Md. Abdullah Saeed Khan

সংশয় থেকে বিশ্বাস: এক পথিকের গল্প

মো: আবদুল্লাহ সাঈদ খান

পেশা- চিকিৎসক

আমার জন্ম একটি মোটামুটি প্র্যাকটিসিং মুসলিম পরিবারে। যদিও আমার পিতা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আলেম ছিলেন না তিনি ইসলাম সম্পর্কে স্বেচ্ছায় অনেক বিস্তারিত পড়ালেখা করেছিলেন। তার প্রভাবে আমাদের মা এবং ভাই-বোনদের চেষ্টা ছিলো ইসলামের বেসিক আমলগুলো ঠিকমত করার। সে সুবাদে আমিও ছোটবেলা থেকে চেষ্টা করতাম যেন মৌলিক ইবাদতগুলো মিস না হয়।

কিন্তু, শয়তান আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছে যে সে মানুষের চতুর্দিক থেকে আক্রমন করবে। তাই কিশোর বয়স থেকেই আমার মাঝে সংশয়ের বীজ রোপিত হতে শুরু করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার রহমতে সংশয় আমাকে কখনই পুরোপুরি কুপোকাত করতে পারেনি। ফলে, আমার ইতিহাসটা হলো একটি যুদ্ধের ইতিহাস। সংশয়ের বিরুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের ইতিহাস। মজার বিষয় হলো, ঈমানকে লক্ষ্য করে আসা বিভিন্ন প্রশ্নগুলো আমার মাথায় অন্য কোন বই বা মানুষের প্ররোচনায় আসেনি। হ্যা, দু-এক জন বামপন্থী, নাস্তিক দু’একবার হিন্ট দিয়েছে। কিন্তু, আমার মস্তিষ্কের জন্য ওগুলোই হয়ত যথেষ্ট ছিলো। পরবর্তীতে নতুন নতুন সন্দেহপূর্ণ প্রশ্ন মাথায় একাই খেলা করতো।

তবে অন্তঃর্দ্বন্দ্বের এই সময়টা যে খুব আরামে কাটিয়েছি তা নয়। এখনও মনে পড়ে, প্রথম প্রথম এই সংশয়বাদী প্রশ্নগুলো নিয়ে যখন ভাবতাম বুকে চিন চিন ব্যাথা করতো, বুক চেপে আসতে চাইতো ও শ্বাসঃপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এখন বুঝি যে এগুলো ছিলো প্যানিক এটাকের লক্ষণ যা তীব্র এনজাইটি থেকে আসতো। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা’র কৃপায় সংশয় নিরসন হওয়া সাথে সাথে তীব্র এক প্রশান্তি মনে এসে ভর করতো। পরবর্তীতে জানা ও চিন্তার ম্যাচুরিটির সাথে সাথে বিভ্রান্তীমূলক চিন্তা আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকে। এখন নাস্তিকদের অযুক্তি, কুযুক্তি যতটুকু বুঝতে পারি তা এই তীব্র মানসিক যুদ্ধের ময়দানে প্রাপ্ত প্রশিক্ষনের ফসল।        

যতটুকু মনে পড়ছে আমার প্রথম সংশয়ের শুরুটা হয় তাকদির নিয়ে। তখন নবম শ্রেণীতে উঠেছি কেবল। কিন্তু, এমন একটি বিষয় নিয়ে সংশয় মনে দানা বেঁধেছে যেটি নিয়ে বেশী ভাবলে বিভ্রান্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশী। 

তাকদির সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো সাধারণত যে ধরনের হয় তাকে সংক্ষেপে দুটি বাক্যে নিয়ে আসা যায়- আল্লাহ যদি সবকিছু নির্ধারণ করে রাখেন তাহলে আমাদের বিচার কেন হবে? অথবা, আল্লাহ যেহেতু সবকিছু লিখেই রেখেছেন তাহলে আমি আমার মত যা ইচ্ছে করতে থাকি।

আমার অভিজ্ঞতায় মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী যারা তাকদির নিয়ে চিন্তা করেন তাদের মধ্যে কয়েকটি পরিণতি লক্ষ্য করা যায়। একদল, এই সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা থেকে নিজেকে বিরত রাখে যেন ঈমানে সমস্যা না হয়। আরেকদল, এটির ভুল অর্থ বুঝে নিয়ে পাপ কাজ অবলীলায় করতে থাকে। অর্থাৎ, সে তাকদির-এর বিশ্বাসও করে আবার পাপ কাজও করে। তবে, তাকদির সংক্রান্ত বিভ্রান্তি থেকে নাস্তিক হয়ে যাওয়ার লোকের সংখ্যা কম। যদিও এ বিষয়টি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করতে নাস্তিকরা বেশ তৎপর।

