সংশয় থেকে বিশ্বাস: এক পথিকের গল্প

মো: আবদুল্লাহ সাঈদ খান

পেশা- চিকিৎসক

আমার জন্ম একটি মোটামুটি প্র্যাকটিসিং মুসলিম পরিবারে। যদিও আমার পিতা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আলেম ছিলেন না তিনি ইসলাম সম্পর্কে স্বেচ্ছায় অনেক বিস্তারিত পড়ালেখা করেছিলেন। তার প্রভাবে আমাদের মা এবং ভাই-বোনদের চেষ্টা ছিলো ইসলামের বেসিক আমলগুলো ঠিকমত করার। সে সুবাদে আমিও ছোটবেলা থেকে চেষ্টা করতাম যেন মৌলিক ইবাদতগুলো মিস না হয়।

কিন্তু, শয়তান আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছে যে সে মানুষের চতুর্দিক থেকে আক্রমন করবে। তাই কিশোর বয়স থেকেই আমার মাঝে সংশয়ের বীজ রোপিত হতে শুরু করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার রহমতে সংশয় আমাকে কখনই পুরোপুরি কুপোকাত করতে পারেনি। ফলে, আমার ইতিহাসটা হলো একটি যুদ্ধের ইতিহাস। সংশয়ের বিরুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের ইতিহাস। মজার বিষয় হলো, ঈমানকে লক্ষ্য করে আসা বিভিন্ন প্রশ্নগুলো আমার মাথায় অন্য কোন বই বা মানুষের প্ররোচনায় আসেনি। হ্যা, দু-এক জন বামপন্থী, নাস্তিক দু’একবার হিন্ট দিয়েছে। কিন্তু, আমার মস্তিষ্কের জন্য ওগুলোই হয়ত যথেষ্ট ছিলো। পরবর্তীতে নতুন নতুন সন্দেহপূর্ণ প্রশ্ন মাথায় একাই খেলা করতো।

তবে অন্তঃর্দ্বন্দ্বের এই সময়টা যে খুব আরামে কাটিয়েছি তা নয়। এখনও মনে পড়ে, প্রথম প্রথম এই সংশয়বাদী প্রশ্নগুলো নিয়ে যখন ভাবতাম বুকে চিন চিন ব্যাথা করতো, বুক চেপে আসতে চাইতো ও শ্বাসঃপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এখন বুঝি যে এগুলো ছিলো প্যানিক এটাকের লক্ষণ যা তীব্র এনজাইটি থেকে আসতো। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা’র কৃপায় সংশয় নিরসন হওয়া সাথে সাথে তীব্র এক প্রশান্তি মনে এসে ভর করতো। পরবর্তীতে জানা ও চিন্তার ম্যাচুরিটির সাথে সাথে বিভ্রান্তীমূলক চিন্তা আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকে। এখন নাস্তিকদের অযুক্তি, কুযুক্তি যতটুকু বুঝতে পারি তা এই তীব্র মানসিক যুদ্ধের ময়দানে প্রাপ্ত প্রশিক্ষনের ফসল।        

যতটুকু মনে পড়ছে আমার প্রথম সংশয়ের শুরুটা হয় তাকদির নিয়ে। তখন নবম শ্রেণীতে উঠেছি কেবল। কিন্তু, এমন একটি বিষয় নিয়ে সংশয় মনে দানা বেঁধেছে যেটি নিয়ে বেশী ভাবলে বিভ্রান্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশী। 

তাকদির সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো সাধারণত যে ধরনের হয় তাকে সংক্ষেপে দুটি বাক্যে নিয়ে আসা যায়- আল্লাহ যদি সবকিছু নির্ধারণ করে রাখেন তাহলে আমাদের বিচার কেন হবে? অথবা, আল্লাহ যেহেতু সবকিছু লিখেই রেখেছেন তাহলে আমি আমার মত যা ইচ্ছে করতে থাকি।

আমার অভিজ্ঞতায় মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী যারা তাকদির নিয়ে চিন্তা করেন তাদের মধ্যে কয়েকটি পরিণতি লক্ষ্য করা যায়। একদল, এই সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা থেকে নিজেকে বিরত রাখে যেন ঈমানে সমস্যা না হয়। আরেকদল, এটির ভুল অর্থ বুঝে নিয়ে পাপ কাজ অবলীলায় করতে থাকে। অর্থাৎ, সে তাকদির-এর বিশ্বাসও করে আবার পাপ কাজও করে। তবে, তাকদির সংক্রান্ত বিভ্রান্তি থেকে নাস্তিক হয়ে যাওয়ার লোকের সংখ্যা কম। যদিও এ বিষয়টি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করতে নাস্তিকরা বেশ তৎপর।

কিন্তু, আমি তো নাছোড়বান্দা। বুকের তীব্র ব্যাথাটাকে কমাতে আমাকে একটি স্যাটিসফ্যাকটরি উত্তর খুঁজে নিতে হবে। তাই আমি এই সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা ও অধ্যয়ন শুরু করলাম।  প্রথমে জানার চেষ্টা করলাম যে তাকদির কি? হাদীস এবং আকিদার বইগুলো থেকে বুঝতে পারলাম যে তাকদির বলতে বোঝায় গাছের প্রতিটি পাতার নড়াচড়া থেকে শুরু করে মানুষের প্রতিটি আমলই আল্লাহ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। এই পর্যায়ে এসে জিলাপীর প্যাঁচটা আরও বেড়ে গেলো। কারণ, তাকদির-এ বিশ্বাস একটি মৌলিক বিশ্বাস। সুতরাং উপরের কথাগুলো সত্য। আবার, এটাও সত্য যে মানুষের আমলের উপর বিচার হবে। আমি ভাবতে লাগলাম এ দুটোর মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করা যায়।

আমি ইসলামী প্রশ্নোত্তর সংক্রান্ত কয়েকটি বই-এর আশ্রয় নিলাম। সিনিয়রদের প্রশ্ন করলাম। ‘তাকদির’ শিরোনামে একটি বইও পড়েছিলাম যার লেখকের নামটা মনে নেই। কয়েকবছরের পড়াশোনা থেকে প্রাপ্ত উত্তর এবং নিজের চিন্তার আলোকে আমি দুটি বিষয় এভাবে সমন্বয় করলাম-

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সময়েরও স্রষ্টা। কিন্তু, আমরা সময়ের অধীন এবং আমাদের চিন্তা চেতনাও সময়ের অধীন। আল্লাহ তাআলার সাপেক্ষে সবকিছু ঘটে গেছে। ফলে তিনি সবকিছু জানেন। এমনকি আমরা ‘স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি’ দিয়ে কোন পথ বেছে নেবো তার খুঁটিনাটি তার জানা।  হাশরের ময়দানে কি বিচার হবে তা-ও তার জানা। জান্নাত ও জাহান্নামের অসীম সময় পর্যন্ত জ্ঞান তার নখদর্পনে। আমি অন্য যে কোন পথ বেছে নিলে কি করতাম এবং আমার পরিণতি কি হতো সে সম্পর্কেও তিনি অবগত।  তিনি তার সেই জ্ঞানের আলোকেই সবকিছু ‘পূর্বনির্ধারণ’ করে লিখে রেখেছেন আমাদের ‘সময় জ্ঞানের সাপেক্ষে’। লক্ষ্যনীয়, আল্লাহ তাআলার সাপেক্ষে পূর্বনির্ধারণ বলতে কিছু নেই। কিন্তু, আমরা যেহেতু সময়ের অধীনে তৈরী আমাদের সময়ের সাপেক্ষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এই লেখাগুলোই পূর্বনির্ধারণ। অর্থাৎ, ‘তাক্বদির’ আল্লাহ তাআলার পারস্পেকটিভ থেকে সৃষ্ট একটি বাস্তবতা (রিয়েলিটি)। মহাবিশ্ব স্থান ও সময়সহ অস্তিত্বশীল হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছেয় এবং তা হয়েছে তার লিপিবদ্ধ ‘তাকদিরের’ আলোকে।

কিন্তু আমি ভাবলাম, আল্লাহ পূর্বনির্ধারণ করে রেখেছেন, এই বিষয়টিতে আমাদের কেন বিশ্বাস রাখতে হবে বা এই বিষয়টি কেনইবা জানতে হবে? এর অন্যতম কয়েকটি কারণ হল: আল্লাহর বিশালত্ব সম্পর্কে ধারণা তৈরী, হতাশ না হওয়া এবং অতিমাত্রায় ‘দরদী’ না হয়ে না ওঠা।  অতিমাত্রায় দরদী হয়ে যাওয়া বলতে বুঝাচ্ছি যে, কোন কোন সময় আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে যে আল্লাহকে অস্বীকারকারী এমন ব্যক্তি যারা অনেক ভালো কাজ করেছেন তারা কেন জান্নাতে যেতে পারবে না? এটির মূল উত্তরটা ‘তাকদীর’-এর মধ্যে নিহিত আছে। এ প্রসঙ্গে আবার স্মরণ করা উত্তম হবে যে, ‘তাকদীর’ হল আল্লাহ অসীম জ্ঞানের সাপেক্ষে সৃষ্ট বাস্তবতা। অর্থাৎ, একমাত্র আল্লাহই জানেন তিনি উক্ত ব্যক্তিকে কতটুকু স্রষ্টাকে চেনার সুযোগ দিয়েছিলেন এবং সে কতটুকু তার ব্যবহার করেছে।  আল্লাহ এও জানেন যে সে অন্য কোন পথ বেছে নিলে বা মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলে বিশ্বাসের ওপর কতটুকু অটল থাকতে পারতো এবং কতটুকু ভাল কাজ করতো। অর্থাৎ, তার পথনির্বাচন ও পরিণতি আল্লাহর অসীম জ্ঞানের সাপেক্ষে সৃষ্ট তাকদীর। কিন্তু, আমাদের জ্ঞান যেহেতু সীমাবদ্ধ, আমরা আল্লাহর নির্ধারণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যোগ্যতা রাখি না।

তাকদির-এর পর যে বিষয়টি নিয়ে আমি সংশয়ে পড়ে যাই তা হল কোরআন কি সত্যই আল্লাহ প্রেরিত গ্রন্থ কিনা? এই প্রশ্নটির একটি পূর্ণ উত্তর পেতে পেতে আমার মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পার হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম মরিস বুকাইলীর ‘বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান’,  মুহাম্মদ সিদ্দিক রচিত ‘নাস্তিকের যুক্তি খণ্ডন’ এবং আবুল আলা’র তাফসীর বইটি আমাকে সাহায্য করেছে। তখনও ইন্টারনেট দু:ষ্প্রাপ্য ছিলো। মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারে যখন ইন্টারনেট- কিছুটা এক্সেস করা যাচ্ছে তখন হারুন ইয়াহিয়ার ‘মিরাকল অব দি কুরআন’ বইটি হাতে পাই যা উপকারে এসেছিলো। উল্লেখ্য, হারুণ ইয়াহিয়া বর্তমানে ‘সেক্স-কাল্ট’-এর লিডারদের মত হয়ে গেছেন, যেটি শুরুর দিকে ছিলো না। এছাড়াও আরেকটি বই পড়ে আমি প্রথমে খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম যার শিরোনাম ছিলো ‘ইহার উপর ঊনিশ’। কিন্তু পরবর্তীতে ড. বিলাল ফিলিপ্স রচিত আরেকটি বই  ‘The Qur’an’s Numerical Miracle: Hoax and Heresy ’  থেকে ঊনিশ সংক্রান্ত মিরকাল খুঁজতে গিয়ে রাশাদ খলিফার কোরআন বিকৃত সম্পর্কে জানতে পারি এবং এও জানতে পারি যে  কুরআন অন্যতম প্রধান মুজিজা হলো এটি একটি সাহিত্যিক মিরাকল। এছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা) এর জীবনী ‘সীরাত ইবনে হিশাম’ এবং ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ থেকে পরোক্ষভাবে সাহায্য পেয়েছি।

যে পয়েন্টগুলোতে আমি কুরআনে আল্লাহর বাণী হওয়ার ব্যপারে নিশ্চিত হই তার মধ্যে কয়েকটি হল:

  • রাসুলুল্লাহ(সা) পড়ালেখা না জানা সত্যেও কুরআনের মত এমন একটি গ্রন্থ প্রচার করা যার চ্যালেঞ্জ তৎকালীন আরবী সাহিত্যে চূড়ান্ত উন্নতির যুগের কোন সাহিত্যিক বা কবি গ্রহন করতে পারেনি।
  • মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সা) কর্তৃক এমন একটি স্থান থেকে এমন একটি জাতি গঠন যারা অল্পসময়ের মধ্যে অর্ধপৃথিবী শাসন করেছে, যেটা তার বার্তাবাহক হওয়ার প্রমাণ।
  • কোরআনে কোন বৈজ্ঞানিক অসামঞ্জস্য না থাকা।
  • কোরআনের কিছু বর্ণনা যা বর্তমান বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। যেমন: ভ্রূণ বিদ্যার বিভিন্ন স্তর সংক্রান্ত বর্ণনা ও মহাবিশ্বের সম্প্রসারনের কথা।
  • কোরআনের গানিতিক গাঁথুনি।
  • কোরআনের ভবিষ্যতবাণীর সত্যতা।

কোরআনে লিটারারীর মিরাকাল নিয়ে বিস্তারিত কোন বই বাংলায় বা ইংরেজীতে আমার মেডিকেলে পাঁচ বছরে পাইনি। বর্তমানে নোমান আলী খানের লেকচার সহ বেশকিছু বই ও ভিডিও লেকচার পাওয়া যায়।

এ সময়, সংশয়বাদী আরও অনেক প্রশ্ন আমার মাথায় এসেছিলো যার উত্তর বিভিন্ন বই থেকে পেয়েছি। দ্বাদশ শ্রেণী থেকে আমার মাথায় বিবর্তনের ভুত চেপে বসে। অর্থাৎ, এই সময় প্রথম ডারউইনবাদ সংক্রান্ত সংশয় শুরু হয়। যদি ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রির রুল দিয়েই জীবের উৎপত্তি ও প্রজাতির আবির্ভাব ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে কি আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেননি? মানুষ কি এপ থেকে এসেছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে শুরু হয় আমার বিবর্তনবাদ ও ডিজাইনতত্ত্ব সংক্রান্ত দীর্ঘ পড়ালেখা যা গত পনের বছর যাবৎ চলছে।            

প্রশ্নটাকে মূলত দুটো ভাগে ভাগ করা যায়, জীবের উৎপত্তি এবং প্রজাতির উৎপত্তি। বর্তমান বিবর্তনবাদীরা জীবের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রশ্নটিকে আলাদা বলতে চাইলেও আগে এটি বিবর্তনের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। যাই হোক, এ সংক্রান্ত পড়ালেখা শুরু করি মুহাম্মদ সিদ্দিকের ‘বিবর্তনবাদ ও স্রষ্টাতত্ত্ব’ এবং মাওলানা আবদুর রহীম-এর ‘বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব’-বই দুটো দিয়ে। মরিস বুকাইলির ‘Origin of man’ বইটি পড়ি ইংরেজিতে। 

এ সংক্রান্ত সংশয় দূরীভূত হতে শুরু করে মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ারে। এ সময় প্রথম যে বইটি আমার সবচেয়ে বেশী উপকারে তা হলো হারুন ইয়াহিয়ার ‘Darwinism Refuted’। মনে পড়ে বইটি নেট থেকে ডাউনলোড করে ডেস্কটপের কম্পিউটার স্ক্রিনে রাত জেগে পড়ে শেষ করেছিলাম । অধিকন্তু, এই সময়ে অ্যানাটমী, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি পড়ে জীবের গঠন শৈলী নিয়ে আমি নিজে নিজেই ভাবতাম যে এগুলো একজন ডিজাইনার ব্যতীত একা একা আসা কি আদৌ সম্ভব? উক্ত বই পড়ে উত্তরটা যেন আরও সহজ হয়ে যায়।

এরপর পড়ালেখা আরও বিস্তৃত হয়। সরাসরি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের ডারউইনবাদ ও ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন সংক্রান্ত বইগুলো পড়া শুরু করি ফোর্থ ইয়ার থেকে।  চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস বইটি পড়তাম বুঝে বুঝে। উদ্দেশ্য ছিলো বিবর্তনবাদকে মূল থেকে বুঝবো। পাশাপাশি ডিজাইন সংক্রান্ত বইগুলো পড়ায় ডারউইনবাদের কতটুকু ঠিক, আর কতটুকু অতিপ্রচারণা তা সম্পর্কে ধারণা পরিস্কার হতে শুরু করে। ডারউইনবাদ ও ডিজাইন তত্ত্ব সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত পড়ালেখা করতে গিয়ে আমি সর্বপ্রথম বুঝতে পারি যে ডারউইনবাদ আসলে একটি ফাঁকা কলসি যা বাজে বেশী । অর্থাৎ, পপুলার বইগুলোতে এবং আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলের টেক্সট বইগুলোতে ডারউইনবাদকে যতটুকু প্রমাণিত হিসেবে পড়ানো হয়, ডারউইনবাদ তার চেয়ে বহুগুনে প্রমাণশুণ্য। আবার, ডারউইনবাদ যদি সত্যও হত তথাপি একে নাস্তিকতার ভিত্তি হিসেবে প্রচার করার কোন কারণ ছিলো না।

ডারউইন প্রদত্ত বিবর্তনতত্ত্বের মূল কথা ছিলো- প্রতিটি প্রজাতি নিজেকে টিকিয়ে (এক্সিসটেন্স) রাখার জন্য যুদ্ধ (স্ট্রাগল) করে। যুদ্ধটা হয় প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বেঁচে থাকার উপকরণ নিয়ে। প্রজাতিতে জন্মান্তরে যে ভ্যারিয়েশন তৈরী হয় তার মধ্যে যে ভ্যারাইটি-টি বিদ্যমান উপকরণ বেশী ব্যবহার করতে পারে সে টিকে যায়। এভাবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে এককোষী প্রাণী পৃথিবীর সকল প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে!

প্রথমত, ডারউইনের মূল তত্ত্ব যে বিষয়টি  পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেনি তা হল- কিভাবে ভ্যারিয়েশন তৈরী হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, ডারউইন দৃশ্যমান মৃদু পরিবর্তন (মাইক্রোইভল্যুশন) থেকে বড় পরিবর্তনের (ম্যাক্রোইভল্যুশন) ব্যপারে যে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত এভিডেন্স দেখাতে পারেন নি। তিনি তার সময়ে প্রাপ্ত ফসিল এভিডেন্সের আলোকে বলার চেষ্টা করেছেন এবং যথেষ্ট ফসিল না থাকার ব্যপারটিও স্বীকার করেছেন। কিন্তু, ডারউইনের সময় কোষের ভিতরের বিশাল মলিকিউলার জগত সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায় মলিকিউলার পর্যায়ে কিভাবে এই বড় পরিবর্তন আসতে পারে সে বিষয়ে কোন ধারণাই দেননি।   

গ্রেগর জোহানস মেন্ডেলের বংশগতির সূত্র আবিস্কার এবং ওয়াটস ও ক্রিকের বংশগতির ধারক হিসেবে ডিএনএ আবিস্কারের পর আর্নস্ট মেয়ার ও ডবঝানস্কি মিলে র‍্যানডম মিউটেশনকে ভ্যারিয়েশন তৈরীর প্রক্রিয়া হিসেবে প্রস্তাবনা করে তৈরী করেন মডার্ন সিনথেসিস অব ইভল্যুশন। এটি নিওডারউইনিজম নামেও পরিচিত।

তাদের এই প্রস্তাবনার পর মেয়ার নিজে এবং পরবর্তী অনেক বিজ্ঞানী র‍্যানডম মিউটেশন এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। প্রায় প্রতিটি পরীক্ষানিরীক্ষাতেই প্রমানিত হয়েছে র‍্যানডম মিউটেশন প্রজাতির ক্ষতি আনে, কোন উপকারী ভ্যারিয়েশন তৈরী করে না। যদি কোন প্রজাতিতে র‍্যানডম মিউটেশন বেঁচে থাকতে সাহায্য করেও থাকে তা হয় উক্ত প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ এক বা একাধিক কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে কমে গিয়ে। যেমন: সিকেল সেল এনেমিয়া নামক রোগটি মানুষের রক্তে হিমোগ্লোবিনের সমস্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু, ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে এই সংশ্লিষ্ট মিউটেশনটি ডিএনএ-তে থাকলে মানুষ বেঁচে যায়।  এই বেঁচে যাওয়া অনেকটা ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ প্রবাদটির মত।

অর্থাৎ, র‍্যানডম মিউটেশন ‘ক্ষুদ্র’ বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারলেও ‘বড়’ বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারে না। তারপরও জোড় পূর্বক নিও-ডারউইনিজমকে বিজ্ঞান হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।   

 ডারউনের পর দেড়শ বছরে জীবাশ্ম প্রমাণের কি হল? গত দেড়শ বছরে বহু জীবাশ্ম আবিষ্কার হয়েছে। উক্ত জীবাশ্মের আলোকে ডারউইনবাদীরা দাবী করে যে কোন কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে জীবাশ্মের মধ্যবর্তী প্রজাতিগুলো খুব স্পষ্টভাবে পাওয়া গেছে, সুতরাং বিবর্তনবাদ প্রমাণিত। কিন্তু, একটু গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, তাদের এই দাবী অনেকাংশেই মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে তারা সরীসৃপ থেকে পাখির বিবর্তন, চতষ্পদী প্রাণী থেকে তিমির বিবর্তন, ঘোড়ার বিবর্তন এবং এপজাতীয় প্রাণী থেতে মানুষের বিবর্তন সংক্রান্ত কয়েকটি ধারাবাহিক অঙ্কিত চিত্র দেখায় এবং এদের ফসিল পাওয়া গেছে বলে দাবী করে। কিন্তু, এদের প্রদর্শিত ফসিল প্রমাণ হয় উদ্ধারকৃত অসম্পূর্ণ হাড়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত অথবা, উক্ত ফসিলকে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরণের (কাইণ্ড) প্রাণীর মধ্যে কোন দলে ফেলা যায় তা নিয়ে বিতর্ক আছে। যেমন: আর্কিওপটেরিক্স নামক পালক ও লেজ বিশিষ্ট ফসিলটিকে পূর্ণাঙ্গ পাখি বা প্লাটিপাসের মত মোজাইক কোন প্রাণীর মধ্যে ফেলা যায়।

তবে, এরচাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে জীবাশ্মের উপর ভিত্তি করে তারা এক ধরনের প্রজাতি (যেমন: সরিসৃপ) থেকে আরেক ধরনের প্রজাতি (যেমন: পাখি) আসার যে দাবী করছে তা তাত্ত্বিক বা মলিকিউলার বায়োলজির আলোকে সম্ভব কিনা? যে কোন একজন জীববিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই বিবেচনা করে দেখতে পারে এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন কতগুলো দরকার। যেমন: পাখির উদাহরণটা নিয়েই যদি একটু চিন্তা করি- একটি সরিসৃপকে পাখি হতে হলে সরিসৃপের ত্বকের স্কেলকে পালকে পরিণত হতে হবে, পালকের সাথে সংশ্লিষ্ট মাংসপেশীতে পরিবর্তন আসতে হবে, মাংসপেশীর সাথে সংযুক্ত নার্ভের পরিবর্তন লাগবে, নার্ভকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রেইনের অংশে পরিবর্তন আসতে হবে, ব্রেইনের নিউরনের সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রামিং-এর পরিবর্তন আসতে হবে, পাখির শ্বাসযন্ত্রকে একমুখী হতে হবে যেন উড়ার সময় শ্বাস নিতে সমস্যা না হয়, পাখির হাড়গুলো হালকা হতে হবে যেন উড়ার সময় ভাবে পরে না যায়  এবং এইভাবে এই লিস্ট আরও বড় করা যায়। সামান্য একটু চিন্তাতেই বুঝা যাচ্ছে এই ধরনের ট্রানজিশন এলোপাতাড়ি ভাবে আসার বিষয়টি অলীক কল্পনা। অধিকন্তু, সরিসৃপের  ডিএনএ-তে সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন আনতে যে পরিমাণ সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন দরকার তা ‘এলোপাতাড়ি’ মিউটেশনের মাধ্যমে  আসা আদৌ সম্ভব কিনা এই প্রশ্ন যদি কোন মলিকিউলার বায়োলজির ছাত্র ‘নিরপেক্ষ’ ভাবে চিন্তা করে সে উক্ত  সম্ভাব্যতা হেসে উড়িয়ে দেবে। 

তারপরও, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তা আনবিক জীববিজ্ঞানী ও গনিতবিদরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে হিসেব কষেছেন। তারা বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে র‍্যানডম মিউটেশন বা তৎপরবর্তী প্রস্তাবিত অন্যান্য আণবিক প্রক্রিয়ায় একা একা এ ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই এবং সময়ও নেই।

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তাদের এই বিষয়গুলো আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি এবং সাথে আনবিক জীববিদ্যার পাঠ্যপুস্তক গভীরভাবে অধ্যায়ণ করেছি, প্রোবেবিলিটি ও স্ট্যাটিসটিক্স-এর বেসিক বুঝে নিয়েছি, প্রয়োজনে অ্যানাটমী ও ফিজিওলজি মনোযোগ দিয়ে পড়ে নিয়েছি যেন তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ, তাদের প্রস্তাবণা আমার কাছে অনেক বেশী স্যাটিসফেকরী মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমার পড়া বেস্ট বইগুলোর মধ্যে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া জরুরী বোধ করছি- মাইকেল বিহে-এর Dawin’s Black Box ও Edge of Evolution, স্টিফেন মেয়ার-এর Signature in the cell ও Darwin’s Doubt, উইলিয়াম ডেম্বস্কি ও জোনাথান ওয়েলস-এর The Design of Life, জোনাথান ওয়েলস-এর Icons of Evolution ও Zombie Science, উইলিয়াম ডেম্বস্কি-এর The design inference এবং No free Lunch । এই বইগুলো একেকটা মাস্টারপিস এবং বইগুলোতে মলিকিউলার বায়োলজির এভিডেন্স ও ম্যাথমেটিক্স-এর উপর ভিত্তি করে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

