এক.
ঢাকা মেডিক্যালের প্রথম বর্ষের ছাত্র রাকিব। সে এইচএসসি’তে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় এবং মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পায়। রাকিবের বিজ্ঞানের প্রতি রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। তাই সে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও নতুন নতুন ক্ষেত্র সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। জ্যোতির্বিদ্যা ও জীববিজ্ঞানে তার আলাদা দুর্বলতা আছে। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সে তার চারপাশের পরিবেশ ও মানুষ নিয়ে চিন্তা করে। মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা তাকে ভাবায়।
তৌফিক রাকিবের খুব ভালো বন্ধু। সেও রাকিবের মতো নটরডেম কলেজ থেকে সর্বোচ্চ স্কোর নিয়ে উত্তীর্ণ হয়। এখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগের ছাত্র। এরা দু’জনে সে সকল ছাত্রদের মতো নয়, যারা শুধু মাত্র সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য পড়ে। বরং তারা প্রতিটি বিষয় নিয়ে যুক্তি-ভিত্তিক চিন্তা করতে ভালোবাসে। তৌফিক আর রাকিবের মাঝে প্রায়ই বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথোপকথন হয়। গত দিনের মতো আজকেও তারা ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসিতে এসেছে। পাশের ক্যাফেটেরিয়া থেকে দু’জনে দু’কাপ কফি নিয়ে কাছের বেঞ্চটার নিকটে গেল।
“রাকিব একটা বিষয় ইদানীং আমাকে খুব চিন্তিত করে রেখেছে। কয়েকদিন ধরেই ব্যাপারটা বলব বলে ভাবছি। বলি বলি করে আর বলা হয়ে ওঠেনি।” রাকিব ফুঁ দিয়ে বসার জায়গাটা পরিষ্কার করতে করতে বলল, “কোন্ বিষয়টা, দ্রুত বলে ফেল।”
“বিষয়টা হলো মানুষের আদি উৎস। তোর কী মনে হয়? মানুষের আদি উৎস কী? বিজ্ঞানের বইগুলোতে মানুষের আদি উৎসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার The Origin of Species বইয়ে প্রাণী জগতের উদ্ভব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের অবতারণা করেন। বিবর্তনবাদ মতে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে বানর জাতীয় মানুষ (Australopithecines) থেকে পর্যায়ক্রমে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে। আবার ধর্মতত্ত্বানুসারে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই গঠন ও আকৃতি দিয়ে, যে গঠন ও আকৃতি এখন দেখা যায়।” তৌফিক কফির কাপে চুমুক দিল। রাকিব বলল, “তাহলে প্রশ্নের অবতারণা হয় যে আমরা কোন্ তত্ত্বটিকে মেনে নেব। যদি বিবর্তনবাদ তত্ত্ব মেনে নিই তাহলে এটা মেনে নিতে হয় যে, মানুষ ও অন্যান্য জীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্রমান্বয়ে উদ্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে ধর্ম প্রস্তাবিত কথাগুলোকে অস্বীকার করা ছাড়া উপায় থাকে না। আবার যদি এটা মেনে নিই যে মানুষকে তার বর্তমান আকৃতিতেই সৃষ্টি করা হয়েছে তাহলে বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করতে হয়। ঠিক এ প্রশ্নটাই আমার মাথায়ও এসেছিল। তাই আমি এ বিষয়ে কিছুটা পড়েছিও।” রাকিবকে একই বিষয়ে ভাবতে দেখে তৌফিক মনে মনে খুশি হল। সে প্রশ্ন করল, “কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব কিভাবে সত্য হয়? বানর থেকে মানুষ আসার বিষয়টি সাধারণ জ্ঞানেই তো বোধগম্য হয় না!”
Finch পাখির ঠোঁট: ডারউইন এগুলোকে গালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে দেখেছিলেন এবং তার তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরেছিলেন। আসলে, পাখির ঠোঁটের এ বিভিন্নতার কারণ হলো Genetic Variation, কোন Macro-evolution নয়।
“ব্যাপারটা স্পষ্ট। বিবর্তন তত্ত্বটি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন কর্তৃক প্রস্তাবিত একটা ধারণা বা মতবাদ। কিন্তু এই মতবাদটি ডারউইনের বইয়ে যখন প্রথম অবতারণা করা হয় এরপর থেকে গত ১৫০ বছর যাবৎ তত্ত্বটিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ধারণাটি এখনও হাইপোথিসিস হিসেবেই রয়ে গেছে। বরং অনুসন্ধানের ফলে এর বিপরীতে যত প্রমাণ বের হয়ে এসেছে তা এর পক্ষে উপস্থাপিত প্রমাণের চেয়ে অনেক বেশি। এরপরও পশ্চিমা বিজ্ঞানজগতের বিভিন্ন প্রকাশনা, ডকুমেন্টারি দেখলে মনে হয় বিবর্তনকে একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। এমনকি সমগ্র বিশ্বেই এটিকে স্কুল কলেজগুলোর পাঠ্যক্রমে একটি প্রমাণিত সত্য হিসেবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। যদিও আমাদের দেশে সৌভাগ্যক্রমে সে পরিমাণটা খুবই সামান্য!”
“তাহলে বিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে বিবর্তন মতবাদটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে প্রতিটি জীবকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি জীব যদি সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে বিজ্ঞান জগতে স্রষ্টায় অবিশ্বাসীর সংখ্যা এত বেশি কেন?” তৌফিক প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকালো।
“বিবর্তনবাদ মতবাদটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলেও বস্তুবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রভাবিত সমাজব্যবস্থায় এখনও এ মতবাদটিকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত রাখার ফলে উক্ত সমাজে গড়ে ওঠা বিজ্ঞানীরা নাস্তিক হয়ে বড় হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে বিবর্তনবাদ নিজেই একটি বিশ্বাসের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এর সাথে বিজ্ঞানের ন্যূনতম সম্পর্কও নেই।” রাকিব কফিটা শেষ করতে করতে উত্তর করল।
তৌফিক হঠাৎ করে পাশের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে তুই বলছিস এখানে বিশ্বাস বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে, বিজ্ঞান দ্বারা জ্ঞান পরিমার্জিত হয়নি? বিজ্ঞানের ওপর অন্ধবিশ্বাসের জয় হয়েছে?” রাকিব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। সে তার হাতের কফির কাপটাকে মোচড়াতে মোচড়াতে বলল, “তবে সাধারণে এটা প্রচলিত যে, ধর্ম শুধুমাত্র বিশ্বাসের ব্যাপার আর বিজ্ঞান হলো পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা লব্ধ জ্ঞান। সুতরাং এখানে বিশ্বাসের কোন প্রশ্নই আসে না। এ ধারণাটাকে পুঁজি করে যদি বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে উপস্থাপন করা যায় তাহলেই বস্তুবাদীদের কার্যোদ্ধার হয়। আর সে কাজটাই করেছে প্রচারমাধ্যম। ফলে দেখা যায়, জীববিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মানব ইতিহাস এমনকি অর্থনীতি রাজনীতিও বিবর্তনবাদ দ্বারা প্রভাবিত এবং এ সংক্রান্ত রচনা ও প্রবন্ধের বইগুলোতে বিবর্তনবাদকে প্রমাণিত সত্য ধরে নিয়ে লিখা হয়।”
তৌফিক কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “বিবর্তনবাদ না হয় জীববিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিতে বিবর্তনবাদের প্রভাবের ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারছি না!”
“কেন তুই কী আমাদের মাধ্যমিক সমাজবিজ্ঞান বইয়ে পড়িসনি- প্রস্তরযুগ, ব্রোঞ্জযুগ, লৌহযুগের কথা? মানব ইতিহাসের এ পর্যায়গুলো তো বিবর্তনবাদী চিন্তাধারারই ফসল। এ সম্বন্ধে জানার জন্য আমাদের বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কী বলে? কীভাবে এটি প্রমাণ উপস্থাপন করে? কীভাবে বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আলোকে এটি ভুল প্রমাণিত হয়? বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের আদি উৎস সম্পর্কে কী বলে?”
রাকিব আর তৌফিক দু’জনই বেঞ্চ থেকে উঠে দোয়েল চত্বরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। রাকিব বলতে থাকে, “আমার পরিচিত এক বড় ভাই আছে। তার নাম রাজীব। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তার এ ব্যাপারে ভালো পড়াশোনা করা আছে। মাঝে মধ্যেই তার সাথে আমার আলাপ হয়। চল আমরা একদিন তার কাছে যাই।”
“দোস্ত আগামীকালই যাওয়া যায় কি-না দেখ। ব্যাপারটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।”
“ঠিক আছে আমি আজ ফোন করে রাজীব ভাইয়ের কাছে থেকে সময় চেয়ে নেব।”
ফোনের কথা বলতে না বলতেই তৌফিকের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। তৌফিক ফোনে কথা শেষ করে বলল, “রাকিব বাসা থেকে ফোন এসেছে। জরুরি কাজ আছে বাসায় ফিরতে হবে। আজ আসি।”
রাকিব আর তৌফিক সালাম বিনিময় করে বিদায় নিল। তৌফিক একটা রিকশা করে সেগুনবাগিচার দিকে গেল আর রাকিব শাহবাগের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
দুই.
