রাকাত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করে দুহাত তুলে তার স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে:

“হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমা করতে পছন্দ কর। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। হে আমার স্রষ্টা তুমিই আমাকে কতই না সুন্দর করে সৃষ্টি করেছ। আমি যখন প্রতিটি মূহুর্তে তোমার অবাধ্য হয়েছি। ঠিক মত নামাজ পড়িনি, রোযা রাখিনি। প্রতি পদে পদে তোমার আদেশ অমান্য করেছি। বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, কাজে কর্মে তোমার স্মরণ ছিল না। বুঝে কোরআন পড়িনি। তোমার হুকুমগুলো জানার চেষ্টা করিনি। সেই প্রতিটি মূহুর্তে তুমি তোমার প্রিয় সৃষ্টিকে একটি মূহুর্তের জন্যও ভুলোনি। তুমি আমার অজান্তে আমার শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করেছ। আমার ক্ষুদার অন্ন দিয়েছ। আমার হৃদপিন্ডের নিয়ন্ত্রণ তুমি তোমার হাতে রেখে আমাকে সচল রেখেছ। হে আমার রব, তুমি আমার অন্ধত্বকে দূর করে দিয়েছ। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমার দেয়া প্রতিটি প্রশ্বাসের মূল্য আমি বুঝতে পেরেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও হে গাফুরুর রাহীম”।

প্রতিরাতের মত আজকের রাতও ফজরের দিকে এগিয়ে চলেছে- অঝোর ধারায় কাদছে জাফর।

সমাপ্ত

স্বপ্নভঙ্গ

১.

ধুম শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সজীবের। কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে এল সজীবের সে দিকে কৌতুহল নেই। তার মনে হচ্ছিল সে একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখেছে। সজীব চোখ খোলার চেষ্টা করল কিন্তু আশেপাশে এতটাই অন্ধকার যে সে চোখ খুলেছে কি খুলেনি বুঝতে পারল না। তবে বিষয়টা তাকে অতটা বিচলিত করল না। কারণ, অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় তার আজকের স্বপ্নটা বেশ বাস্তব মনে হচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল যে স্বপ্নের অনেক ঘটনাই তার স্মরণে আছে। হঠাৎ সে খেয়াল করল যে, সে কখন ঘুমিয়েছে, সর্বশেষ সে কি করছিল তা-র কিছুই মনে আসছে না। ‘যাই হোক, এখন ওটা স্মরণ করার দরকার নেই। কি যেন দেখছিলাম স্বপ্নটা?” চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল সজীব।

স্বপ্নটা স্মরণ করতেই সজীবের কেমন যেন আনন্দ অনুভূত হচ্ছিল। ভাবতে ভাবতে সে কল্পনার জগতে ডুবে গেল।প্রথমেই যে দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল- একজন সুন্দর নারী হেসে হেসে তার সাথে কথা বলছে। “এই যে সজীব। আমি এখানে। দেখত ওটা কে?” নারীটার পাশে একজন সুদর্শন পুরুষকে দেখা যাচ্ছে। সে-ও খুব সুন্দর করে হাসছে। কিন্তু এরপর কি হল মনে নেই। দৃশ্যপট পালটে গেল। ছোট্ট একটা মেয়ে মিষ্টি হেসে বলছে, “আমার নাম কথা। তোমার নাম কি?” “আমার নাম…” সজীব নামটা বলতে পারল না। অবাক বিষয় হল স্বপ্নটার মাঝে কেমন একটা ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু কোনা ঘটনাই পুরো মনে আসছে না। এর পরের দৃশ্যে সজীব নিজেকে আবিস্কার করল একটা ক্লাস রুমে। বড় দাড়ি বিশিষ্ট হুজুর গোছের একটা লোক বেশ শব্দ করে পড়াচ্ছে, “তোমার রব কে?” সজীব ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাল। পরক্ষনেই তার মনে হল সে রাস্তা দিয়ে হাটছে।তার পাশে হালকা পাতলা ও লম্বা একটা ছেলে হাটছে। ছেলেটা মোটা গলায় বলল, “সজীব চল, রফিক স্যারের ব্যাচে ভর্তি হই উনি ভাল ম্যাথ পড়ায়”। ছেলেটার কথায় সাড়া না দিয়ে সজীব একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে হল সুমধুর সুরে কোন ঘোষনা হচ্ছে। দৃশ্যপট পাল্টে গেল। সজীব নিজেকে আবিস্কার করল কম্পিউটারের সামনে। সে কারও সাথে চ্যাট্ করছিল। চারিদিকে অন্ধকার, মনে হয় গভীর রাত। আযানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। “এটা কি ফজরের আযান…?” সজীব ঘুমের ঘোরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু পরক্ষনেই সে বিছানা থেকে উঠে বসল। উঠে সে দেখতে পেল একজন সুশ্রী নারী বাচ্চা কোলে তার পাশে বসে আছে। মনে হল যেন শিশুটির প্রতি তার অনেক বছরের মায়া জমে আছে।

সজীব পাশ থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে পাশে তাকাল – একজন বয়স্ক মহিলা একজন বৃদ্ধ লোকের লাশের পাশে বসে কাদছে। সজীবের মনে হল তার চোখেও পানি চলে এসেছে। সজীব হাত বাড়িয়ে তার টলমল চোখ মুছে তাকাতেই লক্ষ্য করল, সে একটা আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে যেখানে একটা বৃদ্ধ লোক, মুখের চামড়া থুবড়ে পড়েছে।  পাশ থেকে কে যেন ডেকে উঠল, “বাবা, খেতে এস”।  আচমকা সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। দূর হতে সাদা আলখেল্লা পড়া দুটো লোক এদিকেই আসছে। কাছে এসে তারা প্রশ্ন করল “তোমার রব কে?” সজীবের মনে হল প্রশ্নটা আগেও কোথায় যেন শুনেছে।

২.

ধুম! আরেকটা বিকট শব্দে ভাবনার ঘোর ভেঙ্গে গেল সজীবের। তার মনে হল, “আমি এ কেমন স্বপ্ন দেখলাম?” সজীবের সাড়া শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, প্রতিটি মাংসপেশীতে ব্যথা হচ্ছে। সে চোখ খুলতে চেষ্টা করল। কিন্তু একটা তীব্র আলো তার চোখে এসে পড়ায় চোখ বুজেই রইল। সে চারিদিকে হাতড়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল । কিন্তু আশে পাশে কিছুই পেল না।

“আমি কি এতক্ষন শুয়ে ছিলাম না বসে ছিলাম?” সে তার অবস্থান বুঝতে পারল না । তারা মনে হল সে দাড়িয়ে আছে। সে আবার চোখ দুটো খোলার চেষ্টা করল। এবার সে চোখ ঠিকই খুলতে পারল তবে যা দেখল তাতে সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে নিজেকে সীমাহীন এক ধুধু প্রান্তরে আবিস্কার করল । হঠাৎ সেই বিকট আওয়াজটি আবার হল। নিজের অজান্তেই সামনের দিকে হাটতে লাগল সে।

৩.

“এই সেই দিন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হয়েছিল”। আকাশে বাতাসে ঘোষনা হচ্ছে। সজীবের সমস্ত শরীর শিহরণে কেপে উঠল। সমস্ত মন ও মগজকে আচ্ছন্ন করে তার উপলব্ধি হল এতক্ষন যাকে সে স্বপ্ন ভাবছিল, যে স্বপ্নিল জীবনটা সে অতিবাহিত করেছে, সেটা ছিল তার ইহলৌকিক জীবন। আজ প্রকৃতই তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তার মনে হচ্ছিল সে পৃথিবীতে অনধিক একটি দিন অতিবাহিত করেছে। কিন্তু এ অল্প সময়ে বর্তমানের প্রস্তুতি সে কি নিতে পেরেছে? একরাশ ভয় আর আতঙ্ক সজীবের মনকে ঘিরে ফেলল।

                                      ……………………

শত সহস্র বিবস্ত্র মানুষ বিস্তীর্ণ ময়দানে জমায়েত হচ্ছে। কিন্তু কেউ কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। কারণ আজ তাদের জীবনে কৃত সব পাপাচারের স্মৃতি একে একে তাদের মনে পড়ে যাচ্ছে। ভয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে সবাই, অপেক্ষা করছে এক অনাগত পরিণতির শংকায় !

                                      ……………………

ফেরা

১.

“কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না?”

দুই হাত দিয়ে মাথা চাপড়ে নিজেকে প্রশ্ন করছে রাজু। প্রচণ্ড অনুশোচনা, ভয় ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে নিজেকে নিজে তীরস্কার করছে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে জল। এই পাপ থেকে বার বার ফিরে আসতে চেয়েও আবার নিমজ্জিত হয়ে যায় সে। যতবারই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, ততবারই আত্মগ্লানীতে নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে তার। পবিত্র হয়। স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু, একটা সময় পরে কি যেন হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোন কোন সময় ঘন্টার পর ঘন্টা সে নষ্ট করে দেয় এই ঘৃণ্য পাপকর্মে।

“এটি আমার জীবনীশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে। আমার স্মরণ শক্তি কমে যাচ্ছে।” প্রতিবার তওবার সময় সে নিজেকে বোঝাতে থাকে।

“কোন বই-এ যেন পড়েছিলাম, ব্রেইনের এডিকশন সাইকেল যে নিউরণগুলো দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই আসক্তি চক্র-ই এই পাপের সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া যারা এই জঘন্য পাপাচারকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তারা এটিতে সেচ্ছায় যায় না। কোন বা কোন ভাবে তাদেরকে প্ররোচিত করা হয়। এইতো কয়েকদিন আগেই একজনের ইন্টারভিউ দেখেছিলাম। আরও অনেক কনফেশন ইন্টারনেট ঘুরলেই পাওয়া যায়। তাহলে কেন আমি নিজেকে বিরত রাখছি না।” নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে রাজু।

“কোন একটা ইন্টারভিউতে শুনেছিলাম- যারা বয়:সন্ধি হওয়ার আগেই এই ধরনের শ্লীলতাহীন চিত্র বা চলচ্চিত্রের সম্মুখিন হয় তাদের মধ্যে এই পাপাচারের আসক্তি তৈরী হয়। আমার ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে দু-একবার দুষ্টুমিচ্ছলে দেখাই কি আমাকে এই চক্রাকার গহবরে নিমজ্জিত করেছে তাহলে?” রাজু ভাবে এবং নানাভাবে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, কয়েকদিন পর আবার ব্যর্থ হয় সে।

প্রতিবার আসক্তির চরম আকর্ষণে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার করার চেষ্টা করে। কিন্তু, এরপরও নিজের সাবকনাশাস আকাঙ্খার তীব্রতাকে অবনমিত করতে ব্যর্থ হয়। “কেন বুঝিনা আমি? ওরা বস্তু না। মানুষ। ওদের ভেতর মন আছে, আত্মা আছে। ওরা শুধু শরীর নয়।”

এ যুগে সবার হাতে হাতে এনড্রয়েড ডিভাইস। খুবই স্বল্প খরচে পাওয়া যায় ইন্টারনেট। ফেসবুকে ভাল কোন পোস্ট পড়লেও হঠাৎ ট্রিগার হিসেবে চলে আসে কোন সুন্দর অবয়ব। ইউটিউবে কোন ভাল ভিডিও দেখার সময়, আটোসাটো জামার বিজ্ঞাপন এসে ছোট্ট করে উদ্দীপনা দিয়ে যায়। এরপর আপাত পরিচ্ছন্ন নাটক, নাটক থেকে আধেক পোশাকের সিনেমা, সিনেমা থেকে পাপের সাগরে হাবুটুবু। এরপর অনুশোচনা আর আত্মগ্লানি। এই ভয়ংকর নষ্ট সিকোয়েন্সে রাজুর জীবনটা আজ বন্দী।

“তাহলে কি আমার বিয়ে করা উচিৎ? সেদিন একজন একটা ভিডিওতে বলছিল যে সে বিয়ে করার পর এই জঘণ্য অপরাধ থেকে মুক্তি পেয়েছে।” এই পাপাচার থেকে বের হয়ে আসার একটা পথ খুঁজতে থাকে রাজু। “কিন্তু আমি পড়াশোনা শেষ না করে কিভাবে বিয়ে করবো? একটা ভালো আয়ের উৎস না হলে কিভাবে বাবা-মাকে বলবো? একদিকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছি না। অন্যদিকে বিয়ে করার সুযোগ নেই।” ভেবে কোন কুল কিনারা বের করতে পারে না সে। লজ্জা ও সামাজিক তিরস্কারের অজানা ভয়ে কারও সাথে তার আসক্তির কথা বলতেও পারে না।

এভাবে কতটা সময় চলে যায়। এক রাশ মুক্ত বাতাসের খোঁজে রাজু অন্ধকারে পথ হাতরে বেড়ায়।
…..

২.

একটি সুন্দর মলাটের বই হাতে বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে আছে রাজু। “‘মুক্ত বাতাসের খোঁজে’- আহ কি সুন্দর নাম। আসলেইতো আমি বন্দী। একটি বদ্ধ ও অন্ধকার জগতের গুমোট বাতাসে প্রশ্বাস নিই আমি। কতদিন বুক ভরে স্বচ্ছ বাতাস নেই না।” রাজুর গাল বেয়ে নোনা জল পড়তে থাকে। “এত চমৎকার বই এতদিন কেউ লেখেনি কেন? কেন আগে জানতে পারিনি সিরিয়াল কিলার থেকে রাক্ষুসে ধর্ষক সবাই এই পাপাচারেরই পরিনতি।”

বই থেকে টিপস নিয়ে কাজে নেমে পড়ে রাজু।
-নামাজ পড়া
-রোজা রাখা
-কোরআন বুঝে পড়া এবং তার মজা অনুধাবন করা
-মাথায় নষ্ট চিন্তা আসলে অন্য দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করা
-অশ্লীল সাইটগুলো ব্লক করে রাখা
-নিজেকে প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত রাখা
-লক্ষ্যভিত্তিক রূটিন জীবন যাপন

৩.
চার মাস পর..

অনেকদিন পর রাজু হৃদয়ে শান্তি অনুভব করছে। মনে হচ্ছে যেন এক মুঠো আলো কেউ বুকে ঢেলে দিয়েছে। নি:শ্বাসের সাথে মুক্ত ও পরিস্কার বাতাস আদান-প্রদান হচ্ছে। অনেক সাধনা, অনেক আত্মত্যাগ, অনেক নিয়ন্ত্রণ ও প্রচন্ড মানসিক পরিশ্রমের পর আজ সে মুক্ত।

আজ বেলা ফুরাবার আগে তার মনে হচ্ছে যেন তার জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছে। যে অধ্যায়ে একজন মানবের গল্প নতুন করে বলা হবে।

আজ মনের অবারিত আনন্দে সেজদায় গিয়ে অঝোড় ধারায় কাঁদবে সে। এ কান্না আনন্দের, এ অশ্রু প্রশান্তির।

ভাষা

“শুনেছি গতকাল রাতে টেক্সাসের আকাশ থেকে নাকি একটা বড় পাথর খণ্ড পড়েছে।” কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ফিওনা। রবার্ট ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল-

“খবর নিয়ে দেখো হয়ত ফেইক নিউজ হবে।”

“ফেইক না। সত্যি। ভাল ভাল চ্যানেলগুলোতে দেখাচ্ছে। এছাড়া পাথর খণ্ডটি কোন সাধারন পাথর বলে মনে হচ্ছে না।..”

“কেন? ইউরেনিয়াম পাথর নাকি? মানে দামী কোন পাথর?” মুখের কথা কেড়ে নিলো রবার্ট।

“তুমি আমার কোন কথাই শেষ করতে দাও না। আগে আমাকে বলতে দাও।”

“আচ্ছা, বল।”

“শোন। শুধু যে পাথর পাওয়া গেছে তা নয়, পাথরে বিভিন্ন ধরনের লেখা পাওয়া গেছে? সরকারী অনুসন্ধানকারী বাহিনী গবেষণায় লেগে পড়েছে। অন্যদিকে ‘Search for Extraterrestrial Intelligence’ তথা ‘SETI’ (সেটি)-কেও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে উন্নত বুদ্ধির এলিয়েন লাইফ ফর্ম-এর খোঁজে।”

“কিন্তু, তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে পাথরে লেখা পাওয়া গেছে?” এক মগ ধুমায়িত কফি হাতে নিয়ে সোফাতে আরাম করে বসল রবার্ট।

ফিওনা রবার্টের হাত থেকে আরেকটি কফির মগ নিয়ে রবার্টের মুখোমুখি বসে উত্তর দিতে লাগল, “টিএনএন-এ পাথরটার একটি ছবি দেখিয়েছে। ওটাতে বিচিত্র কিছু দাগ আছে। তারা বলেছে এগুলো পৃথিবীর পরিচিত কোন ভাষার বর্ণমালার মত না।”

“হতে পারে দাগগুলো জাস্ট ঘষায় ঘষায় তৈরী হয়েছে। এটা যে বর্ণমালাই হবে এটা তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে?”

“আরে, আমি কি নিশ্চিত হয়েছি নাকি। ওরা যা বলেছি আমি তোমাকে তাই বললাম।”

কফির কাপে একবার চুমুক দিয়ে নড়েচড়ে আরাম করে বসে নিলো রবার্ট। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোন আলোচনা শুরু করবে। বলল-

“আচ্ছা ঠিকাছে, ধরে নিলাম ওরা যা বলছে তা ঠিক। কিন্তু, চলো আমরা একটু ভেবে দেখি দাগ গুলো কি অর্থপূর্ণ কোন বর্ণমালা হওয়া সম্ভব কিনা।” ফিওনার এই সব গুরুতর আলোচনা মজা লাগে না। কিন্ত, আজকের ঘটনাটা একটু বেশী ইন্টারেস্টিং হওয়ায় সে রাজী হল।

“ঠিকাছে।”

“চিন্তা করে দেখ, আমরা যখন কোন কিছু লেখি তখন আমাদের বর্ণগুলো কি ধরনের ধারায় সাজানো থাকে? এগুলো একেবারে এলোমেলো বা র‍্যানডম হয় না আবার এগুলো যে একেবারে পর্যাবৃত্ত বা পিরিয়ডিক তাও না।”

ফিওনা একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা, পর্যাবৃত্ত বলতে কি বুঝাচ্ছো।”

রবার্ট কফির কাপটা সামনের টি-টেবল-এ রেখে পাশের ঘরের টেবিল একটা খাতা এবং পেনসিল নিয়ে আসল। এরপর সে খাতার মধ্যে তিনটা বাক্য লিখল-

কখ গজ সহ হজ রত রততসফ (১)

খগ খঘ খগ খগ খঘ খগ খঘ (২)

আমি তোমাকে ভালোবাসি (৩)

লেখা শেষ হলে খাতাটা দেখিয়ে ফিওনাকে রবার্ট বলতে লাগলো-

“দেখো ১ নং লেখাটা পুরোপুরি এলোমেলো। যার কোন অর্থ নেই। এটি হল অক্ষরের র‍্যানডম বিন্যাস। ২নং লেখাটাই হলো পর্যাবৃত্ত লেখা। অর্থাৎ ‘খগ খঘ’ অক্ষর চারটি বার বার ফিরে আসছে বা রিপিট হচ্ছে। আর, ৩নং লেখাটা একটি অর্থ বহন করছে।”

৩নং লেখাটা পড়ে ফিওনার মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। তবে সে আলোচনায় থাকার জন্য ভেবে বলল- “আচ্ছা ৩নং বাক্যটিকেও তো কার্যতো এলোমেলো বলা যায়, তাই না। আসলে আমরা এটাকে একটি অর্থ দিচ্ছি বা এভাবেই অর্থ দেয়া শিখে এসেছি এ কারণে আমাদের কাছে ৩নং বাক্যটি অর্থপূর্ণ লাগছে।”

রবার্ট ফিওনার ধীশক্তি দেখে খুশি হল এবং বলল- “তুমি ঠিক ধরেছো। আচ্ছা চলো আমি তোমাকে আরেক ভাবে লিখে দেখাই।”

১৩৫৪৩২১২৩৭৯ (৪)

১২৩১২৩১২৩১২৩ (৫)

০১১২৩৫৮১৩২১ (৬)

“দেখোতো এই তিনটার মধ্যে কি পার্থক্য আছে?” ফিওনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল রবার্ট।

ফিওনা কিছুক্ষন অংকগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলো- “এখানে ৪নং বাক্যে জাস্ট কতগুলো র‍্যানডম সংখ্যা আছে। ৫নং বাক্যে ‘১২৩’ পর্যাবৃত্তভাবে আছে। তবে ৬নং বাক্যটাও কেমন জানি র‍্যানডম মনে হচ্ছে।”

“তুমি নিশ্চিত যে ৬নং বাক্যটা র‍্যানডম?”

“আমি ঠিক নিশ্চিত না। তবে ধরতে পারছি না।”

“আচ্ছা আমি বলছি দাড়াও। ৪ ও ৫নং বাক্যের ব্যাপারে তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু, ৬নং বাক্যে দেখ ১ এর পরে আছে ২, তারপর ১+২ = ৩, তারপর ৩+৫=৮, ৫+৮=১৩, এবং ৮+১৩= ২১। এটাকে বলে ফিবোনাচ্চি সিরিজ। এই সিরিজের একটি বৈশিষ্ট্য হল পরের সংখ্যাটি দিয়ে পূর্বের সংখ্যাটি ভাগ করলে একটি নির্দিষ্ট রেসিও পাওয়া যায় যার মান হচ্ছে ১.৬১৮০.. । এই রেসিওকে বলে গোল্ডেন রেসিও।”

“মজারতো।” ফিওনা খুব আগ্রহ ভরে শুনতে লাগল।

“সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কোন লেখাতে কোন বর্ণের বিন্যাস তিন রকম হতে পারে- র‍্যানডম, পিরিওডিক এবং ‘প্যাটার্ন’-যুক্ত লেখা। এর মধ্যে র‍্যানডম ও পিরিওডিক লেখা সহজে পার্থক্য করা যায়। কিন্তু, র‍্যানডম ও প্যাটার্নযুক্ত লেখা পার্থক্য করার উপায় হল উক্ত প্যাটার্ন বা ঢং- সম্পর্কে আগে থেকে পরিচিতি থাকা। অর্থাৎ, ৬নং লেখায় অতিরিক্ত এক ধরনের তথ্য আছে যাকে বলা যায় প্যাটার্নের তথ্য।”

ফিওনার চেহারা দেখে মনে হল ও একটু এলোমেলো হয়ে গেছে। তবু কিছুক্ষন ভেবে বিষয়টা বুঝতে পারল। এরপর রবার্টের হাত থেকে কলমটা নিয়ে আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে লিখতে আরম্ভ করল-

///\\[[/[][ (৭)

///\\\///\\\///\\\ (৮)

/\\/\//\//\//\//\\/\/ (৯)

বেশ কিছুক্ষণ পর লেখা শেষ করে রবার্টকে বাক্যগুলো দেখিয়ে বলল- “আসলে এতক্ষণতো আমরা আমাদের পরিচিত বর্ণমালা নিয়ে কথা বলছিলাম। এজন্য বিষয়টি খুব পরিচিত বা সহজ মনে হচ্ছিল। ধরো, আমরা এরকম একটি ভিন দেশী বর্ণমালার কথা চিন্তা করছি। তাহলে হয়ত বিষয়টির খুঁটিনাটি বোঝা যাবে।”

রবার্ট ফিওনার বুদ্ধি দেখে স্তম্ভিত হয়ে মনে মনে ভাবল- আসলেই তো তাই। ফিওনার দিকে খুশি মনে তাকিয়ে বলল- “দেখো ৮নং লেখাতে রেখাগুলোর বিন্যাস স্পষ্টতই পর্যাবৃত্ত। কিন্তু, ৭নং এবং ৯নং লেখায় রেখাগুলোর বিন্যাস এলোমেলো। কিন্তু, ৯ নং লেখার দিকে গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে এক ধরনের প্যাটার্ন লক্ষণ করা যায়। তুমি আসলেই কি ৯নং লেখায় কোন প্যাটার্ন দিয়েছো?”

ফিওনা কফির কাপে শেষু চুমুকটা দিয়ে বলল- “তুমি চেষ্টা করে দেখো না বের করতে পারো কিনা?”

রবার্ট বলল “আচ্ছা, আমি ভেবে দেখছি সময় দাও।” রবার্টকে ভাবার সময় দিয়ে ফিওনা শূণ্য কফির মগদুটো নিয়ে রান্না ঘরে ধুয়ে রেখে আসতে গেলো। কফির কাপ ধোয়া শেষে রাতের খাবার গরম করার ব্যবস্থা করে ফিরে এসে দেখে রবার্ট এখনও ভাবছে।

“কি, এখনও বের করতে পারো নি?”

“ওয়েইট, মনে হয় বুঝতে পেরেছি। ‘/’ কে ‘১’ এবং ‘\’ কে ‘০’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে ৯নং বাক্যটি হয়-

১০০১০১১০১১০১১০১১০০১০১

একে ডেসিমেলে রূপান্তর করলে হয়- ১২৩৫৮১৩। অর্থাৎ, ফিবোনাচ্চি নাম্বার, শুধুমাত্র সামনের ০ ও ১ বাদ দিয়ে। বেশ কঠিন একটি কাজ করে ফেলেছো তো।”

রবার্টের কথা শুনে ফিওনা দুই কাধ নাড়িয়ে বলল-“ফিওনার জন্য এগুলো পানি-ভাত।”

“হা হা হা।” রবার্ট ফিওনার ভাব দেখে জোড়ে হেসে উঠল। বলল- ” আচ্ছা। এখন ভেবে দেখো এই তিন ধরনের লেখাই কিন্তু কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার দ্বারা লেখা সম্ভব। কিন্তু, প্রাকৃতিক নিয়ম বা ফোর্সগুলোর মাধ্যমে শুধুমাত্র অক্ষরের র‍্যানডম ও পর্যাবৃত্ত বিন্যাসগুলো সম্ভব। এমনকি পর্যাবৃত্ত গঠন এমনও হতে পারে যা আপাত দৃষ্টিতে জটিল। কিন্তু, যা আসলে একটু উচু মাত্রার সুশৃংখল ও পর্যায়ক্রমিক বিন্যাস। তবে রেখার বিন্যাসে কোন সুনির্দিষ্ট অর্থবহ প্যাটার্ন কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বা ছাড়া তৈরী হওয়া সম্ভব না।”

ব্যাপারটা ধরতে পেরে ফিওনা বলল- “তার মানে টেক্সাসের পাথরটাতে যে রেখা পাওয়া গেছে, তাতে যদি সুনির্দিস্ট প্যাটার্ন পাওয়া তখনই ধারণা করা যাবে যে উক্তর রেখাগুলো আসলে কোন উন্নত জীবের বর্ণমালা, ঠিক?”

“হ্যা। একদম ঠিক। ইন ফ্যাক্ট, SETI-র কাজও তাই। ওরা ধরে নেয় যে যদি কোন উন্নত জীব আমাদের পৃথিবীতে সিগন্যাল পাঠায় তারা অন্তত আমাদের মত বুদ্ধিমান হবে। সুতরাং, তারা চেষ্টা করবে কোন অর্থবহ সিগন্যাল পাঠানোর জন্য। এক্ষেত্রে ‘গনিত’ হচ্ছে সবচেয়ে সহজ উপায়। কারণ, ‘গনিত’ এক বিমূর্ত তথা অ্যাবস্ট্রাক্ট জগতের ভাষা। সুতরাং, উক্ত ভিন্নভাষী এলিয়েনরা নিশ্চয় কোন মৌলিক সংখ্যা বা ফিবোনাচ্চি নাম্বারের সিরিজ পাঠাবে। আবার, এক্ষেত্রে সহজ উপায় হচ্ছে সংখ্যাগুলোকে তুমি যেভাবে বাইনারীতে রূপান্তর করেছো সেভাবে বাইনারীতে পরিণত করে পাঠানো। কারণ এক্ষেত্রে জাস্ট দুই ধরনের সিগন্যাল সুনির্দিষ্ট বিরতিতে পাঠালেই হবে। বুঝলে?”

ফিওনা স্থিত হয়ে বলল “হ্যা বুঝতে পারলাম বিষয়টা। তার মানে হচ্ছে, আমরা কোন স্থানে বা গঠনে যদি কোন রেখা বা বস্তুর র‍্যানডম বা পর্যায়বৃ্ত্ত বিন্যাস না দেখে পরিচিত প্যার্টার্ন-যুক্ত বিন্যাস সন্দেহ করি। তাহলে ধরে নেয়া যায় যে-এর পিছনে কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার উপস্থিতি আছে। এবং উক্ত বুদ্ধিমান সত্ত্বা কমপক্ষে মানুষের মত উন্নত বুদ্ধি ধারণ করে।”

“তুমি খুব সুন্দর ভাবে আমাদের আলোচনার সারসংক্ষেপ করেছো।”-রবার্ট খাতাট টি-টেবল-এর রাখল আর বলল- “চল, এবার রাতের খাবারটা খেয়ে নি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”

ফিওনা রবার্টের সাথে সম্মত হয়ে আলোচনার ইতি টানলো এবং টেবিলে খাবার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে গেলো।

এক মাস পর..