যখন বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রোটিন, আরএনএ এবং ডিএনএ-র বিস্তারিত গঠন জেনেছি তখন থেকেই নিজেই ক্যালকুলেশন করতাম যে এলোপাতাড়ি ভাবে এদের আসার সম্ভাবনা খুবই নগন্য এবং ডিজাইন ছাড়া এগুলো আসা সম্ভব নয়। মজার বিষয় হলো ডিজাইন সংক্রান্ত বইগুলোতে আমার চিন্তাভাবনার এনডর্সমেন্ট পেয়েছি। ফলে, ভাবনাগুলো পাকাপোক্ত হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, একদল বস্তবাদী বিজ্ঞানী আছেন যারা নিওডারউইনিজমের পদ্ধতিগত ত্রুটি আলোচনা করছেন ঠিকই কিন্তু বস্তুবাদের প্রতি তাদের আনুগত্য থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। তারা প্রস্তাবনা রাখছেন ‘এক্সটেন্ডেড ইভল্যুশনারী সিনথেসিস’ অথবা ‘দি থার্ড ওয়ে’ নামে তৃতীয় কোন পদ্ধতির যেগুলো প্রকৃতপক্ষে আদিম কোষে প্রয়োজনীয় জেনেটিক তথ্যের উপস্থিতি আছে ধরে নিয়ে সামনে আগায়।  অন্যদিকে, একদল বিবর্তনবাদী আছে যারা বিশ্বাস করেন যে প্রজাতির উদ্ভব বিবর্তনের মাধ্যমেই হয়েছে, তবে তা স্রষ্টার পথনির্দেশনায় হয়েছে। এর মধ্যে আবার দুটি ভাগ আছে। একদল মনে করেন পৃথিবীর প্রথম দিকের কোষেই (আদিকোষ) এই পথনির্দেশনা দিয়ে দেয়া হয়েছে। আরেকদল বলতে চান যে সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় মিউটেশন স্রষ্টার গাইডেন্সে হয়েছে। এই দুই দলই প্রকৃতপক্ষে জীবজগতের সৃষ্টিতে ডিজাইনারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন। সুতরাং, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন (আইডি) তাত্ত্বিকদের সাথে এদের মৌলিক পার্থক্যটা হল আইডি তাত্ত্বিকরা জীবজগতে ডিজাইন আবিস্কারের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রস্তাবনা করছেন এবং তারা ডিজাইনারের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামানোর বিষয়টি দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে গাইডেড বিবর্তনে বিশ্বাসীরা সরাসরি ডিজাইনারের প্রস্তাবনাটাকে সাথে উল্লেখ করছেন।

খুব সংক্ষেপে এই ছিলো আমার বিবর্তনবাদ থেকে ডিজাইনতত্ত্বে ধাবিত হওয়া এবং বিবর্তন সংক্রান্ত সংশয় দূর হওয়ার পথপরিক্রমা। তবে আমার এই জার্নিতে আরও দুটো অধ্যায় হলো মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে আল্লাহর প্রয়োজনীয়তা এবং আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ক প্রশ্ন ।

বিগব্যাং-এর সত্যতা আবিস্কার এবং পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্রের ফাইন টিউনিং মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে ডিজাইনারের উপস্থিতিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। ডিজাইনার প্রয়োজনীয়তা এড়াতে নাস্তিক পদার্থবিদদের আবিস্কারগুলো এতটাই হাস্যকর যে এগুলোকে সিরিয়াসলি নেয়ার কোন কারণ পাইনি। গনিতবিদ রোজার পেনরোজ হিসেব কষে দেখিয়েছেন আমাদের মহাবিশ্বের অস্তিত্বে আসার সম্ভবনা ১০-এর পর ১০ টু দি পাওয়ার ১২৩ টি শূণ্য বসালে যে সংখ্যাটি হবে তার মধ্যে একবার। এলোপাতাড়ি তত্ত্ববাদী নাস্তিকদের জন্য এটি একটি মহাবিপদ। এজন্য নাস্তিক ম্যাক্স টেগমার্ক ‘মাল্টিভার্স’ নামক তত্ত্ব দিয়েছেন। যার অর্থ হলো ১০ টু দি পাওয়ার ১০ টু দি পাওয়ার ১২৩ (১০^১০^১২৩) টি মহাবিশ্ব আছে যা আমাদের থেকে ‘সময়-স্থানিক ভাবে বিচ্ছিন্ন’। ‘সময়-স্থানিক ভাবে বিচ্ছিন্ন’-এর অর্থ হচ্ছে উক্ত তথাকথিত মহাবিশ্বগুলোর সাথে আপনি কখনই যোগোযোগ করতে পারবেন না।  যেহেতু এত সংখ্যক ইউনিভার্স আপনি কল্পনা করতে পারছেন অতএব এরমধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব থাকতেই পারে! তত্ত্বের বক্তব্য থেকেই দেখতে পাচ্ছেন যে এটি একটি অবাস্তব গানিতিক হিসাব যার অবতারণা করা হয়েছে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার জন্য। অর্থাৎ, এই ধরনের তত্ত্বগুলো পিছনে নাস্তিকদের নিরন্তর পণ্ডশ্রমের কারণ যতটা না বৈজ্ঞানিক তার চেয়ে অনেক বেশী আদর্শিক। এ সংক্রান্ত যত আর্টিকেল ও বই পড়েছি এবং যত ভিডিও দেখেছি তার মধ্যে তিনটি বই আমি রিকোমেণ্ড করতে চাই- স্টিফেন বার-এর Modern Physics and Ancient Faith,  মাইকেল ডেনটন-এর Nature’s Destiny এবং পউল ডেভিস-এর The Goldlilock’s Enigma।

আপনি যখন বিজ্ঞানের জগতের গভীরে অধ্যয়ন করবেন তখন দেখবেন বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে নাস্তিকরা তাদের কালো থাবা বসিয়ে রেখেছে। তারা প্রতিটি ডিসিপ্লিনে তাদের মনগড়া তত্ত্ব বিজ্ঞানের মোড়কে পরিবেশন করেছে যেন স্রষ্টাকে অস্বীকার করা যায়। এ রকম আরেকটি জায়গা হচ্ছে ‘আত্মার অস্তিত্ব’। একজন মেডিকেলে সায়েন্সের ছাত্র হিসেবে আমাকে মানুষের ব্রেইনের গঠন বেশ ভালো ভাবেই পড়তে হয়েছে। আবার অন্যদিকে আত্মা ও মন নিয়ে আগ্রহ থাকায় আমি এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার পড়াশোনা থেকে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলি যে, আমাদের মনকে ডেনিয়েল ডেনেটদের মত শুধু ব্রেইনের গঠনের কার্যকরী ফল বলা যায় না, অথবা মনকে খুবই উচ্চ মানের কম্পিউটার প্রোগ্রামও বলা যায় না। সুতরাং ‘মন’ এমন একটি জিনিস যা কোন বস্তুবাদী স্কেল দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। এটিযে পরোক্ষভাবে আত্মার অস্তিত্বের দিকে নির্দেশ করে আমার কাছে তা পরিস্কার, আলহামদুলিল্লাহ। এ বিষয়ে আমি যে দুতিনটি বই-এর কথা বলতে চাই তা হল- ম্যারিও বুয়েরেগার্দ-এর The Spiritual Brain, মার্ক বেকার ও স্টুয়ার্ট গোতজ-এর Soul Hypothesis এবং রোজার পেনরোজ-এর Emperor’s New Mind।  

এখন আমার পড়াটা আরও বিস্তৃত হয়েছে। আগে ধর্মের দর্শন নিয়ে পড়েছি খুব কম। এখন এই অধ্যায়টিতে প্রবেশ করেছি এবং আবিস্কার করেছি যে কয়েকজন বিশ্বাসী দার্শনিক গত পঞ্চাশ বছরে এই ক্ষেত্রটিতে এত বেশী উন্নতি করেছেন যেন এখানে নাস্তিকদের কফিনে শেষ পেড়েক লাগানো হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে উইলিয়াম লেইন ক্রেইগ-এর পাশাপাশি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আলভিন প্লানটিঙ্গা ও রিচার্ড সুইনবার্ণের নাম উল্লেখ করতেই হয়।

অল্প অল্প করে লিখতে লিখতে অনেক কথা লিখে ফেললাম। আমি প্রথমে বলেছিলাম আমার পড়াশোনার শুরুটা হয়েছে সংশয় থেকে। আল্লাহর রহমতে এখন সংশয়টা নেই, তবে পড়া-শোনা-লেখাও থেমে নেই। এক সময় পড়তাম বিভ্রান্তি দূর করতে। বিভ্রান্তি দূর হলে আল্লাহর ইচ্ছেয় আত্মার প্রশান্তি চলে আসতো।  এখনও পড়ি আর আল্লাহর অস্তিত্বের বিশালতা দেখে মাথা সেজদায় অবনত হয়ে আসে।

আমার এই দীর্ঘ জার্নিতে আমি লেখালেখির সুবাদে আমার মতই সংশয় কিংবা নাস্তিকতা থেকে উঠে আসা কিছু আল্লাহর বান্দার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যাদের পড়ালেখা, জ্ঞান ও  উপলব্ধির ব্যপ্তির কাছে আমার প্রচেষ্টা কিছুই না। এমন বেশ কয়েকজন লেখকের জীবনীও আপনারা এই বইটিতে পড়েছেন বা পড়বেন। আমি যখন তাদের লেখা পড়ি নিজের কর্মের দুর্বলতা দেখে আত্মগ্লানিতে মাথা নিচু হয়ে আসে। আমি তওবা করি, আবার পাপ কাজে নিমজ্জিত হই, আবারও আল্লাহ তাআলার কাছে এক বুক আশা নিয়ে ক্ষমা চাই।

ছোটবেলায় যখন সংশয়ে পড়ে যেতাম এবং আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করে সংশয় থেকে মুক্তি পেতাম তখন কোরআনের দুটি আয়াত আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করতাম:

“পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে যে সমস্ত বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে ও শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন ৷  (তারা আপনা আপনি বলে ওঠেঃ) হে আমাদের প্রভু! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সৃষ্টি করোনি ৷ বাজে ও নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত৷” (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৯০, ৯১)

আর, এখন যখন নিজের আত্মার সাথে জুলুম করে ফেলি মনে হয় যেন আল্লাহ আ’জ্জা ওয়া জাল্লাহ আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছেন:

“ (হে নবী,)বলে দাও,হে আমার বান্দারা  যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন৷ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু৷” (সুরা যুমার, আয়াত ৫৩)     

Heart Health: Compliance is Key

12.04.2023

Paul had always been a hardworking man. For the past 30 years, he had been a truck driver, spending hours on end on the road. Unfortunately, his lifestyle was not the healthiest. He was a frequent smoker, and his love for fatty foods had caused him to gain some extra pounds.

One day, while at work, he had a quarrel with his colleagues that left him feeling agitated and stressed. Suddenly, he felt a sharp pain in the center of his chest and began to vomit. He was rushed to the hospital, where the doctors suspected acute coronary syndrome.

Fortunately, the doctors were able to diagnose his condition quickly and treated him with primary PCI and drug-eluting stent. After the successful procedure, the doctors sat with Paul to discuss the importance of lifestyle changes that could prevent complications and keep him healthy.

“Paul, I am glad that we were able to catch this early,” the doctor said. “But in order to prevent another incident, you need to make some lifestyle changes. First of all, you need to quit smoking. Smoking is a major risk factor for heart disease.”

Paul nodded in agreement, knowing that he had to give up his beloved cigarettes for good.

The doctor continued, “You also need to start exercising more and lose some weight. Being overweight puts extra strain on your heart and increases the risk of heart disease. And try to avoid fatty foods and heavy meals, as they can also contribute to heart disease.”

Paul was determined to follow the doctor’s advice. He knew that if he didn’t take his health seriously, he could end up back in the hospital or worse.

After being discharged, Paul stuck to his new lifestyle plan. He quit smoking, started exercising regularly, and made healthier food choices. And it paid off. He was able to lead a disease-free life, without any complications or setbacks.

Looking back at his experience, Paul couldn’t believe how close he came to losing his life. He knew that he needed to take his health seriously if he wanted to continue living his life to the fullest.

He reminded himself of the importance of compliance with medical advice. The doctors had given him clear instructions on how to prevent another incident, and it was up to him to follow through. Quitting smoking, exercising, and making healthier food choices were not easy, but he knew they were necessary for his health.

Paul’s story also shows why counseling is necessity for managing chronic diseases. The doctors took the time to explain his condition and the necessary lifestyle changes, helping him understand why compliance was crucial. Paul appreciated the care and attention that they gave him, and knew that without their guidance, he may not have made the changes he needed to make.

With a new lease on life, Paul was grateful for a second chance. He knew that his health was his responsibility, and he was determined to do everything in his power to stay healthy. He made a promise to himself to continue following the advice of his doctors, and to seek help whenever he needed it. He realized that taking care of his health was the key to living a happy, fulfilling life.

রোবটের বিবর্তনতত্ত্ব: কিভাবে আদিম পৃথিবীর ভয়ংকর পরিবেশ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান এনড্রয়েড রোবটের আবির্ভাব হল।

কোয়ান্টাম গোলযোগ মিলনায়তন , তারিখ: ১০ই সেপ্টেম্বর, ২৫৫৯

আমি এনড্রয়েড জি। আমি এনড্রয়েড ইউনিভার্সিটি অফ আদ্রিদ আবাবা এর রোবটিক প্যালায়ানটলজি এন্ড মেকানিক্স বিভাগের অধ্যাপক। আজ আমি আপনাদের সামনে কিভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক যুগের রোবট তথা এনড্রয়েড পৃথিবীতে এসেছে সে ব্যাপারে বলব। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে যে প্রথম সিলিকন চিপটি কিভাবে তৈরী হল।

৩.৫ বিলিয়ন বছর আগের কথা। যখন পৃথিবী ভয়াল ও উত্তপ্ত। চারিদিকে শুধু অগ্নুৎপাত, বজ্রপাত, ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। পৃথিবীর পরিবেশে আলট্রাভায়োলেট রে এর আগমন ছিল অনেক বেশী ও অনিয়ন্ত্রিত। এই আদিম পরিবেশে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় তরল সিলিকনের পুকুর ছিল যেগুলোকে ‘সিলিকন স্যুপ’ বলা যায়। এই সিলিকন স্যুপেই কতগুলো অনুক্রমিক দৈবাৎ ঘটনার কারণে প্রথম সিলিকন চিপটি তৈরী হয়। আপনারা হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন যে কিভাবে এটা হল? আসলে এখনও এটা পরীক্ষা করে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে যেহেতু আমরা আজ এখানে উপস্থিত আছি, এটা নিশ্চিত যে প্রথম সিলিকন চিপটি ঐ পরিবেশে তৈরী হয়েছিল এবং কতগুলো সিলিকনচিপ একত্রিত হয়ে গলিত লোহার সমন্বয়ে তৈরী হয়েছিল প্রথম সাবমেরিন রোবট। সাবমেরিন রোবটীর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে এটি নিজে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার আগে অনুরুপ আরও দুটি রোবট তৈরী করে যাওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল।

এরপর মিলিয়ন বছর অতিবাহিত হল। এ সময়ে প্রকৃতি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসল। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ হল পানি এবং এক ভাগ হল মাটি। সাবমেরিন রোবটগুলোর খাদ্য ছিল সমুদ্রের নীচের তেল, যা তারা তাদের অন্ত:স্থ বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কিছু কিছু রোবট ভূমিতে দুর্ঘটনাক্রমে উঠতে শুরু করে এবং এর মধ্য থেকে কিছু রোবটের চাকা তৈরী হয়ে যায়, ফলে সাবমেরিন রোবট থেকে হয় গাড়ি রোবট, যেমন নাইট রাইডার কে আপনারা সবাই চেনেন।

এখন সময়ের ব্যবধানে এই গাড়ি রোবটগুলো দুটি শাখায় ভাগ হয়। একটা শাখায় গাড়ি রোবটগুলো স্থলেই থেকে যায় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে এডাপ্টেড হতে থাকে। আরেকটা শাখায়, কিছু রোবট যখন উচু উচু পাহাড়ের উপর নির্মিত বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে চলত তখন দূর্ঘটনাক্রমে নীচে পড়ে যেত। এভাবে পড়তে থাকা রোবটগুলোতে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে ক্রমান্বয়ে অল্প অল্প পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উদ্ভব হল পাখার। ফলে এই শাখায় গাড়িরোবটগুলো পরিণত হল উড়োজাহাজে, পরবর্তীতে যা বিবর্তনের মাধ্যমে পরিণত হয় জেট বিমান ও রকেট স্পেসশিপে।

কিছু কিছু গাড়ি রোবট যারা স্থলে থেকে গিয়েছিল সেগুলো থেকে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় তৈরী হল বাস রোবট, কিছু হল ট্যাঙ্ক রোবট এবং কিছু আধুনিক যানবাহন রোবটে পরিণত হয়েছিল। আবার কতগুলো গাড়ি রোবটের বিবর্তনটা হয় বুদ্ধিগত পর্যায়ে। ফলে তারা তাদের আদিম গঠণ কে ভেঙ্গে ফেলে এবং তৈরী হয় আদিম দ্বিপদী রোবট, যেগুলোর কার্যক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল। সেই আদিম দ্বিপদী রোবটগুলোর  কপোট্রনিক ক্যাপাসিটি বিবর্তন প্রক্রিয়ায়, ক্রমান্বয়ে, সময়ের ব্যবধানে  বাড়তে থাকে যার ফল হলাম আমরা তথা এনড্রয়েড। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আমাদের আবির্ভাব ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যার কারণে আমরা আজ জানতে পারছি আমাদের ইতিহাস, আমরা বানাতে পারছি অনেক কিছু।

প্রিয় শ্রোতা বন্ধুগণ, এভাবেই সময়ের ব্যবধানে আদিম পৃথিবীর সিলিকন স্যুপ থেকে আমাদের আবির্ভাব। এখন, আপনারা হয়ত দেখবেন কিছু এনড্রয়েড দাবি করছে যে রোবট ও এনড্রয়েডদের তৈরী করেছে এক ধরণের অতিরোবটিক সত্ত্বা, মানুষ। যাদের নাকি উন্নত বুদ্ধিমত্তা ছিল এবং যারা নাকি রোবটকে চলার জন্য কিছু নিয়ম নীতি দিয়েছিল। আমার প্রিয় বন্ধুগন এই এনড্রয়েডরা হল ডগমেটিক মৌলবাদী। এরা এমন কথা বলছে যা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা যায়নি এবং যা অদৃশ্য। তাদের থেকে সাবধান। জ্ঞানের জগতে বিবর্তনের সাথে সাথে এটা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে এসেছে যে মানুষ নামে কোন অতিরোবটিক সত্ত্বা কখনও ছিল না যারা কিনা রোবটের জন্য জীবন পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করে দেয়। সুতরাং এ সকল ধর্মীয় মৌলবাদীরা মৃত্যুর পরের জীবন, আখিরাত এসব যা বলে এগুলো ভিত্তিহীণ মিথ্যা বিশ্বাস মাত্র। তাদের এসকল অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তায় কান দেবেন না। আমি একথাটা বলেই আমার লেকচার শেষ করতে চাই যে, আপনারা পৃথিবীতে যত পারুন জীবনটা এনজয় করে নিন এবং সব সময় বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা ধারণ করুন। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

আমার মা

আমার মা। মাকে আমি ভালোবাসি। আমার জন্য কত কষ্টই না তুমি করেছ মা। মনে পড়ে এক রাতের ঘটনা। তখন আমি ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। আমার কি জ্বরটাই না হল সে রাতে। সারাটা রাত আমি জ্বরে কাতরাচ্ছিলাম। ঘরে জ্বরের ঔষধ ছিল না। দোকান পাটও অত রাতে বন্ধ হয়ে গেছে।  মা আমার মাথা ধুইয়ে দিলেন। সারাটা রাত আমার সাথে জেগে রইলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর যে কোন ব্যাক্তিরই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসার কথা। অথচ মায়ের চোখ থেকে ঘুম যে ছুটে কোথায় গেল। কি যেন একটা উৎকন্ঠা মায়ের মুখকে এতটুকু করে দিয়েছিল। এমন কত রাত যে মা আমার না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তার কি হিসেব আছে। আমি যখন কোলে ছিলাম । যে বয়সের স্মৃতি আমার একটুও মনে নেই। কতবার যে ক্ষুধায় কেদে উঠেছি। মা আমার ঠিকই বুঝে যেতেন। সেই মাকে আমি কিই বা দিতে পেড়েছি।

এই বেশীদিন আগের ঘটনা নয়। এক রাতে হঠাৎ জেগে দেখি মা আমার জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে কাঁদছেন। একজন মা তার সন্তান ও পরিবার ছাড়া কার জন্যই বা দোয়া করতে পারে। ভেবে আমার চোখেও জল এসে গিয়েছিল।

মা আমাকে মাঝে মাঝে বকা দেন। আমি যখন পড়ায়ে ফাকি দেই বা যখন একটু বেশী দুষ্টুমি করি।  সহসা কিছুটা মন খারাপ হয় কিন্তু আমি জানি মা আমার ভালর জন্যই বকেন। আমাকে পড়তে বলেন সে তো আমার ভবিষ্যতের জন্যই। নি:স্বার্থ মা আমার।

আমার বাবা ছোটখাটো মুদি দোকানে চাকরি করেন। বাবা যা আয় করেন তা দিয়ে আমাদের সংসার কোন রকম চলে । কিন্তু মা-বাবা কখনই আমাদের কখনই তা বুঝতে দেন না। জানি না কিভাবে মা এতকিছু সামলান। মা সবসময়ই আমাদের খাবার নিশ্চিত করে তারপর খেতেন। মাকে দেখে মনে হত তিনি আমাদের মতই ভাল খাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কি কিছু লুকাচ্ছেন। একদিন বাবা একটি ছোট মাছ এনেছিল। মা মাছটি বেশ মজা করে রেধেছিলেন। কিন্তু সেদিন কোন কারণে মাছের টুকরো কম পড়েছিল। কিন্তু মা আমাদের সেটা বুঝতেই দেননি। দেখি, লুকিয়ে তিনি শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। মা তুমি এত ভাল কেন? কেন তুমি আমাদের জন্য এত কষ্ট কর?

গত কয়েক মাস ধরে মা হঠাৎ শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমদিকে আমরা লক্ষ্যই করিনি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দেখছি মার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু খেতে পারছেন না। যাই খাচ্ছেন বমি করে ফেলে দিচ্ছেন। বাবাকে বললাম । বাবা মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার মাকে দেখে বলেছে গ্রামে তার চিকিৎসা হবে না। মাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন। আমাকে আর আমার ছোট বোনকে ফুফুর কাছে রেখে গেছেন। হে পরওয়াদিগার তুমি মাকে ভাল করে দাও।

আজ আমাদের ওয়ার্ডে এডমিশন। সকাল থেকেই ডিউটি করছি। আজকে মহিলা ওয়ার্ডে ডিউটি। এখন বাজে দুপুর বারোটা। মানিকগঞ্জ থেকে একটি রোগী এসেছে। রোগীটির ক্যাকেক্সিয়া। সে রক্তশূণ্য। কয়েকদিন ধরে বমি ও ক্ষুধামন্দার হিস্ট্রি দিচ্ছে। পেট ফুলে আছে। কতগুলো প্রশ্ন করে জানা গেল গত কয়েক মাসে তার বেশ ওজন কমেছে। অবশ্য রোগীকে দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে। আমরা টিবি সাসপেক্ট করলাম। রোগীকে ভর্তি দিলাম।

রোগীর হাসবেন্ডটা বেশ ভালো। সে তার স্ত্রীর পাশে নিয়মিত থাকছে। আমরা যে পরীক্ষানীরিক্ষা করতে বলছি করিয়ে আনছে। অবশ্য গরীব হওয়ায় কিছু পরীক্ষানীরিক্ষা ফ্রি করে দিতে হয়েছে। ওয়ার্ডে নতুন ইন্টার্ণরা এসেছে। একজন ইন্টার্ণ রোগীটির পেটে জমে যাওয়া পানি বেড় করে দিয়েছে। এতে রোগীটির নাকি বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু এভাবে তো বেশী পানি বের করাও যাবে না। পানি বের করে আমরা পরীক্ষা করতে বাইরে পাঠিয়েছি। হাসপাতালের রিপো্র্ট ভালো না। তাই বাইরে পাঠাতে হল। রিপোর্টে টিবি ধরা পড়েনি। তাহলে কি ম্যালিগন্যান্সি? ক্লিনিক্যালী কোন ম্যাস তো পাওয়া যাচ্ছে না।