“আগামীকাল বিকেলে রাজীব ভাই সময় দিয়েছেন। তুই প্রস্তুতি নিয়ে আসিস,” তৌফিককে ফোনে জানাল রাকিব। বিবর্তনবাদ যদি প্রমাণিত না-ই হয় তাহলে বৈজ্ঞানিক সমাজ কেন এটাকে গ্রহণ করে আছে? বিবর্তনবাদ সমাজবিজ্ঞানে কীভাবে প্রভাব রাখল? প্রস্তরযুগ, লৌহযুগ, ব্রোঞ্জযুগের সত্যতাটা কী? কীভাবে বিবর্তনবাদ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মতবাদগুলোকেও প্রভাবিত করল? এরকম নানা প্রশ্ন তৌফিকের মনে তৈরি হতে থাকে। পরদিন বিকেলে রাকিব তৌফিককে নিয়ে বকশিবাজার ডা. ফজলে রাব্বি হলে আসে। হলের গেটে রাজীব ভাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। গেটে সালাম বিনিময়ের পর রাজীব ভাই ওদের নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। রাকিব এর আগেও এখানে এসেছিল। তার কাছে কোন কিছু নতুন নয়। অন্য দিকে তৌফিক হোস্টেলটির সাথে নিজের হোস্টেলের পার্থক্য আর মিলগুলো খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। রাজিব ভাই যে রুমে থাকে সেটি গেট দিয়ে ঢুকতে দুই নম্বর বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায়। রুম নং বি-৪। রাজীব ভাই জানালেন এ বিল্ডিংকে ব্লক বলে। কথোপকথনের শুরুতে রাজীব ভাই তৌফিকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জেনে নিলেন। এরপর তিনি তার শেল্ফ থেকে কয়েকটি বই বের করলেন।
“বিবর্তনবাদকে বুঝতে হলে আমাদের জানা দরকার- বিজ্ঞানী ডারউইনের বই Origion of Species-এ বিবর্তন সম্পর্কে যে ধারণাটি পেশ করা হয়েছে তা কী? সেটি হল, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তি বা অস্তিত্বের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যোগ্যতমের উর্দ্ধতন। তার তত্ত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো হলো-
১. দৈবাৎ স্বয়ংক্রিয় ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবের উৎপত্তি।
২. প্রাকৃতিক নির্বাচন।
৩. বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম।
আরেকটু বিস্তারিত বললে- প্রথমত, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব অনুসারে জীবন্ত বস্তু অস্তিত্বে এসেছে দৈবাৎ কাকতালীয়ভাবে এবং পরবর্তীতে উন্নত হয়েছে আরও কিছু কাকতালীয় ঘটনার প্রভাবে। প্রায় ৩৮ বিলিয়ন বছর আগে, যখন পৃথিবীতে কোন জীবন্ত বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না, তখন প্রথম সরল এককোষী জীবের (আদিকোষ) উদ্ভব হয়। সময়ের পরিক্রমায় আরও জটিল এককোষী এবং বহুকোষী জীব অস্তিত্বে আসে। অন্য কথায় ডারউইনের তত্ত্বানুসারে প্রাকৃতিক শক্তি সরল প্রাণহীন উপাদানকে অত্যন্ত জটিল এবং খুঁতহীন পরিকল্পনাতে পরিণত করেছে! [১]
দ্বিতীয়ত, ডারউইনবাদের মূলে ছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা।… প্রাকৃতিক নির্বাচন এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য একটি সার্বক্ষণিক সংগ্রাম বিদ্যমান। এটা সে সকল জীবকে অগ্রাধিকার দেয় যাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সবচেয়ে শক্তিশালী, ফলে প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে সবচেয়ে বেশি খাপ খাওয়ানো প্রজাতিটি বেঁচে থাকে। যে সকল হরিণ সবচেয়ে বেশি দ্রুতগামী তারাই শিকারী পশুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। অবশেষে হরিণের পালটিতে শুধু দ্রুতগামী হরিণগুলোই টিকে থাকবে।
(কিন্তু লক্ষ্য রাখবে, যত সময় ধরেই উক্ত প্রক্রিয়াটি চলুক না কেন এটা সেই হরিণগুলোকে অন্য প্রজাতিতে পরিণত করবে না। দুর্বল দূরীভূত হবে, শক্তিশালী জয়ী হবে কিন্তু জেনেটিক ডাটাতে কোন পরিবর্তন সূচিত না হওয়ায় প্রজাতিতে কোন পরিবর্তন আসবে না।)
হরিণের উদাহরণটি সকল প্রজাতির জন্যই সত্য। প্রাকৃতিক নির্বাচন শুধুমাত্র যারা দুর্বল অথবা যারা প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না, তাদেরকে দূরীভূত করে। এটা নতুন কোন প্রজাতি, কোন জেনেটিক তথ্য কিংবা কোন অঙ্গ তৈরি করে না। অর্থাৎ এটা কোন কিছুকে বিবর্তিত করতে সাহায্য করে না। ডারউইনও এই সত্যটাকে স্বীকার করেছিলেন এই বলে যে, “প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না যদি অগ্রাধিকার যোগ্য স্বাতন্ত্র পার্থক্য ও বৈচিত্র্য না ঘটে।” [২]
তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের প্রয়োজনীয় ধারণা অনুযায়ী প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য একটি ভয়ানক সংগ্রাম চলছে এবং প্রতিটি জীব শুধু নিজেকে নিয়েই চিন্তা করে। ডারউইন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাসের মত (idea) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ম্যালথাস মনে করতেন যে, মানবজাতিতে সন্দেহাতীতভাবে একটি সার্বক্ষণিক সংগ্রাম চলছে। তার চিন্তাভাবনার ভিত্তি ছিল এই যে, জনসংখ্যা এবং সেই সাথে খাদ্যের প্রয়োজন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, অন্যদিকে খাদ্যর ভাণ্ডার বাড়ছে গাণিতিক হারে। এর ফলে জনসংখ্যার আকৃতি অপরিহার্যভাবে প্রাকৃতিক নিয়ামক, যেমন ক্ষুধা ও রোগ, দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ডারউইন মানবজাতিতে ‘বাঁচার জন্য প্রচণ্ড সংগ্রাম’ সংক্রান্ত ম্যালথাসের দৃষ্টিভঙ্গিকে বড় আকারে একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করেন এবং বলেন যে, ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এ লড়াইয়ের ফল।
যদিও পরবর্তীতে অনুসন্ধানে প্রকাশিত হয় যে, প্রকৃতিতে জীবনের জন্য সেরকম কোন লড়াই সংঘটিত হচ্ছে না যেরূপ ডারউইন স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিয়েছিলেন। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ সালে একজন ব্রিটিশ প্রাণিবিজ্ঞানী ভি.সি. উইনে অ্যাডওয়ার্ডস এ উপসংহার টানেন যে, জীবজগৎ একটি কৌতুহলোদ্দীপক পন্থায় তাদের জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করে। “…. প্রাণীরা তাদের সংখ্যা কোন প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নয় বরং প্রজনন কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে করে।” [৩]
রাজীব ভাই এ পর্যন্ত বলার পর তৌফিক প্রশ্ন করল, “বিবর্তনবাদ ধারণাটিকে বিজ্ঞানী চালর্স ডারউইনই কি প্রথম উপস্থাপন করেন?”
রাজীব ভাই তার ডায়েরিটা খুলে নোট করা কিছু লেখা তৌফিক ও রাকিবকে দেখালেন। তিনি বললেন, “প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব নতুন কিছু নয়। বরং বহু প্রাচীন কালেই এ তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছিল।” এবার তিনি তার কিছু নোট করা লেখা পড়তে পড়তে বললেন, তুর্কী দার্শনিক হারুন ইয়াহিয়া লিখেন-
“(বিবর্তনবাদের) ধারণাটি প্রাচীন গ্রিসের কতিপয় নাস্তিক বহুশ্বেরবাদী দার্শনিক প্রথম প্রস্তাব করেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে সময়ের বিজ্ঞানীরা এমন একজন স্রষ্টায় বিশ্বাস করত, যিনি সমগ্র মহাবিশ্বের স্রষ্টা, ফলে এ সকল দার্শনিকদের ধারণা টিকতে পারেনি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর বস্তুবাদী চিন্তাধারার অগ্রগতির সাথে সাথে বিবর্তনবাদী চিন্তা পুনর্জীবন লাভ করে। [৪]
গ্রিক মাইলেশিয়ান দার্শনিকরা, যাদের কিনা পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা কিংবা জীববিদ্যার কোন জ্ঞানই ছিল না, তারাই ডারউনইবাদী চিন্তাধারার উৎস। থেলিস, অ্যানাক্সিম্যানডার, এমপোডোক্লেসদের মতো দার্শনিকদের একটি মত ছিল জীবন্ত বস্তু প্রাণহীন বস্তু থেকে তথা বাতাস, আগুন এবং পানি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এ তত্ত্ব মতে প্রথম জীবন্ত জিনিসটিও পানি থেকে হঠাৎ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয় এবং পরে কিছু জীব পানি থেকে মাটিতে উঠে এসে বাস করতে শুরু করে। [৫]
মাইলেশিয়ান গ্রিক দার্শনিক থেলিস (Thales) প্রথম স্বয়ং উৎপত্তিসংক্রান্ত ধারণার মত প্রকাশ করেন। অ্যাক্সিম্যানডার তার সময়কালের ঐতিহ্যগত ধারণা যে, জীবন কিছু সূর্যরশ্মির সাহায্যে ‘Pre-biotic Soap’ থেকে উৎপন্ন হয়, তা উপস্থাপন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রথম প্রাণীটির উদ্ভব হয়েছে সূর্যরশ্মির দ্বারা বাষ্পীভূত সামুদ্রিক আঠালো কাদা মাটি (Seaslime) থেকে।
