আপনি কি কখনও আপনার ত্বকের গঠন সম্পর্কে চিন্তা করেছেন? আপনার ত্বক হচ্ছে বাইরের অসংখ্য জীবানু ও ক্ষতিকর প্রভাবক থেকে সুরক্ষাদানকারী প্রাথমিক অঙ্গ। ত্বকের সুশৃংখল গঠনের কারণে আপনার শরীরে সহজে কোন জীবানু প্রবেশ করতে পারে না। আমাদের ত্বক প্রধানত দুই ধরনের লেয়ার নিয়ে গঠিত। বাইরের দিকের লেয়ারকে বলে এপিডার্মিস এবং ভিতরের দিকে লেয়ারকে বলা হয় ডার্মিস। আমাদের ত্বকের যত স্নায়ু ও রক্তনালী আছে তা থাকে ডার্মিস লেয়ারে। সুতরাং, একটা মশা যখন আমাদের ত্বকে বসে তার মুখটা ঢুকিয়ে দেয়, তখন তাকে রক্তপানের জন্য ডার্মিস লেয়ারে মুখ প্রবেশ করাতে হয়।
কিন্তু, ডার্মিস পর্যন্ত প্রবেশ করতে হলেতো মশাকে এপিডার্মিস লেয়ার অতিক্রম করে যেতে হবে। এপিডার্মিস লেয়ার মূলত চার ভাগে (বা পাঁচ ভাগে) বিভক্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বাইরের লেয়ারকে বলা হয় স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম। স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম এক ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত যাকে বলে কেরাটিনাইজড কোষ। কেরাটিনাইজড কোষের বিশেষত্ব হল এতে কেরাটিন নামক এক বিশেষায়িত প্রোটিন অনেক বেশী পরিমানে থাকে। কোষগুলো একটার ওপর আরেকটা এমন ভাবে লেপ্টে থাকে এবং পাশাপাশি এত শক্ত ভাবে যুক্ত থাকে যে এই লেয়ারকে সহজে ভেদ করা যায় না।
মানব ত্বকের গঠন
আপনাকে যদি বলা হয় যে, আপনি একটি সুতা নিন এবং আপনার ত্বকের ভেতর প্রবেশ করান। আপনি কি প্রবেশ করাতে পারবেন? পারবেন না, তাই না? কিন্তু, একটা মশা কিভাবে সুতার চেয়েও হালকা শুঁড়টাকে আপনার ত্বকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে? কখনও ভেবে দেখেছেন। এই অতিক্ষুদ্র শুঁড়টাকে প্রবেশ করানোর সময় তো বেঁকে যাবার কথা? এবং আসলে হয়ও তাই। কিন্তু, মশা তার শুঁড়ের অতি বিশেষায়িত গঠনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করে।
চলুন একটু দেখে নেই কেমন সেই শুঁড়ের গঠন। মশার শুঁড়ের ভিতরে থাকে ধারালো সূচের মত একটি গঠন । এটি মূলত ছয়টি প্রায় একই রকম দেখতে সূচের সমন্বয়ে গঠিত। একে তুলনা দেয়া যায় হাইপোডার্মিক নিড্ল-এর সাথে। আপনারা নিশ্চয়ই সিরিঞ্জ দেখেছেন। সিরিঞ্জের সূচটা যেরকম ধারালো, মশার শুঁড়ের ভিতরের সূচটা দেখতে হুবুহু একই রকম। খালি চোখে অবশ্য আপনি তা দেখতে পারবেন না। মশার শুঁড়ের এই সূচের মত ধারালো গঠন দেখতে আপনাকে অত্যন্ত শক্তিশালী অতিআণুবীক্ষনীক মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করতে হবে।
হাইপোডার্মিক নিডল
তো মশা যখন আপনার ত্বকে বসে তার শুঁড়টা ঢুকাতে শুরু করে অধিকাংশ সময় তার শুঁড়টা বেকে যায়। বাঁকা হয়ে মশা উড়ে গিয়ে আরেকটা স্পট খুঁজে বের করে যেখানে সে শুঁড়টাকে সোজাভাবে ত্বকে প্রবেশ করাতে পারবে। শুঁড় প্রবেশ করারনোর সময় ভিতরে অবস্থিত সূচের দুটো অংশ ত্বকে প্রবেশ করাতে সাহায্য করে। এরপর শুঁড়টা ত্বকের উপরের লেয়ারে হালকা প্রবেশ হয়ে স্থির হলে পরে মশা রক্তশোষনকারী ফ্যাসিকলটাকে ধীরে ধীরে প্রবেশ করাতে শুরু করে। এরপর সূচটা যখন রক্তের সন্ধান পায় তখন মশা স্থির হয়ে রক্ত পান করতে থাকে (১)। শুঁড় প্রবেশ করার পর সূচের অন্য দুটো অন্য দুটো অংশ কোষগুলোকে সরিয়ে ধরে রাখে যাতে রক্ত শোষনে কোন বাঁধা সৃষ্টি না হয়। এই সময় অন্য আরেকটি সূচের মাধ্যমে মশার এক ধরনের কেমিক্যাল নি:সৃত করতে থাকে যার ফলে রক্ত প্রবাহ অব্যহত থাকে।
মশার শুঁড় ও সূচ (প্রবোসিস ও ফ্যাসিকল)
বিস্ময়ের বিষয় হল মশা ত্বকে সূঁচ প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াতে অত্যন্ত কম বল (Little Force) ব্যবহার করে । এটা সম্ভব হয় সূঁচটির অত্যন্ত ক্ষুদ্র, সূক্ষ্ণ ও সুনির্দিষ্ট গঠন এবং মশার সূঁচ প্রবেশ করানো দক্ষতার কারণে (২)।
পাঠক চিন্তা করে দেখুন মশাকে তার শুঁড় মানুষের ত্বকে প্রবেশ করাতে হলে কি কি করতে হবে? প্রথমত, ত্বকের গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ কৈশিকরক্তনালীগুলো কোন লেয়ারে থাকে তা জানতে হবে। এপিডার্মিস লেয়ারে প্রবেশ করাতে হলে তাকে কতটুকু ফোর্স দিতে হবে তা জানতে হবে। কতটুকু গভীরে প্রবেশ করতে হবে তার উপর নির্ভর করবে তার সূঁচের দৈর্ঘ্য। সূঁচের মত ধারালো সাকশন মেশিন দরকার সেটা জানতে হবে এবং এভাবে লিস্ট করতে থাকলে হয়ত কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলা যাবে।
আপনাদের কি ধারণা মশা একা একা এটা চিন্তা করে বের করে এই গঠন বানিয়ে নিয়েছে। নাকি ‘অন্ধ’ প্রকৃতি (blind nature)-র এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ায় এই গঠন একা একা তৈরী হয়েছে? নাকি এই গঠনের পিছনের আছেন অতি বুদ্ধিমান কোন স্বত্ত্বা যিনি একই সাথে উভয়েরই সৃষ্টিকর্তা?
তবুও কি আমরা স্রষ্টার অনুগত হব না?
রেফারেন্স:
১. Ramasubramanian MK, Barham OM, Swaminathan V. Mechanics of a mosquito bite with applications to microneedle design. Bioinspiration and Biomimetics. 2008;3(4).
২. Kong XQ, Wu CW. Mosquito proboscis: An elegant biomicroelectromechanical system. Phys Rev E – Stat Nonlinear, Soft Matter Phys. 2010;82(1):1–5.