কাশি থেকে হাসি

11/03/2023

কাশি থেকে হাসি (গল্প)

রুদ্র সাহেব ৪০ বছর বয়সী একজন ব্যবসায়ী। পুরোনো ঢাকায় তার পাইকারী ব্যাবসা। তার ব্যবসা ভাল চললেও শরীরটা ইদানিং আগের মত চলছে না। গত এক বছর ধরে তার কফ-সহ কাশি হচ্ছে। কাশির ফ্রিকোয়েন্সি, সময়কাল এবং তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

মিস্টার রুদ্র সচেতন মানুষ। কিন্তু, তার একটা বদ অভ্যাস আছে। তিনি প্রচুর সিগারেট খান। সিগারেট যে তার কাশির কারণ হতে পারে তা তিনি আচ করতে পেরেছেন। কিন্তু, কেন যেন ছাড়তে পারছেন না। বছরের পর বছর ধরে তিনি ধূমপান করে আসছেন। এতদিনের যে অভ্যাস, তা ছাড়া তো আর সহজ কাজ নয়। অতীতে বেশ কয়েকবার তিনি ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই আবার সিগারেট ধরে ফেলেছেন। তবে এবার কাশির তীব্রতা বাড়ায় ভালোর জন্য ধূমপান ছাড়তে  তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

অতীতে, রুদ্রের ধূমপান ত্যাগ করার প্রচেষ্টাগুলি বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। যেমন- এক কাপ ধূমায়িত কফি এবং সিগারেট খেতে খেতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, কাজের চাপ, শূন্য শূন্য অনুভূতি, মনোযোগ দিতে ব্যর্থতা এবং দাম্পত্য জীবনের কোন ঝগড়া। রুদ্র সাহেবের স্ত্রীও ধুমপান পছন্দ করেন না। দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিকে তিনি রুদ্রকে এই ব্যপারে সতর্কও করেছিলেন। কিন্তু, একজন মানুষকে কতবার এক বিষয়ে বলা যায়। তাই আস্তে আস্তে সয়ে গেছেন। 

রুদ্রও অবশ্য সিগারেট কমিয়ে দিয়েছিলেন। স্ত্রীর সামনে তিনি ধুমপান করেন না। বাসায় আলাদা রুমে দরজা আটকে, বারান্দায়, টয়লেটেই সুখটানটা সেরে নেন।  স্ত্রীর অপছন্দ সত্যেও ধুমপান ত্যাগ করতে পারছেন না বিধায় অবশ্য তার মনে ক্ষুদ্র অনুশোচনাও কাজ করত অবশ্য। কিন্তু, তাতে কি? জীবনে যে পরিমান স্ট্রেস তাতো রিলিফ করতে হবে।

রুদ্র সাহেবের ব্যবসায় অনেক সময় দিতে হয়। অনেক কষ্টে তিনি খেলনার ব্যবসাটা দাড় করিয়েছেন। করোনার সময় ব্যবসায় বেশ বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন সেটা পুষিয়ে নিতে হবে। অন্যদিকে, রুদ্রের সন্তান হয় নি অনেক বছর। নীলার সাথে বিয়ের সংসার প্রায় ৭ বছর। অনেক দিনে চেষ্টা করেও সন্তান হচ্ছিল না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। খুব বড় কোন সমস্যা যে ছিলো তাও না। যাই হোক, অনেক ভাবে চেষ্টা করে অবশেষে দুই বছর আগে তাদের ঘর আলো করে ফুটফুটে একটি ছেলে হয়েছে। নাম রেখেছেন জীবন।

জীবনকে নিয়েও তার স্ট্রেস -এর কমতি নেই। গত দুই বছরে অন্তত চার বার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। হাচি, কাশি, জ্বর লেগেই থাকে ছেলেটার। অসুস্থতার জন্য বেড়েই ওঠতে পারছে না ও। ইদানিং ঠান্ডা লাগলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। রুদ্র খুব চিন্তায় আছেন জীবনকে নিয়ে। 

একদিন দুপুর বারটার দিকের ঘটনা। রুদ্র তখন অফিসে। নীলা বাচ্চাকে নানীর কাছে রেখে মার্কেটে গিয়েছে। জীবনের হঠাৎ শ্বাস কষ্ট শুরু হল। রুদ্র ও নীলা শুনতে পেয়ে দ্রুত বাসার দিকে রওনা হলো। কিন্তু, রাস্তার জ্যাম ঠেলে আসতে আসতে জীবনের অবস্থা খারাপ। হাসপাতালে নিতে নিতে জীবন শরীর নীল হয়ে গেছে প্রায়। ডাক্তার দ্রুত চিকিৎসা দিলেন। ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করতে হলো। অনেক কষ্টে সে যাত্রায় জীবন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরল।  