বস্তুপূজারীদের মতো ডারউইনবাদীরা বিশ্বাস করে যে দৈবাৎ পানির মধ্য থেকে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে। এই অবোধগম্য দাবি অনুসারে ছবিতে প্রদর্শিত তথাকথিত ‘Pre-biotic soap’ থেকে কতগুলো জ্ঞানহীন পরমাণু একত্রিত হয় এবং জীবন গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
চার্লস ডারউইনের ধারণাও উক্ত বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ডারউইনের ‘প্রজাতির মধ্যে অস্তিত্বের লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন’ ধারণাটির মূল নিহিত রয়েছে গ্রিক দর্শনে। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের থিসিস অনুযায়ী জীবজগতে সার্বক্ষণিক লড়াই সংঘটিত হচ্ছে। [৬]
আবার, গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস বিবর্তনবাদ তত্ত্বের প্রস্তুতিতে ভূমিকা রাখেন, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যেই বস্তুবাদী চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত তিনি তার ভিত্ রচনা করেন। তার মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছোট ছোট বস্তুকণা দ্বারা গঠিত এবং বস্তুছাড়া অন্য কিছুরই অস্তিত্ব নেই। পরমাণু সবসময়ই বিরাজমান ছিল যা সৃষ্টি ও ধ্বংসহীন। [৭]
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলও ডারউইনবাদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরিস্টটলের মতে জীব প্রজাতিসমূহকে সরল থেকে জটিলের দিকে একটি হাইয়ারার্কিতে সাজানো যায় এবং তাদেরকে মইয়ের মতো একটি সরল রেখায় আনা যায়। তিনি এ তত্ত্বটিকে বলেন- ‘Scala Naturae’। এরিস্টটলের এ ধারণা অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের চিন্তাচেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং পরে তা ‘The Great Chain of Being’- এ বিশ্বাসের উৎসে পরিণত হয়, পরবর্তীতে যেটা বিবর্তনবাদ তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়।
‘The Great Chain of Being’-একটি দার্শনিক ধারণা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এ বিশ্বাস অনুসারে ছোট ছোট জীব ধাপে ধাপে বড় জীবে পরিণত হয়। উক্ত ‘chain’-এ প্রতিটি জীবেরই একটি অবস্থান আছে। এ ধারণা অনুসারে পাথর, ধাতু, পানি এবং বাতাস ক্রমে কোন প্রকার বাঁধা ছাড়াই জীবন্ত বস্তুতে পরিণত হয়, তা থেকে হয় প্রাণী ও প্রাণী থেকে হয় মানবজাতি।
‘The Great Chain of Being’ ধারণাটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে রেনেসাঁ পর্যন্ত বেশ বিখ্যাত ছিল এবং সে যুগের বস্তুবাদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল। ফরাসি বিবর্তনবাদী কোঁতে ডি বুফন (Comte de Bufon) অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্যতম বহুল পরিচিত বিজ্ঞানী ছিলেন। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় যাবৎ তিনি প্যারিসের ‘রয়াল বোটানিক্যাল গার্ডেন’-র পরিচালক ছিলেন। ডারউইন তার তত্ত্বের একটি বড় অংশ বুফনের কাজের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেন। বিজ্ঞানী ডারউইনের (তত্ত্ব উপস্থাপন করতে) যে সকল উপাদান ব্যবহার করা দরকার ছিল তা (কোঁতে ডি বুফনের) ৪৪ খণ্ডের পুস্তক ‘Historie Naturelle’-তে পাওয়া যায়। ডি বুফন এবং লামার্ক দু’জনেরই বিবর্তনসংক্রান্ত তত্ত্বের ভিত্তি ছিল ‘Great Chain of Being’-র ধারণা।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব প্রাচীন গ্রিক উপকথা ‘The Great Chain of Being’-র আধুনিক রূপান্তর ছাড়া কিছুই নয়। ডারউইনের আগেও বিবর্তনবাদী ছিল এবং তাদের তথাকথিত ধারণা ও প্রমাণাদি উক্ত মতবাদে পাওয়া যেত। ডি বুফন ও লামার্ক ‘Great Chain of Being’-কে বিজ্ঞান জগতে একটি নতুন আকারে প্রকাশ করেন যা ডারউইনকে প্রভাবিত করেছিল।
…. লরেন আইসল তার Darwin’s Century-বইতে উল্লেখ করেন, “অষ্টাদশ শতাব্দীর অস্তিত্বের ক্রমবিকাশের ধারণাকে ডারউইন তার বই Origin of Species-এ ব্যবহার করেন এবং এ ধারণাটিও সেখান থেকে উৎপত্তি লাভ করে যে সমগ্র জৈব পদার্থ পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।” [৮] রাজীব ভাই এ পর্যন্ত পড়ে শোনালেন।
রাকিব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখছিলো। আছরের আজান হয়ে গেছে। ওরা বের হয়ে হলের মসজিদের দিকে নামাজ আদায় করার জন্য এগোতে থাকলো। নামাজের পর রাজীব ভাই রাকিব আর তৌফিককে নাশতা করালেন। চা খেতে খেতে তৌফিক বলল, “রাজীব ভাই, আপনি এতক্ষণ যা বললেন তাতে বোঝা যায় যে বিবর্তনবাদী চিন্তাধারা অনেক বছর ধরেই সমাজে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছিল। আর এ ব্যাপারে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিজ্ঞানী লামার্কের বিশেষ অবদান ছিল।”
“তুমি ঠিকই বলেছ, বিবর্তনবাদ তত্ত্বের মূল প্রাচীন গ্রিসে নিহিত হলেও এটিকে বিজ্ঞান জগতের মনোযোগের বিষয় পরিণত করা হয উনবিংশ শতাব্দীতে। ফ্রেঞ্চ জীববিজানী জন ব্যাপটিস্ট লামার্ক তার Zoological Philosophy (১৮০৯) গ্রন্থে বিবর্তনবাদ সম্পর্কিত সবচেয়ে বিস্তারিত দর্শন প্রকাশ করেন। লামার্ক ভেবেছিলেন যে, প্রতিটি জীবের মধ্যেই একটি জীবনী শক্তি (vital force) কাজ করে যেটি তাদেরকে জটিল গঠনের দিকে বিবর্তনের জন্য চালিত করে। তিনি এটাও ভেবেছিলেন যে, জীবেরা তাদের জীবনকালে অর্জিত গুণাবলি তাদের বংশধরে প্রবাহিত করতে পারে। এ ধরণের যুক্তি পেশ করার একটি উদাহরণ হল লামার্কের জিরাফ সম্পর্কিত প্রস্তাবনা। তিনি বলেছিলেন- জিরাফের লম্বা ঘাড় বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে তখন, যখন তাদের পূর্ববর্তী কোন খাটো ঘাড়ের প্রজাতি ঘাসে খাবার খোঁজার পরিবর্তে গাছের পাতা খুঁজতে থাকে। কিন্তু লামার্কের এই বিবর্তনবাদী মডেল বংশানুক্রমিকতার জিনতত্ত্বীয় মডেল দ্বারা বাতিল প্রমাণিত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যবতী সময়ে ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কারের ফলে প্রকাশিত হয় যে, জীবিত বস্তুর কোষের নিউক্লিয়াস বিশেষ ধরণের জৈবিক সঙ্কেত ধারণ করে এবং এ তথ্য অন্য কোন অর্জিত গুণ দ্বারা পরিবর্তনযোগ্য নয়। অন্য কথায় জিরাফের জীবনকালে জিরাফ যদি গাছের উপরের শাখাগুলোর দিকে ঘাড় লম্বা করতে গিয়ে তার ঘাড়কে কিছুটা লম্বা করে ফেলতে সক্ষম হয়ও তবুও তা তার বংশধরে পৌঁছাবে না। সংক্ষেপে লামার্কের তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার দ্বারা বাতিল হয়ে গেছে এবং তা একটি ত্রুটিপূর্ণ ধারণা হিসেবে ইতিহাসে রয়ে গেছে।” [৯]
তৌফিকরা নাশতা শেষ করলে রাজীব ভাই আবার তাদের রুমে নিয়ে গেলেন। তৌফিক বলল, “আপনার কথা থেকে মনে হচ্ছে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কিছু পর্যবেক্ষণের ওপর নির্মিত একটি দর্শন বা মতবাদ, যা কিনা গ্রিক দার্শনিকরা প্রথম প্রস্তাব করেন এবং ক্রমান্বয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের হাতে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের রূপ লাভ করে।”
“কিন্তু, রাজীব ভাই, সকল জীব প্রজাতিকে যদি সরল থেকে ক্রমান্বয়ে জটিলের দিকে সাজানোই যায়, তাহলে এ সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, জীব প্রজাতি ক্রমাগত বিবর্তনের মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছে।” রাকিব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রাজীব ভাইয়ের দিকে তাকালো।
রাজীব ভাই বললেন, “ঠিক! এমনকি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ মতবাদের কট্টর সমর্থক ও প্রচারক Earnst Hackel এ সংক্রান্ত একটি স্কেচও করেন, যা ‘Tree of Life’ নামে অভিহিত। তোমরা হয়তো উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান বইয়ে এটি দেখে থাকবে।
তৌফিক জিজ্ঞাসা করলো, “Tree of Life কী?”
Tree of Life: বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী Earnst Hackel কর্তৃক অঙ্কিত ‘Tree of Life’
রাজীব ভাই বললেন, “এ বিষয়টি জানার আগে আমাদের জানা থাকা দরকার, তোমরা হয়তো ইতোমধ্যে জেনেও থাকবে যে, সমগ্র জীবজগৎকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে কতগুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে জীবজগতে একটি জীবের শ্রেণীবিন্যাসগত যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে থাকে- জগৎ (Kingdom), পর্ব (Phylum), শ্রেণী (Class), বর্গ (Order), গোত্র (Family), গন (Genus) এবং প্রজাতি (Species)।
আমরা জানি, সমগ্র জীবজগৎকে মোটামুটি ৫টি জগতে ভাগ করা যায়। এরা হলো প্রাণীজগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, ছত্রাক, প্রোটিস্টা এবং মনেরা। তন্মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ হলো প্রাণীজগৎ। প্রাণীজগতে ৩৫টির মতো পর্ব রয়েছে। তার মধ্যে প্রোটোজয়া, নিডোফোরা, প্লাটিহেলমিনথেস, নেমাটোডা, মলাস্ক, আর্থ্র্রোপোডা এবং কর্ডাটা সম্পর্কে আমরা পড়েছি কিন্তু আমরা এও জানি যদিও প্রজাতিগুলোর কতগুলো সমবৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এগুলোকে বিভিন্ন পর্বে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তথাপি প্রতিটি প্রজাতিই স্বতন্ত্র। প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে এই বিষয়গুলো আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন কর্ডাটা পর্বের মামালিয়া উপপর্বের দু’টি প্রজাতি হলো বানর ও বেবুন। যদিও এরা দেখতে প্রায় একই রকম কিন্তু এদের মধ্যে সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র পার্থক্য আছে।” [১০]
তৌফিক কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “যদি প্রজাতিগুলোর মধ্যে বিবর্তন প্রক্রিয়াটি সত্যিই সংঘটিত হয়ে থাকে তাহলে তো দু’টি কাছাকাছি প্রজাতির মধ্যে একটি অবস্থান্তরবর্তী (Transitional) প্রজাতি থাকার কথা। বিবর্তনবাদীরা যেমন বলে যে মাছ থেকে সরীসৃপ হয়েছে। সেক্ষেত্রে মাছ ও সরীসৃপের মধ্যবর্তী প্রজাতি থাকার কথা।”
রাজীব ভাই বললেন, “এক্স্যাক্টলি, তাহলে প্রশ্ন হয় যে বর্তমানে এ ধরণের প্রজাতি নেই কেন? এর উত্তরে ডারউইন বলেন, প্রাকৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে উন্নত প্রজাতি বাছাই হয়ে গেলে বিবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী সে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে জীবাশ্মের মধ্যে সেই অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির সন্ধান পাওয়ার কথা। এ ব্যাপারটি ডারউইন নিজেও অনুভব করেছিলেন। তার বইয়ের Difficulties of the theory অধ্যায়ে তিনি নিজেই এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন এভাবে- কিন্তু যদিও এ তত্ত্বানুসারে অসংখ্য মধ্যবর্তী রূপ (Transitional Form) থাকার কথা তথাপি আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠে তাদের অগণিত সংখ্যায় প্রোথিত পাচ্ছি না কেন?” [১১]
“ডারউইন তার উত্থাপিত প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন এই বলে যে, জীবাশ্ম রেকর্ড খুবই অসম্পূর্ণ। কিন্তু ডারউইন এ তত্ত্ব দেয়ার পর গত ১৫০ বছর যাবৎ মিলিয়ন মিলিয়ন জীবাশ্ম উদ্ধার করে রেকর্ড করা হয়েছে। জীবাশ্ম রেকর্ড এখন প্রায় সম্পূর্ণ। কিন্তু এখনও ডারউইনের উক্ত প্রশ্নের কোন সমাধান হয়নি। এ ব্যাপারে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জীবাশ্মবিদ্যায় পারদর্শী একজন একনিষ্ঠ বিজ্ঞান রবার্ট ক্যারোল স্বীকার করেন যে, ডারউইনের মৃত্যুর পর একশত বছরের ব্যাপক সংগ্রহ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অসংখ্য মধ্যবর্তী সংযোজনকারী প্রজাতির যে চিত্র আশা করা হচ্ছিল তা দেখা যাচ্ছে না।” [১২]
“বিবর্তনবাদীদের এ ধরণের মন্তব্য থেকে লক্ষণীয় যে, তারা সুস্পষ্টভাবে তাদের তত্ত্বের ভিত্তি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে অন্ধবিশ্বাসী হয়ে আছে। আর হ্যাঁ, ট্রি অব লাইফ-এর ধারণা সম্পর্কে হারুণ ইয়াহিয়া লিখেন, ট্রি অফ লাইফ অনুযায়ী পর্বসমূহ (Phylum) পর্যায়ক্রমে স্তরে স্তরে আবির্ভূত (Emerge) হয়েছে। ডারউইনবাদ অনুসারে, প্রথমে একটি পর্বকে অবশ্যই আবির্ভূত হতে হবে এবং তারপর অন্য পর্বসমূহ ব্যাপক সময়ের ব্যবধানে অল্প অল্প করে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হতে থাকবে। নিচের চিত্রটিতে ডারউইনবাদীদের চোখে প্রাণীর পর্বের সংখ্যার পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির ব্যাপারটি দেখানো হয়েছে। বিবর্তনবাদ অনুসারে জীবন এভাবেই তৈরী হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তাই? নিশ্চয় না। বরঞ্চ, প্রাণীরা তাদের আবির্ভাবকাল থেকেই সম্পূর্ণ পৃথক ও জটিল গঠনের অধিকারী ছিল। বর্তমানে জ্ঞাত সকল প্রাণী পর্বসমূহ (Animal Phyla) জিওলজিকাল পিরিওডের ঠিক মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হয়। এ সময়টিকে বলা হয় ক্যামব্রিয়ান এরা (Cambrian Era)। ক্যামব্রিয়ান এরা হলো জিওলজিকাল পিরিয়ডের ৬৫ মিলিয়ন বছর দীর্ঘ একটি সময় যার বিস্তৃতি ৫৭০ থেকে ৫০৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত। কিন্তু অধিকাংশ প্রাণী পর্বসমূহের হঠাৎ আবির্ভাবকে ক্যামব্রিয়ানের মধ্যবর্তী আরও ক্ষুদ্র সময়ের একটি দশায় স্থাপন করা যায়, যা ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশন নামে অভিহিত।…. এ সময়ের আগে, এককোষী জীব ও কিছু আদিম (Primitive) কিন্তু জটিল বহুকোষী জীব যেমন ট্রাইলোবাইট, এনোমেলোক্যারিস ইত্যাদি ছাড়া কোন জীবাশ্ম পাওয়া যায় না। সকল প্রাণী পর্বসমূহ সম্পূর্ণ সুগঠিতভাবে একই সঙ্গে আবির্ভূত হয় অতি ক্ষুদ্র এই সময়টিতে।” [১৩]
জীবাশ্ম রেকর্ড বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করে
বিবর্তনবাদ বলে জীবজগতের বিভিন্ন দলসমূহ একই পূর্ব-পুরুষ (প্রজাতি) থেকে এসেছে এবং সময়ের পরিক্রমায় পৃথক হয়ে গেছে। উপরের ছবিটি এই দাবিটি উপস্থাপন করে। ডারউইনবাদীদের মতে জীবসমূহ পরস্পর থেকে গাছের শাখা প্রশাখার মত পৃথক হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ফসিল রেকর্ড তার বিপরীত অবস্থাই প্রদর্শন করে। উপরের চিত্রটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, জীবজগতের বিভিন্ন দলসমূহ তথা পর্বসমূহ হঠাৎ তাদের বিভিন্ন গঠনসহ আবির্ভূত হয়। Cambrian era-তে ১০০টির মতো পর্ব হঠাৎ উত্থিত (Emerge) হয়। পরবর্তীতে সংখ্যাটা না বেড়ে কমতে থাকে। কেননা কিছু পর্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। (From: www.arn.org)
রাকিব রাজীব ভাইয়ের সাথে সংযুক্ত করল, “ডারউইন প্রাণীর সঙ্করায়ণের ওপর পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, এ প্রক্রিয়ায় অধিক উৎপাদনশীল প্রাণী (যেমন অধিক উৎপাদনশীল গরু) উৎপন্ন হচ্ছে। এর ওপর ভিত্তি করে তিনি বলেন যে, এভাবে ক্রমাগত একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের অবস্থার মধ্যে থাকতে থাকতেই কোন প্রজাতিতে পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে। কিন্তু তাতে যত পরিবতন হোক গরু তো গরুই থাকছে। এটাই বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। এ ব্যাপারে মাওলানা আব্দুর রহীম তার বিবর্তনবাদ ও স্রষ্টাতত্ত্ব বইয়ে লিখেছেন, “জীবজন্তুর বংশবৃদ্ধিজনিত অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দৈহিক আঙ্গিকতার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের দ্বিতীয় রূপ। ডারউইনের বিশেষ মতদার্শের প্রাসাদ এর-ই ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বংশবৃদ্ধিতত্ত্বে পারদর্শী লোকেরা ঘোড়া, গরু, মেষ, হাঁস-মুরগির বিভিন্ন বিশেষত্ব সম্পন্ন বহু উত্তম ও উন্নতমানের বংশ উদ্ভাবন করে থাকেন। এ বিশেষত্বসমূহ বংশানুক্রমিক হয়। মুরগির বংশবৃদ্ধি তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। বেশি বেশি ডিম দানে সক্ষম কিংবা বেশি হৃষ্টপুষ্ট মুরগি অধিক গোশতসম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদনে সক্ষম হয়। এ থেকে ডারউইন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছেন যে, লালন পালন পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করে অধিক উন্নতমানের বংশ উদ্ভাবন করা সম্ভব। আর এ বিশেষত্ব বংশানুক্রমিকতার সাহায্যে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।
এ কথা অনেকটা সত্য এবং অনস্বীকার্য, কিন্তু তা যতটা পর্যবেক্ষণে আসে ততটাই, তার বেশি নয়। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিভিন্ন জীববংশে সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উন্নতি ও উৎকর্ষ বিধান এবং তা অধস্তন বংশে সংক্রমণ করাই ছিল আসল লক্ষ্য। তার কার্যক্রম ও পদ্ধতি কী হতে পারে তা-ই ছিল প্রশ্ন। কিন্তু যে প্রাণীগুলোর মধ্যে আদৌ কোন বিশেষত্ব নেই সেগুলোকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।
এ জন্য কেবলমাত্র বাছাই করা ও উন্নতমানের বংশকেই গ্রহণ করা হয়েছে। খারাপ ও অনুন্নতমানের বংশ নিয়ে কখনও এ প্রচেষ্টা চালানো হয়নি নিতান্ত নিষ্ফল ও পণ্ডশ্রম মনে করে। এ জন্য বংশানুক্রমিকতার বিধান ও খাদ্যের বিশেষ অধ্যয়ন চলছে। কিন্তু এসবের মূলে দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কোনরূপ মৌলিক ও আঙ্গিক পরিবর্তন সাধন কখনও লক্ষ্য ছিল না। আঙ্গিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কখনই এরূপ করা হয়নি।
অবস্থিত মৌলিক বিশেষত্বে উন্নতি বিধান ও উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যেই এ সব করা হয়েছে। কিন্তু বংশবৃদ্ধি তত্ত্বে পারদর্শীদের এসব অভিজ্ঞতাকে দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাঠামো পরিবর্তন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার চিন্তা কেবলমাত্র ডারউইনের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত এবং তাকে বংশানুক্রমিক বলে তার মতাদর্শের ওপর ভিত্তি উপস্থাপন করা তার-ই অভিনব ও হাস্যকর বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। অথচ চেষ্টালব্ধ বিশেষত্ব চিরকালই ক্ষণস্থায়ী, তা কখনো বংশানুক্রমিক হয় না। প্রকৃতপক্ষে সংকরায়ণের মাধ্যমে উত্তম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব উৎপাদন করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে জীবগুলো উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এটাকে সহজভাবে বুঝতে হলে মনে করি অধিক দুধ দিতে সক্ষম দুটো প্রজাতির গরুতে সংকরায়ণ করা হলো। এভাবে যে বাছুরটি জন্ম নেবে সে পরবর্তীতে আরও বেশী দুধ দিবে। পরবর্তীতে এ ধরণের দুটো গরুতে পুনরায় বংশবৃদ্ধি করা হলো। পরবর্তী গরুটি হয়ত আরও দুধ দিতে সক্ষম হবে কিন্তু প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি পরবর্তী বংশধর তৈরীর প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দেহে পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ কোথায়। বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা তাদের বক্তব্যে এ বিষয়টি চতুরতার সাথে এড়িয়ে যায়।”
মাওলানা আরও লিখেন, “কিন্তু উত্তরাধিকার বিধান সম্পর্কে ডারউইন চরমভাবে অজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ। মেন্ডেলের বৈজ্ঞানিক গবেষণা তার জ্ঞান বহির্ভূত। নিছক চিন্তাবিলাস ও আকাশ কুসুম কল্পনাই তার একমাত্র মূলধন। যে জিনিসকে তিনি বংশানুক্রমিক বলে অভিহিত করেছেন, তা যে আদৌ বংশানুক্রমকি নয় তাও তার অজানা।
উইলিয়াম বেক লিখেছেন: ‘জীবজন্তুর বংশে কোন-কোন পরিবর্তন বা পার্থক্য সূচিত হতে থাকে প্রকৃতপক্ষে এ ধারণাই ক্রমবিকাশ তত্ত্বের ভিত্তি। ডারউইন মেন্ডেলের গবেষণা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তার গ্রন্থ অরিজিন অব স্পিসিজ থেকে স্পষ্ট মনে হয়, উপার্জিত পরিবর্তনসমূহ বংশানুক্রমিক হবে- এ কল্পনাকে বাস্তব প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ডারউইন দৈহিক পরিবর্তনসমূহকে খুব ভয়ে ভয়ে ও সঙ্কোচসিদ্ধ পেঁচানো পন্থায় পেশ করেছেন।’ [৩৩] কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেন্ডেলের গবেষণা ফল যখন আত্মপ্রকাশ করল এবং তিনি যখন বংশানুক্রমিকতার বিধান ব্যাখ্যা করলেন তখন ডারউইনের কল্পনার ভিত্তিহীনতা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। আর চেষ্টা সাধনা ও দ্বন্দ্ব সংগ্রামলব্ধ উপার্জিত বিশেষত্ব যে বংশানুক্রমিক হয় না তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকল না।
বস্তুত জীবদেহের প্রতিটি কোষে এক বিশেষ ধরণের জীবাণু থাকে। তার নাম ক্রোমাসোম। প্রত্যেক প্রজাতির জীবের জন্য ক্রোমোসমের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন। মানবদেহের প্রতিটি কোষে তেইশ জোড়া (৪৬টি) ক্রোমোসোম থাকে। ইউরোপের উন্নতমানের সংস্কৃতিসম্পন্ন শ্বেতাঙ্গ মানুষ কিংবা আফ্রিকার বৃহদাকার আরণ্যিক অথবা পিতবর্ণের চৈনিক বা রেড ইন্ডিয়ান যেই হোক, সকলের ক্ষেত্রেই এ কথা সমানভাবে সত্য। আর এ ক্রোমোসোমই হয় উত্তরাধিকারমূলক গুণের ধারক। তা-ই হয় জীবন স্থির রাখার নিরামক।
গর্ভধারণের মাধ্যমে জীবন সংক্রমণের জন্যও তা-ই দায়ী। গ্রেগর মেন্ডেলের আবিষ্কার এবং পরবর্তীকালের গবেষণায় এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে প্রতিটি ক্রোমোসোমে থাকে জিন, যা বংশগতির তথ্য ধারণ করে রাখে। জিনের মধ্যে কোন পরিবর্তন না হলে কোন জীবের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসমূহের কোনটাই পরিবর্তিত হওয়া সম্ভব নয়।” [১৪]
রাকিব তার সাথে নিয়ে আসা ডায়েরি থেকে কথাগুলো পড়ে শোনাল। তৌফিক বললো- “ডারউইনের সময়ে যে অনুন্নত অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছিল তাতে প্রতিটি কোষকে একটি প্রকোষ্ঠ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের ফলে একটি সাধারণ কোষের গঠন যে কত জটিল তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অতএব, স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন পদার্থ থেকে কোষের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণা স্পষ্টতই অযৌক্তিক।”
তৌফিকের কথা শেষ হতে হতে মাগরিবের আজান পড়ে গেল। নামাজ আদায়ের পর রাজীব ভাই তৌফিক ও রাকিবের সাথে ঠিক করলেন আজকের মতো এখানেই তাদের আলোচনা সমাপ্ত। তবে আগামী শুক্রবার তারা আবার বসুন্ধরা সিটির আট তলায় মিলিত হবেন।
তিন.
শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় বসুন্ধরা সিটির নিচে পানির ফোয়ারার কাছে দাঁড়িয়ে রাজীব ভাই অপেক্ষা করছিলেন রাকিব ও তৌফিকের জন্য। বাদ আসর তাদের মিলিত হওয়ার কথা। রাজীব ভাই আজকে তার সাথে তার এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন। নাম ওমর। ওমর ভাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল সেমিস্টারে আছেন। কিছুক্ষণ পরই রাকিব ও তৌফিক পূর্ব দিক হতে এসে রাজীব ভাইয়ের সাথে মিলিত হলে তারা ওমর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিল। লেভেল এইটে ওঠার জন্য তারা এলিভেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ‘বসুন্ধরা সিটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম শপিং কমপ্লেক্স। এত বড় লাক্সারিয়াস মার্কেট বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। আবার এ ধরণের একটি শপিং কমপ্লেক্স বাংলাদেশে হওয়াটাও একটা বিশাল ব্যাপার, প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু। যাই হোক, একটা বিষয়কে কত দিক থেকে যুক্তি দিয়ে বুঝানো যায়। লজিক আর এন্টি-লজিক সবসময় সমান তালে চলে। কিন্তু সঠিক যুক্তিগুলো তো সত্যের ওপর ভিত্তি করেই হয়ে থাকে। যেমন নিউটোনিয়ান বলের সূত্র একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। কেউ যদি বলে, ‘আমাদের ওজনের সমপরিমাণ বিপরীত বল আমাদের ওপর ক্রিয়া করার ফলেই আমরা কোন তলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি’ তাহলে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য জগতের সবক্ষেত্রে তার কথাটি ঠিক এবং বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। সুতরাং এর বিপরীতে অনেক যুক্তি দেয়া হলেও তা সুযুক্তি হবে না।’ রাকিব কথাগুলো মনে মনে ভাবছিল। এলিভেটর নিচে চলে এসেছে। ভেতর থেকে বিভিন্ন মানুষ বের হয়ে এল। রাকিবরা ভেতরে প্রবেশ করল। তাদের গন্তব্য লেভেল ৮। এলিভেটরের কাছের দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাকিব দেখল হঠাৎ করে মাথায় একটা চাপ অনুভূত হয়ে এলিভেটর ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। নিচের জগৎটা ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। লেবেল ৮-এ পৌঁছে রাজীব ভাই সবাইকে নিয়ে একটা খাবারের দোকানের কাছে গিয়ে বসলেন। সবার আগে ওমর ভাই মুখ খুললেন-
“আসলে বুয়েটে প্রথম বর্ষে পড়াকালীন আমি নাস্তিকতাবাদে বিশ্বাসী ছিলাম। আমার অন্য কয়েকজন বন্ধুর মতো আমারও কিছু বইয়ের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। মানুষের আদি উৎসের ব্যাপারে আমারও বিবর্তনবাদেই বিশ্বাস ছিল। আমার মনে হতো বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তত্ত্ব। ফলে আমিও মনে করতাম পৃথিবীর আদি প্রকৃতিতে একদিন হঠাৎ দুর্ঘটনাক্রমে আদি কোষ তৈরি হয়। আগে ধর্মসমূহকে মানুষের তৈরি মনে হতো, পরে আমার এক বন্ধুর দেয়া কিছু বই পড়ে আমার চিন্তার বন্ধ দ্বার খুলে যায়। আমি উপলব্ধি করতে পারি যে, বিশ্বজগতের এই বিশাল জটিল ও অসাধারণ উপাদানসমূহ কোন দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্টি হয়নি। বরং একজন বুদ্ধিদীপ্ত সত্তা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তখন আমি নিজের ধর্ম ইসলাম সম্বন্ধেও জানার চেষ্টা করলাম। আমার কাছে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা আমাদের শুধু সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি, বরং আমাদের জীবনকে সুন্দর ও শান্তিময় করার জন্য প্রতি যুগেই কিছু সুস্পষ্ট বিধান দিয়ে তিনি নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছিলেন। আর এটাও বুঝতে সক্ষম হই মানুষ পরবর্তীতে আল্লাহর দেয়া বিধানকে পরিবর্তন করে নিজেদের অধীন বানিয়ে নিয়েছে। সে যাই হোক, আমি রাজীবের কাছ থেকে তোমাদের আলোচনা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। খুবই ভালো। সৃষ্টি কি দুর্ঘটনা? এ ব্যাপারে তাফহিমুল কুরআনে বলা হয়েছে- “প্রথমে সৃষ্টিকর্তা নিজের প্রত্যেক সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি করেন এবং তারপর সেই মানুষের বংশ বিস্তারে এমন শক্তি সৃষ্টি করে দেন যার ফলে তার শুক্র থেকে তারই মত মানুষের জন্ম হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভূমির সারবস্তু একত্র করে একটি নির্দেশের মাধ্যমে তার মধ্যে এমন জীবন চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তি সৃষ্টি করে দেন যার মাধ্যমে মানুষের মতো একটি আশ্চর্যজনক সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করে। এটি ছিল একটি কর্মকুশলতা। আবার দ্বিতীয় কর্মকুশলতা হচ্ছে আগামীতে আরো মানুষ তৈরি করার জন্য এমন একটি অদ্ভুত কাঠামো মানুষের নিজের কাঠামোতেই রেখে দেন। যার গঠন প্রকৃতি ও কার্যধারা দেখে মানবীয় বিবেকবুদ্ধি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়।
ডারউইনের যুগের বিজ্ঞানীগণ এ চিন্তাধারার ব্যাপারে নাসিকা কুঞ্চন করে আসছেন এবং ডারউইনবাদকে বৈজ্ঞানিক মতবাদ গণ্য করে অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরে একে প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে থাকেন। কিন্তু মানুষের ও জীবের সমস্ত প্রজাতির না হোক অন্ততপক্ষে সর্বপ্রথম জীবনকোষের সরাসরি সৃষ্টি থেকে তো তারা নিজেদের চিন্তাকেই মুক্ত করতে পারবে না। এ সৃষ্টিকে মেনে না নিলে এ ধরণের একদম বাজে কথা মেনে নিতে হবে যে, জীবনের সূচনা হয় নিছক একটা দুর্ঘটনাক্রমে অথচ শুধুমাত্র এককোষসম্পন্ন জীবের মধ্যে জীবনের সবচেয়ে সহজ অবস্থাও এতটা জটিল ও সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কারুকাজে পরিপূর্ণ যাকে একটি দুর্ঘটনার ফল বলে গণ্য করা একেবারেই অযৌক্তিক। এটা ক্রমবিবর্তন মতবাদের প্রবক্তারা ‘সৃষ্টি মতবাদ’-কে যতটা অবৈজ্ঞানিক মনে করেন তার চেয়ে লাখো গুণ বেশি অবৈজ্ঞানিক। আর মানুষ যদি একবার এ কথা মেনে নেয় যে, জীবের প্রত্যেক প্রজাতির প্রথমজন স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপর তার বংশধারা প্রজনন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে চলে আসছে তাহলে এমন অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, ডারউইনের পতাকাবাহীদের সকল বৈজ্ঞানিক কাব্যচর্চা সত্ত্বেও তাদের ক্রমবিবর্তনবাদী মতবাদের যেগুলোর কোন সমাধান হয়নি।”” [১৫]
রাজীব ভাই বললেন, “আণবিক জীববিদ্যার গবেষণা দ্বারা এটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে জীবনকে যেরূপ সরল মনে করা হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সেটি তার চেয়ে বহুগুনে জটিল। এতে অসংখ্য জটিল অণু বিদ্যমান। আমরা জানি, কোষ বিভিন্ন ধরণের কার্বোহাইড্রেট (শর্করা), প্রোটিন (আমিষ), লিপিড (চর্বি), ভিটামিন ও মিনারেল এবং পানি দিয়ে গঠিত। এ ছাড়া কোষে প্রতিনিয়ত অনেক পরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ আণবিক প্রক্রিয়া সর্বদা সংঘটিত হচ্ছে। মাইকেল ডেন্টন তার Evolution: A theory in crisis গ্রন্থে লিখেন: ‘আণবিক জীববিদ্যা জীবনের যে বাস্তবতা প্রকাশ করেছে সেটি অনুধাবন করতে হলে, আমাদের একটি কোষকে শতকোটি গুন বড় করে দেখতে হবে যতক্ষণ না তা এত বড় করে দেখা হয় যে, তা বিশ কিলোমিটার ব্যাস ধারণ করে এবং গোটা লন্ডন বা নিউইয়র্ক শহরকে ঢেকে দেয়ার মত বিশাল উড়োজাহাজের অনুরূপ আকৃতি লাভ করে। আমরা তখন যা দেখতে পাব তা হলো, একটি উপযুক্ত নকশা ও অসামান্য জটিলতার বস্তু। উপরিতলে আমরা দেখতে পাব একটি বিশাল মহাকাশ যানে আলো বাতাস ঢোকার জন্য যে ছিদ্র রাখা হয় তার মতো লক্ষ লক্ষ ছিদ্র যেগুলো অনবরত খুলছে ও বন্ধ হচ্ছে এবং কোষের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ভেতরে ঢোকানোর ও বাইরে বের করে দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আমরা যদি রন্ধ্রগুলোর একটিতে ঢুকতে চাইতাম তাহলে আমরা আমাদেরকে এক সর্বোৎকৃষ্ট প্রযুক্তি ও বিস্ময়কর জটিলতার জগতে দেখতে পেতাম- এটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য যে এলোপাতাড়ি কতগুলো প্রক্রিয়া এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যার ক্ষুদ্রতম উপাদানটিও (যেমন প্রোটিন বা জিন) এতটাই জটিল যা আমাদের নিজেদের সৃষ্টিশীল যোগ্যতার বাইরে? বরং (এই জটিলতাটাই) এমন একটি বাস্তবতা, যা ‘দৈবাৎ সৃষ্টি’ হওয়ার মতবাদের বিপরীত তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে এবং যেটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে তৈরি যে কোন জিনিসের জটিলতাকে ছাড়িয়ে যায়।’ [১৬] ইংলিশ জোতির্বিদ এবং গাণিতিক স্যার ফ্রেড হোয়েল একজন বিবর্তনবাদী হওয়া সত্ত্বেও বলেন, ‘(একটি) উচ্চতর বৈজ্ঞানিক গঠন অকস্মাৎ তৈরি হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা এর সাথে তুলনীয় যে, একটি টর্নেডো কোন লোহা-লক্করের স্তূপের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান প্রস্তুত হয়ে গেল।’ [১৭]
অন্যদিকে বিবর্তনবাদীরা একটি কোষ তো দূরে থাক বরং কোষের গাঠনিক উপাদান যেমন একটি প্রোটিনের উৎপত্তি পর্যন্ত ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। প্রোটিনের গাঠনিক একক অ্যামাইনো এসিড। সবচেয়ে সরলতম প্রোটিনটিও ৫০টি অ্যামাইনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, কোন প্রোটিনে একটি অ্যামাইনো এসিডও যদি যোগ বা বিয়োগ অথবা পরিবর্তন করা হয় তবে প্রোটিনটি একটি অব্যবহারযোগ্য অণু স্থূপে পরিণত হয়। [১৮]
সাইটোক্রোম সি প্রোটিনের জটিল ত্রিমাত্রিক গঠন। ছোট ছোট বলগুলো অ্যামাইনো এসিডকে বুঝাচ্ছে। অ্যামাইনো এসিডের ক্রম ও আপেক্ষিক অবস্থানে ন্যূনতম ব্যত্যয় ঘটলে পুরো প্রোটিনটিই অকার্যকর হয়ে যাবে। অথচ বিবর্তনবাদীদের ধারণা এ ধরণের অসংখ্য প্রোটিন নাকি কোন প্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই দৈবাৎ দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে তৈরী হয়ে গেছে।
প্রোটিন গঠিত হয় ২০ ধরণের এমাইনো এসিড দিয়ে এবং প্রোটিনের গঠন খুবই স্পেসিফিক। ধরা যাক, দুটো এমাইনো এসিড পরস্পর পেপটাইড বণ্ড দিয়ে যুক্ত হবে। তাহলে সম্ভাব্য সমাবেশ হতে পারে, ২০x২০ তথা ৪০০ ধরণের। তিনটি হলে ২০x২০x২০ তথা ৮০০০ ধরণের, ৪টি হলে ২০৪ = ১৬০০০০ ধরণের। অথচ, কোষের ভিতর ছোট আকৃতির একটি কার্যকরী (ফাংশনাল) প্রোটিন গড়ে ১৫০টি এমাইনো এসিডের সমন্বয়ে তৈরী হয়। সুতরাং ১৫০ ঘরে বিন্যাস হবে ২০১৫০ তথা ১০১৯৫ ধরণের। যার মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক বিন্যাসই কার্যকরী প্রোটিন গঠন করতে পারে। এই সংখ্যাটা কত বড় তা বুঝানোর জন্য বলা যায়, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে ১০৮০টি মৌলিক কণা আছে এবং আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১০১৬ সেকেণ্ড। সুতরাং র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে কি প্রোটিন আসা সম্ভব? ক্যালিফর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করার সময় ডগলাস এক্স এ বিষয়টি পরীক্ষামূলক ভাবে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরী অব মলিকিউলার বায়োলজিতে এলান ফার্স্ট-এর অধীনে রিসার্চের সুযোগ পেয়ে যান। তিনি ও তার সহযোগিরা ১৫০ এমাইনো এসিডের সম্ভাব্য সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
প্রসঙ্গত প্রোটিন শুধু মাত্র এমাইনো এসিডের চেইন হিসেবে থাকে না। প্রোটিন তিনটি ধাপে ভাঁজ (ফোল্ড) হয়। এদেরকে প্রাইমারী, সেকেণ্ডারী এবং টারশিয়ারী স্ট্রাকচার বলে। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক ফোল্ড সঠিক হওয়ার উপরই এর ফাংশন নির্ভর করে। সকল এমাইনো এসিড সিকোয়েন্স-এ যেমন ত্রিমাত্রিক ফোল্ড হয় না আবার সকল ত্রিমাত্রিক ফোল্ড ফাংশনাল হয় না। ডগলাস এক্স প্রাথমিক ভাবে দেখতে পান যেই সংখ্যক সিকোয়েন্স ফাংশনাল ফোল্ড গঠন করে তাদের সম্ভাব্যতা ১০৭৪ এর মধ্যে ১ বার। (মিল্কি ওয়েতে পরমাণুর সংখ্যা ১০৬৫) এর মধ্যে যেই ফোল্ডগুলো কার্যকরী তাদেরকে হিসেবে নিলে সম্ভাব্যতা দাঁড়ায় ১০৭৭। [২৯]
তদুপরি, এমাইনো এসিড দু-ধরণের হতে পারে, বাঁহাতি অথবা ডানহাতি, কিন্তু প্রোটিনে প্রাপ্ত এমাইনো এসিড শুধু বাঁহাতি ধরণের। ফলে, শুধু বাঁহাতী এমাইনো এসিড প্রোটিনে আসার সম্ভাব্যতা ২১৫০ তথা ১০৪৫ এর মধ্যে একবার। অন্যদিকে, প্রোটিনে এমাইনো এসিড শুধুমাত্র পেপটাইড বন্ধন নামক বিশেষ রাসায়নিক বন্ধনে যুক্ত হয়। কিন্তু এমাইনো এসিডসমূহ অন্যান্য বন্ধনেও পরস্পর যুক্ত হতে পারে। অতএব, শুধু পেপটাইড বন্ধনযুক্ত রাসায়নিক যৌগ পাওয়ার সম্ভাব্যতা আবারও ২১৫০ তথা ১০৪৫ এর মধ্যে একবার। এসবগুলো হিসেবকে যুক্ত করলে ১৫০টি অ্যামাইনো এসিডের একটি প্রোটিন আসার সম্ভাব্যতা দাড়ায় ১০৭৪ গুনন ১০৪৫ গুনন ১০৪৫ তথা ১০৭৪+৪৫+৪৫ বা ১০১৬৪ এর মধ্যে একবার।
ডিসকভারি ইনস্টিটিউটের ড. উইলিয়াম আলবার্ট ডেম্বসকি (সংক্ষেপে বিল ডেম্বসকি) একটি এলোমেলো (র্যাণ্ডম) ও অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া একা একাই হয়ে যেতে পারবে কি-না তা নির্ণয় করার জন্য সম্ভাব্যতার একটি সীমা হিসেব করেছেন। তিনি একে বলেন বিশ্বজনীন সম্ভাব্যতার সীমা (Universal Probability Bound)। ডেম্বস্কির এই বাউন্ড বা সীমার হিসাবটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন হিসাব বা মাত্রা থেকে পাওয়া যায়। মাত্রা তিনটি হল:
১) ১০৮০, যা হল আমাদের অবজারভেবল ইউনিভার্স বা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের (observable universe) আনুমানিক সর্বোচ্চ এলিমেন্টারি পার্টিকেল বা প্রাথমিক উপাদান সংখ্যা।
২) ১০৪৫, যা হল প্রতি সেকেন্ডে পদার্থের রূপান্তরের সর্বোচ্চ পরিমাণ অথবা প্ল্যাঙ্ক টাইমের (Planck time) ইনভারস বা বিপরীত।
৩) ১০২৫, যা হল আমাদের মহাবিশ্বের বয়স সেকেন্ডে হিসাব করলে যে মান হয় তার থেকে ১ বিলিওন গুন বেশি একটি মান।
এখন, ইউনিভার্সাল প্রোবাবিলিটি বাউন্ড = অবজারভেবল ইউনিভার্সের সর্বোচ্চ অ্যাপ্রক্সিমেট এলিমেন্টারি পার্টিকেল x প্রতি সেকেন্ডে পদার্থের রূপান্তরের সর্বোচ্চ পরিমাণ x সেকেন্ডের হিসাবে আমাদের মহাবিশ্বের বয়স = ১০৮০ x ১০৪৫ x ১০২৫ = ১০১৫০
এই হিসাবটি দিয়ে কী বোঝা যায়? এই হিসাবটি দ্বারা আসলে বোঝা যায় যে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রতি সেকেন্ডে যদি পদার্থের সর্বোচ্চ পরিমাণ রূপান্তর বা পরিবর্তন হয় অর্থাৎ প্রতিটি কণা যদি প্ল্যাঙ্ক সেকেন্ডে পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া (interaction) করে তাহলে তারা বর্তমান সময় পর্যন্ত আনুমানিক সর্বোচ্চ ১০১৫০টি মিথস্ক্রিয়া (interaction) ঘটাতে পারবে। তার মানে মহাবিশ্বে এখনও পর্যন্ত মোট প্রায় ১০১৫০টি বেসিক ঘটনা ঘটেছে। [৩০]
অথচ আমরা জেনেছি একটি মাঝারি আকৃতির প্রোটিন একা একা তৈরী হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা ১০১৬৪ এর মধ্যে একবার। অর্থাৎ মহাবিশ্বের ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাবে কিন্ত ততক্ষণে একটি প্রোটিনও তৈরী হবে না। অথচ একটি কোষে শুধুমাত্র সহস্রাধিক প্রোটিন-ই থাকে না, থাকে নিউক্লিয়িক এসিড, শর্করা, লিপিড, ভিটামিন এবং আরো অনেক রাসায়নিক দ্রব্য যেমন আয়নসমূহ যা গাঠনিক ও কার্যকরী দিক থেকে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে পরিকল্পিতভাবে ভারসাম্যতা বজায় রেখে অবস্থান করে। … নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রবার্ট শাকিরো একটি ব্যাকটেরিয়াতে প্রাপ্য ২০০০ প্রোটিনের কাকতালীয়ভাবে একইসঙ্গে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা হিসাব করেন। তিনি যে সংখ্যাটি পান তা হল ১০৪০০০০ এর ভেতর ১ বার! (অবিশ্বাস্য, তাই না? অনুরূপ একজন মানুষের একটি কোষেও সহস্রাধিক বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন থাকে।)
ওয়েল্স ইউনিভার্সিটির কলেজ কার্ডিফের প্রায়োগিক গণিত ও জোতির্বিদ্যার অধ্যাপক চন্দ্র বিক্রমাসিংহে মন্তব্য করেন: জীবনের প্রাণহীন বস্তু থেকে তৈরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হলো ১ এর পরে ৪০০০০ শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয় তার মধ্যে ১। … এটা এমন বড় একটা সংখ্যা যা ডারউইন ও তার বিবর্তন তত্ত্বকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য যথেষ্ট। না, পৃথিবীতে কোন আদি অর্গানিক সুপ ছিল না, অন্য কোথাও না। এবং যদি জীবনের শুরু দৈবাৎ না হয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই কোন উদ্দেশ্যপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তৈরি হয়ে থাকবে। [১৯]
স্যার ফ্রেড হয়েল এই অযৌক্তিক সংখ্যার ব্যাপারে এভাবে মন্তব্য করেন: ‘বস্তুত (একজন বুদ্ধিমান সত্তা দ্বারা জীবন প্রস্তুত হওয়ার) তত্ত্বটি এতটাই সুস্পষ্ট যে, একজন অবাক হয় যে কেন এটি স্বতঃপ্রমাণিত হিসেবে ব্যাপকভাবে গৃহীত হচ্ছে না? (আসলে) এটি গ্রহণ না করার পেছনের কারণটি বৈজ্ঞানিক নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক।’ [৩১]
বিবর্তনবাদের বড় বড় প্রবক্তারাও জীবনের প্রথম অধ্যায়ে এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিবর্তনবাদের অসারতার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু এটাই বিস্ময়কর যে, তাদের তত্ত্বের সম্পূর্ণ অযৌক্তিকতা দেখার পরও তারা কীভাবে ঔদ্ধত্যের সংগে সংশ্লিষ্ট থাকে? প্রকৃতপক্ষে এটি সম্পূর্ণ আদর্শিকভাবে স্থিরীকৃত হয়েছে।
এতক্ষণ তো শুধুমাত্র প্রোটিন নিয়ে আলোচনা করা হল। কিন্তু প্রোটিন কি একাই তৈরি হয়? না। বরং প্রোটিন তৈরির জন্য আছে একটি মেশিনারি। যাতে থাকে ডিএনএ ও আরএনএ। কিন্তু ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন পরস্পরের পরিপূরক। ডিএনএ ও আরএনএ ছাড়া যেমন সম্ভব নয় প্রোটিন তৈরি হওয়া তেমনি কতগুলো প্রোটিন এনজাইম ছাড়া সম্ভব নয় ডিএনএ রেপ্লিকেশন অথবা আরএনএ সংশ্লেষণ (ট্রান্সক্রিপশন)।
সুতরাং একটি কোষকে সক্রিয় হতে হলে ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন একই সাথে বর্তমান থাকতে হবে। আর এ ছাড়া কার্বোহাইড্রেট, লিপিড, ভিটামিন ও অন্যান্য আয়নতো আছেই। সর্বোপরি এ সকল বিষয় একত্রে নিয়ে যদি একটি কোষের স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বিচার করা হয় তাহলে যে সংখ্যা দাঁড়াবে তা হয়তো কাগজে লিখেও স্থান দেয়া সম্ভব হবে না।” [২০] রাজীব ভাই তার নোট থেকে কথাগুলো পড়ে শোনালেন।
একটি কোষের গঠনের রূপ জটিলতা দেখে তৌফিক অবাক হল। বিবর্তনবাদ সম্পর্কে তার সন্দেহ যেন আরও প্রগাঢ় হল। রাকিব মেডিক্যালে পড়ায় মানবদেহ সম্পর্কে ইতোমধ্যেই অনেক জেনেছে। কিন্তু রাজীব ভাইয়ের কথায় সে যেন মানবদেহের গঠনের জটিলতা ও সামঞ্জস্য নতুনভাবে আবিষ্কার করল। যেখানে একটি ছোট্ট কোষের গঠনই এত জটিল সেখানে মানবদেহের মত অসংখ্য আন্তঃসম্পর্কিত প্রক্রিয়াপূর্ণ গঠনের জটিলতা যে মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ রইল না।
রাকিব বলল, “প্রথম সৃষ্টি সময়কালে যে পরিবেশের কথা চিন্তা করা হয় তাতে কোন জীবন্ত বস্তুর ন্যূনতম টিকে থাকার সম্ভাবনাই শূন্য। সুতরাং রাসায়নিক বিবর্তনবাদ একটি অর্থহীন মতবাদ ছাড়া কিছুই হতে পারে না। (রাসায়নিক বিবর্তনবাদকে এখন এবায়োজেনেসিস বলা হয়।)