কিন্তু, আমি তো নাছোড়বান্দা। বুকের তীব্র ব্যাথাটাকে কমাতে আমাকে একটি স্যাটিসফ্যাকটরি উত্তর খুঁজে নিতে হবে। তাই আমি এই সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা ও অধ্যয়ন শুরু করলাম।  প্রথমে জানার চেষ্টা করলাম যে তাকদির কি? হাদীস এবং আকিদার বইগুলো থেকে বুঝতে পারলাম যে তাকদির বলতে বোঝায় গাছের প্রতিটি পাতার নড়াচড়া থেকে শুরু করে মানুষের প্রতিটি আমলই আল্লাহ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। এই পর্যায়ে এসে জিলাপীর প্যাঁচটা আরও বেড়ে গেলো। কারণ, তাকদির-এ বিশ্বাস একটি মৌলিক বিশ্বাস। সুতরাং উপরের কথাগুলো সত্য। আবার, এটাও সত্য যে মানুষের আমলের উপর বিচার হবে। আমি ভাবতে লাগলাম এ দুটোর মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করা যায়।

আমি ইসলামী প্রশ্নোত্তর সংক্রান্ত কয়েকটি বই-এর আশ্রয় নিলাম। সিনিয়রদের প্রশ্ন করলাম। ‘তাকদির’ শিরোনামে একটি বইও পড়েছিলাম যার লেখকের নামটা মনে নেই। কয়েকবছরের পড়াশোনা থেকে প্রাপ্ত উত্তর এবং নিজের চিন্তার আলোকে আমি দুটি বিষয় এভাবে সমন্বয় করলাম-

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সময়েরও স্রষ্টা। কিন্তু, আমরা সময়ের অধীন এবং আমাদের চিন্তা চেতনাও সময়ের অধীন। আল্লাহ তাআলার সাপেক্ষে সবকিছু ঘটে গেছে। ফলে তিনি সবকিছু জানেন। এমনকি আমরা ‘স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি’ দিয়ে কোন পথ বেছে নেবো তার খুঁটিনাটি তার জানা।  হাশরের ময়দানে কি বিচার হবে তা-ও তার জানা। জান্নাত ও জাহান্নামের অসীম সময় পর্যন্ত জ্ঞান তার নখদর্পনে। আমি অন্য যে কোন পথ বেছে নিলে কি করতাম এবং আমার পরিণতি কি হতো সে সম্পর্কেও তিনি অবগত।  তিনি তার সেই জ্ঞানের আলোকেই সবকিছু ‘পূর্বনির্ধারণ’ করে লিখে রেখেছেন আমাদের ‘সময় জ্ঞানের সাপেক্ষে’। লক্ষ্যনীয়, আল্লাহ তাআলার সাপেক্ষে পূর্বনির্ধারণ বলতে কিছু নেই। কিন্তু, আমরা যেহেতু সময়ের অধীনে তৈরী আমাদের সময়ের সাপেক্ষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এই লেখাগুলোই পূর্বনির্ধারণ। অর্থাৎ, ‘তাক্বদির’ আল্লাহ তাআলার পারস্পেকটিভ থেকে সৃষ্ট একটি বাস্তবতা (রিয়েলিটি)। মহাবিশ্ব স্থান ও সময়সহ অস্তিত্বশীল হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছেয় এবং তা হয়েছে তার লিপিবদ্ধ ‘তাকদিরের’ আলোকে।

কিন্তু আমি ভাবলাম, আল্লাহ পূর্বনির্ধারণ করে রেখেছেন, এই বিষয়টিতে আমাদের কেন বিশ্বাস রাখতে হবে বা এই বিষয়টি কেনইবা জানতে হবে? এর অন্যতম কয়েকটি কারণ হল: আল্লাহর বিশালত্ব সম্পর্কে ধারণা তৈরী, হতাশ না হওয়া এবং অতিমাত্রায় ‘দরদী’ না হয়ে না ওঠা।  অতিমাত্রায় দরদী হয়ে যাওয়া বলতে বুঝাচ্ছি যে, কোন কোন সময় আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে যে আল্লাহকে অস্বীকারকারী এমন ব্যক্তি যারা অনেক ভালো কাজ করেছেন তারা কেন জান্নাতে যেতে পারবে না? এটির মূল উত্তরটা ‘তাকদীর’-এর মধ্যে নিহিত আছে। এ প্রসঙ্গে আবার স্মরণ করা উত্তম হবে যে, ‘তাকদীর’ হল আল্লাহ অসীম জ্ঞানের সাপেক্ষে সৃষ্ট বাস্তবতা। অর্থাৎ, একমাত্র আল্লাহই জানেন তিনি উক্ত ব্যক্তিকে কতটুকু স্রষ্টাকে চেনার সুযোগ দিয়েছিলেন এবং সে কতটুকু তার ব্যবহার করেছে।  আল্লাহ এও জানেন যে সে অন্য কোন পথ বেছে নিলে বা মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলে বিশ্বাসের ওপর কতটুকু অটল থাকতে পারতো এবং কতটুকু ভাল কাজ করতো। অর্থাৎ, তার পথনির্বাচন ও পরিণতি আল্লাহর অসীম জ্ঞানের সাপেক্ষে সৃষ্ট তাকদীর। কিন্তু, আমাদের জ্ঞান যেহেতু সীমাবদ্ধ, আমরা আল্লাহর নির্ধারণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যোগ্যতা রাখি না।

তাকদির-এর পর যে বিষয়টি নিয়ে আমি সংশয়ে পড়ে যাই তা হল কোরআন কি সত্যই আল্লাহ প্রেরিত গ্রন্থ কিনা? এই প্রশ্নটির একটি পূর্ণ উত্তর পেতে পেতে আমার মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পার হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম মরিস বুকাইলীর ‘বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান’,  মুহাম্মদ সিদ্দিক রচিত ‘নাস্তিকের যুক্তি খণ্ডন’ এবং আবুল আলা’র তাফসীর বইটি আমাকে সাহায্য করেছে। তখনও ইন্টারনেট দু:ষ্প্রাপ্য ছিলো। মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারে যখন ইন্টারনেট- কিছুটা এক্সেস করা যাচ্ছে তখন হারুন ইয়াহিয়ার ‘মিরাকল অব দি কুরআন’ বইটি হাতে পাই যা উপকারে এসেছিলো। উল্লেখ্য, হারুণ ইয়াহিয়া বর্তমানে ‘সেক্স-কাল্ট’-এর লিডারদের মত হয়ে গেছেন, যেটি শুরুর দিকে ছিলো না। এছাড়াও আরেকটি বই পড়ে আমি প্রথমে খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম যার শিরোনাম ছিলো ‘ইহার উপর ঊনিশ’। কিন্তু পরবর্তীতে ড. বিলাল ফিলিপ্স রচিত আরেকটি বই  ‘The Qur’an’s Numerical Miracle: Hoax and Heresy ’  থেকে ঊনিশ সংক্রান্ত মিরকাল খুঁজতে গিয়ে রাশাদ খলিফার কোরআন বিকৃত সম্পর্কে জানতে পারি এবং এও জানতে পারি যে  কুরআন অন্যতম প্রধান মুজিজা হলো এটি একটি সাহিত্যিক মিরাকল। এছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা) এর জীবনী ‘সীরাত ইবনে হিশাম’ এবং ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ থেকে পরোক্ষভাবে সাহায্য পেয়েছি।

যে পয়েন্টগুলোতে আমি কুরআনে আল্লাহর বাণী হওয়ার ব্যপারে নিশ্চিত হই তার মধ্যে কয়েকটি হল:

  • রাসুলুল্লাহ(সা) পড়ালেখা না জানা সত্যেও কুরআনের মত এমন একটি গ্রন্থ প্রচার করা যার চ্যালেঞ্জ তৎকালীন আরবী সাহিত্যে চূড়ান্ত উন্নতির যুগের কোন সাহিত্যিক বা কবি গ্রহন করতে পারেনি।
  • মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সা) কর্তৃক এমন একটি স্থান থেকে এমন একটি জাতি গঠন যারা অল্পসময়ের মধ্যে অর্ধপৃথিবী শাসন করেছে, যেটা তার বার্তাবাহক হওয়ার প্রমাণ।
  • কোরআনে কোন বৈজ্ঞানিক অসামঞ্জস্য না থাকা।
  • কোরআনের কিছু বর্ণনা যা বর্তমান বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। যেমন: ভ্রূণ বিদ্যার বিভিন্ন স্তর সংক্রান্ত বর্ণনা ও মহাবিশ্বের সম্প্রসারনের কথা।
  • কোরআনের গানিতিক গাঁথুনি।
  • কোরআনের ভবিষ্যতবাণীর সত্যতা।

কোরআনে লিটারারীর মিরাকাল নিয়ে বিস্তারিত কোন বই বাংলায় বা ইংরেজীতে আমার মেডিকেলে পাঁচ বছরে পাইনি। বর্তমানে নোমান আলী খানের লেকচার সহ বেশকিছু বই ও ভিডিও লেকচার পাওয়া যায়।

এ সময়, সংশয়বাদী আরও অনেক প্রশ্ন আমার মাথায় এসেছিলো যার উত্তর বিভিন্ন বই থেকে পেয়েছি। দ্বাদশ শ্রেণী থেকে আমার মাথায় বিবর্তনের ভুত চেপে বসে। অর্থাৎ, এই সময় প্রথম ডারউইনবাদ সংক্রান্ত সংশয় শুরু হয়। যদি ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রির রুল দিয়েই জীবের উৎপত্তি ও প্রজাতির আবির্ভাব ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে কি আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেননি? মানুষ কি এপ থেকে এসেছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে শুরু হয় আমার বিবর্তনবাদ ও ডিজাইনতত্ত্ব সংক্রান্ত দীর্ঘ পড়ালেখা যা গত পনের বছর যাবৎ চলছে।            

প্রশ্নটাকে মূলত দুটো ভাগে ভাগ করা যায়, জীবের উৎপত্তি এবং প্রজাতির উৎপত্তি। বর্তমান বিবর্তনবাদীরা জীবের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রশ্নটিকে আলাদা বলতে চাইলেও আগে এটি বিবর্তনের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। যাই হোক, এ সংক্রান্ত পড়ালেখা শুরু করি মুহাম্মদ সিদ্দিকের ‘বিবর্তনবাদ ও স্রষ্টাতত্ত্ব’ এবং মাওলানা আবদুর রহীম-এর ‘বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব’-বই দুটো দিয়ে। মরিস বুকাইলির ‘Origin of man’ বইটি পড়ি ইংরেজিতে। 

এ সংক্রান্ত সংশয় দূরীভূত হতে শুরু করে মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ারে। এ সময় প্রথম যে বইটি আমার সবচেয়ে বেশী উপকারে তা হলো হারুন ইয়াহিয়ার ‘Darwinism Refuted’। মনে পড়ে বইটি নেট থেকে ডাউনলোড করে ডেস্কটপের কম্পিউটার স্ক্রিনে রাত জেগে পড়ে শেষ করেছিলাম । অধিকন্তু, এই সময়ে অ্যানাটমী, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি পড়ে জীবের গঠন শৈলী নিয়ে আমি নিজে নিজেই ভাবতাম যে এগুলো একজন ডিজাইনার ব্যতীত একা একা আসা কি আদৌ সম্ভব? উক্ত বই পড়ে উত্তরটা যেন আরও সহজ হয়ে যায়।

এরপর পড়ালেখা আরও বিস্তৃত হয়। সরাসরি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের ডারউইনবাদ ও ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন সংক্রান্ত বইগুলো পড়া শুরু করি ফোর্থ ইয়ার থেকে।  চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস বইটি পড়তাম বুঝে বুঝে। উদ্দেশ্য ছিলো বিবর্তনবাদকে মূল থেকে বুঝবো। পাশাপাশি ডিজাইন সংক্রান্ত বইগুলো পড়ায় ডারউইনবাদের কতটুকু ঠিক, আর কতটুকু অতিপ্রচারণা তা সম্পর্কে ধারণা পরিস্কার হতে শুরু করে। ডারউইনবাদ ও ডিজাইন তত্ত্ব সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত পড়ালেখা করতে গিয়ে আমি সর্বপ্রথম বুঝতে পারি যে ডারউইনবাদ আসলে একটি ফাঁকা কলসি যা বাজে বেশী । অর্থাৎ, পপুলার বইগুলোতে এবং আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলের টেক্সট বইগুলোতে ডারউইনবাদকে যতটুকু প্রমাণিত হিসেবে পড়ানো হয়, ডারউইনবাদ তার চেয়ে বহুগুনে প্রমাণশুণ্য। আবার, ডারউইনবাদ যদি সত্যও হত তথাপি একে নাস্তিকতার ভিত্তি হিসেবে প্রচার করার কোন কারণ ছিলো না।

ডারউইন প্রদত্ত বিবর্তনতত্ত্বের মূল কথা ছিলো- প্রতিটি প্রজাতি নিজেকে টিকিয়ে (এক্সিসটেন্স) রাখার জন্য যুদ্ধ (স্ট্রাগল) করে। যুদ্ধটা হয় প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বেঁচে থাকার উপকরণ নিয়ে। প্রজাতিতে জন্মান্তরে যে ভ্যারিয়েশন তৈরী হয় তার মধ্যে যে ভ্যারাইটি-টি বিদ্যমান উপকরণ বেশী ব্যবহার করতে পারে সে টিকে যায়। এভাবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে এককোষী প্রাণী পৃথিবীর সকল প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে!

প্রথমত, ডারউইনের মূল তত্ত্ব যে বিষয়টি  পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেনি তা হল- কিভাবে ভ্যারিয়েশন তৈরী হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, ডারউইন দৃশ্যমান মৃদু পরিবর্তন (মাইক্রোইভল্যুশন) থেকে বড় পরিবর্তনের (ম্যাক্রোইভল্যুশন) ব্যপারে যে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত এভিডেন্স দেখাতে পারেন নি। তিনি তার সময়ে প্রাপ্ত ফসিল এভিডেন্সের আলোকে বলার চেষ্টা করেছেন এবং যথেষ্ট ফসিল না থাকার ব্যপারটিও স্বীকার করেছেন। কিন্তু, ডারউইনের সময় কোষের ভিতরের বিশাল মলিকিউলার জগত সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায় মলিকিউলার পর্যায়ে কিভাবে এই বড় পরিবর্তন আসতে পারে সে বিষয়ে কোন ধারণাই দেননি।   

গ্রেগর জোহানস মেন্ডেলের বংশগতির সূত্র আবিস্কার এবং ওয়াটস ও ক্রিকের বংশগতির ধারক হিসেবে ডিএনএ আবিস্কারের পর আর্নস্ট মেয়ার ও ডবঝানস্কি মিলে র‍্যানডম মিউটেশনকে ভ্যারিয়েশন তৈরীর প্রক্রিয়া হিসেবে প্রস্তাবনা করে তৈরী করেন মডার্ন সিনথেসিস অব ইভল্যুশন। এটি নিওডারউইনিজম নামেও পরিচিত।

তাদের এই প্রস্তাবনার পর মেয়ার নিজে এবং পরবর্তী অনেক বিজ্ঞানী র‍্যানডম মিউটেশন এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। প্রায় প্রতিটি পরীক্ষানিরীক্ষাতেই প্রমানিত হয়েছে র‍্যানডম মিউটেশন প্রজাতির ক্ষতি আনে, কোন উপকারী ভ্যারিয়েশন তৈরী করে না। যদি কোন প্রজাতিতে র‍্যানডম মিউটেশন বেঁচে থাকতে সাহায্য করেও থাকে তা হয় উক্ত প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ এক বা একাধিক কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে কমে গিয়ে। যেমন: সিকেল সেল এনেমিয়া নামক রোগটি মানুষের রক্তে হিমোগ্লোবিনের সমস্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু, ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে এই সংশ্লিষ্ট মিউটেশনটি ডিএনএ-তে থাকলে মানুষ বেঁচে যায়।  এই বেঁচে যাওয়া অনেকটা ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ প্রবাদটির মত।

অর্থাৎ, র‍্যানডম মিউটেশন ‘ক্ষুদ্র’ বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারলেও ‘বড়’ বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারে না। তারপরও জোড় পূর্বক নিও-ডারউইনিজমকে বিজ্ঞান হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।   

 ডারউনের পর দেড়শ বছরে জীবাশ্ম প্রমাণের কি হল? গত দেড়শ বছরে বহু জীবাশ্ম আবিষ্কার হয়েছে। উক্ত জীবাশ্মের আলোকে ডারউইনবাদীরা দাবী করে যে কোন কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে জীবাশ্মের মধ্যবর্তী প্রজাতিগুলো খুব স্পষ্টভাবে পাওয়া গেছে, সুতরাং বিবর্তনবাদ প্রমাণিত। কিন্তু, একটু গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, তাদের এই দাবী অনেকাংশেই মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে তারা সরীসৃপ থেকে পাখির বিবর্তন, চতষ্পদী প্রাণী থেকে তিমির বিবর্তন, ঘোড়ার বিবর্তন এবং এপজাতীয় প্রাণী থেতে মানুষের বিবর্তন সংক্রান্ত কয়েকটি ধারাবাহিক অঙ্কিত চিত্র দেখায় এবং এদের ফসিল পাওয়া গেছে বলে দাবী করে। কিন্তু, এদের প্রদর্শিত ফসিল প্রমাণ হয় উদ্ধারকৃত অসম্পূর্ণ হাড়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত অথবা, উক্ত ফসিলকে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরণের (কাইণ্ড) প্রাণীর মধ্যে কোন দলে ফেলা যায় তা নিয়ে বিতর্ক আছে। যেমন: আর্কিওপটেরিক্স নামক পালক ও লেজ বিশিষ্ট ফসিলটিকে পূর্ণাঙ্গ পাখি বা প্লাটিপাসের মত মোজাইক কোন প্রাণীর মধ্যে ফেলা যায়।

তবে, এরচাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে জীবাশ্মের উপর ভিত্তি করে তারা এক ধরনের প্রজাতি (যেমন: সরিসৃপ) থেকে আরেক ধরনের প্রজাতি (যেমন: পাখি) আসার যে দাবী করছে তা তাত্ত্বিক বা মলিকিউলার বায়োলজির আলোকে সম্ভব কিনা? যে কোন একজন জীববিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই বিবেচনা করে দেখতে পারে এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন কতগুলো দরকার। যেমন: পাখির উদাহরণটা নিয়েই যদি একটু চিন্তা করি- একটি সরিসৃপকে পাখি হতে হলে সরিসৃপের ত্বকের স্কেলকে পালকে পরিণত হতে হবে, পালকের সাথে সংশ্লিষ্ট মাংসপেশীতে পরিবর্তন আসতে হবে, মাংসপেশীর সাথে সংযুক্ত নার্ভের পরিবর্তন লাগবে, নার্ভকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রেইনের অংশে পরিবর্তন আসতে হবে, ব্রেইনের নিউরনের সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রামিং-এর পরিবর্তন আসতে হবে, পাখির শ্বাসযন্ত্রকে একমুখী হতে হবে যেন উড়ার সময় শ্বাস নিতে সমস্যা না হয়, পাখির হাড়গুলো হালকা হতে হবে যেন উড়ার সময় ভাবে পরে না যায়  এবং এইভাবে এই লিস্ট আরও বড় করা যায়। সামান্য একটু চিন্তাতেই বুঝা যাচ্ছে এই ধরনের ট্রানজিশন এলোপাতাড়ি ভাবে আসার বিষয়টি অলীক কল্পনা। অধিকন্তু, সরিসৃপের  ডিএনএ-তে সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন আনতে যে পরিমাণ সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন দরকার তা ‘এলোপাতাড়ি’ মিউটেশনের মাধ্যমে  আসা আদৌ সম্ভব কিনা এই প্রশ্ন যদি কোন মলিকিউলার বায়োলজির ছাত্র ‘নিরপেক্ষ’ ভাবে চিন্তা করে সে উক্ত  সম্ভাব্যতা হেসে উড়িয়ে দেবে। 

তারপরও, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তা আনবিক জীববিজ্ঞানী ও গনিতবিদরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে হিসেব কষেছেন। তারা বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে র‍্যানডম মিউটেশন বা তৎপরবর্তী প্রস্তাবিত অন্যান্য আণবিক প্রক্রিয়ায় একা একা এ ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই এবং সময়ও নেই।

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তাদের এই বিষয়গুলো আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি এবং সাথে আনবিক জীববিদ্যার পাঠ্যপুস্তক গভীরভাবে অধ্যায়ণ করেছি, প্রোবেবিলিটি ও স্ট্যাটিসটিক্স-এর বেসিক বুঝে নিয়েছি, প্রয়োজনে অ্যানাটমী ও ফিজিওলজি মনোযোগ দিয়ে পড়ে নিয়েছি যেন তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ, তাদের প্রস্তাবণা আমার কাছে অনেক বেশী স্যাটিসফেকরী মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমার পড়া বেস্ট বইগুলোর মধ্যে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া জরুরী বোধ করছি- মাইকেল বিহে-এর Dawin’s Black Box ও Edge of Evolution, স্টিফেন মেয়ার-এর Signature in the cell ও Darwin’s Doubt, উইলিয়াম ডেম্বস্কি ও জোনাথান ওয়েলস-এর The Design of Life, জোনাথান ওয়েলস-এর Icons of Evolution ও Zombie Science, উইলিয়াম ডেম্বস্কি-এর The design inference এবং No free Lunch । এই বইগুলো একেকটা মাস্টারপিস এবং বইগুলোতে মলিকিউলার বায়োলজির এভিডেন্স ও ম্যাথমেটিক্স-এর উপর ভিত্তি করে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

যখন বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রোটিন, আরএনএ এবং ডিএনএ-র বিস্তারিত গঠন জেনেছি তখন থেকেই নিজেই ক্যালকুলেশন করতাম যে এলোপাতাড়ি ভাবে এদের আসার সম্ভাবনা খুবই নগন্য এবং ডিজাইন ছাড়া এগুলো আসা সম্ভব নয়। মজার বিষয় হলো ডিজাইন সংক্রান্ত বইগুলোতে আমার চিন্তাভাবনার এনডর্সমেন্ট পেয়েছি। ফলে, ভাবনাগুলো পাকাপোক্ত হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, একদল বস্তবাদী বিজ্ঞানী আছেন যারা নিওডারউইনিজমের পদ্ধতিগত ত্রুটি আলোচনা করছেন ঠিকই কিন্তু বস্তুবাদের প্রতি তাদের আনুগত্য থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। তারা প্রস্তাবনা রাখছেন ‘এক্সটেন্ডেড ইভল্যুশনারী সিনথেসিস’ অথবা ‘দি থার্ড ওয়ে’ নামে তৃতীয় কোন পদ্ধতির যেগুলো প্রকৃতপক্ষে আদিম কোষে প্রয়োজনীয় জেনেটিক তথ্যের উপস্থিতি আছে ধরে নিয়ে সামনে আগায়।  অন্যদিকে, একদল বিবর্তনবাদী আছে যারা বিশ্বাস করেন যে প্রজাতির উদ্ভব বিবর্তনের মাধ্যমেই হয়েছে, তবে তা স্রষ্টার পথনির্দেশনায় হয়েছে। এর মধ্যে আবার দুটি ভাগ আছে। একদল মনে করেন পৃথিবীর প্রথম দিকের কোষেই (আদিকোষ) এই পথনির্দেশনা দিয়ে দেয়া হয়েছে। আরেকদল বলতে চান যে সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় মিউটেশন স্রষ্টার গাইডেন্সে হয়েছে। এই দুই দলই প্রকৃতপক্ষে জীবজগতের সৃষ্টিতে ডিজাইনারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন। সুতরাং, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন (আইডি) তাত্ত্বিকদের সাথে এদের মৌলিক পার্থক্যটা হল আইডি তাত্ত্বিকরা জীবজগতে ডিজাইন আবিস্কারের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রস্তাবনা করছেন এবং তারা ডিজাইনারের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামানোর বিষয়টি দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে গাইডেড বিবর্তনে বিশ্বাসীরা সরাসরি ডিজাইনারের প্রস্তাবনাটাকে সাথে উল্লেখ করছেন।

খুব সংক্ষেপে এই ছিলো আমার বিবর্তনবাদ থেকে ডিজাইনতত্ত্বে ধাবিত হওয়া এবং বিবর্তন সংক্রান্ত সংশয় দূর হওয়ার পথপরিক্রমা। তবে আমার এই জার্নিতে আরও দুটো অধ্যায় হলো মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে আল্লাহর প্রয়োজনীয়তা এবং আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ক প্রশ্ন ।

বিগব্যাং-এর সত্যতা আবিস্কার এবং পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্রের ফাইন টিউনিং মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে ডিজাইনারের উপস্থিতিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। ডিজাইনার প্রয়োজনীয়তা এড়াতে নাস্তিক পদার্থবিদদের আবিস্কারগুলো এতটাই হাস্যকর যে এগুলোকে সিরিয়াসলি নেয়ার কোন কারণ পাইনি। গনিতবিদ রোজার পেনরোজ হিসেব কষে দেখিয়েছেন আমাদের মহাবিশ্বের অস্তিত্বে আসার সম্ভবনা ১০-এর পর ১০ টু দি পাওয়ার ১২৩ টি শূণ্য বসালে যে সংখ্যাটি হবে তার মধ্যে একবার। এলোপাতাড়ি তত্ত্ববাদী নাস্তিকদের জন্য এটি একটি মহাবিপদ। এজন্য নাস্তিক ম্যাক্স টেগমার্ক ‘মাল্টিভার্স’ নামক তত্ত্ব দিয়েছেন। যার অর্থ হলো ১০ টু দি পাওয়ার ১০ টু দি পাওয়ার ১২৩ (১০^১০^১২৩) টি মহাবিশ্ব আছে যা আমাদের থেকে ‘সময়-স্থানিক ভাবে বিচ্ছিন্ন’। ‘সময়-স্থানিক ভাবে বিচ্ছিন্ন’-এর অর্থ হচ্ছে উক্ত তথাকথিত মহাবিশ্বগুলোর সাথে আপনি কখনই যোগোযোগ করতে পারবেন না।  যেহেতু এত সংখ্যক ইউনিভার্স আপনি কল্পনা করতে পারছেন অতএব এরমধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব থাকতেই পারে! তত্ত্বের বক্তব্য থেকেই দেখতে পাচ্ছেন যে এটি একটি অবাস্তব গানিতিক হিসাব যার অবতারণা করা হয়েছে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার জন্য। অর্থাৎ, এই ধরনের তত্ত্বগুলো পিছনে নাস্তিকদের নিরন্তর পণ্ডশ্রমের কারণ যতটা না বৈজ্ঞানিক তার চেয়ে অনেক বেশী আদর্শিক। এ সংক্রান্ত যত আর্টিকেল ও বই পড়েছি এবং যত ভিডিও দেখেছি তার মধ্যে তিনটি বই আমি রিকোমেণ্ড করতে চাই- স্টিফেন বার-এর Modern Physics and Ancient Faith,  মাইকেল ডেনটন-এর Nature’s Destiny এবং পউল ডেভিস-এর The Goldlilock’s Enigma।

আপনি যখন বিজ্ঞানের জগতের গভীরে অধ্যয়ন করবেন তখন দেখবেন বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে নাস্তিকরা তাদের কালো থাবা বসিয়ে রেখেছে। তারা প্রতিটি ডিসিপ্লিনে তাদের মনগড়া তত্ত্ব বিজ্ঞানের মোড়কে পরিবেশন করেছে যেন স্রষ্টাকে অস্বীকার করা যায়। এ রকম আরেকটি জায়গা হচ্ছে ‘আত্মার অস্তিত্ব’। একজন মেডিকেলে সায়েন্সের ছাত্র হিসেবে আমাকে মানুষের ব্রেইনের গঠন বেশ ভালো ভাবেই পড়তে হয়েছে। আবার অন্যদিকে আত্মা ও মন নিয়ে আগ্রহ থাকায় আমি এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার পড়াশোনা থেকে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলি যে, আমাদের মনকে ডেনিয়েল ডেনেটদের মত শুধু ব্রেইনের গঠনের কার্যকরী ফল বলা যায় না, অথবা মনকে খুবই উচ্চ মানের কম্পিউটার প্রোগ্রামও বলা যায় না। সুতরাং ‘মন’ এমন একটি জিনিস যা কোন বস্তুবাদী স্কেল দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। এটিযে পরোক্ষভাবে আত্মার অস্তিত্বের দিকে নির্দেশ করে আমার কাছে তা পরিস্কার, আলহামদুলিল্লাহ। এ বিষয়ে আমি যে দুতিনটি বই-এর কথা বলতে চাই তা হল- ম্যারিও বুয়েরেগার্দ-এর The Spiritual Brain, মার্ক বেকার ও স্টুয়ার্ট গোতজ-এর Soul Hypothesis এবং রোজার পেনরোজ-এর Emperor’s New Mind।  

এখন আমার পড়াটা আরও বিস্তৃত হয়েছে। আগে ধর্মের দর্শন নিয়ে পড়েছি খুব কম। এখন এই অধ্যায়টিতে প্রবেশ করেছি এবং আবিস্কার করেছি যে কয়েকজন বিশ্বাসী দার্শনিক গত পঞ্চাশ বছরে এই ক্ষেত্রটিতে এত বেশী উন্নতি করেছেন যেন এখানে নাস্তিকদের কফিনে শেষ পেড়েক লাগানো হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে উইলিয়াম লেইন ক্রেইগ-এর পাশাপাশি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আলভিন প্লানটিঙ্গা ও রিচার্ড সুইনবার্ণের নাম উল্লেখ করতেই হয়।

অল্প অল্প করে লিখতে লিখতে অনেক কথা লিখে ফেললাম। আমি প্রথমে বলেছিলাম আমার পড়াশোনার শুরুটা হয়েছে সংশয় থেকে। আল্লাহর রহমতে এখন সংশয়টা নেই, তবে পড়া-শোনা-লেখাও থেমে নেই। এক সময় পড়তাম বিভ্রান্তি দূর করতে। বিভ্রান্তি দূর হলে আল্লাহর ইচ্ছেয় আত্মার প্রশান্তি চলে আসতো।  এখনও পড়ি আর আল্লাহর অস্তিত্বের বিশালতা দেখে মাথা সেজদায় অবনত হয়ে আসে।

আমার এই দীর্ঘ জার্নিতে আমি লেখালেখির সুবাদে আমার মতই সংশয় কিংবা নাস্তিকতা থেকে উঠে আসা কিছু আল্লাহর বান্দার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যাদের পড়ালেখা, জ্ঞান ও  উপলব্ধির ব্যপ্তির কাছে আমার প্রচেষ্টা কিছুই না। এমন বেশ কয়েকজন লেখকের জীবনীও আপনারা এই বইটিতে পড়েছেন বা পড়বেন। আমি যখন তাদের লেখা পড়ি নিজের কর্মের দুর্বলতা দেখে আত্মগ্লানিতে মাথা নিচু হয়ে আসে। আমি তওবা করি, আবার পাপ কাজে নিমজ্জিত হই, আবারও আল্লাহ তাআলার কাছে এক বুক আশা নিয়ে ক্ষমা চাই।

ছোটবেলায় যখন সংশয়ে পড়ে যেতাম এবং আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করে সংশয় থেকে মুক্তি পেতাম তখন কোরআনের দুটি আয়াত আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করতাম:

“পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে যে সমস্ত বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে ও শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন ৷  (তারা আপনা আপনি বলে ওঠেঃ) হে আমাদের প্রভু! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সৃষ্টি করোনি ৷ বাজে ও নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত৷” (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৯০, ৯১)

আর, এখন যখন নিজের আত্মার সাথে জুলুম করে ফেলি মনে হয় যেন আল্লাহ আ’জ্জা ওয়া জাল্লাহ আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছেন:

“ (হে নবী,)বলে দাও,হে আমার বান্দারা  যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন৷ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু৷” (সুরা যুমার, আয়াত ৫৩)     

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top