এই ঘটনা রুদ্রের জন্য একটা বড় ধাক্কা ছিল। জীবনের বংশের কোন দিকে দিয়েই কারও হাপানি নেই। কিন্তু, জীবনের এই সমস্যা কিভাবে হল। ডাক্তার বলেছেন প্যাসিভ বা সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং-এর ফলে তাদের বাচ্চার এ রকম হতে পারে। রুদ্র বাসার রুমে বা বাথরুমে সিগারেট খেলেও তার ধোঁয়া বাসায় ছড়িয়ে পড়ে। বহুদিন ধরে এই যৎসামান্য সিগারেটের ধোঁয়াই হয়ত মূল কালপ্রিট।

তাই রুদ্র সাহেব এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন যে ধূমপান ত্যাগ করবেন। তিনি জানতেন যে ধূমপান ত্যাগ করার জন্য দৃঢ় সংকল্প এবং ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন । তাই অবচেতন মনকে শক্ত করার জন্য তিনি ধূমপানের খারাপ প্রভাব নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন । প্রতিবার ধূমপান ত্যাগের প্রচেষ্টা করতে গিয়ে তিনি তার ব্যর্থতা থেকে শিখেছেন এবং সফল হবার জন্য আরও ভাল কৌশল তৈরি করেছেন।

রুদ্র বুঝতে পেরেছিলেন যে ধূমপান ত্যাগ করা শুধুমাত্র একটি শারীরিক চ্যালেঞ্জ নয়, মানসিকও। ধূমপানের তাগিদকে প্রতিহত করার জন্য তার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং দৃঢ় সংকল্প গড়ে তুলতে হবে। ধূমপানের ট্রিগার এড়াতে তিনি তার জ্ঞানের বিকাশ এবং তার অবচেতন মনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।

অধ্যবসায় এবং দৃঢ় ইচ্ছার মাধ্যমে, রুদ্র সাহেব অবশেষে ‘অ্যাডাপটেশন’ পর্যায়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অ্যাডাপটেশন হল ট্রান্সথিওরেটিক্যাল মডেল অব বিহেইভিওর চেইঞ্জ-এর একটি ধাপ। ‘ট্রান্সথিওরেটিক্যাল মডেল অব বিহেইভিওর চেইঞ্জ’ হল মানুষ তার ব্যবহার পরিবর্তনের জন্য যে ধাপগুলোর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তার একটি মডেল। উক্ত মডেলের ধাপ হল- প্রি-কনটেমপ্লেশন, কনটেমপ্লেশন, প্রিপারেশন, অ্যাডাপটেশন, মেইনটেইনেন্স এবং টার্মিনেশন। একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত কোন আচরণ পরিবর্তনের উপকার না জানে ততক্ষণ সে উক্ত মডেলে প্রবেশ করে না। ধুমপানের অপকার সম্পর্কে জানতে পারলে সে প্রি-কনটেমপ্লেশন ফেইজে আছে। কনটেমপ্লেশন ফেইজে সে তার অভ্যাস পরিবর্তনের উপকার সম্পর্কে চিন্তা করে এবং তা পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এরপর সে নিজের মনকে প্রস্তুত করে এবং পরিবর্তনের সূচনা করে। সর্বশেষ, পরিবর্তিত অভ্যাস বজায় রাখার চেষ্টা করে। টার্মিনেশন স্টেইজে গিয়ে মানুষের নতুন আচরণটি অটোমেটিক হয়ে যায় এবং সে তার আগের আচরণে ফিরে যেতে চায় না। এই স্টেইজে খুব কম মানুষই প্রবেশ করতে পারে।  

অবশেষে রুদ্র পুনরায় ধূমপান ত্যাগ করলেন, কিন্তু তিনি জানতেন যে চ্যালেঞ্জ এখনও শেষ হয়নি। তিনি তার পুরোনো অভ্যাসগুলিতে ফিরে আসতে পারবেন না। অর্থাৎ তাকে যত কষ্টই হোক নতুন ধুমপানমুক্ত জীবনধারা বজায় রাখতে হবে।

..

প্রায় এক বছর পর।

ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরে ধীরে ধীরে রুদ্র সাহেবের কাশি ভাল হয়ে গিয়েছে। তিনি আগের চেয়ে সুস্থ, আরও উদ্যমী এবং আরও মনোযোগী বোধ করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে তার আগের ধূমপানের অভ্যাসটি শুধুমাত্র তার স্বাস্থ্যের ক্ষতিই করেনি, বরং তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনকেও প্রভাবিত করছিলো। রুদ্র অবশেষে ধূমপান ছাড়ার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা, দৃঢ় সংকল্প, অধ্যবসায় এবং জ্ঞানের গুরুত্বের উপর জোর দেন। তার যাত্রা আমাদের শেখায় যে ধূমপান ত্যাগ করা মানে শুধু শারীরিক আসক্তি কাটিয়ে ওঠা নয়, মানসিক আসক্তিও। ধূমপানের প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে, অধ্যবসায়, মজুবত ইচ্ছাশক্তি এবং দৃঢ় সংকল্প গড়ে তুলতে হবে। রুদ্রের গল্পটি এই সত্যের প্রমাণ যে ধূমপান ত্যাগ করা সম্ভব, এবং দীর্ঘমেয়াদে, ধূমপানমুক্ত জীবনধারা বজায় রাখার পুরষ্কারগুলিও অনেক বড়।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *