ধরুন, আপনি বোটে করে সমুদ্র ভ্রমণে বেরিয়েছেন। পথিমধ্যে বোটের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে। ওদিকে আপনি পান করার জন্য যতটুকু পানি নিয়ে এসেছেন তা শেষ হয়ে গেছে। আপনার কাছে সফট ড্রিংকস আছে। কিন্তু, তাতে কি আপনার তৃষ্ণা মিটবে? আপনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন যে জীবনে পানির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।
মানুষের একটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে যে বিষয়গুলো কোন প্রকার কষ্ট ছাড়াই প্রতিদিন উপভোগ করছে সেগুলো তার মনে কখনও ভাবনার উদ্রেক করে না। যেমন আমরা সবসময় দেখি কোন জিনিস উপর থেকে ফেললে নিচে পড়ে। কিন্তু, কেন পড়ে সেই বিষয়ে আমাদের কোন কৌতুহল জাগ্রত হয় না। যারা একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করে তারা পর্যবেক্ষণলব্ধ ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ খুঁজে পায়।
পানি হচ্ছে মহান আল্লাহর এমন একটি নেয়ামত যার গুরুত্ব আমরা সচরাচর উপলব্ধি করি না। তাই আসুন আজকে আমরা একটু পানি নিয়ে ভাবনার জগতে ডুব দেই।
আনবিক পর্যায়ে দুটি হাইড্রোজেন অ্যাটোম এবং একটি অক্সিজেন অ্যাটোমের সমন্বয়ে তৈরী হয় পানি। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দুটিই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বায়বীয় অবস্থায় থাকে। অথচ, এই দুটোর সমন্বয়ে তৈরী হয় অসাধারণ এক তরল যার উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে আছে সমগ্র জীবজগত। মানবদেহের প্রায় সত্তর শতাংশ হল পানি।
পানির অনেকগুলো ইউনিক বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্যান্য তরল পদার্থের নেই। Michael Denton তার বই Nature’s Destiny: How the Laws of Biology reveals Purpose in the Universe-এ পানির বেশ কিছু ‘ইউনিক’ তথা স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেছেন। চলুন এ রকম কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নিই।
পদার্থের একটা সাধারন নিয়ম হল উত্তপ্ত করলে প্রসারিত হয় এবং ঠান্ডা করলে সংকুচিত হয়। পানির ক্ষেত্রেও এ রকম হয়। তবে অন্যান্য পদার্থকে ঠান্ডা করতে থাকলে সেগুলো সংকুচিত হতে হতে একটা সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গিয়ে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। উক্ত তাপমাত্রাকে বলা ‘ফ্রিজিং পয়েন্ট’। পানির একটি ‘ইউনিক’ বৈশিষ্ট্য হল পানি যেই তাপমাত্রায় (শুন্য ডিগ্রী সেলসিয়াস) গিয়ে বরফে পরিণত হয় ঠান্ডা করতে থাকলে পানি সেই পর্যন্ত সংকুচিত হয় না। বরং চার ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত সংকুচিত হওয়ার পর প্রসারিত হতে শুরু করে এবং বরফে পরিনত হওয়ার সময় হঠাৎ অনেক বেশী প্রসারিত হয়। পানির এ বৈশিষ্ট্যের কারণে অত্যন্ত ঠাণ্ডা এলাকায় পুকুর বা লেক বা মেরুঅঞ্চলের সমুদ্রে পানি উপরিতলে বরফে পরিনত হলেও নিচে তরল হিসেবে থাকে। ফলে, গভীরের বসবাসরত সামুদ্রিক জীবগুলো বরফে পরিণত হয় না এবং বেঁচে থাকে। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, পানিও তো পদার্থ। তাহলে কেন এটা অন্যান্য পদার্থের মত ‘ফ্রিজিং পয়েন্ট’ পর্যন্ত সংকুচিত হয় না?
কোন পদার্থ যখন তরল থেকে বায়োবীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয় তখন পরিবেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপগ্রহন করে। একে বলে ‘ল্যাটেন্ট’ হিট। পৃথিবীতে যত তরল আছে তার মধ্যে পানির ‘ল্যাটেন্ট’ হিট সবচেয়ে বেশী। এই গরম কালে আপনি আপনার রুমে কিছু কাপড় ভিজিয়ে রেখে দেখুন। ধীরে ধীরে রুমটা অনেক ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কারণ কাপড়ের উপরিস্তর থেকে পানির অনু জলীয়বাস্প হয়ে উড়ে যাওয়ার সময় পরিবেশ থেকে তাপ শোষন করে নিয়ে যায়। পানির এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে পৃথিবীর আবহাওয়া খুব দ্রুত তাপমাত্রা পরিবর্তন হত। ছোট ছোট লেক বা নদী খুব দ্রুত উধাও হয়ে যেত আবার উদয় হত। অন্যদিকে জীবজগতের শারিরীক তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রন সুশৃংখলভাবে সম্ভব হচ্ছে পানির এই বৈশিষ্ট্যের কারণে।
কোন পদার্থের তাপমাত্রা এক ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বাড়ানোর জন্য যতটুকু তাপ দেয়া দরকার তাকে বলে ‘থারমাল ক্যাপাসিটি’। পানির থার্মাল ক্যাপাসিটিও অন্যান্য সব পদার্থের চেয়ে বেশী। এইটাও পানির একটি ‘ইউনিক’ বৈশিষ্ট্য। কেন? এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে শীতকাল ও গরমকালে তাপমাত্রার পার্থক্য আরও প্রকট হত। আমরা উপরে জেনেছি মানুষের শরীরের প্রায় সত্তরভাগ পানি। পানির তাপমাত্রা এক ডিগ্রী বাড়াতে যদি অল্প তাপ দিলেই হত তাহলে অতিদ্রুত কোষের অন্ত:স্থ তাপমাত্রা বেড়ে যেত। ফলে কোষের ভিতরের গাঠনিক উপাদানগুলোর গঠন নষ্ট হয়ে যেত। জীবের গঠনের একাগ্রতা (ইনটেগ্রিটি) বিনষ্ট হত।
পানির আরেকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল পানির তাপ পরিবহন ক্ষমতা অন্যান্য সাধারণ তরল থেকে চারগুন বেশী। পানির এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে কোষের ভিতরে তাপমাত্রার সমসত্ব বিস্তৃতি সম্ভব হতো না।
অন্যদিকে বরফের তাপ পরিবহন ক্ষমতা কম। এ কারণে মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের উপরিভাগ বরফ হয়ে গেলেও নিচের অংশ বরফ হয় না যা জলস্থ জীবের বেঁচে থাকার জন্য জরুরী।
যে কোন তরলের উপরের স্তরে একটা পৃষ্ঠটান (সারফেস টেনশন) থাকে। পানির পৃষ্ঠটান অনেক বেশী। যার ফলে মাটির তলদেশে গাছপালার মূল পানির সরবরাহ বজায় থাকে। অন্যান্য তরল পদার্থের মত পানির পৃষ্ঠটান থাকলে পৃথিবীতে বড় কোন বৃক্ষ থাকত না। পানির এই পৃষ্ঠটানের কারণে পাথরের মধ্যস্থিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্র ও ফাটলগুলোতে পানি জমা হয় এবং এই পানি যখন ঠাণ্ডা হয়ে যায় তখন পাথর ভেঙ্গে যায় এবং পাথরে জমা হওয়া খনিজ পদার্থ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। যার মাধ্যমে পানি পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপরে আমরা পানির যে ফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানলাম জীবজগতের গঠনে এগুলো কোন উপকারেরই আসত না যদি না পানির রাসায়নিক গঠনও স্বতন্ত্র হত। পানিকে বলা হয় সার্বজনীন দ্রাবক। কারণ পানি অসংখ্য রাসায়নিক পদার্থকে দ্রবিভূত করতে পারে। পানি সার্বজনীন দ্রাবক না হলে জীবকোষের অসংখ্য রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্ভব হতো না এবং পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের বিস্তৃতি সমান হতো না।
পানির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এটি বেশ সক্রীয় (রিএকটিভ) রাসায়নিক পদার্থ। তবে বিভিন্ন অ্যাসিড বা ক্ষারের মত এত বেশী সক্রীয় না। যদি হত, তাহলে যে কোন পদার্থ পানিতে দেয়া মাত্রই মিশে যেত এবং কোন জৈবিক বৈশিষ্ট্য গঠন করা সম্ভব হতো না।