“ব্রেকিং নিউজ! টিনএনএন-এর রাত ৮-টার সংবাদে আমি মিরা বলছি। গত এক মাস আগে যেই পাথরটা টেক্সাসের আকাশ থেকে জমিতে পড়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল সেই পাথরটার গায়ে অংকিত রেখাগুলোর অর্থ উদ্ধার করা গেছে বলে দাবী করেছেন গবেষকরা। যদিও তার এই মূহুর্তে এতে কি লেখা আছে বলতে চাচ্ছে না। আমরা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি যে এখানে রেখাগুলোতে কতগুলো সংখ্যা লেখা আছে, যা আমাদের পরিচিত ফিবোনাচ্চি নাম্বারের মত।…”

সংবাদটা শোনার পর থেকে ফিওনার গা শিউরে উঠেছে। গায়ের সমস্ত লোম দাড়িয়ে গেছে। তাহলে কি পৃথিবীর বাইরে কোন বুদ্ধিমান প্রাণী আছে যারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে? যদি থাকে তারা কেমন? তারা কি মানুষের মত যুদ্ধপ্রবণ। তারা কি পৃথিবী আক্রমণ করতে আসছে? ফিওনার মনে নানা কল্পনা খেলা করছে। আর ভয় এবং কৌতুহলের এক মিশ্র অনুভূতি ঘিরে রেখেছে তাকে।

পৃথিবী এগিয়ে চলছে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে….

উপলব্ধি

এক.

প্রচণ্ড মন খারাপ লাগছে শৈবালের। মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। মেডিকেল থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই ওর বাবা মারা যায়। ফলে স্কুল পড়ুয়া ছোট দুই বোন এবং মা-সহ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ওর ওপর। একটা পার্টটাইম জব করে এবং দুটো টিউশনি করে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া এবং সংসারের খরচ বহন করার চেষ্টা করে। তারপরও মাস শেষে হাতে টাকা থাকে না অনেক সময়। তাই মাঝে ইচ্ছে না থাকলেও ঋণ নিতে হয়ে।

এ জমানায় কেউ টাকা ধার দিতে চায় না। আর ধার দিবেই বা কি করে? ও যাদেরকে চেনে তাদের সবারই খুব হিসেব করে চলতে হয়। তবে যারা বেহিসেবী খরচ করে তারা ধার দেয় সুদে।

গতকাল রাতে একজন পাওনাদারের সাথে কথা ফোনে কাটাকাটি হয়েছে শৈবালের। লোকটা টাকা ফেরৎ দেয়ার সময় হবার আগেই টাকা চেয়ে বসেছে। এদিকে মাসের শেষ সময় চলছে। ও কোথা থেকে টাকা দেবে? এইসব ভেবে রাতের ঘুমটা ভাল হয়নি। তাই সকাল থেকেই মেজাজটা খিটখিটে হয়ে আছে শৈবালের। কেমন যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। পৃথিবীর সবকিছুকেই অসহ্য মনে হচ্ছে ওর। প্রতিদিনের রূটিন মত আজকেও সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছে । কিন্তু, ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে নাস্তা রেডী হয়নি। মা’র সাথে রাগ করে বাসা থেকে না খেয়েই বের হয়ে যায়।

‘ওই খালি, যাবা?’

‘কই মামা?’

‘ঢাকা মেডিকেল।’

‘যামু।’

‘ভাড়া কত?’

‘পঞ্চাশ টাকা?’

‘পঞ্চাশ টাকা মানে? মগের মুলুক পাইছো? আজিমপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল পঞ্চাশ টাকা?’

‘মামা, যে জ্যাম দেখছেন? পঞ্চাশ টাকা না গেলে পুশাইবো না।’

শৈবালের মেজাজ আরও গরম হয়ে যায়। ও রিকশায় না উঠে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটার সময় এলোমেলো ভাবনা আসতে থাকে মনে। ভাবে- কেন এত গরীব হলাম? বাবার এ সময়েই মৃত্যু হল কেন? আল্লাহ কেন আমাদের এত কষ্ট দিলেন? ওর সম্পদশালী বন্ধুদের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে পলাশীর দিকে আসার সময় ওর চোখের সামনে হঠাৎ একটা মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সিডেন্ট করে। মোটর সাইকেলটা সামনের একটি রিকশায় জোড়ে ধাক্কা দেয়। ফলে রিকশাটা উল্টে যায়। রিকশাচালক এবং যাত্রীরা দূরে ছিটকে পড়ে। মোটর সাইকেল আরহী প্রচণ্ড বেগে সামনে গিয়ে আছড়ে পড়ে। সাথে সাথে তাদের সাহায্য করার জন্য মানুষজন জটলা পাঁকাতে শুরু করে । শৈবাল দ্রুত কাছে দৌড়ে যায়।

রিকশাচালক এবং যাত্রী অপেক্ষাকৃত কম আঘাত পেয়েছে। তারা উঠে দাড়িয়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। ঐদিকে মোটর সাইকেল আরোহীর নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। শৈবাল সাথে সাথেই পালসটা চেক করার জন্য সামনে আগায়। দেখে পালস এখনও চলমান। সে আরেকজন ব্যক্তির সহায়তায় লোকটাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়।

মেডিকেলে ভর্তি করার পর লোকটার আত্মীয়সজনের নাম্বার যোগার করে তাদের খবর পাঠানো হয়। তারা হাসপাতালে আসলে শৈবাল ওর ওয়ার্ডে ক্লাস করার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। শৈবালের যে ওয়ার্ডে ক্লাস আছে সেখানে যাবার পথে পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যেতে হয়। ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওর চোখে পড়ে একজন মা পরম যত্নে তার শিশুকে আগলে রেখেছে। শিশুটির খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। তাকে অক্সিজেন দেয়া আছে এবং বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। শিশুটিকে মা তার কোলে নিয়ে বুকের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসিয়ে রেখেছে। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে রাজ্যের ঘুম এসে যাচ্ছে তার চোখে। কিন্তু বাচ্চাকে খেয়াল রাখতে গিয়ে সে ঘুমাতে পারছে না।

হঠাৎ করে ওর মা’র কথা মনে পড়ে। আজকে সকালে রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলো ও। অনুশোচনায় চোখে পানি চলে আসে ওর। ভাবতে থাকে আজকের দূর্ঘটনার শিকাড় ওই হতে পারতো। কিন্তু, আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ভাবতে ভাবতেই দেখে নিউরোসার্জারী বিভাগে তরুণ একটি ছেলে অসুস্থ হয়ে এলোমেলো বকছে। তাকে ঘিরে ডিউটি ডাক্তাররা রাউণ্ডে আলোচনা করছে। ও শুনতে পেলো ছেলেটার সাবঅ্যারাকনয়েড হিমোরেজ হয়েছে। রোগটা কি শৈবাল জানে। কারও কারও মাথার রক্তনালীতে এক ধরনের অস্বাভাবিক বর্ধিকাংশ থাকতে পারে। যাকে বলা হয় এনিউরিজম। অনেক সময় এগুলো ফেটে ব্রেইনের ভিতরে রক্ত জমা হয়। তরুণ বয়সেও এই রোগ হতে পারে।

শৈবাল উপলব্ধি করে এই রোগটি ওরও হতে পারতো। শুধু তাই না। এই যে অগনিত কঠিন রোগ সম্পর্কে ও পড়ছে এগুলোর যে কোনটি ওর হতে পারতো। শৈবাল বুঝতে পারে যে আসলে সে ভালো আছে। অন্য অনেকের চেয়ে ভালো আছে সে। মনটা ভালো হয়ে যায়। মনের গভীর থেকে প্রশান্ত চিত্তে বলে ওঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’!

দুই,

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আস্তে করে মায়ের রুমে যায় শৈবাল। সালাম দিয়ে ঢোকার অনুমতি নেয়। ছলছল চোখের মায়ের মুখের দিকে তাকায় একবার । চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারে না। মা’র পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিছু বলতে পারে না।

মা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘কেঁদো না বাবা। ধৈর্য্য ধরো। আল্লাহ সব সহজ করে দিবেন।’

মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন: আদৌ কি সম্ভব? (পর্ব ২)

বিবর্তনতত্ত্বের পপুলারাইজারদের মতে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন হবার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কেননা ম্যাক্রোইভলুশন না হলে আমরা আজ এখানে বসে আলোচনা করছি কিভাবে? ম্যাক্রোইভলুশনের কারণেই তো মানুষ এসেছে, তাই না?

কিন্ত, একাডেমিয়াতে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যারা বিবর্তনের ম্যাকানিজমের সমালোচনা করেন, তাদের সকল একাডেমিক ডিবেটগুলো মূলত এই জায়গাটাতেই।

বস্তুত, The Third Way  গ্রুপটি তৈরী হয়েছে এমন একদল বিজ্ঞানী নিয়ে যারা ইভুলশনারী সিনথেসিস (নিও-ডারউইনিজম)-এর বর্ণীত ম্যাকানিজম (র‍্যানডম মিউটেশন, ন্যাচারাল সিলেকশন, জেনেটিক ড্রিফট, জিন ফ্লো, হিচহাইকিং, ননর‍্যানডম মেটিংপ্রভৃতি)-কে অপর্যাপ্ত মনে করেন।

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন প্রবক্তা এবং কয়েকজন ইনডিভিজুয়াল রিসার্চারদের গবেষণা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রস্তাবিত কোন ম্যাকানিজমই মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন ঘটাতে পারে না। (এজন্য এরা মেইনস্ট্রিমে ঘৃণীত বা ক্রিয়েশনিস্ট হিসেবে ধীকৃত হন বা এড হোমিনেম এর শিকার হন।)

আসলে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের অনেকগুলো হার্ডল আছে। যা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। এর আগে এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ পোস্ট লিখেছিলাম।

মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন: আদৌ কি সম্ভব?

আগের প্রবন্ধে অল্প কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। অদ্য প্রবন্ধে আরও কিছু বিষয় সন্নিবেশিত হল।
পপুলেশন জেনেটিক্সের পর্যায়ে কিছু গবেষণা আছে যা মাইক্রোইভলুশন থেকে ম্যাক্রোইভলুশন হওয়ার হার্ডলগুলোকে প্রকাশ করেছে। যেমন, ওয়েটিং টাইম প্রবলেম। একটি  গবেষণা (1) দেখিয়েছে যে মাত্র ৫টি নতুন নিউক্লিওটাইড হোমিনিন ম্যাক্রোইভলুশনের মধ্য দিয়ে হোমিনিন পপুলেশনে যোগ হতে প্রায় ২ বিলিয়ন বছর লাগে। অথচ, ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে পুরোনো হোমিনিন এসেছে মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন বছর আগে।

আগে মনে করা হতো মিউটেশন প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি র‍্যানডম। কিন্তু, জেমন শ্যাপিরো(2) দেখিয়েছেন যে, ব্যাকটেরিয়ার ভিতর কঠিন পরিবেশে এডাপ্ট করার জন্য কতগুলো প্রক্রিয়া ইনবিল্ট আছে। ফলে ব্যাকটেরিয়া নতুন কোন পরিবেশে এলে তার ‘নির্দিষ্ট’ কিছু জেনেটিক রিজিওনে ‘র‍্যানডম মিউটেশন জেনারেটিং’ প্রক্রিয়া এক্টিভেট করে। যেন অভিনব পরিবেশে সে খাপ খাওয়াতে পারে। অর্থাৎ, আদতে এই প্রক্রিয়াটি র‍্যানডম না। বিষয়টার সাথে ভার্টিব্রেট জীবের ইমিউন সিস্টেমের পদ্ধতিগত মিল আছে।

জিন ডুপ্লিকেশন হল নতুন ফাংশন যুক্ত জিন তৈরীর একটি কার্যকর উপায়। কিন্তু, জিন ডুপ্লিকেশনের মাধ্যমে যদি এমন কোন এডাপটেশনের প্রয়োজন হয় যেখানে দুই বা ততোধিক অ্যামাইনো এসিড দরকার হবে। অর্থাৎ, একাধিক পয়েন্ট মিউটেশনের দরকার হবে। সেক্ষেত্রে উক্ত এডাপটেশনটি জিনোমে ফিক্স হতে যে পরিমাণ অর্গানিজম দরকার তার সংখ্যা অনেক বেশী ১০ (3)। অর্থাৎ, ব্যাকটেরিয়া জাতীয় এককোষী প্রাণী ছাড়া অন্য কোন প্রাণীতে এই ধরনের পরিবর্তন আসা প্রায় অসম্ভব।

ম্যালেরিয়া জীবানু Plasmodium-এ ক্লোরোকুইন রেজিসেন্ট হতে প্রোটিন-প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইটে মিউটেশন লাগে। মাইকেল বিহে তার বাই Edge of Evolution (4)-এ হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, একটি প্রোটিন প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইটে সাইমুলটেনিয়াস মিউটেশন (দুটি মিউটেশন একই সাথে) হতে মিনিমাম অর্গানিজম দরকার ১০২০। ফলে, চারটি সাইমুলটেনিয়াস মিউটেশনের জন্য দরকার ১০৪০ টি ব্যাকটেরিয়া (অর্গানিজম)। যা পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো ব্যাকটেরিয়া তৈরী হয়েছে তার সমান। অর্থাৎ, র‍্যানডম প্রক্রিয়ায় নতুন তথ্য যোগ হওয়া সম্ভব হলেও তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্গানিজম পৃথিবীর ইতিহাসে খুজে পাওয়া যাবে না।

এন গজার এবং ডগলাস এক্স, পরীক্ষা করে দেখেছেন একটি এনজাইমকে ভিন্ন ফাংশনের একটি এনজাইমে পরিণত করতে দরকার কমপেক্ষে সাতটি বা ততোধিক একই সাথে সংঘটিত মিউটেশন (5)। সুতরাং, উপরের প্যারায় বর্ণিত পয়েন্টের সাপেক্ষে বিবেচনা করলে এই ধরনের পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পপুলেশন পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া কঠিন।   

কিন্তু, মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের পথে আরও বড় বাধা হচ্ছে এই আবিস্কার যে একটি জীবের গঠন শুধুমাত্র তার ডিএনএ-তে সন্নিবেশিত তথ্যের উপর নির্ভর করে না। কারণ, ডিএনএ-তে প্রোটিনের গঠন নির্ধারণকারী তথ্য আছে সরলরৈখিক ফর্মে। কিন্তু, এর বাইরে কোষের ডিএনতে আরও কিছু কোড আছে। যেমন: ডিএনএ-র কোন অংশ চালু হবে আর কোনটা চুপ থাকবে তার জন্য এপিজেনেটিক কোড, ডিএনএ-তে থেকে আরএনএ তৈরী হওয়া পর স্প্লাইসিং-এর জন্য স্প্লাইসিং কোড, ডিএনএ-থেকে ম্যাসেঞ্জার আরএনএ-তৈরী হয়ে কোথায় যাবে তার জন্য প্রয়োজনীয় জিপ কোড ইত্যাদি। এগুলো এক ধরনের সরলরৈখিক কোড যা একমাত্রিক। এর বাইরের কোষের গঠন এবং এক কোষ (জাইগোট) থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণী হওয়ার জন্য আরও কিছু স্থানিক (Spatial) কোড আছে- বায়োইলেকট্রিক কোড এবং সুগার কোড। যেগুলো দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক কোড।

বায়োইলেকট্রিক কোড-এর উপর নির্ভর করে এমব্রায়োর গঠন। অর্থাৎ, একটি কোষ থেকে বিভাজিত হতে হতে বহুকোষী প্রাণীতে পরিণত হওয়া সময়, কোষের ঝিল্লীতে তৈরী হওয়া আয়ন চ্যানেল গুলো এক ধরনের বায়োইলেকট্রিক ফিল্ড গঠন করে, যার উপর নির্ভর করছে এমব্রায়োর মাথা থেকে পা পর্যন্ত গঠনের সঠিক অবস্থান। অর্থাৎ, কোথায় মাথা হবে, কোথায় হাত-পা হবে, এগুলোর স্থানিক তথ্য ধারন করে এই বায়োইলেকট্রিক কোড।

সুগার কোড নির্ধারণ হয় কোষঝিল্লীতে অবস্থিত গ্লাইকেন দ্বারা। সুগার কোডের কাজ হলো কোষ ঝিল্লীর ‘পোস্ট অফিস’ তৈরী এবং তার পোস্ট কোড নির্ধারণ করা। ঐ যে ডিএনএ থেকে বের হওয়ার আরএনএ যার মধ্যে জিপকোড ট্যাগ করা আছে, সে উক্ত পোস্ট কোডের উপর ভিত্তি করে কোষ ঝিল্লীর নির্দিষ্ট স্থানে যাবে। সুগার কোডের তথ্য বহনকারী কণার বৈশিষ্ট্যের কারণে সুগার কোড ডিএনএ-র জেনেটিক কোড অনেক বেশী জটিল।

এ কারণে শুধু জেনেটিক লেভেলে পরিবর্তন এবং এভাবে সৃষ্ট উপকারী ভ্যারিয়েশনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রোইভলুশন হবার দাবীর সাথে ‘দ্য থার্ড ওয়ে’-সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা একমত হতে নারাজ। এজন্য, তারা অন্যান্য ম্যাকানিজম, যেমন- symbiogenesis, horizontal gene transfer, mobile DNA action এবং epigenetic modification কে আমলে নিয়ে Extended synthesis of Evolution-এর প্রস্তাবনা করেছেন (6)। কিন্তু, এ সব ম্যাকানিজমের সমন্বয়ে একটি Holistic প্রস্তাবনা তারা দিতে চাইছেন। যদি এই প্রস্তাবনা বিবর্তনের একটি সমন্বিত পথপরিক্রমা দেখাতে সক্ষম হয়, তখনই কেবল মাইক্রো থেকে ম্যাক্রোইভলুশন প্রাকৃতিক নিয়মেই সম্ভব বলা যাবে।

বাস্তবে ম্যাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের গবেষণা কঠিন বিধায় কম্পিউটারের সিমুলেশনের মাধ্যমে এর পক্ষে প্রমাণ খোঁজার অনেক চেষ্টা হয়েছে। গবেষকরা বিভিন্ন ইভলুশনারী আলগরিদম তৈর করে দেখাতে চেয়েছেন যে সিম্পল থেকে কমপ্লেক্স অর্গানিজম কিভাবে আসে। এ সম্পর্কিত প্রোগ্রামগুলোর সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক আছে। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, এই প্রোগ্রামগুলোকে যদি প্রথমেই টিউন করে দেয়া হয়, তারা জটিলতার টার্গেট অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু, এদের মধ্যে যদি প্রকৃত অনিশ্চয়তা (True randomness) সেট করা হয়, দেখা যায় যে উক্ত প্রোগ্রামগুলোর কোন কার্যকর বিবর্তন হয় না (7)।  

পরিশেষে বলব, মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশনের বিষয়টি অমিমাংসীত। বরং, আদৌ কি মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো ইভলুশন প্রাকৃতিক উপায়ে হওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে। তবে হ্যা যদি বিষয়টিকে এভাবে ভাবেন যে, Last Universal Common Ancestor অথবা Common Ancestor কোষগুলোতে ইন বিল্ট নিয়ন্ত্রিত এবং সুসংঘটিত বিবর্তন ম্যাকানিজম তৈরী করা ছিল তাহলে হয়ত সময়ে সাথে সাথে মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো বিবর্তন ঘটতে পারে। তবে এ ধরনের Complete এবং Hollistic Mechanism-কেউ দিতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই।

তথ্যসূত্র:

  1. https://tbiomed.biomedcentral.com/…/s12976-015-0016-z
  2. https://www.sciencedirect.com/…/abs/pii/0959437X93900038
  3. http://onlinelibrary.wiley.com/doi/10.1110/ps.04802904/full
  4. Behe, Michael. The Edge of Evolution; pp. 143
  5. https://bio-complexity.org/ojs/index.php/main/article/viewArticle/BIO-C.2011.1
  6. https://www.thethirdwayofevolution.com/
  7. এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে এই বইটিতে- Introduction to evolutionary informatics. আর জানা যাবে এই সাইট থেকে – https://evoinfo.org/

বিবর্তনতত্ত্ব, বিজ্ঞান এবং বিশ্বাস

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম

বিলুপ্ত হোমিনিন প্রজাতির জিনোম এবং হিউম্যান ইভল্যুশন সংক্রান্ত আবিস্কারের জন্য ভ্যান্তে পাবো ২০২২ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তিনি নিয়ানডার্থাল জিনোমের সিকোয়েন্সিং করেছেন।

এই সংবাদটির আলোকে স্রষ্টায় অবিশ্বাসীদের দাবী হলো, এই আবিস্কার মানুষের বিবর্তন প্রমাণ করেছে, সুতরাং আব্রাহামিক ধর্মগুলোর আদম-হাওয়া তত্ত্বের কোন ভিত্তি নেই।

মনে হয় যেন,নিয়ানডার্থাল জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং হিউম্যান জিনোমের সাথে তুলনা করতে পারা মানেই মানুষের বিবর্তন প্রমাণিত হওয়া।

সায়েন্টিজমের অনুসারী এবং নিও-এথিস্টদের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে বিজ্ঞানের মধ্যে তাদের ফিলোসফি ঢুকিয়ে ধর্মবিরোধী মতবাদের পক্ষে প্রচার চালানো। সেই হিসেবে এ ধরনের হাইপ কোন অস্বাভাবিক বিষয় না।

তাই তাদের এই হাইপকে একপাশে রেখে আমাদের তিনটি প্রশ্নের আলোকে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা দরকার।

১. বিবর্তন তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক ভাবে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত কি না?

২. বিবর্তন তত্ত্ব স্রষ্টায় বিশ্বাসের সাথে সাংঘার্ষিক কিনা?

৩. বিবর্তনতত্ত্ব ইসলামের সাথে সাংঘার্ষিক কিনা?

প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর অনেক বিস্তৃত এবং বড় কলেবরে এক বা একাধিক খণ্ডের বই-এর দাবী রাখে। তবে, এই পোস্টে খুব সংক্ষেপে ১ ও ২ নং প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা থাকবে।

প্রথমেই, ২নং প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরটি সবচেয়ে সহজে দেয়া যায়-

স্রষ্টার বিশ্বাসের সাথে বিবর্তনবাদ কোনভাবেই সাংঘার্ষিক নয়। কারণ, স্রষ্টা চাইলে সরাসরি জৈব প্রজাতিকে তাদের আকৃতিতে সৃষ্টি করতে পারেন অথবা ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরী করতে পারেন। এটি মেটাফিজিক্যালী ইমপসিবল কোন বিষয় নয়, কারণ এটি লজিক্যালী পসিবল।

এখন, প্রথম প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকবে। কিন্তু, উক্ত আলোচনায় যাবার আগে চলুন হালকা জেনে নেই বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে।

বিজ্ঞান যে কোন তত্ত্ব প্রমাণের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক তথ্য ও প্রমাণের ওপর নির্ভর করে। তবে, বর্তমান বৈজ্ঞানিক জগৎ কোন ঘটনার অতিপ্রাকৃতিক ব্যাখ্যার অনুমতি দেয় না। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের শর্ত হচ্ছে কোন তত্ত্বের প্রমাণে কেবল প্রাকৃতিকভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য ব্যাখ্যা এবং উপাত্ত দিতে হবে।

দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞানে যে কোন তত্ত্বের প্রমাণের প্রশ্নে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জ্ঞানতত্ব এবং দর্শন চলে আসে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না এরকম ঘটনার প্রাকৃতিক কারণ খোঁজা যেন বন্ধ হয়ে না যায়।

যেমন- পাখি কিভাবে উড়ছে? এই প্রশ্নে উত্তরে আমি যদি এটুকু বলে থেমে যাই যে আল্লাহ তাদের ওড়ার ক্ষমতা দিয়েছেন তাই উড়ছে, তাহলে পাখির উড়তে পারার যে এ্যারোডাইন্যামিক পদ্ধতি সে সম্পর্কে গবেষণা থেমে যাবে।

এ কারণে, বিজ্ঞানীরা, হোক সে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী, বৈজ্ঞানিক গবেষণার সময় পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদ (Methodological naturalism)- এর আশ্রয় নেন।

কিন্তু, নব্য-নাস্তিকরা (Neo-atheist)-রা মানুষের মাঝে বিজ্ঞানের বড়ত্ব প্রচার করতে গিয়ে দর্শনগত প্রকৃতিবাদ (Philosophical naturalism) কে জুড়ে দেন। ফলে, বিষয়গুলোকে অনভ্যস্তরা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পরে। আস্তিক বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক ঘটনার বিষয়টিকে দুভাবে বিবেচনা করেন। একদল, বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় (স্রষ্টায়) বিশ্বাসকে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে আলাদা রাখতে চান। আরেকদল মনে করেন, স্রষ্টা সবকিছুই বৈজ্ঞানিক নিয়মের মধ্যে করেন, সুতরাং বৈজ্ঞানিক নিয়ম আবিস্কার স্রষ্টাকে জানারই একটি পদ্ধতি। তদুপরি, বিজ্ঞান যেহেতু কিছু দার্শনিক অনুমান ধরে নিয়ে কাজ করে বিজ্ঞান সংজ্ঞানুযায়ীই সীমাবদ্ধ। যাই হোক, এটি সম্পূর্ণ আলাদা একটি আলোচনার বিষয়।

এখন চলুন দেখি, বিজ্ঞান প্রাকৃতিক কোন পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যায় কিভাবে কাজ করে? বিজ্ঞানীরা কোন পর্যবেক্ষণের কার্যকারণ ( causual inference ) ব্যাখ্যার জন্য “ থিওরী – হাইপোথিসিস- রিসার্চ-অবজারভেশন- থিওরী” এই চাক্রিক প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে যান।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমদিকে অবশ্য বিষয়টি এরকম ছিল না। তখন, বিজ্ঞানীরা কজাল ইনফারেন্সের জন্য শুধু মাত্র যৌক্তিক সিদ্ধান্ত (Rational Inference)-এর ওপর নির্ভর করতেন। সপ্তদশ শতাব্দীর সায়েন্টিফিক রিভলুশন থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এজন্য পরীক্ষা নিরীক্ষালব্ধ জ্ঞান (Empiricism)-এর ওপর জোড় দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমার পর্যবেক্ষণলব্ধ ‘ হাঁস’ গুলো যদি সবসময় ‘কালো’ হয়, আমি সিদ্ধান্ত দিতে পারবো যে ‘হাঁস কালো’।

এই পদ্ধতির একটি সমস্যা হল আপনি যদি একটি সাদা হাস দেখে ফেলেন, আমার থিওরী ভেঙ্গে যাবে। (Problem of Induction)

পরর্বতীতে কার্ল পপার এই আরোহ পদ্ধতি (Inductive approach)কে প্রশ্ন করে বলেন যে, বিজ্ঞান মূলত কাজ করে অবরোহ পদ্ধতিতে (Deductive Approach)। অর্থাৎ, কোন ঘটনার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তাভাবনা করে এক বা একাধিক থিওরী তৈরী করেন, এরপর তার পক্ষে পরীক্ষা নিরীক্ষালব্ধ প্রমাণ যোগার করার চেষ্টা করেন। এ প্রক্রিয়া কয়েকটি প্রতিযোগিতামূলক তত্ত্বের মধ্যে একটি বা আরেকটির প্রমাণ পোক্ত হয়।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এই দুটি পদ্ধতির সমন্বয়ে কাজ করেন। তারা অবজারভেশন থেকে একটি থিওরী ভাবেন এবং তা থেকে বিভিন্ন হাইপোথিসিস দাড় করান। অত:পর, উক্ত হাইপোথিসিসকে প্রমাণ বা অপ্রমাণের জন্য রিসার্চ প্রসেসের মধ্য দিয়ে তথ্য যোগাড় করেন। এই প্রক্রিয়া হাইপোথিসিস ভুল হলে থিওরীর পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হয়। এভাবে, কোন কজাল ইনফারেন্সের জন্য যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত যোগাড় হলে একটি কজাল থিওরী আপাত প্রমাণ হয়।

এখন, বিবর্তনতত্ত্ব হচ্ছে এমন একটি তত্ত্ব যা একটি কোষ থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে বর্তমান পৃথিবীর অসংখ্য জৈব প্রজাতির আগমনকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। বিজ্ঞানী ডারউইন তার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ (যেমন: ফিঞ্চ পাখির ঠোট, কৃত্রিম সংকরায়ণ, বিভিন্ন প্রাণীর কাছাকাছি গঠন [Homology], ফসিল এভিডেন্স) প্রভৃতির আলোকে বি

এখন, বিবর্তনতত্ত্ব হচ্ছে এমন একটি তত্ত্ব যা একটি কোষ থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে বর্তমান পৃথিবীর অসংখ্য জৈব প্রজাতির আগমনকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। বিজ্ঞানী ডারউইন তার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ (যেমন: ফিঞ্চ পাখির ঠোট, কৃত্রিম সংকরায়ণ, বিভিন্ন প্রাণীর কাছাকাছি গঠন [Homology], ফসিল এভিডেন্স) প্রভৃতির আলোকে বিবর্তনতত্ত্ব প্রদান করেন। এরপর এই তত্ত্ব সত্য হলে কি কি ধরনের পর্যবেক্ষণ লব্ধ উপাত্ত পাওয়া যাবার কথা এই ধরনের হাইপোথিসিস দেন এবং তার সপক্ষে কিছু যৌক্তিক প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করেন।

যেমন একটি হাইপোথিসিস হল, বিবর্তনতত্ত্ব সত্য হলে ফসিল বেডে ক্রমান্বয়িক (Gradual) জটিল প্রজাতি পাওয়া যাবে (Common Descent)। এর প্রমাণস্বরুপ, জীবাশ্মবিদ্যার বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা দেয়া দেখা গেছে যে যতই পুরোনো ফসিল বেডে যাওয়া যায় ততই তুলনামূলক সরল জীবাশ্ম পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, ফসিল বেডে যত গভীরে যাওয়া যায়, তা সাধারনত ততই আগের জিওলজিকাল এইজকে রিপ্রেজেন্ট করে।

কিন্তু, পরিক্ষানীরিক্ষা লব্ধ তথ্য প্রমাণ সব সময় যে হুবহু থিওরীর পক্ষে যাবে তা নয়। যেমন, ফসিল এভিডেন্স-এর বিষয়টিতেই আসা যাক। ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব অনুযায়ী, ফসিল বেডে দুটি বিষয় ঘটতে হবে। এক, ধাপে ধাপে সরল থেকে জটিল প্রজাতি পাওয়া যাবে (Common Descent)। দুই, প্রজাতিগুলোর ফসিলের মধ্যে একটি ক্রমান্বয়িক ধারাবাহিকতা (Gradualism) থাকবে। কিন্তু, প্যালেন্টোলজিস্ট নাইলস এলড্রেজ এবং স্টিফেন জে. গোল্ড দেখিয়েছেন যে ফসিলে Common Descent থাকলেও Gradualism নেই। বরং, আছে Sudden appearance এবং Stasis। যাই হোক, বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন দ্বিধাবিভক্ত। তবে, Common descent-এর ব্যাপারে সবাই একমত।

বিবর্তনতত্ত্বের আরেকটি প্রস্তাবনা হলো, প্রজাতির প্রজন্মান্তরে সৃষ্ট বৈচিত্র (Variation) এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন। যেমন, কৃত্রিম সংকরায়নের মধ্য দিয়ে অধিক দুগ্ধদানকারী গাভীর জাত তৈরী করা হলে, খামারীরা উক্ত জাতটিকে কৃত্রিম ভাবে চয়ন করেন (Artificial selection)। ঠিক একই ভাবে, অধিক লোমযুক্ত ভাল্লুক বরফের দেশে প্রাকৃতিক ভাব সিলেক্টেড হয় (Natural selection)।

কিন্তু, প্রজাতিতে প্রজন্মান্তরে এই ভ্যারিয়েশন কিভাবে আসে? জেনেটিক্স আবিস্কারের আগ পর্যন্ত ভ্যারিয়েশন আসার বিষয়টি শক্ত কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো না। জেনেটিক্স আসার পর দেখা গেল যে মিউটেশনসহ বিভিন্ন ধরনের পপুলেশন জেনেটিক প্রক্রিয়ায় প্রজাতির বৈচিত্র তৈরী এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন হতে পারে। এর প্রেক্ষিতে ডারউইনের মূল তত্ত্ব মোডিফাই হয়ে, বিভিন্ন বিজ্ঞানীর হাত ধরে ইভল্যুশনারী সিনথেসিস (তথা সিনথেসিস থিওরী)-তে রূপান্তরিত হয়।

এই পরিবর্তীত তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে মলিকিউলার হোমোলজী থেকে ফাইলোজেনেটিক্স (জেনেটিক ট্রি তৈরী)-এর বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়। তবে মজার বিষয় হল মলিকিউলার হোমোলজি থেকে প্রাপ্ত প্রজাতি বিন্যাস এবং বয়স, ফসিল ডেটিং এবং এনাটমিক হোমোলজি থেকে প্রাপ্ত বিন্যাস এবং বয়সের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ম্যাচ করে না। আবার দেখা যায়, হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফারের কারণে প্রজাতির জন্য সুনির্দিষ্ট জেনেটিক গঠন অনেকটাই অস্বচ্ছ হয়ে যায়। ফলে, মলিকিউলার হোমোলজীর মাধ্যমে প্রজাতির বিবর্তনীয় ধারা বের করার গবেষণা অনেক ধরনের জটিলতায় আক্রান্ত।

বর্তমানে সিনথেটিক থিওরীর প্রসেসগুলোর (অর্থাৎ, মিউটেশন ও অন্যান্য পপুলেশন জেনেটিক প্রসেস) সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে একদল বিজ্ঞানী বিভিন্ন বিকল্প প্রসেসের কথা বলছেন। যেমন: ন্যাচারাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, সিমবায়োসিস, নিও-লামার্কিজম প্রভৃতি। এই সকল বিজ্ঞানীদের থিওরীকে একত্রে বলা হচ্ছে The Third Way of Evolution. যাই হোক, থার্ড ওয়ের প্রবক্তারাও মূল বিবর্তনতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা Common Descent এর ব্যাপারে সর্বসম্মতভাবে একমত। উপরন্তু, তারাও ফিলোসফিক্যাল ন্যাচারালিজম-এর বাইরে কোন প্রস্তাবনা দিতে রাজি নন।

কিন্তু, অনেক সময় একই পর্যবেক্ষণের একাধিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তখন, তুলনামূলক প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে কোনটি গৃহীত হবে, তা নির্ধারিত হয় অন্যান্য সম্পূরক তথ্য প্রমাণ এবং তাত্ত্বিক চিন্তা গবেষণার আলোকে।

জীবজগতের পর্যবেক্ষণে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তারা একটি ভিন্ন প্রস্তাবনা এনেছেন। তাদের মতে প্রজাতির উৎপত্তি ও বিভিন্ন ধাপে আগমন ইন্টেলিজেন্ট এজেন্সির ইন্টারভেনশন ছাড়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। তাদের মতে ‘কমন ডিজাইন’ প্রজাতির সাদৃশ্যের একটি বিকল্প প্রস্তাবনা হতে পারে। তারা হোমোলজিকে বিবর্তনবাদের প্রমাণ হিসেবে দেখানোকে চাক্রিক যুক্তি মনে করেন। কারণ, আমি দুই বা ততোধিক প্রজাতির গাঠনিক সাদৃশ্য দেখে যদি কোন তত্ত্ব দাড় করাই যে ‘গাঠনিক সাদৃশ্য থাকলে দুটো প্রজাতি পূর্ববর্তী কোন কমন প্রজাতি থেকে এসে থাকবে’ এবং তার প্রমাণ হিসেবে ‘দুই বা ততোধিক প্রজাতির গাঠনিক সাদৃশ্য’-কেই উপস্থাপন করি তা চাক্রিকই মনে হবে।

অন্যদিকে, তারা দেখিয়েছেন যে, জীবজগতের কিছু কিছু গঠন Irreducibly Complex এবং বিবর্তনবাদীদের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়াগুলোতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত পরিবর্তিত জিন পপুলেশনে সেট হতে পারে তথা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত প্রজাতির পরিবর্তন আসতে পারে, যা প্রজাতির ক্লাসিফিকেশন হাইয়ারারকিতে (Kingdom-Phylum-Class-Order-Family-Genus-Species) জেনাস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। উক্ত প্রক্রিয়াতে ম্যাক্রো পরিবর্তন আসার জন্য প্রয়োজনীয় সময় এবং পপুলেশন সাইজ মহাবিশ্বের ইতিহাসে নেই।

প্রসঙ্গত, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কোন পর্যবেক্ষণযোগ্য ইনডাকটিভ প্রমান না থাকায়, তারা এবডাকটিভ ইনফারেন্স একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তাদের মতে মানুষকে যেমন ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে জটিল কাঠামো নির্মান করতে দেখা যায়, তথা জটিল কাঠামো দেখে যেমন এর পেছনে মানুষের মত কোন ইন্টেলিজেন্স ইনফার করা যায়। তেমনি, জীবজগতের জটিলতা দেখেও এর পেছনে ইন্টেলিজেন্ট এজেন্টকে ইনফার করা যায়।

কিন্তু, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনতত্ত্ব ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনার’ নামক ‘অপ্রাকৃতিক’ এজেন্সিকে ইনফার করে বিধায়, ডমিনেন্ট সায়েন্টিফিক সার্কেল-এর তাদের তত্ত্বের কোন গ্রহনযোগ্যতা নেই। একদিকে, যারা অবিশ্বাসী তারা দর্শনগত কারনেই এই তত্ত্বর্কে কোন সুযোগ দিতে রাজী নন। অন্যদিকে, যারা বিশ্বাসী তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে Methodological Naturalism বজায় রাখতে গিয়ে উক্ত তত্ত্বের সুযোগ দিতে রাজী নন। এই দ্বিতীয় দলটির আরেকটি আশংকা হচ্ছে, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন God of the gaps ফ্যালাসীর আশ্রয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রসঙ্গত, God of the gaps হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বর্তমান সময়ে বোঝার সীমাবদ্ধতা থাকলে, তাকে স্রষ্টা করেছেন বলে চালিয়ে দেয়া। তবে একজন সতর্ক পাঠক বুঝতে পারবেন যে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বের ফর্মুলেশনটি ঠিক এরকম নয়।

সুতরাং, ১ নং প্রশ্নের উত্তরে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বের পক্ষে তথ্য প্রমাণ এমন নয় যে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে। সর্বচ্চো এটুকু বলা যায় যে, বিভিন্ন ভাবে তথ্য প্রমাণ একত্র করার প্রচেষ্টা অব্যহত আছে। মজার বিষয় হলো, Methodological Naturalism-এর সীমায় প্রজাতির উৎপত্তি ব্যাখ্যায় বিবর্তনতত্ত্বের বিকল্প কোন তত্ত্বের প্রবেশাধিকারই নেই। অর্থাৎ, বিবর্তনতত্ত্বের পক্ষে সাপোর্ট যতটানা Empirical তার চেয়ে বেশী Philosophical.

এজন্য অধিকাংশ সময়ই বিবর্তনতত্ত্বের আলোচনা তত্ত্ব থেকে ‘বিবর্তনবাদ’-এ চলে যায়। এ আলোচনায় অটোমেটিক ভাবেই দর্শন চলে আসে। ফলে, আর্নস্ট মেয়ার, আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস, রোনাল্ড ফিসার বা ডগলাস ফুতুয়ামা থেকে আমরা রিচার্ড ডকিন্স বা ইউভাল নোয়া হারারীদের বেশী চিনি।

তিন নাম্বার প্রশ্নের উত্তরটি নিয়ে ড. শোয়েব আল মালিক তার বই Islam and Evolution: Al-Ghazālī and the Modern Evolutionary Paradigm -এ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অধিক আগ্রহীরা এই ফ্রি বইটি ডাউনলোড করতে পারবেন এখান থেকে- https://library.oapen.org/handle/20.500.12657/48443

তবে আরেকটি পর্বে এই বিষয়টির একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা রাখার চেষ্টা করবো, ইন শা আল্লাহ।
..

০৬.১০.২০২২

বানান সম্পাদনা: তাওহিদ হাসান

বিবর্তন নিয়ে মুসলিম চিন্তকদের অবস্থান কি?

গত বছর আমি আল বালাগ একাডেমি, লন্ডনের একটি অনলাইন উইকলি কোর্সে এনরোল করি- এথেইজম এবং ইসলাম। সেখানে ইসলাম এবং বিবর্তনবাদ নিয়ে একটি ক্লাস ছিল। ক্লাসটি নিয়েছিলেন ড. শোয়েব আহমেদ মালিক। ক্লাসটিতে তিনি সংক্ষেপে বিবর্তন নিয়ে মুসলিম চিন্তকদের অবস্থান সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেছিলেন। আমার আজকের এই পোস্ট-এ সেই ক্লাসে নেয়া আমার কিছু নোটের ভিত্তিকে আলোচনা করতে চাই।

চলুন প্রথমে একটু ড. মালিক সম্পর্কে জেনে নেই। ড. মালিক University of Nottingham থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিরিয়াং-এ পিএইচডি করার পর যায়েদ ইউনিভার্সিটিতে নাচারাল সায়েন্স বিভাগে এসিসটেন্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন। সম্প্রতি উনার ইন্টারেস্ট ফিলোসফী অব সায়েন্স এণ্ড রিলিজিয়ন-এর দিকে ডাইভার্ট হয়। রিসেন্টলি তিনি ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ থেকে ফিলোসফি অব সায়েন্স-এ আরেকটি মাস্টার্স শেষ করেছেন এবং পিএইচডি-র জন্য এনরোলড হয়েছেন। এ বছর ইসলাম ও বিবর্তনবাদের উপর একটি বিশদ বই – Islam and Evolution: Al-Ghazali and the Modern Evolutionary Paradigm-এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট লিখে শেষ করেছেন যা আগামী বছর রোলেজ থেকে পাবলিশ হবে ইন শা আল্লাহ।

(https://www.facebook.com/shoaib.a.malik.18)

এখন মূল আলোচনায় আসি। ড. মালিক তার ক্লাসে বলেছিলেন বিবর্তনবাদ নিয়ে মুসলিম চিন্তকদের প্রায় ২৭টি ভিন্ন রকম অবস্থান আছে। তবে, ব্রডলি মুসলিম চিন্তকদের অবস্থানকে তিনটি মূল ভাগে ভাগ করা যায়- রিজেকশন, এক্সেপটেন্স, এবং পার্সিয়াল এক্সেপটেন্স। সাধারণ হিসেবে প্রায় ৩৫% বিবর্তনবাদকে রিজেক্ট করেন, ৩৫% এক্সেপ্ট করেন এবং ৩০% -এর অবস্থান মর্ধবর্তী।

তবে, এই তিন দলের অবস্থান নির্ভর করে মূলত দুটি বিষয়ের উপর-

(১) বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সম্পর্কে চিন্তকের পড়াশোনা এবং কনভিকশন

(২) জীবজগত সম্পর্কে ইসলামী নলেজ সোর্স -কোরআন এবং হাদিসের বক্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান এবং চিন্তক তা কিভাবে নিচ্ছেন

তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল (৩) ‘মানুষের বিবর্তন’।

বস্তুত, এই প্রশ্নে এসেই বিবর্তনবাদের পার্সিয়াল এক্সেপটেন্স গ্রুপটি তৈরী হয়েছে। কারণ, কোরআন ও হাদীসে অন্যান্য জীবের সৃষ্টি সম্পর্কে ‘explicit’ বক্তব্য না থাকলেও আদম (আ)-এর সৃষ্টির ব্যাপারে ‘explicit’ বক্তব্য আছে। তবে ভ্যারিয়েশন তৈরী হয়েছে উক্ত বক্তব্যের ইন্টারপ্রিটেশনের উপরে।

যারা বিবর্তনবাদকে পুরোপুরি গ্রহন করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিন্তক হল –

১. ড. রানা দেজানী,

২. ড. নিধাল আহমেদ, এবং

৩. ড. ইসরার আহমেদ।

এদের মতে বিবর্তনবাদের সত্যতা সন্দেহ করার সুযোগ নেই, এবং সবাই একমত যে মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টির ব্যপারে ইসলামের বক্তব্যও বিবর্তনবাদ গ্রহনে কোন বাধা দেয় না।

তবে কোরআনের মানব সৃষ্টি সম্পকির্ত কথার ব্যপারে তাদের চিন্তা বিভিন্ন। ড. দেজানীর মতে, এই বক্তব্য গুলো ‘রূপক’ তথা Matephorical। ড. আহমেদের মতে কোরআনে আয়াতগুলো বিভিন্ন ভাবে অর্থ করা এবং ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। ড. ইসরার আহমেদের মতে দুনিয়াকে দুটি ভাগে পৃথক করা যায়- খালক এবং আমর। কোরআনে মানুষকে একবার ইনসান এবং একবার বাশার হিসেবে সন্মোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ, মানবজাতির দুটোর স্বত্ত্বা আছে। একটি দৈহিক এবং আরেকটি স্পিরিচুয়েল। মানবদেহ বিবর্তনের মাধ্যমেই এসেছে, তবে তাদের মধ্যে রূহ ইনস্টল করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং, বিবর্তনবাদের সাথে ইসলামের বাহ্যত কোন কনফ্লিক্ট নেই।

যারা বিবর্তনবাদকে সোজাসুজি (outright) রিজেক্ট করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিন্তক হলেন-

১. ড. সায়্যেদ হুসাইন নাসর

২. শায়েখ নুহ কেলার

৩. হারুন ইয়াহিয়া (গং)

এদের মধ্যে বিবর্তন রিজেক্ট করার ধরন এবং কারণে ভিন্নতা আছে। ড. নাসর বিবর্তনকে অস্বীকার করেন purely metaphysical কারণে। তার মতে প্রতিটি সৃষ্টি জীবের স্বত্ত্বা সুনির্দিষ্ট এবং এগুলোকে এই ফর্মেই পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং, বিবর্তন হবার সুযোগ নেই।

শায়েখ কেলার অন্যান্য জীবের বিবর্তনের ব্যপারে সন্দেহে থাকলেও মানুষের বিবর্তনকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। কারণ, তার মতে কোরআনের সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো আক্ষরিক, স্পষ্ট এবং এগুলোকে রূপক ভাবার সুযোগ নেই। তিনি আরও মনে করেন আদম (আ)-কে আক্ষরিকভাবেই বেহেশতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে।

হারুন ইয়াহিয়া (এবং মূলত তার অধীনে কাজ করা চিন্তকরা) বিবর্তনের উপস্থাপিত প্রমানকে মিথ্যা মনে করেন নতুবা প্রমানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে তাদের অধিকাংশ সন্দেহের ভিত ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্টাই-ইভুলিউশনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত।

যারা বিবর্তনকে আংশিকভাবে গ্রহণ করে তাদের মধ্যে আছেন-

১. শায়েখ ইয়াসির কাদি

২. ডেভিড সলোমোন জালাজেল

৩. হুসাইন আল জিসর

এদের মধ্যে মধ্যে প্রথম দু’জন বিবর্তনবাদের এর উপস্থাপিত প্রমানের বিষয়ে কনভিন্সড। তন্মধ্যে শায়েখ কাদি’র মতে কোরআনের মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য নেই। তবে, আদম(আ) হচ্ছে মিরাকুলাসলি ক্রিয়েটেড। তবে আদমের আগ পর্যন্ত হোমিনিন গোত্র বিবর্তনের মাধ্যমেই এসেছে। আদম (আ)-এর মাধ্যমে আধুনিক হোম স্যাপিয়েন্স সূচনা হয়েছে।

সলোমোন জালাজেলের মতে হোমো স্যাপিয়েন্স তথা মানুষের বিবর্তনের ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। কারণ প্রমাণ অনেক কনভিন্সিং। আবার কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আদম (আ)-কে মিরাকুলাসলি সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য কথায় তার full form-এ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু, কিভাবে আদম (আ) এবং হোম স্যাপিয়েন্স একইভূত হয়ে গেল সে বিষয়ে কোরআন এবং হাদীস থেকে কিছু জানা যায় না, অতএব এ ব্যাপারে ‘তাওয়াক্কুফ’ অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ, এ বিষয়ে ডেভিল সলোমোন তার পড়াশোনার আলোকে কোন ‘মন্তব্য না করার’ অবস্থান নিয়েছেন।

হুসাইন আল জিসর উনবিংশ শতাব্দীর একজন মুসলিম চিন্তক। তার চিন্তাটা একটু ভিন্ন ধরনের। বিবর্তনবাদীদের উপস্থাপিত প্রমাণ এবং উপস্থাপনের ধরনের বিষয়ে তার প্রশ্ন আছে। তার কাছে প্রমাণ সমূহ ‘inadequate’। তদুপরী বিবর্তনবাদকে যে বস্তুবাদের মোড়কে পরিবেশন করা সেই বস্তুবাদকে তিনি রিজেক্ট করেন। তবে তিনি এই ব্যাপারে নমনীয় যে বিবর্তনবাদ যদি যথেষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা স্থিত হয় তাহলে বিবর্তনবাদ গ্রহন করা যেতে পারে। অন্যথা বিবর্তনবাদ ততদিন পর্যন্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। বস্তুত, হুসাইন আল জিসর-ও মনে করতেন যে কোরআনে সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনা সরাসরি ‘as it is’ সৃষ্টির ব্যাপারে কোন স্পষ্ট বক্তব্য দেয় না।

এই ছিলো মোটামুটি আমার গৃহীত নোটের সারসংক্ষেপ।

এখন এই পজিশনগুলোর মধ্যে আমি নিজেকে কোন গ্রুপে মনে করি? আমি মনে করি আমার পজিশন অনেকটাই হুসাইন আল জিসর-এর চিন্তার কাছাকাছি। বিবর্তনবাদের ম্যাক্রোইভল্যুশনের পক্ষে উপস্থাপিত প্রমাণাদি আমি যতটুকু নিজে পড়েছি তাতে কনভিন্সড নই।

তবে আমি এখনও পড়ছি। যদি কখনও দেখি ‘ম্যাক্রো’ বিবর্তনবাদের উপস্থাপিত প্রমাণ যথেষ্ট কনভিন্সিং আমারও বিবর্তন মেনে নিতে সমস্যা নেই। বস্তুত, এটা আমার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসেও কোন বাধাও সৃষ্টি করবে না। কারণটা, লেখক আরিফ আজাদের বিবর্তন সম্পর্কিত রিসেন্ট পোস্টটের একটা কথাকে কোট করে বলতে চাই। আরিফ লিখেছেন –

“আল্লাহ গোটা মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। ধাপে ধাপে। একইভাবে তিনি যদি প্রাণীজগতকেও ধাপে ধাপে সৃষ্টি করে থাকেন, যা বিবর্তনে বলা হয়ে থাকে, তা মেনে নিতেও আমাদের অসুবিধে থাকার কথা নয়।“

অর্থাৎ, দার্শনিক বিবেচনায় আল্লাহ তার সৃষ্টিকে যে কোন উপায়ে সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি চাইলে প্রথম কোষের মধ্যেই বিবর্তিত হবার ম্যাকানিজম তৈরী করে দিতে পারেন। তিনি চাইলে হোমো স্যাপিয়েন্স পর্যন্ত বিবর্তন ঘটিয়ে এর মধ্যে একজনকে উন্নত বুদ্ধিমত্তা, এবং চেতনা ইনস্টল করে দিতে পারেন। আবার তিনি চাইলে প্রতিটি জীবকে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ভ্যারী করার বৈশিষ্ট্য সহ- সুনির্দিষ্ট ‘এসেন্স বা আর্কিটাইপাল ফর্ম’-এ সৃষ্টি করতে পারেন।

……

হে মুসলিম পাঠক, আপনি নিজেকে কোন দলের মনে করেন?

….

পুনশ্চ‍ঃ ইসলামের ব্যাপারে অবিশ্বাসীদের জন্য এই পোস্ট না। কারণ, উপরের আলোচনা থেকে দেখলাম একজন ব্যাক্তি শুধুমাত্র বিবর্তনতত্ত্বের কারণে ইসলামে অবিশ্বাস করবে না। বরং, ইসলামে অবিশ্বাসী হলে সমূহ সম্ভাবনা আছে যে বিবর্তনকে বস্তুবাদের মোড়কে উপস্থাপন করে বিশ্বাসীদের বিভ্রান্ত করতে চাইবে।

নাইলনেজ এনজাইম কি বিবর্তনের উদাহরণ?

বিবর্তনবাদীরা যখন আপনার কাছে বিবর্তনের পক্ষে কথা বলতে আসবে, আপনি প্রথমেই জেনে নিন সে বিবর্তন বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছে? বিবর্তনের উদাহরণ দিতে গিয়ে যদি সে ব্যাকটেরিয়ার ড্রাগ রেজিস্টেন্স, ভাইরাসের নতুন নতুন স্ট্রেইনের ঘটনাকে নিয়ে আসে তাহলে বুঝবেন সে মাইক্রোইভুলিউশনের কথা বলছে, যেটা প্রকৃতিতে অহরহ ঘটছে। আপনি তার কাছে ম্যাক্রোইভুলিউশনের উদাহরণ জানতে চাইবেন।

যদি সে বলে মাইক্রোইভুলিউশন মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে ম্যাক্রোইভুলিউশন করেছে। তখন বুঝবেন তার এই ‘ইনফারেন্স’ এক ধরনের বস্তুবাদী বিশ্বাস, বিজ্ঞান নয়। কেননা মাইক্রোইভুলিউশন একটি নির্দিষ্ট লিমিট পর্যন্ত হয়। এই লিমিট বা সীমাটি হলো যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের বা ইউক্যারিয়টের ‘ভাইটাল’ গাঠনিক উপাদান প্রভাবিত না হয়।  তাকে প্রশ্ন করুন ম্যাইক্রোইভুলিউশনের এমন কোন উদাহরণ দিতে পারবে কিনা যেখানে নতুন কোন গঠনগত ও কার্যকরী প্রোটিন বা প্রোটিন সমষ্টি তৈরী হয়েছে। কেননা, কোন গাঠনিক উপাদান ছাড়া একটি জীবকে আরেকটি ভিন্ন জীবে পরিণত করা অসম্ভব।

মজার ব্যপার হলো, সে আপনাকে ব্যাকটেরিয়ার বাইরে খুব কমই উদাহরণ দিতে পারবে। মাইক্রোইভল্যুশনের মাধ্যমে প্রোটিন তৈরীর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট যে উদাহরণটা আনা যেতে পারে তা হল নাইলনেজ নামক নতুন একটি এনজাইম তৈরীর ঘটনা । নাইলন একটি কৃত্রিম বা সিনথেটিক পলিমার, যেখানে অনেকগুলো সিক্স এমাইনো ক্যাপ্রয়েট নামক যৌগের ডাইমার পর পর যুক্ত হয় বড় একটি চেইন তৈরী করে। নাইলনেজ-এর কাজ হলো এই ডাইমারকে ভেঙ্গে নাইলন পলিমারকে ভাঙ্গা। ফ্ল্যাভোব্যাকটেরিয়াম Arthrobacter sp. K17-এর ‘প্লাজমিড’-এ একটি ফ্রেমশিফট মিউটেশনের মাধ্যমে এই এনজাইমটি তৈরী হয়েছে বলে ধারণা করা হয় (১)।

নাইলনেজ এনজাইম কি বিবর্তনের উদাহরণ?

নাইলনেজ এনজাইমের ত্রিমাত্রিক গঠন, উৎস

এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। মিউটেশনটি ঘটেছে প্লাজমিডে, কোন স্ট্রাকচারাল প্রোটিনে নয় এবং ব্যাকটেরিয়ার মূল জিনোমিক এলিমেন্টে নয়। মূলত ফ্রেমশিফট মিউটেশন হলে পুরো প্রোটিন নষ্ট হয়ে অকার্যকর প্রোটিন তৈরী হয়। সুতরাং মূল জিনোমে হলে এবং স্ট্রাকচারাল প্রোটিনে হলে ব্যাকটেরিয়া টিকতে পারতো না। তদুপরী ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিড একটি চলাচলযোগ্য গোলাকার ডিএনএ খণ্ড, যা ব্যাকটেরিয়া পরস্পর আদান প্রদান করতে পারে। এটা ব্যাকেটেরিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু এনজাইম ও অতিরিক্ত স্ট্রাকচারের জেনেটিক তথ্য ধারণ করে। এটি ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজমের সাহায্য ছাড়া একাই নিজের কপি তৈরী করতে পারে। ফলে প্লাজমিডে মিউটেশন হলে ব্যাকটেরিয়ার মূল স্ট্রাকচারে কোন পরিবর্তন আসে না।

ফ্ল্যাভোব্যাকটেরিয়ামে যে ফ্রেমশিফটের ঘটনাটি ঘটেছে সেটিও ‘ইউনিক’।[১] এটি বুঝতে আসুন জানি ফ্রেমশিফটে কি হয়। যারা জেনেটিক্সের প্রাথমিক ধারনা রাখেন তারা জানেন, ডিএনতে চারটি নিউক্লিউটাইড এডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন(C), থায়ামিন(T) বিভিন্ন কম্বিনেশনে পরস্পর যুক্ত থেকে প্রোটিন তৈরীর তথ্য ধারণ করে। প্রতি তিনটি নিউক্লিউটাইড একটি এমাইনোএসিডকে কোড করে। যেমন: GGU কোড করে গ্লাইসিন নামক একটি এমাইনো এসিডকে। ধরুন, CCUGGUUUG একটি ডিএনএ স্ট্রিং। এটি কোড করবে, প্রোলিন-গ্লাইসিন-লিউসিন (CCU-GGU-UUG)। এখন কোন কারণে যদি একটি ডিলেশন মিউটেশন হয় এবং প্রথম ‘C’টি বাদ হয়ে যায় তাহলে স্ট্রিংটি হবে-CUG-GUU-UG()। সুতরাং এ অবস্থায় প্রথম থেকে পড়লে, এমাইনো এসিডগুলো হবে- লিউসিন-ভ্যালিন-(বাস্তবে যেহেতু স্ট্রিং আরও বড় হয় একটি স্টপ কোডন (UGA, UAA, UAG) বা অন্য কোন এমাইনোএসিড)। অতএব, বুঝতেই পারছেন একটি ফ্রেমশিফট মিউটেশন প্রোটিনে কেমন ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন আনতে পারে। অধিকাংশ ফ্রেমশিফট মিউটেশনে স্টপ কোডন তৈরী হয় বা অকার্যকরী প্রোটিন তৈরী হয়। কিন্তু ফ্ল্যাভোব্যাকটেরিয়ামে সৌভাগ্যক্রমে একটি ফাংশানাল প্রোটিন তৈরী হয়ে গিয়েছিল যেটি নাইলনকে ব্রেকডাউন করিয়ে ব্যাকটেরিয়াটিকে প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচার সুবিধে করে দেয় (লক্ষ্যনীয় সংজ্ঞানুযায়ী প্লাজমিড এই ধরনের কাজই করে থাকে)।

মজার ব্যাপার হলো, এখানে ফ্রেমশিফট হয়েছে একটি রিপিটেটিভ ইউনিটের যেটা তিনের গুনিতক নয়। রিপিটেটিভ ইউনিটটি ১০টি নিউক্লিউটাইড বিশিষ্ট এবং এর স্টপ কোডন নেই। ফলে এর রিডিং একটি নিউক্লিউটাইড আগে বা পরে থেকে এমনিতেই পড়ার সুযোগ ছিল এবং এই ফ্রেম শিফটের কারণে কোন স্টপ কোডন তৈরী হয়নি। কিন্তু নাইলনেজ এনজাইম তৈরীর ঘটনায় একটি স্টার্ট কোডন তৈরী হয় ইনসারশন ইভেন্টের মধ্য দিয়ে। আর যেহেতু রিপিটিটিভ সিকোয়েন্সটিকে আগে থেকে ফ্রেম শিফট করে পড়ার উপায় ছিল (স্টপ কোডন না থাকায়), ফলে যখন নাইলনেজ এনজাইম ফ্রেম শিফট-এর মাধ্যমে তৈরী হয় এটি নাইলন যুক্ত পরিবেশে সিলেকটিভ এডভানটেজ দেয়ায় ন্যাচারালী সিলেকটেড হয়। (২)

প্রসঙ্গত, মোডিফিকেশন অব ফাংশন মিউটেশনের মধ্য দিয়ে কোন একটি এনজাইমে এমন পরিবর্তন আসতে পারে যাতে এনজাইমটি তার সাবস্ট্রেটের সাথে প্রায় একই গঠনযুক্ত সাবস্ট্রেট ব্যবহার করতে পারে। মিউটেশনের মধ্য দিয়ে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। সুতরাং নাইলনেজ এনজাইমের পিছনেও এরকম একটি ঘটনা থাকা অসম্ভব না। নেগোরো এবং সহকর্মীরা এই বিষয়টিই বলতে চাচ্ছেন। (দেখুন, পরবর্তী প্যারা) উল্লেখ্য, মোডিফিকেশন অব ফাংশন মিউটেশনের মধ্য দিয়ে কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন জেনেটিক তথ্য যুক্ত হয় না। অন্য কথায় যে এনজাইম গ্লুকোজকে ব্যবহার করছে, সে মোডিফিকেশন অব ফাংশন মিউটেশনের মধ্য দিয়ে হয়ত গ্লুকোজের আইসোমার গ্যালাকটোজকে ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু তার পক্ষে কোন এমাইনোএসিডকে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। আবার যে এনজাইমটি পরিবর্তন হলো সে যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ মাল্টিপ্রোটিন কমপ্লেক্সের সদস্য হয়, সেক্ষেত্রে তার ফাংশনের মোডিফিকেশন ব্যাকটেরিয়া (তথা অর্গেনিজম)-র ফিটনেস কমিয়ে দেবে। আর মোডিফিকেশন যদি এমন ভাবে হয়, যে এনজাইম তার মূল কাজ একেবারেই করতে না পারে, তাহলে তো ব্যাকটেরিয়াটি সারভাইভ-ই করতে পারবে না। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে কয়েকটি র‍্যানডম মিউটেশন দিয়ে নতুন স্ট্রাকচার তৈরী প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণেই সম্ভব নয়।  

একটি এনজাইম যে সাবস্ট্রেট তথা উপাদানের উপর কাজ করে সেটির সাথে কাছাকছি গঠনের উপাদানের উপর কাজ করার যোগ্যতা রাখে। ফলে দেখা যায়, অনেক ‘মোডিফিকেশন অব ফাংশন’ মিউটেশনের মধ্যে দিয়ে একটি এনজাইম পরিবর্তিত হয়ে উক্ত কাছাকাছি গঠনের উপাদানকে শক্ত করে বাঁধতে পারলো (অর্থাৎ স্পেসিফিসিটি পরিবর্তন হলো) এবং বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারলো। এ ঘটনাকে মাইক্রোইভুলিউশনের মধ্য দিয়ে হোমোলোগাস সাবস্ট্রেটে স্পেসিফিসি পরিবর্তন বলা যায়। যেমন: যে এনজাইম রিবিটলকে (সাবস্ট্রেট)  অক্সিডাইজ (বিক্রিয়া) করতো সে ডিলেশন অব ফাংশন মিউটেশনের ( রিবিটল ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইমের রিপ্রেসর লস) মধ্য দিয়ে রিবিটলের সাথে হোমোলোগাস জাইলিটল বা এরাবিটল ব্যবহার করতে জানে।  Negoro et el.  দেখিয়েছেন নাইলনেজ (যার মূল নাম: সিক্সএমাইনো ক্যাপ্রোয়েট ডাইমার হাইড্রোলেজ) এনজাইমটির কাছাকাছি গঠনের এনজাইম হলো হেক্সাকার্বক্সিলিক এসিড এস্টারেজ তথা কার্বক্সিলএসটারেজ এনজাইম (হোমোলোগাস)। সুতরাং অস্বাভাবিক না যে, পরের এনজাইমটি থেকে মোডিফিকেশন অব ফাংশন মিউটেশনের মধ্য দিয়ে নাইলনেজ তৈরী হতে পারে। (৩)

নাইলনেজ এনজাইম কি বিবর্তনের উদাহরণ?

সিক্স অ্যামাইনো হেক্সানয়েট ডাইমার হাইড্রোলেজ, উৎস

ইন ফ্যাক্ট হয়েছেও তাই। যে জাপানী বিজ্ঞানীরা নাইলোনেজ এনজাইম প্রথম আবিস্কার করেন তাদের পরবতী গবেষণায় প্রমানিত হয় যে নাইলোনেজ এনজাইমে নতুন কোন প্রোটিন গঠন তৈরী হয়নি। বরং, যে প্রোটিন থেকে বিবর্তিত হয়ে নাইলোনেজ এসেছে তাতে পূর্ব থেকেই কার্বক্সিলএস্টারেজ এক্টিভিটি এবং সাথে অল্প মাত্রার নাইলোনেজ এক্টিভিটি ছিল । এমনকি, পরীক্ষা করে দেখা গেছে নতুন নাইলোনেজ এনজাইম কমপ্লেক্স-এর একই সাথে কার্বক্সিলএস্টারেজ ও নাইলোনেজ এক্টিভিটি আছে (৪)। সেক্ষেত্রে এটাকে একেবারে নতুন কার্যকরী প্রোটিন (new functional protein) তৈরীর সংজ্ঞায় ফেলা যাচ্ছে না।

সুতরাং বিবর্তনবাদীদের উপস্থাপিত এই একটি উদাহরণও প্রশ্নাতীত নয়। অথচ, এরুপ ব্যতিক্রম কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ উদাহরণ এনে তারা মাইক্রোইভুলিউশন থেকে ম্যাক্রোইভুলিউশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত(!) তথা ইনফারেন্স টেনে ফেলেছে। রিসার্চ মেথোডোলজিতে নাল হাইপোথিসিস বলে একটি কথা আছে। অর্থাৎ কোন কিছুর সাথে কোন কিছুর সম্পর্ক আছে প্রমাণ করতে হলে আগে ধরে নিতে হয়ে সম্পর্ক নাই। তারপর ‘উপযুক্ত’ ও ‘যথেষ্ট’ প্রমাণাদি দিয়ে সেই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হয়। বিচারব্যবস্থাতেও অভিযুক্তকে নিরপরাধ ধরেই বিচার করতে হয়। বিজ্ঞানের সকল নিয়মই এভাবে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কিন্তু মজার ব্যপার হোলো, বিবর্তনবাদীরা আগে ধরে নেন যে বিবর্তন হয়েছে, তারপর পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। কিন্তু কতগুলো দুর্বল যুক্তির উপর একটি বড় সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে তাকে বিজ্ঞান বলে না, অপবিজ্ঞান বলে।  

নাস্তিক ডারউইনবাদীরা বিজ্ঞানের ভিতর নিজের অন্ধবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়ে স্রষ্টায় বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে খণ্ডিত করার মিথ্যাচার চালাচ্ছে। অতএব, তাদের এই প্রতারণা ধরিয়ে দেয়া যে কোন সচেতন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির দায়িত্বের মধ্যে পরে।

রেফারেন্স:

১. Venema D. Intelligent Design and Nylon-Eating Bacteria [Internet]. Biologos. 2016. Available from: https://biologos.org/articles/intelligent-design-and-nylon-eating-bacteria

২.Dembski W. Why Scientists Should NOT Dismiss Intelligent Design [Internet]. Uncommondescent. 2005. Available from: https://uncommondescent.com/evolution/why-scientists-should-not-dismiss-intelligent-design/

৩. Negoro S. et el. X-ray crystallographic analysis of 6-aminohexanoate-dimer hydrolase: molecular basis for the birth of a nylon oligomer-degrading enzyme. J Biol Chem. 2005 Nov 25;280(47):39644-52. Epub 2005 Sep 14

৪. Guager A. The Nylonase Story: When Imagination and Facts Collide [Internet]. Evolutionnews. 2017 [cited 2019 Nov 18]. Available from: https://evolutionnews.org/2017/05/the-nylonase-story-when-imagination-and-facts-collide/

লাস্ট আপডেট: ১৮/১১/২০১৯

মানুষের আদি পিতা-মাতা ও বিজ্ঞান সাংবাদিকতা

সাংবাদিকরা যখন বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেন তখন যে বিজ্ঞানের ‘ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি’ অবস্থা হয় তার সবচেয়ে উদাহরণ হল বাংলাদেশের চিকিৎসা বা চিকিৎসকদের নিয়ে করা প্রতিবেদন। ধরে নিলাম অধিকাংশ বাংলাদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে এত বড় আশা কঠিন যে তারা কোন বিষয় সম্পর্কে বিস্তর জেনে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ দিবে। কিন্তু পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যমগুলোর কি অবস্থা? বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে তাদের কোন প্রতিবেদনে কি বিশ্বাস করা যায়?

ব্যক্তিগতভাবে আমার এই ধরনের সকল ‘পপুলার সায়েন্স নিউজ’-এ এক সময় ভালই আস্থা ছিল। কিন্তু, এখন আর তা করতে পারি না। কারণ, বিবর্তনবাদ, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রভৃতি নিয়ে সায়েন্স নিউজ রাইটারদের চটকদার নিউজ পড়ার পর যতবারই একটু গভীরে ঘেটে দেখেছি ততই তাদের তথা সায়েন্স (নিউজ) রাইটারদের প্রতি আমার বিশ্বাস হালকা হয়ে গেছে। সায়েন্স রাইটাররা দুই ধরনের হয়- হয় তারা ভাল জানে এবং জেনে ইচ্ছেকৃত স্পেসিফিক এজেন্ডা (সায়েন্টিজম-এর প্রসার) এর জন্য লিখে, অথবা, তারা জিনিসটা সম্পর্কে না জেনে বা না বুঝে লিখে। সব সায়েন্স নিউজ পোর্টাল এরকম হয় তাও বলছি না। তবু, সায়েন্স নিয়ে কোন ‘নিউজ’ দেখলে চেষ্টা করি মূল রিসার্চটা কি বলেছে একটু ঘেটে দেখার। বিশেষ করে, যদি সময় পাই, যে বিষয়টির টেকনিকাল দিকগুলো সম্পর্কে পড়েছি, অন্তত সে বিষয়গুলো একটু দেখে নেই।   


যাই হোক, ফেসবুকে ডেইলী মেইলের একটি নিউজ সবাই শেয়ার করছে যাতে বলা হচ্ছে যে, মার্ক স্টিকল ও ডেভিস থেলার নামক দু জন বিজ্ঞানী তাদের ২০১৮ সালের একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখিয়েছেন সমস্ত মানুষ এক জোড়া মানুষ থেকে এসেছে এবং এক লক্ষ বছর আগে একটি সর্বব্যপী দূর্ঘটনায় পৃথিবীর সব স্পিসিস প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।(1)

এই নিউজ যারা পড়েছেন এবং শেয়ার করেছেন তাদের মধ্যে দু’ধরনের রিসপন্স দেখলাম-
১. যারা ডারউইনবাদকে বিতর্কিত তত্ত্ব বলে মনে করেন তারা এই গবেষণাটিকে বিবর্তনের বিপরীতে এভিডেন্স হিসেবে দেখছেন এবং তারা ইমপ্লিসিট ভাবে মনে করছেন যে এই আবিস্কার মেজর রিলিজিওন বর্ণিত ‘আদম-হাওয়া’ থেকে মানুষের আবির্ভাবকে এনডর্স করে।
২. যারা ডারউইনবাদকে প্রশ্নাতীতভাবে সত্য মনে করেন, তারা হয় চুপ আছেন বা এই রিসার্চ বিবর্তনতত্ত্বকে এনডর্স করে বলে মনে করছেন।

আগে থেকে এই ধরনের রিসপন্স সম্পর্কে পরিচিতি থাকায় আমি ভাবলাম মূল রিসার্চটা একটু পড়ে দেখা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। আর্টিকেলটা পড়লাম। মলিকিউলার ইভল্যুশন সম্পর্কে আইডিয়া না থাকলে আর্টিকেল থেকে মূল বক্তব্য বের করাটা একটু কঠিন। তবে আমি যতটুকু বুঝেছি সেখান থেকে পাঠকদের জন্য আমার দুই পয়সা-
  
মূল রিসার্চটার টাইটেল হল “Why should mitochondria define species?” এটি প্রকাশিত হয়েছে হিউম্যান ইভল্যুশন জার্নালে ২০১৮ সালের মে মাসে(2)। নিচে আর্টিকেলে মূল বিষয়গুলো নিজের ভাষায় বলার চেষ্টা করছি।

১. আমরা জানি, প্রতিটি বহুকোষী জীব-এ মাইটোকন্ড্রিয়া নামক অঙ্গানু থাকে যা এটিপি হিসেবে শক্তি সঞ্চিত রাখে।

২. কোষে নিউক্লিয়ার ডিএনএ ছাড়াও মাইটোকন্ড্রিয়ার নিজস্ব ডিএনএ আছে।

৩. নিউক্লিয়ার ডিএনএ-তে মিউটেশনের ফলে জীবের ফিনোটাইপে (অর্থাৎ বাহ্যিক আকার আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য) পরিবর্তন হয়।

৪. কিছু কিছু মিউটেশন আছে যাকে বলে ‘নিউট্রাল মিউটেশন’। কারণ, এই ধরনের মিউটেশনের ফলে প্রোটিনের অ্যামাইনো এসিড সিকোয়েন্সে কোন পরিবর্তন হয় না।

৫. কিন্তু, নিউক্লিয়ার ডিএনএ-তে এই ধরনের মিউটেশনের ফলেও ফেনোটাইপে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন  লক্ষ্য করা যায়।   

৬. প্রায় সব মিউটেশনই প্রোটিনের মূল ফাংশনের ব্যঘাত ঘটায়- হয় তার কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় বা বিকল করে ফেলে। ফেনোটাইপে এ ধরনের পরিবর্তন হলে, উক্ত প্রানীটি রিপ্রোডাক্টিভ ক্ষমতা কমে যায়। কারণ, তার এক বা একাধিক ফাংশনে ত্রুটি থাকায় সে বেঁচে থাকার লড়াই-এ হেরে যায়। এ কারণে এই ধরনের মিউটেশনগুলো পরবর্তি জেনারেশনের প্রবাহিত হতে পারে না। অর্থাৎ, নিউক্লিওটাইড চেঞ্জযুক্ত প্রাণীগুলো অন্য প্রাণীর সাথে প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়। (এভাবে, মিউটেশনযুক্ত প্রাণীর মারা যাওয়া ও অরিজিনাল ফাংশনাল  সিকোয়েন্সযুক্ত প্রাণীর বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে বলে পিউরিফাইং সিলেকশন।)

৭. এর ফলে ‘মা’ প্রানী ও ‘সন্তান’ প্রাণীর নিউক্লিয়ার ডিএনএ-তে খুব বেশী পরিবর্তন পাওয়া যায় না।

৮. কিন্তু, মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ-এর ক্ষেত্রে ‘নিউট্রাল মিউটেশন’ কোন গুরুত্বপূর্ণ ফাংশনাল পরিবর্তন (ফেনোটাইপিক পরিবর্তন) আনে না। অর্থাৎ, মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএতে এই নিউট্রাল মিউটেশনগুলো থেকে যায়। অর্থাৎ ‘মা’ থেকে ‘সন্তানে’ জননকোষ বিভাজনের সময় সংঘটিত মাইটোকন্ড্রিয়াল মিউটেশনগুলো থেকে যায়।

৯. মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএতে এই নিউট্রাল মিউটেশনগুলো থেকে যাওয়া উপকারিতা কি?

১০. উপকারিতা হল- এর ফলে ‘মা’ এর তুলনায় ‘সন্তানদের’ মাইটোকন্ড্রিয়াতে যথেষ্ট জেনেটিক ডাইভারসিটি তৈরী হয়।

১১.  এখন, আপনি যদি ধরে নেন যে মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ-তে প্রতিবার রিপ্রোডাকশনের সময় সংঘটিত পরিবর্তনগুলো একটি স্থির হারে হয় এবং আপনার যদি কোন স্পিসিস-এর প্রতি রিপ্রোডাকশনে মিউটেশনের হার জানা থাকে, তাহলে আপনি কোন প্রজাতির আভ্যন্তরিন জেনেটিক ডাইভারসিটি থেকে উক্ত প্রজাতি ও তার কমন এনসেস্টর-এর মর্ধবর্তী সময় বের করতে পারবেন(3)। (এই সময়কে বলা হয় কোলেসেন্স টাইম)

১২. বিজ্ঞানী স্টিকেল ও থেলার কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার এই বৈশিষ্ট্যটি ব্যবহার করে মানুষের কমন এনসেস্টর কত পূর্বে ছিলো এবং একই সাথে অন্যান্য প্রাণীদের কমন এনসেস্টর কতপূর্বে ছিলো তার একটি এস্টিমেট বের করেন।

১৩. তারা মাইটোকন্ড্রিয়ার COI barcode ডাটাবেজ BOLD-এর ডাটা ব্যবহার করেন। লক্ষ্যনীয় যে, GenBank এবং BOLD ডাটাবেজ মিলে প্রায় ৫০ লক্ষ প্রানীর COI barcode ডাটা সংরক্ষিত আছে।

১৩. তাদের হিসেব অনুযায়ী মানুষের কমন এনসেস্টর ছিলো প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে। অর্থাৎ, প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে একজন পুরুষ ও নারী থেকে বর্তমান মানব জাতি এসেছে। 

১৪. মজার বিষয় হলো, একই সাথে তারা অন্যান্য প্রাণীর বারকোড থেকে হিসেব করেন যে প্রাণী জগতের বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৯০%-এর কমন এনসেস্টর-এর বয়সও প্রায় ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর। অর্থাৎ, মানুষের মত অন্যান্য প্রাণীও ১ থেকে ২ লক্ষ বছর পূর্বের এক জোড়া কমন এনসেস্টর থেকে এসেছে।

১৫. এর অর্থ কি? সহজ বাংলায়, স্টিকেল ও থেলারের গবেষণা অনুযায়ী বর্তমানে প্রাণীজগতের প্রায় ৯০% প্রায় ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগের সংশ্লিষ্ট প্রজাতির এক জোড়া থেকে এসেছে। উদাহরণস্বরুপ, মানুষের ক্ষেত্রে এক জোড়া নারী-পুরুষ, বাঘের ক্ষেত্রে একজোড়া বাঘ ও বাঘিনী, ইত্যাদি। যারা প্রায় ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে প্রায় কাছাকাছি সময় জীবিত ছিলো ।

১৬.  মানুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের হিসেব (Estimate) আগেও করা হয়েছে।

১৭. লক্ষ্যনীয়, মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শুধুমাত্র নারীদের জনন কোষ থেকে সন্তানের জাইগোটে প্রবাহিত হয়। ফলে, কেউ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ থেকে মানুষের এনসেস্ট্রি অ্যানালাইজ করলে মানুষের সর্বশেষ কমন ‘মা’-কে ট্রেস করতে পারবে। ঠিক একই ভাবে শুধুমাত্র ‘Y’ ক্রোমোজোম নিয়ে এনসেস্টি অ্যানালাইজ করলে মানুষের সর্বশেষ কমন ‘বাবা’ কে ট্রেস করা যাবে।

১৮. মাইটোকন্ড্রিয়ার ভিত্তিতে প্রথম কমন ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’ এর বয়স বের করেন বিজ্ঞানী কেন, স্টোনকিং এবং উইলসন। তাদের হিসেবে অনুযায়ী মানুষের কমন ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’-এর বয়ষ প্রায় ২ লক্ষ বছর। অর্থাৎ ২ লক্ষ বছর আগে আমাদের কমন ‘মা’ পৃথিবীতে বিচরণ করেছিলেন। (4)


১৯.  ‘Y’ ক্রোমোজোম-এর ভিত্তিতে মানুষের কমন বাবা তথা ‘Y ক্রোমোজোমাল অ্যাডাম’-এর বয়স হিসেব ২০০০ সালের দিকে হিসেব করা হয়েছিলো প্রায় ৫০০০০ বছর(5)। যা ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’ থেকে প্রায় দেড় লক্ষ বছর ছোট।

২০. কিন্তু, পরবর্তীতে আরও রাইগোরাসটিল গবেষণা করে ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’ এবং ‘Y ক্রোমোজোমাল অ্যাডাম’-এর বয়স হিসেব করা হয় যথাক্রমে ৯৯ থেকে ১লক্ষ ৪৮ হাজার বছর এবং ১লক্ষ ২০ হাজার থেকে ১লক্ষ ৫৬ হাজার বছর(6)।

২১. বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযয়ী, ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’ এবং ‘Y ক্রোমোজোমাল অ্যাডাম’ প্রায় কাছাকাছি সময় বাস করেছিলেন।


২২. তবে আমাদের মনে রাখা দরকার, এগুলো আসলে কিছু Provisional Estimate. কোন কনফার্মড হিসেবে নয়(7)।

২৩. যাই হোক, এখন আমরা যদি ১৫ নম্বর পয়েন্ট আবার পড়ি- স্টিকেল ও থেলারের গবেষণা অনুযায়ী বর্তমানে প্রাণীজগতের প্রায় ৯০% প্রায় ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগের সংশ্লিষ্ট প্রজাতির এক জোড়া থেকে এসেছে। উদাহরণস্বরুপ, মানুষের ক্ষেত্রে এক জোড়া নারী-পুরুষ, বাঘের ক্ষেত্রে একজোড়া বাঘ ও বাঘিনী, ইত্যাদি। যারা প্রায় ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে প্রায় কাছাকাছি সময় জীবিত ছিলো।

২৪. এই রিসার্চ থেকে দুটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে।

২৫. এক, ১ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে কোন এক বড় ধরনের  ক্যাটাস্ট্রফিক ইভেন্ট-এর কারণে তখনকার প্রায় অনেক প্রজাতির ‘ভিন্ন নিউক্লাওটাইড সিকোয়েন্স’ যুক্ত ভাই-বোনেরা মারা যায়। ফলে, যে একজোড়া পুরুষ-নারী থেকে পরবর্তী জেনারেশন-এর ডাইভারসিফিকেশন হয়। (একে বলা হয় পপুশেন বোটল নেক)


২৬. দুই,  ১ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে পৃথকভাবে একজোড়া করে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী পৃথিবীতে পাঠানো হয় এবং তা থেকে পরবর্তী জেনারেশন-এর ডাইভারসিফিকেশন হয়।

২৭. মজার বিষয়, ‘ম্যাটেরিয়ালিস্ট’-দের জন্য ২৫ ও ২৬ দুইটাই প্রবলেমেটিক। কারণ, ২৫ ঠিক হলে নূহ (আ)-এর প্লাবণ-এর মত একটি ক্যাটাস্ট্রফের ইঙ্গিত পাওয়া, যার সম্পর্কে প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থে বিভিন্নভাবে বর্ণনা এসেছে। আর, ২৬-কে তারা outright রিজেক্ট করে।

২৮. এজন্য আলোচ্য রিসার্চের দুইজন অথারকে বলতে শুনা যায়-

“This conclusion is very surprising,” co-author David Thaler of the University of Basel is quoted as saying, “and I fought against it as hard as I could.” His co-author is fellow geneticist Mark Stoeckle of Rockefeller University in New York (3)

২৯. মজার বিষয় হলো এরা আগে ২০০৪ সালের একটি পেপারে একই অথাররা পাখির দুটো লিনিয়েজ পরীক্ষা করে বলেছিলেন-
“The ad hoc modifications to neutral theory commonly proposed to account for low variation in individual cases, namely, recurrent bottlenecks or selective sweeps, struggle as general mechanisms. If bottlenecks limit variation, then a universal low ceiling implies recent population crashes for all species. This appears unlikely– almost a Noah’s Ark hypothesis–although perhaps long-term climate cycles might cause widespread periodic bottlenecks.” (8)

৩০. সবার শেষে Evolution News-এর এন্ড্রু জোনস-এর একটি কথা কোট করে শেষ করছি –

“In any case, one thing is clear: reconstructing the past is a complicated business and it is still full of surprises. There may be even bigger surprises in store.”

রেফারেন্স:

1.      McManus L. Every person was spawned from single pair of adults living up to 200,000 years ago, scientists claim | Daily Mail Online [Internet]. Daily Mail. 2018 [cited 2018 Nov 26]. Available from: https://www.dailymail.co.uk/news/article-6424407/Every-person-spawned-single-pair-adults-living-200-000-years-ago-scientists-claim.html?fbclid=IwAR25ZFBERNCQqdzNrdMfrQkVIFS8CSbBvJlRXTv8seHsngm-W8DR39Ke_HA

2.      Stoeckle MY, Thaler DS. Why should mitochondria define species? Hum Evol. 2018;33:1–30.

3.      Jones A. New Paper in Evolution Journal: Humans and Animals Are (Mostly) the Same Age? Evolution News. 2018.

4.      Cann RL, Stoneking M, Wilson AC. Mitochondrial DNA and human evolution. Nature [Internet]. 325(6099):31–6. Available from: http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/3025745

5.      Thomson R, Pritchard JK, Shen P, Oefner PJ, Feldman MW. Recent common ancestry of human Y chromosomes: Evidence from DNA sequence data. Proc Natl Acad Sci U S A [Internet]. 2000;97(13):7360–5. Available from: http://www.pnas.org/content/97/13/7360.abstract%5Cnhttp://www.pnas.org/content/97/13/7360.full.pdf

6.      Poznik GD, Henn BM, Yee MC, Sliwerska E, Euskirchen GM, Lin AA, et al. Sequencing Y chromosomes resolves discrepancy in time to common ancestor of males versus females. Science (80- ). 2013;341(6145):562–5.

7.      Klinghoffer D. About “Y Chromosome Adam” and & “Mitochondrial Eve” [Internet]. Evolution News. 2013 [cited 2018 Nov 26]. Available from: https://evolutionnews.org/2013/08/about_y_chromos/

8.      Stoeckle MY, Thaler DS. DNA barcoding works in practice but not in (neutral) theory. PLoS One. 2014;9(7):3–9.