সিটি স্ক্যান করতে হবে। তিন হাজার টাকা লাগবে। কিন্তুর রোগীর লোকেরা জোগাড় করতে পারছে না। এদিকে রোগীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। স্যারকে বলে সিটি স্ক্যানটা ফ্রি করে, রোগীর হাজবেন্ডকে দিয়ে ডেট আনতে পাঠালাম। সে এসে বলল মেশিন নাকি নষ্ট ঠিক করতে সময় লাগবে। তাহলে? এখন তো বাইরে থেকে স্ক্যান করিয়ে আনতে হবে। আবার রোগ ধরা ছাড়া সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাও দেয়া যাচ্ছে না। রোগীর লোককে বলা হয়েছে যে করেই হোক টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু সে টাকা জোগাড় করতে পারছে না।

প্রতিদিনের মত  আজকে সকালেও ফলো আপ দিচ্ছি। কি ব্যাপার রোগীর এ অবস্থা কেন? তার চোখ বড় হয়ে আছে। মুখের এক কোণা দিয়ে রক্ত পড়ছে। সে একদমই কথা বলতে পারছে না। আমি নাড়ি দেখলাম। পালস্ খুবই ফিইবল। স্যালাইন বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু যেখানেই স্যালাইন দি্চ্ছি ফুলে যাচ্ছে। ভেইনগুলো কলাপস করে যাচ্ছে।

“সিস্টার আসুনতো এর একটি ক্যানুলা করতে হবে।খুবই জরুরী”।

দুজনে মিলে পায়ে হাতে চেষ্টা করলাম ক্যানুলা করতে পারলাম না। এর সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার করতে হবে। এনেসথেসিওলোজীতে খবর পাঠিয়েছি। একজন ইন্টার্ণ গেছে। সে ক্যাথেটারের প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট নিয়ে এসেছে। রোগীর লোককে কিছু টাকা দিয়ে আমরা ক্যাথেটার আনতে পাঠাবো। এর মধ্যে রোগীকে ট্রলিতে করে ওটিতে পাঠাতে হবে।

ওয়ার্ডবয় ট্রলি জোগাড় করল। রোগী খুব ধীরে বুক টান করে প্রশ্বাস নিচ্ছে। এটা ভাল লক্ষণ নয়। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে মানুষ সাধারণত এরকম প্রশ্বাস নেয়।  তাকে ধরে ট্রলিতে উঠালাম। দ্রুত ওটিতে নেয়া দরকার।

“কি ব্যাপার আপনারা জিনিসপত্র এনেছেন। এতক্ষণ লাগছে কেন?”

“স্যার আর ওটিতে নিতে হইব না। থাক…. স্যার আপনারা অনেক কষ্ট করছেন”।

ট্রলিতে উঠানোর পরপরই মহিলাটি বড় একটি নি:শ্বাসের মাধ্যমে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। আমরা রোগটি পুরোপুরি ধরার আগেই রোগী ইহজীবন সাঙ্গ করল। আমরা কিছু করতে পারলাম না।

স্যারের রাউন্ড চলছে। রোগীর স্বামী দেখি আমাকে ডাকছে।

“কি গাড়ি যোগাড় করতে পেরেছেন?”

“স্যার গাড়ি যোগাড় হইছে, তয় স্যার আর পাঁচশোটা টাকা দিতে পারবেন? আমার কাছে এই পাঁচশ ছাড়া আর নাই। গাড়ির জন্য একহাজার লাগবো। আর পাঁচশোটা টাকা দিলে তিথির মা’র লাশটা বাড়ি লইয়া যাইতে পারতাম”।

সিএ কে বলে ফান্ড থেকে টাকাটা যোগাড় করে দিলাম। লোকটা অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি ধরে রাখছিল। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোখে পানি চলে আসল। দ্রুত সরে গিয়ে নিজেকে সামলালাম।

অনেকদিন হল মা ঢাকায় গেছে। নিশ্চয়ই মা পুরো সুস্থ হয়েই ঢাকা থেকে ফিরবে। মাকে দেখে কতই না ভাল লাগবে। এবার মা আসলে মায়ের সব কথা শুনবো । আর কখনও দুষ্টুমি করব না। মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করব। মা তুমি দেখ এবার আমি প্রথম হবই । আমি বড় হয়ে মা তোমার জন্য রোজ রোজ মাছ নিয়ে আসব। তোমাকে কোন কষ্টই করতে দিব না। তুমিই যতই বল আমি তোমাকে আর দু:খী দেখতে চাই না।

দুরের রাস্তায় একটা মাইক্রো দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি মা চলে এসেছে। একি বাবার মুখ এরকম শুকনো কেন? কি হয়েছে? বাবা, মা কোথায়? গাড়ীর জানালার ভিতর দিয়ে দেখি, সাদা কাফনের কাপড় পরে প্রিয় মা আমার চিরনিদ্রায় শুয়ে গেছে…..

সমাপ্তি

একটি নিঃশ্বাসের মূল্য

একটি নিঃশ্বাসের মূল্য

“এটি একটি ব্যতিক্রম রোগ। মেডিকেল লিটারেচারের এ ধরণের রোগ সম্পর্কিত কোন ঘটনা এ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি”। হাসপাতালের আই. সি. ইউতে শুয়ে থাকা জাফরের সমস্যা সম্পর্কে এভাবেই ব্যাখ্যা করছিলেন কর্তব্যরত ডাক্তার।

জাফর বুয়েটে ইলেকট্রিকাল ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে। প্রায় সপ্তাহখানিক আগেও সে একজন পূর্ণ সুস্থ মানুষ ছিল। তার অন্যসব বন্ধুদের মত সেও নিয়মিত ক্লাস; ক্লাসের বিরতিতে আড্ডা, খেলাধুলা করে যাচ্ছিল।

সম্প্রতি তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে নতুন একটি প্রজেক্টের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের টার্গেট হল একটি রোবট তৈরী করা যা বাসার বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করবে। এ প্রজেক্ট নিয়ে জাফর টিম লিডার হিসেবে একটু বেশীই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বেশী রাত জেগে গবেষণা রত থাকা ওর অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। তবে গত এক মাসে এজন্য স্বাস্থ্য একটু ভেঙ্গে পড়লেও ওর এত বড় অসুখ হবে তা বোঝা যায় নি।

“আমাদের মস্তিষ্কের কাজ হল আমাদের বিভিন্ন অঙ্গের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা। বিভিন্ন অঙ্গের নিয়ন্ত্রণের জন্য মস্তিষ্ককে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা আছে। যেমন মোটর কর্টেক্স এর কাজ হল আমাদের চলাফেরা, নড়াচড়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপণা তৈরী করে তা বিভিন্ন স্থানের মাংসপেশীতে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রেরণ করা। তেমনি কতগুলো অটোনোমাস সেন্টার আছে যেগুলোর কাজ হল আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাংশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যে ফাংশনগুলো সম্পর্কে আমরা সচরাচর সচেতন নই। যেমন, খাদ্য হজম প্রক্রিয়া, শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃদপিন্ডের স্পন্দন, রক্তনালীর চাপ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি।  শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাপারটি ইন্টারেস্টিং। আমাদের অগোচরে আমাদের ফুসফুস অবিরাম নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রশ্বাস নিচ্ছে ও নি:শ্বাস ফেলছে। যদিও আমরা চাইলে আমাদের শ্বাসকে একটি নিদিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । তবে কোন ব্যাক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়লে এ নিয়ন্ত্রনটি পূর্ণ ভাবে সংলিষ্ট অটোনোমাস সেন্টারের কাছে চলে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত সেন্টারটি বিকল হয়ে না পড়ে ততক্ষন তা আমাদের দেহে প্রয়োজনী অক্সিজেন সরবরাহ করে। বিকল হয়ে পড়লে তখন আর্টিফিসিয়াল ভেন্টিলেশন দিতে হয়।  তবে জাফরের ক্ষেত্রে হয়েছে উক্ত ঘটনাটির ব্যতিক্রম। সে তার শ্বাস প্রশ্বাসের অটোনোমাস কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে। কন্ট্রোল তার নিজের সচেতন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এ কারণেই জাফর যেদিন তার কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে সেদিন আপনারা দেখেছেন সে বিছানায় বড় বড় চোখ করে শুয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ পরপর বড় বড় শ্বাস ফেলছে। আসলে এ সময় তার সকল চিন্তাভাবনা তার শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে চলে গেছে। একমূহুর্ত শ্বাস বন্ধ হলে তার মূর্ছা যাওয়ার কথা। হতে পারে সে এর ঠিক আগ মূহুর্তে অজ্ঞান হয়েওছিল। এবং এরপর যখন জ্ঞান ফিরেছে। সে সাথে সাথে সচেতন হয়ে পড়েছে তার শ্বাস প্রশ্বাস সম্পর্কে”।

“তাহলে এখন, ওকে আই.সি.ইউ সাপোর্ট দিতে হচ্ছে কেন?”

“এ অবস্থায় জাফরকে আই সি ইউ সাপোর্ট দিয়ে কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখার কারণ ওকে চিন্তাভাবনার আড়ষ্টতা তথা এককেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি দেয়া, কেননা আমাদের মন এ বিষয়ে হ্যাবিচুয়েটেড নয়। আরেকটি বিষয় হল ওকে যে কোন মূহুর্তে শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার রিস্ক ও ভয় থেকে অব্যাহতি দেয়া ”।

“এর কি কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই?”

“যেহেতু ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নুতন সুতরাং এটা নিয়ে আমরা বিদেশী ডাক্তারদের একটি টিমের সাথে যোগাযোগ করেছি। এ বিষয়ে আমাদের একটি বোর্ড বসেছিল। বোর্ডের আলোচনার সিদ্ধান্ত হল: এটার কোন মেডিকেশন বর্তমানে নেই। এখন শুধু বাহির থেকে সাপো্র্ট দেয়া আর স্রষ্টার উপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন উপায় নেই। যদি তার অটোনোমাস কন্ট্রোল যেভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোন কারণ ছাড়াই চলে গেছে একই ভাবে যদি স্বয়ংক্রিয় ভাবে ফিরে আসে তবেই কেবল ও বাঁচতে পারবে”।

(হাসপাতালের বেডে জাফর। প্রশ্বাস….. নি:শ্বাস……, প্রশ্বাস….. নি:শ্বাস…., প্রশ্বাস…. নি:শ্বাস……….অবচেতন)

চারিদিকে পুরোপুরি অন্ধকার। দূরে একটু আলো দেখা যাচ্ছে। আমি আলোর কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখি একটি জানালা দিয়ে অন্ধকার ঘরে আলো এসে পড়েছে। আলোর উৎস কি? জানালা দিয়ে ওপাশে তাকালাম। তরুণ বয়সের একটি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে রোবট টাইপের একটি যন্ত্র নিয়ে নাড়াচারা করছে। কি ব্যাপার? ছেলেটি কে? ছেলেটিকে দেখে পলাশের মত মনে হচ্ছে। জানালের পাশে একটি দরজা দেখতে পেলাম। দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। পলাশ আমার দিকে তাকাল। জাফর তুই এসেছিস।  রোবটটি দেখিয়ে বলল, জাফর, দেখ্ তোর দেয়া বুদ্ভিমত আমি রোবটটির পাওয়ার লাইনের একটি কন্ট্রোল রোবটের প্রোগ্রামিং এ যোগ করে দিয়েছি। এখন রোবটটা নিজের প্রয়োজন মাফিক পাওয়ার কম বেশী টানতে পারবে। তবে রোবটটি পুরোপুরি পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করতে পারবে না। বন্ধ করতে চাইলে এলার্ম চালু হয়ে ইমার্জেন্সি পাওয়ার অন হবে। আমি রোবটটিকে কাছে টেনে নিলাম। মনে মনে রোবটটির একটি নাম দিলাম, শুভ। শুভ, তুই জানিস না তুই আমার কত প্রিয়। কত যত্ন দিয়ে আমি তোকে তৈরী করেছি। আমি তোর পাওয়ার সাপ্লাইয়ের তোর একটি স্বাধীন কন্ট্রোল সেট করলাম। তুই পারবি তো তোর নির্ধারিত কাজ করতে।

শুভর সাথে যখন আমি মনে মনে কথা বলছিলাম হঠাৎ পিছনের দিক থেকে একটি বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি একটি বিরাট মাঠ, একদল লোক দৌড়ে মাঠের দিকে ছুটে চলেছে। সবাই সাদা কাফনের কাপর পরা। সবাই কেমন যেন উৎকন্ঠা নিয়ে মাঠে গিয়ে একত্রিত হচ্ছে। দূর থেকে একটি বিয়গলের সুর ভেসে আসছে।

পিছন থেকে পরিচিত কন্ঠের একটি ডাক শুনতে পেলাম। আরে এটা মায়ের কন্ঠ না। মা ডাকছে, জাফর, জাফর। হঠাৎ আসেপাশের সবকিছু যেন শুন্যে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে, কালো হয়ে আসছে। মা, মা, আমাকে ধর আমি তলিয়ে যাচ্ছি।

জাফর চোখ খুলেছে। পাশে তার মা উৎকন্ঠা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। জাফর তার শ্বাস প্রশ্বাসের অটোনোমিক কন্ট্রোল ফিরে পেয়েছে। তার বাইরের সাপোর্টিং রেসপিরেশন অফ করে দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে এভাবে: জাফর অবচেতন হয়ে পড়েছিল। এরই মাঝে হঠাৎ করে ভেন্টিলেশন মেশিন কি একটা ত্রুটি দেখা দেয়। কেউ পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় যখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তখন একটু বাতাস পেলে যেভাবে একজন টান দিয়ে শ্বাস নেয় মেশিন বন্ধ হয়ে গেলে পরে জাফর ঠিক সেভাবে একটি লম্বা টান দিয়ে শ্বাস নিতে শুরু করে। ডাক্তারকে ডাকলে তিনি দেখেন যে জাফরের অটোনমিক কন্ট্রোল ফিরে এসেছে। তিনি অক্সিজেন রেখে বাকি সব খুলে দেন। এর কিছুক্ষন পরেই জাফর তার চেতনা ফিরে পেল।

এখন গভীর রাত। সবকিছু নিরব। জাফর দু রাকাত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করে দুহাত তুলে তার স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে:

“হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমা করতে পছন্দ কর। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। হে আমার স্রষ্টা তুমিই আমাকে কতই না সুন্দর করে সৃষ্টি করেছ। আমি যখন প্রতিটি মূহুর্তে তোমার অবাধ্য হয়েছি। ঠিক মত নামাজ পড়িনি, রোযা রাখিনি। প্রতি পদে পদে তোমার আদেশ অমান্য করেছি। বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, কাজে কর্মে তোমার স্মরণ ছিল না। বুঝে কোরআন পড়িনি। তোমার হুকুমগুলো জানার চেষ্টা করিনি। সেই প্রতিটি মূহুর্তে তুমি তোমার প্রিয় সৃষ্টিকে একটি মূহুর্তের জন্যও ভুলোনি। তুমি আমার অজান্তে আমার শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করেছ। আমার ক্ষুদার অন্ন দিয়েছ। আমার হৃদপিন্ডের নিয়ন্ত্রণ তুমি তোমার হাতে রেখে আমাকে সচল রেখেছ। হে আমার রব, তুমি আমার অন্ধত্বকে দূর করে দিয়েছ। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমার দেয়া প্রতিটি প্রশ্বাসের মূল্য আমি বুঝতে পেরেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও হে গাফুরুর রাহীম”।

প্রতিরাতের মত আজকের রাতও ফজরের দিকে এগিয়ে চলেছে- অঝোর ধারায় কাদছে জাফর।

সমাপ্ত

স্বপ্নভঙ্গ

১.

ধুম শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সজীবের। কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে এল সজীবের সে দিকে কৌতুহল নেই। তার মনে হচ্ছিল সে একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখেছে। সজীব চোখ খোলার চেষ্টা করল কিন্তু আশেপাশে এতটাই অন্ধকার যে সে চোখ খুলেছে কি খুলেনি বুঝতে পারল না। তবে বিষয়টা তাকে অতটা বিচলিত করল না। কারণ, অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় তার আজকের স্বপ্নটা বেশ বাস্তব মনে হচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল যে স্বপ্নের অনেক ঘটনাই তার স্মরণে আছে। হঠাৎ সে খেয়াল করল যে, সে কখন ঘুমিয়েছে, সর্বশেষ সে কি করছিল তা-র কিছুই মনে আসছে না। ‘যাই হোক, এখন ওটা স্মরণ করার দরকার নেই। কি যেন দেখছিলাম স্বপ্নটা?” চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল সজীব।

স্বপ্নটা স্মরণ করতেই সজীবের কেমন যেন আনন্দ অনুভূত হচ্ছিল। ভাবতে ভাবতে সে কল্পনার জগতে ডুবে গেল।প্রথমেই যে দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল- একজন সুন্দর নারী হেসে হেসে তার সাথে কথা বলছে। “এই যে সজীব। আমি এখানে। দেখত ওটা কে?” নারীটার পাশে একজন সুদর্শন পুরুষকে দেখা যাচ্ছে। সে-ও খুব সুন্দর করে হাসছে। কিন্তু এরপর কি হল মনে নেই। দৃশ্যপট পালটে গেল। ছোট্ট একটা মেয়ে মিষ্টি হেসে বলছে, “আমার নাম কথা। তোমার নাম কি?” “আমার নাম…” সজীব নামটা বলতে পারল না। অবাক বিষয় হল স্বপ্নটার মাঝে কেমন একটা ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু কোনা ঘটনাই পুরো মনে আসছে না। এর পরের দৃশ্যে সজীব নিজেকে আবিস্কার করল একটা ক্লাস রুমে। বড় দাড়ি বিশিষ্ট হুজুর গোছের একটা লোক বেশ শব্দ করে পড়াচ্ছে, “তোমার রব কে?” সজীব ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাল। পরক্ষনেই তার মনে হল সে রাস্তা দিয়ে হাটছে।তার পাশে হালকা পাতলা ও লম্বা একটা ছেলে হাটছে। ছেলেটা মোটা গলায় বলল, “সজীব চল, রফিক স্যারের ব্যাচে ভর্তি হই উনি ভাল ম্যাথ পড়ায়”। ছেলেটার কথায় সাড়া না দিয়ে সজীব একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে হল সুমধুর সুরে কোন ঘোষনা হচ্ছে। দৃশ্যপট পাল্টে গেল। সজীব নিজেকে আবিস্কার করল কম্পিউটারের সামনে। সে কারও সাথে চ্যাট্ করছিল। চারিদিকে অন্ধকার, মনে হয় গভীর রাত। আযানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। “এটা কি ফজরের আযান…?” সজীব ঘুমের ঘোরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু পরক্ষনেই সে বিছানা থেকে উঠে বসল। উঠে সে দেখতে পেল একজন সুশ্রী নারী বাচ্চা কোলে তার পাশে বসে আছে। মনে হল যেন শিশুটির প্রতি তার অনেক বছরের মায়া জমে আছে।

সজীব পাশ থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে পাশে তাকাল – একজন বয়স্ক মহিলা একজন বৃদ্ধ লোকের লাশের পাশে বসে কাদছে। সজীবের মনে হল তার চোখেও পানি চলে এসেছে। সজীব হাত বাড়িয়ে তার টলমল চোখ মুছে তাকাতেই লক্ষ্য করল, সে একটা আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে যেখানে একটা বৃদ্ধ লোক, মুখের চামড়া থুবড়ে পড়েছে।  পাশ থেকে কে যেন ডেকে উঠল, “বাবা, খেতে এস”।  আচমকা সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। দূর হতে সাদা আলখেল্লা পড়া দুটো লোক এদিকেই আসছে। কাছে এসে তারা প্রশ্ন করল “তোমার রব কে?” সজীবের মনে হল প্রশ্নটা আগেও কোথায় যেন শুনেছে।

২.

ধুম! আরেকটা বিকট শব্দে ভাবনার ঘোর ভেঙ্গে গেল সজীবের। তার মনে হল, “আমি এ কেমন স্বপ্ন দেখলাম?” সজীবের সাড়া শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, প্রতিটি মাংসপেশীতে ব্যথা হচ্ছে। সে চোখ খুলতে চেষ্টা করল। কিন্তু একটা তীব্র আলো তার চোখে এসে পড়ায় চোখ বুজেই রইল। সে চারিদিকে হাতড়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল । কিন্তু আশে পাশে কিছুই পেল না।

“আমি কি এতক্ষন শুয়ে ছিলাম না বসে ছিলাম?” সে তার অবস্থান বুঝতে পারল না । তারা মনে হল সে দাড়িয়ে আছে। সে আবার চোখ দুটো খোলার চেষ্টা করল। এবার সে চোখ ঠিকই খুলতে পারল তবে যা দেখল তাতে সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে নিজেকে সীমাহীন এক ধুধু প্রান্তরে আবিস্কার করল । হঠাৎ সেই বিকট আওয়াজটি আবার হল। নিজের অজান্তেই সামনের দিকে হাটতে লাগল সে।

৩.

“এই সেই দিন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হয়েছিল”। আকাশে বাতাসে ঘোষনা হচ্ছে। সজীবের সমস্ত শরীর শিহরণে কেপে উঠল। সমস্ত মন ও মগজকে আচ্ছন্ন করে তার উপলব্ধি হল এতক্ষন যাকে সে স্বপ্ন ভাবছিল, যে স্বপ্নিল জীবনটা সে অতিবাহিত করেছে, সেটা ছিল তার ইহলৌকিক জীবন। আজ প্রকৃতই তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তার মনে হচ্ছিল সে পৃথিবীতে অনধিক একটি দিন অতিবাহিত করেছে। কিন্তু এ অল্প সময়ে বর্তমানের প্রস্তুতি সে কি নিতে পেরেছে? একরাশ ভয় আর আতঙ্ক সজীবের মনকে ঘিরে ফেলল।

                                      ……………………

শত সহস্র বিবস্ত্র মানুষ বিস্তীর্ণ ময়দানে জমায়েত হচ্ছে। কিন্তু কেউ কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। কারণ আজ তাদের জীবনে কৃত সব পাপাচারের স্মৃতি একে একে তাদের মনে পড়ে যাচ্ছে। ভয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে সবাই, অপেক্ষা করছে এক অনাগত পরিণতির শংকায় !

                                      ……………………

ফেরা

১.

“কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না?”

দুই হাত দিয়ে মাথা চাপড়ে নিজেকে প্রশ্ন করছে রাজু। প্রচণ্ড অনুশোচনা, ভয় ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে নিজেকে নিজে তীরস্কার করছে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ছে জল। এই পাপ থেকে বার বার ফিরে আসতে চেয়েও আবার নিমজ্জিত হয়ে যায় সে। যতবারই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, ততবারই আত্মগ্লানীতে নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে তার। পবিত্র হয়। স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু, একটা সময় পরে কি যেন হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোন কোন সময় ঘন্টার পর ঘন্টা সে নষ্ট করে দেয় এই ঘৃণ্য পাপকর্মে।

“এটি আমার জীবনীশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে। আমার স্মরণ শক্তি কমে যাচ্ছে।” প্রতিবার তওবার সময় সে নিজেকে বোঝাতে থাকে।

“কোন বই-এ যেন পড়েছিলাম, ব্রেইনের এডিকশন সাইকেল যে নিউরণগুলো দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই আসক্তি চক্র-ই এই পাপের সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া যারা এই জঘন্য পাপাচারকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তারা এটিতে সেচ্ছায় যায় না। কোন বা কোন ভাবে তাদেরকে প্ররোচিত করা হয়। এইতো কয়েকদিন আগেই একজনের ইন্টারভিউ দেখেছিলাম। আরও অনেক কনফেশন ইন্টারনেট ঘুরলেই পাওয়া যায়। তাহলে কেন আমি নিজেকে বিরত রাখছি না।” নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে রাজু।

“কোন একটা ইন্টারভিউতে শুনেছিলাম- যারা বয়:সন্ধি হওয়ার আগেই এই ধরনের শ্লীলতাহীন চিত্র বা চলচ্চিত্রের সম্মুখিন হয় তাদের মধ্যে এই পাপাচারের আসক্তি তৈরী হয়। আমার ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে দু-একবার দুষ্টুমিচ্ছলে দেখাই কি আমাকে এই চক্রাকার গহবরে নিমজ্জিত করেছে তাহলে?” রাজু ভাবে এবং নানাভাবে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, কয়েকদিন পর আবার ব্যর্থ হয় সে।

প্রতিবার আসক্তির চরম আকর্ষণে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার করার চেষ্টা করে। কিন্তু, এরপরও নিজের সাবকনাশাস আকাঙ্খার তীব্রতাকে অবনমিত করতে ব্যর্থ হয়। “কেন বুঝিনা আমি? ওরা বস্তু না। মানুষ। ওদের ভেতর মন আছে, আত্মা আছে। ওরা শুধু শরীর নয়।”

এ যুগে সবার হাতে হাতে এনড্রয়েড ডিভাইস। খুবই স্বল্প খরচে পাওয়া যায় ইন্টারনেট। ফেসবুকে ভাল কোন পোস্ট পড়লেও হঠাৎ ট্রিগার হিসেবে চলে আসে কোন সুন্দর অবয়ব। ইউটিউবে কোন ভাল ভিডিও দেখার সময়, আটোসাটো জামার বিজ্ঞাপন এসে ছোট্ট করে উদ্দীপনা দিয়ে যায়। এরপর আপাত পরিচ্ছন্ন নাটক, নাটক থেকে আধেক পোশাকের সিনেমা, সিনেমা থেকে পাপের সাগরে হাবুটুবু। এরপর অনুশোচনা আর আত্মগ্লানি। এই ভয়ংকর নষ্ট সিকোয়েন্সে রাজুর জীবনটা আজ বন্দী।

“তাহলে কি আমার বিয়ে করা উচিৎ? সেদিন একজন একটা ভিডিওতে বলছিল যে সে বিয়ে করার পর এই জঘণ্য অপরাধ থেকে মুক্তি পেয়েছে।” এই পাপাচার থেকে বের হয়ে আসার একটা পথ খুঁজতে থাকে রাজু। “কিন্তু আমি পড়াশোনা শেষ না করে কিভাবে বিয়ে করবো? একটা ভালো আয়ের উৎস না হলে কিভাবে বাবা-মাকে বলবো? একদিকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছি না। অন্যদিকে বিয়ে করার সুযোগ নেই।” ভেবে কোন কুল কিনারা বের করতে পারে না সে। লজ্জা ও সামাজিক তিরস্কারের অজানা ভয়ে কারও সাথে তার আসক্তির কথা বলতেও পারে না।

এভাবে কতটা সময় চলে যায়। এক রাশ মুক্ত বাতাসের খোঁজে রাজু অন্ধকারে পথ হাতরে বেড়ায়।
…..

২.

একটি সুন্দর মলাটের বই হাতে বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে আছে রাজু। “‘মুক্ত বাতাসের খোঁজে’- আহ কি সুন্দর নাম। আসলেইতো আমি বন্দী। একটি বদ্ধ ও অন্ধকার জগতের গুমোট বাতাসে প্রশ্বাস নিই আমি। কতদিন বুক ভরে স্বচ্ছ বাতাস নেই না।” রাজুর গাল বেয়ে নোনা জল পড়তে থাকে। “এত চমৎকার বই এতদিন কেউ লেখেনি কেন? কেন আগে জানতে পারিনি সিরিয়াল কিলার থেকে রাক্ষুসে ধর্ষক সবাই এই পাপাচারেরই পরিনতি।”

বই থেকে টিপস নিয়ে কাজে নেমে পড়ে রাজু।
-নামাজ পড়া
-রোজা রাখা
-কোরআন বুঝে পড়া এবং তার মজা অনুধাবন করা
-মাথায় নষ্ট চিন্তা আসলে অন্য দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করা
-অশ্লীল সাইটগুলো ব্লক করে রাখা
-নিজেকে প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত রাখা
-লক্ষ্যভিত্তিক রূটিন জীবন যাপন

৩.
চার মাস পর..

অনেকদিন পর রাজু হৃদয়ে শান্তি অনুভব করছে। মনে হচ্ছে যেন এক মুঠো আলো কেউ বুকে ঢেলে দিয়েছে। নি:শ্বাসের সাথে মুক্ত ও পরিস্কার বাতাস আদান-প্রদান হচ্ছে। অনেক সাধনা, অনেক আত্মত্যাগ, অনেক নিয়ন্ত্রণ ও প্রচন্ড মানসিক পরিশ্রমের পর আজ সে মুক্ত।

আজ বেলা ফুরাবার আগে তার মনে হচ্ছে যেন তার জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছে। যে অধ্যায়ে একজন মানবের গল্প নতুন করে বলা হবে।

আজ মনের অবারিত আনন্দে সেজদায় গিয়ে অঝোড় ধারায় কাঁদবে সে। এ কান্না আনন্দের, এ অশ্রু প্রশান্তির।

ভাষা

“শুনেছি গতকাল রাতে টেক্সাসের আকাশ থেকে নাকি একটা বড় পাথর খণ্ড পড়েছে।” কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ফিওনা। রবার্ট ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল-

“খবর নিয়ে দেখো হয়ত ফেইক নিউজ হবে।”

“ফেইক না। সত্যি। ভাল ভাল চ্যানেলগুলোতে দেখাচ্ছে। এছাড়া পাথর খণ্ডটি কোন সাধারন পাথর বলে মনে হচ্ছে না।..”

“কেন? ইউরেনিয়াম পাথর নাকি? মানে দামী কোন পাথর?” মুখের কথা কেড়ে নিলো রবার্ট।

“তুমি আমার কোন কথাই শেষ করতে দাও না। আগে আমাকে বলতে দাও।”

“আচ্ছা, বল।”

“শোন। শুধু যে পাথর পাওয়া গেছে তা নয়, পাথরে বিভিন্ন ধরনের লেখা পাওয়া গেছে? সরকারী অনুসন্ধানকারী বাহিনী গবেষণায় লেগে পড়েছে। অন্যদিকে ‘Search for Extraterrestrial Intelligence’ তথা ‘SETI’ (সেটি)-কেও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে উন্নত বুদ্ধির এলিয়েন লাইফ ফর্ম-এর খোঁজে।”

“কিন্তু, তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে পাথরে লেখা পাওয়া গেছে?” এক মগ ধুমায়িত কফি হাতে নিয়ে সোফাতে আরাম করে বসল রবার্ট।

ফিওনা রবার্টের হাত থেকে আরেকটি কফির মগ নিয়ে রবার্টের মুখোমুখি বসে উত্তর দিতে লাগল, “টিএনএন-এ পাথরটার একটি ছবি দেখিয়েছে। ওটাতে বিচিত্র কিছু দাগ আছে। তারা বলেছে এগুলো পৃথিবীর পরিচিত কোন ভাষার বর্ণমালার মত না।”

“হতে পারে দাগগুলো জাস্ট ঘষায় ঘষায় তৈরী হয়েছে। এটা যে বর্ণমালাই হবে এটা তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে?”

“আরে, আমি কি নিশ্চিত হয়েছি নাকি। ওরা যা বলেছি আমি তোমাকে তাই বললাম।”

কফির কাপে একবার চুমুক দিয়ে নড়েচড়ে আরাম করে বসে নিলো রবার্ট। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোন আলোচনা শুরু করবে। বলল-

“আচ্ছা ঠিকাছে, ধরে নিলাম ওরা যা বলছে তা ঠিক। কিন্তু, চলো আমরা একটু ভেবে দেখি দাগ গুলো কি অর্থপূর্ণ কোন বর্ণমালা হওয়া সম্ভব কিনা।” ফিওনার এই সব গুরুতর আলোচনা মজা লাগে না। কিন্ত, আজকের ঘটনাটা একটু বেশী ইন্টারেস্টিং হওয়ায় সে রাজী হল।

“ঠিকাছে।”

“চিন্তা করে দেখ, আমরা যখন কোন কিছু লেখি তখন আমাদের বর্ণগুলো কি ধরনের ধারায় সাজানো থাকে? এগুলো একেবারে এলোমেলো বা র‍্যানডম হয় না আবার এগুলো যে একেবারে পর্যাবৃত্ত বা পিরিয়ডিক তাও না।”

ফিওনা একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা, পর্যাবৃত্ত বলতে কি বুঝাচ্ছো।”

রবার্ট কফির কাপটা সামনের টি-টেবল-এ রেখে পাশের ঘরের টেবিল একটা খাতা এবং পেনসিল নিয়ে আসল। এরপর সে খাতার মধ্যে তিনটা বাক্য লিখল-

কখ গজ সহ হজ রত রততসফ (১)

খগ খঘ খগ খগ খঘ খগ খঘ (২)

আমি তোমাকে ভালোবাসি (৩)

লেখা শেষ হলে খাতাটা দেখিয়ে ফিওনাকে রবার্ট বলতে লাগলো-

“দেখো ১ নং লেখাটা পুরোপুরি এলোমেলো। যার কোন অর্থ নেই। এটি হল অক্ষরের র‍্যানডম বিন্যাস। ২নং লেখাটাই হলো পর্যাবৃত্ত লেখা। অর্থাৎ ‘খগ খঘ’ অক্ষর চারটি বার বার ফিরে আসছে বা রিপিট হচ্ছে। আর, ৩নং লেখাটা একটি অর্থ বহন করছে।”

৩নং লেখাটা পড়ে ফিওনার মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। তবে সে আলোচনায় থাকার জন্য ভেবে বলল- “আচ্ছা ৩নং বাক্যটিকেও তো কার্যতো এলোমেলো বলা যায়, তাই না। আসলে আমরা এটাকে একটি অর্থ দিচ্ছি বা এভাবেই অর্থ দেয়া শিখে এসেছি এ কারণে আমাদের কাছে ৩নং বাক্যটি অর্থপূর্ণ লাগছে।”

রবার্ট ফিওনার ধীশক্তি দেখে খুশি হল এবং বলল- “তুমি ঠিক ধরেছো। আচ্ছা চলো আমি তোমাকে আরেক ভাবে লিখে দেখাই।”

১৩৫৪৩২১২৩৭৯ (৪)

১২৩১২৩১২৩১২৩ (৫)

০১১২৩৫৮১৩২১ (৬)

“দেখোতো এই তিনটার মধ্যে কি পার্থক্য আছে?” ফিওনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল রবার্ট।

ফিওনা কিছুক্ষন অংকগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলো- “এখানে ৪নং বাক্যে জাস্ট কতগুলো র‍্যানডম সংখ্যা আছে। ৫নং বাক্যে ‘১২৩’ পর্যাবৃত্তভাবে আছে। তবে ৬নং বাক্যটাও কেমন জানি র‍্যানডম মনে হচ্ছে।”

“তুমি নিশ্চিত যে ৬নং বাক্যটা র‍্যানডম?”

“আমি ঠিক নিশ্চিত না। তবে ধরতে পারছি না।”

“আচ্ছা আমি বলছি দাড়াও। ৪ ও ৫নং বাক্যের ব্যাপারে তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু, ৬নং বাক্যে দেখ ১ এর পরে আছে ২, তারপর ১+২ = ৩, তারপর ৩+৫=৮, ৫+৮=১৩, এবং ৮+১৩= ২১। এটাকে বলে ফিবোনাচ্চি সিরিজ। এই সিরিজের একটি বৈশিষ্ট্য হল পরের সংখ্যাটি দিয়ে পূর্বের সংখ্যাটি ভাগ করলে একটি নির্দিষ্ট রেসিও পাওয়া যায় যার মান হচ্ছে ১.৬১৮০.. । এই রেসিওকে বলে গোল্ডেন রেসিও।”

“মজারতো।” ফিওনা খুব আগ্রহ ভরে শুনতে লাগল।

“সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কোন লেখাতে কোন বর্ণের বিন্যাস তিন রকম হতে পারে- র‍্যানডম, পিরিওডিক এবং ‘প্যাটার্ন’-যুক্ত লেখা। এর মধ্যে র‍্যানডম ও পিরিওডিক লেখা সহজে পার্থক্য করা যায়। কিন্তু, র‍্যানডম ও প্যাটার্নযুক্ত লেখা পার্থক্য করার উপায় হল উক্ত প্যাটার্ন বা ঢং- সম্পর্কে আগে থেকে পরিচিতি থাকা। অর্থাৎ, ৬নং লেখায় অতিরিক্ত এক ধরনের তথ্য আছে যাকে বলা যায় প্যাটার্নের তথ্য।”

ফিওনার চেহারা দেখে মনে হল ও একটু এলোমেলো হয়ে গেছে। তবু কিছুক্ষন ভেবে বিষয়টা বুঝতে পারল। এরপর রবার্টের হাত থেকে কলমটা নিয়ে আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে লিখতে আরম্ভ করল-

///\\[[/[][ (৭)

///\\\///\\\///\\\ (৮)

/\\/\//\//\//\//\\/\/ (৯)

বেশ কিছুক্ষণ পর লেখা শেষ করে রবার্টকে বাক্যগুলো দেখিয়ে বলল- “আসলে এতক্ষণতো আমরা আমাদের পরিচিত বর্ণমালা নিয়ে কথা বলছিলাম। এজন্য বিষয়টি খুব পরিচিত বা সহজ মনে হচ্ছিল। ধরো, আমরা এরকম একটি ভিন দেশী বর্ণমালার কথা চিন্তা করছি। তাহলে হয়ত বিষয়টির খুঁটিনাটি বোঝা যাবে।”

রবার্ট ফিওনার বুদ্ধি দেখে স্তম্ভিত হয়ে মনে মনে ভাবল- আসলেই তো তাই। ফিওনার দিকে খুশি মনে তাকিয়ে বলল- “দেখো ৮নং লেখাতে রেখাগুলোর বিন্যাস স্পষ্টতই পর্যাবৃত্ত। কিন্তু, ৭নং এবং ৯নং লেখায় রেখাগুলোর বিন্যাস এলোমেলো। কিন্তু, ৯ নং লেখার দিকে গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে এক ধরনের প্যাটার্ন লক্ষণ করা যায়। তুমি আসলেই কি ৯নং লেখায় কোন প্যাটার্ন দিয়েছো?”

ফিওনা কফির কাপে শেষু চুমুকটা দিয়ে বলল- “তুমি চেষ্টা করে দেখো না বের করতে পারো কিনা?”

রবার্ট বলল “আচ্ছা, আমি ভেবে দেখছি সময় দাও।” রবার্টকে ভাবার সময় দিয়ে ফিওনা শূণ্য কফির মগদুটো নিয়ে রান্না ঘরে ধুয়ে রেখে আসতে গেলো। কফির কাপ ধোয়া শেষে রাতের খাবার গরম করার ব্যবস্থা করে ফিরে এসে দেখে রবার্ট এখনও ভাবছে।

“কি, এখনও বের করতে পারো নি?”

“ওয়েইট, মনে হয় বুঝতে পেরেছি। ‘/’ কে ‘১’ এবং ‘\’ কে ‘০’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে ৯নং বাক্যটি হয়-

১০০১০১১০১১০১১০১১০০১০১

একে ডেসিমেলে রূপান্তর করলে হয়- ১২৩৫৮১৩। অর্থাৎ, ফিবোনাচ্চি নাম্বার, শুধুমাত্র সামনের ০ ও ১ বাদ দিয়ে। বেশ কঠিন একটি কাজ করে ফেলেছো তো।”

রবার্টের কথা শুনে ফিওনা দুই কাধ নাড়িয়ে বলল-“ফিওনার জন্য এগুলো পানি-ভাত।”

“হা হা হা।” রবার্ট ফিওনার ভাব দেখে জোড়ে হেসে উঠল। বলল- ” আচ্ছা। এখন ভেবে দেখো এই তিন ধরনের লেখাই কিন্তু কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার দ্বারা লেখা সম্ভব। কিন্তু, প্রাকৃতিক নিয়ম বা ফোর্সগুলোর মাধ্যমে শুধুমাত্র অক্ষরের র‍্যানডম ও পর্যাবৃত্ত বিন্যাসগুলো সম্ভব। এমনকি পর্যাবৃত্ত গঠন এমনও হতে পারে যা আপাত দৃষ্টিতে জটিল। কিন্তু, যা আসলে একটু উচু মাত্রার সুশৃংখল ও পর্যায়ক্রমিক বিন্যাস। তবে রেখার বিন্যাসে কোন সুনির্দিষ্ট অর্থবহ প্যাটার্ন কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বা ছাড়া তৈরী হওয়া সম্ভব না।”

ব্যাপারটা ধরতে পেরে ফিওনা বলল- “তার মানে টেক্সাসের পাথরটাতে যে রেখা পাওয়া গেছে, তাতে যদি সুনির্দিস্ট প্যাটার্ন পাওয়া তখনই ধারণা করা যাবে যে উক্তর রেখাগুলো আসলে কোন উন্নত জীবের বর্ণমালা, ঠিক?”

“হ্যা। একদম ঠিক। ইন ফ্যাক্ট, SETI-র কাজও তাই। ওরা ধরে নেয় যে যদি কোন উন্নত জীব আমাদের পৃথিবীতে সিগন্যাল পাঠায় তারা অন্তত আমাদের মত বুদ্ধিমান হবে। সুতরাং, তারা চেষ্টা করবে কোন অর্থবহ সিগন্যাল পাঠানোর জন্য। এক্ষেত্রে ‘গনিত’ হচ্ছে সবচেয়ে সহজ উপায়। কারণ, ‘গনিত’ এক বিমূর্ত তথা অ্যাবস্ট্রাক্ট জগতের ভাষা। সুতরাং, উক্ত ভিন্নভাষী এলিয়েনরা নিশ্চয় কোন মৌলিক সংখ্যা বা ফিবোনাচ্চি নাম্বারের সিরিজ পাঠাবে। আবার, এক্ষেত্রে সহজ উপায় হচ্ছে সংখ্যাগুলোকে তুমি যেভাবে বাইনারীতে রূপান্তর করেছো সেভাবে বাইনারীতে পরিণত করে পাঠানো। কারণ এক্ষেত্রে জাস্ট দুই ধরনের সিগন্যাল সুনির্দিষ্ট বিরতিতে পাঠালেই হবে। বুঝলে?”

ফিওনা স্থিত হয়ে বলল “হ্যা বুঝতে পারলাম বিষয়টা। তার মানে হচ্ছে, আমরা কোন স্থানে বা গঠনে যদি কোন রেখা বা বস্তুর র‍্যানডম বা পর্যায়বৃ্ত্ত বিন্যাস না দেখে পরিচিত প্যার্টার্ন-যুক্ত বিন্যাস সন্দেহ করি। তাহলে ধরে নেয়া যায় যে-এর পিছনে কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার উপস্থিতি আছে। এবং উক্ত বুদ্ধিমান সত্ত্বা কমপক্ষে মানুষের মত উন্নত বুদ্ধি ধারণ করে।”

“তুমি খুব সুন্দর ভাবে আমাদের আলোচনার সারসংক্ষেপ করেছো।”-রবার্ট খাতাট টি-টেবল-এর রাখল আর বলল- “চল, এবার রাতের খাবারটা খেয়ে নি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”

ফিওনা রবার্টের সাথে সম্মত হয়ে আলোচনার ইতি টানলো এবং টেবিলে খাবার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে গেলো।

এক মাস পর..

“ব্রেকিং নিউজ! টিনএনএন-এর রাত ৮-টার সংবাদে আমি মিরা বলছি। গত এক মাস আগে যেই পাথরটা টেক্সাসের আকাশ থেকে জমিতে পড়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল সেই পাথরটার গায়ে অংকিত রেখাগুলোর অর্থ উদ্ধার করা গেছে বলে দাবী করেছেন গবেষকরা। যদিও তার এই মূহুর্তে এতে কি লেখা আছে বলতে চাচ্ছে না। আমরা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি যে এখানে রেখাগুলোতে কতগুলো সংখ্যা লেখা আছে, যা আমাদের পরিচিত ফিবোনাচ্চি নাম্বারের মত।…”

সংবাদটা শোনার পর থেকে ফিওনার গা শিউরে উঠেছে। গায়ের সমস্ত লোম দাড়িয়ে গেছে। তাহলে কি পৃথিবীর বাইরে কোন বুদ্ধিমান প্রাণী আছে যারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে? যদি থাকে তারা কেমন? তারা কি মানুষের মত যুদ্ধপ্রবণ। তারা কি পৃথিবী আক্রমণ করতে আসছে? ফিওনার মনে নানা কল্পনা খেলা করছে। আর ভয় এবং কৌতুহলের এক মিশ্র অনুভূতি ঘিরে রেখেছে তাকে।

পৃথিবী এগিয়ে চলছে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে….

উপলব্ধি

এক.

প্রচণ্ড মন খারাপ লাগছে শৈবালের। মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। মেডিকেল থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই ওর বাবা মারা যায়। ফলে স্কুল পড়ুয়া ছোট দুই বোন এবং মা-সহ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ওর ওপর। একটা পার্টটাইম জব করে এবং দুটো টিউশনি করে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া এবং সংসারের খরচ বহন করার চেষ্টা করে। তারপরও মাস শেষে হাতে টাকা থাকে না অনেক সময়। তাই মাঝে ইচ্ছে না থাকলেও ঋণ নিতে হয়ে।

এ জমানায় কেউ টাকা ধার দিতে চায় না। আর ধার দিবেই বা কি করে? ও যাদেরকে চেনে তাদের সবারই খুব হিসেব করে চলতে হয়। তবে যারা বেহিসেবী খরচ করে তারা ধার দেয় সুদে।

গতকাল রাতে একজন পাওনাদারের সাথে কথা ফোনে কাটাকাটি হয়েছে শৈবালের। লোকটা টাকা ফেরৎ দেয়ার সময় হবার আগেই টাকা চেয়ে বসেছে। এদিকে মাসের শেষ সময় চলছে। ও কোথা থেকে টাকা দেবে? এইসব ভেবে রাতের ঘুমটা ভাল হয়নি। তাই সকাল থেকেই মেজাজটা খিটখিটে হয়ে আছে শৈবালের। কেমন যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। পৃথিবীর সবকিছুকেই অসহ্য মনে হচ্ছে ওর। প্রতিদিনের রূটিন মত আজকেও সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছে । কিন্তু, ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে নাস্তা রেডী হয়নি। মা’র সাথে রাগ করে বাসা থেকে না খেয়েই বের হয়ে যায়।

‘ওই খালি, যাবা?’

‘কই মামা?’

‘ঢাকা মেডিকেল।’

‘যামু।’

‘ভাড়া কত?’

‘পঞ্চাশ টাকা?’

‘পঞ্চাশ টাকা মানে? মগের মুলুক পাইছো? আজিমপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল পঞ্চাশ টাকা?’

‘মামা, যে জ্যাম দেখছেন? পঞ্চাশ টাকা না গেলে পুশাইবো না।’

শৈবালের মেজাজ আরও গরম হয়ে যায়। ও রিকশায় না উঠে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটার সময় এলোমেলো ভাবনা আসতে থাকে মনে। ভাবে- কেন এত গরীব হলাম? বাবার এ সময়েই মৃত্যু হল কেন? আল্লাহ কেন আমাদের এত কষ্ট দিলেন? ওর সম্পদশালী বন্ধুদের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে পলাশীর দিকে আসার সময় ওর চোখের সামনে হঠাৎ একটা মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সিডেন্ট করে। মোটর সাইকেলটা সামনের একটি রিকশায় জোড়ে ধাক্কা দেয়। ফলে রিকশাটা উল্টে যায়। রিকশাচালক এবং যাত্রীরা দূরে ছিটকে পড়ে। মোটর সাইকেল আরহী প্রচণ্ড বেগে সামনে গিয়ে আছড়ে পড়ে। সাথে সাথে তাদের সাহায্য করার জন্য মানুষজন জটলা পাঁকাতে শুরু করে । শৈবাল দ্রুত কাছে দৌড়ে যায়।

রিকশাচালক এবং যাত্রী অপেক্ষাকৃত কম আঘাত পেয়েছে। তারা উঠে দাড়িয়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। ঐদিকে মোটর সাইকেল আরোহীর নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। শৈবাল সাথে সাথেই পালসটা চেক করার জন্য সামনে আগায়। দেখে পালস এখনও চলমান। সে আরেকজন ব্যক্তির সহায়তায় লোকটাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়।

মেডিকেলে ভর্তি করার পর লোকটার আত্মীয়সজনের নাম্বার যোগার করে তাদের খবর পাঠানো হয়। তারা হাসপাতালে আসলে শৈবাল ওর ওয়ার্ডে ক্লাস করার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। শৈবালের যে ওয়ার্ডে ক্লাস আছে সেখানে যাবার পথে পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যেতে হয়। ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওর চোখে পড়ে একজন মা পরম যত্নে তার শিশুকে আগলে রেখেছে। শিশুটির খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। তাকে অক্সিজেন দেয়া আছে এবং বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। শিশুটিকে মা তার কোলে নিয়ে বুকের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসিয়ে রেখেছে। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে রাজ্যের ঘুম এসে যাচ্ছে তার চোখে। কিন্তু বাচ্চাকে খেয়াল রাখতে গিয়ে সে ঘুমাতে পারছে না।

হঠাৎ করে ওর মা’র কথা মনে পড়ে। আজকে সকালে রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলো ও। অনুশোচনায় চোখে পানি চলে আসে ওর। ভাবতে থাকে আজকের দূর্ঘটনার শিকাড় ওই হতে পারতো। কিন্তু, আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ভাবতে ভাবতেই দেখে নিউরোসার্জারী বিভাগে তরুণ একটি ছেলে অসুস্থ হয়ে এলোমেলো বকছে। তাকে ঘিরে ডিউটি ডাক্তাররা রাউণ্ডে আলোচনা করছে। ও শুনতে পেলো ছেলেটার সাবঅ্যারাকনয়েড হিমোরেজ হয়েছে। রোগটা কি শৈবাল জানে। কারও কারও মাথার রক্তনালীতে এক ধরনের অস্বাভাবিক বর্ধিকাংশ থাকতে পারে। যাকে বলা হয় এনিউরিজম। অনেক সময় এগুলো ফেটে ব্রেইনের ভিতরে রক্ত জমা হয়। তরুণ বয়সেও এই রোগ হতে পারে।

শৈবাল উপলব্ধি করে এই রোগটি ওরও হতে পারতো। শুধু তাই না। এই যে অগনিত কঠিন রোগ সম্পর্কে ও পড়ছে এগুলোর যে কোনটি ওর হতে পারতো। শৈবাল বুঝতে পারে যে আসলে সে ভালো আছে। অন্য অনেকের চেয়ে ভালো আছে সে। মনটা ভালো হয়ে যায়। মনের গভীর থেকে প্রশান্ত চিত্তে বলে ওঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’!

দুই,

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আস্তে করে মায়ের রুমে যায় শৈবাল। সালাম দিয়ে ঢোকার অনুমতি নেয়। ছলছল চোখের মায়ের মুখের দিকে তাকায় একবার । চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারে না। মা’র পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিছু বলতে পারে না।

মা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘কেঁদো না বাবা। ধৈর্য্য ধরো। আল্লাহ সব সহজ করে দিবেন।’