যে বৈশিষ্ট্যের জন্য পদার্থের আঠালো ভাবটা তৈরী হয় তাকে বলে সান্দ্রতা বা ভিসকোসিটি। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন তরল পদার্থের মধ্যে পানির সান্দ্রতা সবচেয়ে কম। শুধুমাত্র কিছু গ্যাসীয় পদার্থের (যেমন: হাইড্রোজেন) তরল অবস্থায় পানির চেয়ে কম সান্দ্রতা থাকে। মজার বিষয় হল পানির সান্দ্রতাও অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ সীমায় নির্ধারণ করা হয়েছে। পানির সান্দ্রতা যদি তরল হাইড্রোজেনের মত কম হত কোষের ভিতরস্থ কোন ধরনের আনুবিক্ষনিক গঠনকে ধরে রাখা সম্ভব হত না। আবার, পানির সান্দ্রতা বেশী হলে মাছ বলে কিছু থাকত না, পানিতে নৌকা চালানো সম্ভব হত না, সাতার কাটা যেত না। এমনকি, কোন আনুবিক্ষনীক জীব বা কোষের আভ্যন্তরীন ক্ষুদ্রাঙ্গের পক্ষে পানিতে চলাফেরা করা সম্ভব হত না।
ব্যাপন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রনে সান্দ্রতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। পানির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পদার্থ খুব দ্রুত ব্যাপন প্রক্রিয়ায় অল্প দূরত্বে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। কোষের ভিতর এবং বাহিরে বিভিন্ন উপাদানের আদান প্রদান নির্ভর করে ব্যাপন প্রক্রিয়ার উপর। পানির সান্দ্রতা দশগুন বেশী হলে ব্যাপন হার দশভাগ কমে যেত। ফলে কোন অনুজীব ব্যাপন প্রকিয়ায় খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করতে পারত না।
কৈশিক জালিকার মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নালী দিয়ে রক্ত প্রবেশ করার জন্য যে ধরনের সান্দ্রতা থাকা দরকার পানির সান্দ্রতাও ঠিক ততটুকুই ভারসাম্যপূর্ণ। সান্দ্রতা বেশী হলে কৈশিক জালিকায় রক্ত সঞ্চালনের জন্য হার্টের অনেক বেশী প্রেসার দিতে হত ফলে এমন কোন রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া তৈরীই সম্ভব হত না যা সফলভাবে কাজ করে।
বরফের সান্দ্রতাও পৃথিবীতে জীবন ধারনের জন্য নিয়ন্ত্রিত। বরফের সান্দ্রতা পানির সান্দ্রতার তুলনায় ১০^১৬ গুন বেশী। বরফের সান্দ্রতা কয়েক ভাগ কম হলে বরফপিণ্ড কর্তৃক পাহাড়ের মাটি ভেঙ্গে প্রকৃতিতে মিনারেল ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হতো না। অন্যদিকে সান্দ্রতা বেশী হয়ে গ্রানাইটের কাছাকাছি হলে মেরু অঞ্চলে পানির প্রবাহ থাকতো না, বিশাল বরফের স্তর থাকতো এবং পৃথিবীতে পরিমিত পরিমাণ তরল পানিই থাকতো না।
পানির ঘনত্বও জীবন গঠনের জন্য যথার্থ। পানির ঘনত্ব বর্তমানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী হলে জীবের ওজন বেশী হত, আকার আকৃতি অনেক ছোট হত এবং মানুষের মত সোজা মেরুদণ্ডী দ্বিপদী প্রানীর অস্তিত্ব সম্ভব হত না। শুধু তাই না ঘনত্ব বেশি হলে কার্বনভিত্তিক সকল জীব জলরাশির উপরের স্তরে ভেসে বেড়াতে হতো, ডুবতে পারতো না। অন্যদিকে ঘনত্ব কম হলে সিসার বলের মত পানির তলদেশে ডুবে যেত।
জীবনকে নিশ্চিত করার জন্য পানির এই সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর সংখ্যা এখানেই শেষ নয়। আবহাওয়ার চক্র নিয়ন্ত্রনের পানির বিভিন্ন ফিজিক্যাল ও কেমিকাল বৈশিষ্ট্যগুলোর ঠিক যতটুকু ‘টিউনিং’ হওয়া দরকার ঠিক ততটুকুই টিউনিং করা আছে।
সুতরাং, আমরা বুঝতে পারছি কেন পানির অপর নাম জীবন।
আপনার কি ধারণা পানির এই সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো একা একাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে তৈরী হয়ে গেছে? নাকি পানিকে এইভাবে পরিকল্পনা করেছেন কোন পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান স্বত্তা যিনি জীবন তৈরীর জন্য পানির প্রয়োজনীয় গঠন সম্পর্কে জানেন?
এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে বসুন। একবার ভাবুনতো এই যে মাটি খুড়লেই আপনি ভুগর্ভস্থ পানি পেয়ে যাচ্ছেন কেন এবং কোথা থেকে এই পানি আসল? পানির যে বৈশিষ্ট্যের জন্য মাটির গভীরে বা পাথরের ফাঁকে পানি জমে থাকছে সেই বৈশিষ্ট্য কার রহমতে সৃজিত হল? চিন্তা করে দেখুনতো, এই পানির স্তর যদি আরও নিচে নেমে যেত তাহলে কি আপনি বেঁচে থাকতে পারতেন?
“বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদেরকে সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা?” (সুরা মূলক্, আয়াত নং-৩০)