ওমর ভাই বললেন, “এ বিষয়গুলো বিবর্তনবাদী বস্তুবাদীদের কাছে স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের প্রমাণস্বরূপ জীবাশ্ম থেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে যদিও জীবাশ্ম রেকর্ডে অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়ার কথা কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তার বিপরীত। এরপরও তারা কোন কোন সময় উদ্ধার করা ফসিলকে দু’টি প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতি হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন এবং তা ফলাওভাবে প্রচার করা হয়। তারা ধারণা করেন যে, মাছ হয়ে যায় উভচর প্রাণী আর কোন কোন উভচর প্রাণী হয়ে যায় সরীসৃপ। সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী ও পাখির জন্ম। আর সব শেষে স্তন্যপায়ী থেকে মানুষের উদ্ভব। এক্ষেত্রে সংক্ষেপে আমরা প্রজাতির উৎপত্তির প্রকৃত ইতিহাস বিবেচনা করতে পারি। তোমরা রাজীবের কাছ থেকে ইতোমধ্যেই হয়তো জেনে গেছ যে, জীবাশ্ম রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিবর্তনবাদীরা রেকর্ডে যেরূপ “Tree of Life”- এর উপাত্ত পাবেন বলে ধারণা করেছিলেন অনুরূপ কোন উপাত্ত পাওয়া যায় না। বরং এক্ষেত্রে কোন নিকটবর্তী প্রজাতির জীবাশ্ম ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ প্রজাতির স্বতন্ত্র জীবাশ্ম একই সাথে পাওয়া যায়, যেগুলো জীবাশ্ম রেকর্ডে হঠাৎ আবির্ভূত হয়। তোমরা জেনেছ, এই সময়টিকে বলা হয় ক্যামব্রিয়ান এরা এবং উক্ত ঘটনাটকে বলা হয় ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশন। এ সম্পর্কে Science News Magazin-এর রিচার্ড মনটারস্কি বলেন, ‘প্রায় অর্ধ বিলিয়ন বছর আগে…. প্রাণিকুলের উল্লেখযোগ্য জটিল আকার, যা এখন আমরা দেখি, তা হঠাৎ আবির্ভূত হয়। মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর ক্যামব্রিয়ান পিরিয়ডের এই মুহূর্তটি সেই বৈবর্তনিক বিস্ফোরণকে নির্দেশ করে যখন সমুদ্রগুলো পৃথিবীর জটিলতম সৃষ্টি দ্বারা পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।’ [২১]
বিবর্তনবাদীরা প্রতিটি পর্বকে অন্য পর্বের বিবর্তনের ফল মনে করে। তারা দাবি করে কর্ডাটা পর্বটি একটি অমেরুদণ্ডী পর্ব থেকে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এসেছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য ব্যাপার হলো কর্ডাটা পর্বের প্রায় প্রতিটি সদস্যই ক্যামব্রিয়ান এরাতে আবির্ভূত হয় যা উক্ত দাবিকে শুরুতেই বাতিল করে দেয়। কর্ডাটা পর্বের প্রাচীনতম সদস্যটি হল পিকিয়া (Pikia) যেটি একটি সামুদ্রিক জীব। (প্রথম দর্শনে পিকিয়াকে একটি কৃমির মতো মনে হয়) পিকিয়ার পূববর্তী প্রজাতি হিসেবে প্রস্তাবনা রাখা যায় এমন একটি প্রাণীর সাথে পিকিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে একই সময়ে।
….আবার, বিবর্তনবাদীরা মনে করে পিকিয়া প্রজাতিটি ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়ায় মাছে পরিণত হয়েছে। মাছের বিবর্তন তত্ত্বটিরও কোন জীবাশ্ম প্রমাণ পাওয়া যায় না। মিলিয়ন মিলিয়ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং মিলিয়ন মিলিয়ন মাছের জীবাশ্ম থাকলেও মাছ এবং অমেরুণ্ডী প্রাণীর মধ্যবর্তী পরিবর্তনকালীন (ট্রানজিশনাল ফর্ম) একটি অবিতর্কিত জীবাশ্মও নেই।
ব্যাঙের উৎপত্তির কোন বিবর্তন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়নি। জ্ঞাত সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাঙটি মাছ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল এবং এর সকল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সহকারে আবির্ভূত হয়। আমাদের সময়কার ব্যাঙও ঠিক একই ধরণের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ডমিনিকান রিপাবলিকে প্রাপ্ত অ্যামবারে সংরক্ষিত ব্যাঙ ও উক্ত ব্যাঙের বর্তমানে প্রাপ্ত জীবিত নমুনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
রবার্ট ক্যারোল প্রথম দিককার মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে কয়েকটি প্রাণীর উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদীদের কোণঠাসা অবস্থার কথা স্বীকার করেন বলেন, ‘Cephalochordate এবং Craniate-র অবস্থান্তরকালীন (Transitional) প্রজাতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। যথার্থরূপে নির্ণয় করা প্রাচীতনতম মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে ক্র্যানিয়েটের যে সকল বৈশিষ্ট্য আমরা জীবাশ্মে আশা করি, তার সবই পাওয়া যায়। এমন কোন জীবাশ্ম সম্বন্ধে জানা নেই যেটাকে চোয়ালযুক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীদের উৎপত্তির প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।’ বরং মাছ ও উভচর প্রাণীর মধ্যে দাবিকৃত ট্রানজিশনাল ফর্মগুলো এইজন্য ট্রানজিশনাল নয় যে, তাদের মধ্যে খুব কমই পার্থক্য আছে; বরং এজন্য যে, তারা একটি বিবর্তনীয় চিত্রকল্পের জন্য প্রিয় বিষয়। রবার্ট ক্যারোল, তার Pattern and process of vertebrate evolution গ্রন্থে এ দু’টি প্রজাতি সম্পর্কে লিখেন- Eusthenopteron এবং Acanthostega-র মধ্যে ১৪৫টি অ্যানাটমিকাল বৈশিষ্ট্যের ৯১টির মধ্যেই ভিন্নতা আছে। অথচ বিবর্তনবাদীরা বিশ্বাস করে যে এই সবগুলোই ১৫ মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে ডিজাইন হয়েছে। এই ধরণের একটা কল্পকাহিনীতে বিশ্বাস করা বিবর্তবাদের পক্ষে সম্ভব হলেও এটা বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ ঘটনাটি সকল মাছ-উভচর প্রাণী বিবর্তন চিত্রকল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।” [২২]
রাজীব ভাই বলেন, “বিবর্তনবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী স্থলচর চতুষ্পপদী প্রাণীসমূহ সমুদ্রে বসবাসকারী মাছ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রমাণ হলো কিছু মাছের ডানাগুলো মাংসল। এ মাছগুলো যখন স্থলে অলক্ষিতভাবে প্রবেশ করতে শুরু করে তখন মাছের ডানাগুলো পর্যায়ক্রমে পায়ে পরিণত হয়। এর বিপরীতে কী প্রমাণ আছে?”
“লক্ষ্য রাখা দরকার বিবর্তবাদীদের ঐ দাবিটি একটা কাল্পনিক ব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই নয়, কারণ এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। বরঞ্চ এই যুক্তির ধরণ লামার্কের যুক্তির মতো। অথচ স্থলে চলতে যে ধরণের সুগঠিত পায়ের প্রয়োজন তার সম্পর্কে না মাছের জানা ছিল, না বুদ্ধিহীন প্রকৃতির জানা আছে। ডানা এবং পায়ের কঙ্কালতন্ত্রে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান,’’ ওমর ভাই উত্তর করলেন।
রাকিব যোগ করল, ‘‘শুধু তা-ই নয় জলচর থেকে স্থলচর প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে হলে আরও যে সকল সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায় তা হল-
১. ভার বহন: জলচর প্রাণীদের শুধুমাত্র তাদের নিজেদের ওজন বহন করতেই ৪০ শতাংশ শক্তি ব্যয় করতে হয়। সুতরাং পানি থেকে মাটিতে পৌঁছানোর জন্য কোন প্রাণীকে একই সাথে নতুন মাংসপেশি ও কঙ্কালতন্ত্র গঠন করতে হবে এবং এটা কোন প্রকার দৈবাৎ মিউটেশনের মাধ্যমে অসম্ভব।
২. তাপ ধারণ: তাদেরকে স্থলের দ্রুত পরিবর্তনশীল তাপমাত্রার সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযুক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সহকারে পানি থেকে মাটিতে আসতে হবে।
৩. রেচনতন্ত্র: স্থলচর প্রাণী ও জলচর প্রাণীদের রেচনতন্ত্রের হঠাৎ আবির্ভাব হতে হবে। কারণ রেচনতন্ত্রে অল্প অল্প পরিবর্তন সম্ভব নয়।
৪. শ্বসনতন্ত্র: জলচর প্রাণীদের স্থলচর প্রাণীতে পরিণত হতে হলে পূর্ণরূপে প্রস্তুত ফুসফুস নিয়ে আবির্ভূত হতে হবে। [২৩]
যখন তাদের কাছে কোয়েলাকান্থ (Coelacanth)-এর শুধু ফসিল ছিল, প্রত্যেক বিবর্তনবাদী জীবাশ্মবিদ সেগুলো সম্পর্কে কিছু ডারউইনবাদী ধারণা উপস্থাপন করেন; যাই হোক যখন এর জীবিত নমুনা পাওয়া গেল, উক্ত ধারণাগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। উপরের চিত্রে জীবিত কোয়েলাকান্থ-এর উদাহরণ দেখানো হয়েছে। উপরের দিকে থেকে সর্বশেষ ছবিটি ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় প্রাপ্ত কোয়েলাকান্থের সর্বশেষ নমুনা।
একটি জলচর প্রাণীকে স্থলচর প্রাণীতে পরিণত হতে হলে এ সকল শর্ত একই সঙ্গে পূরণ হতে হবে। কোন মাছের উভচর প্রাণীতে পরিণত হতে হলে এর কঙ্কালতন্ত্রে ‘পেলভিস’ তথা পশ্চাতদেশে ইলিয়াম, ইশ্চিয়াম ও পিউবিস নামক তিনটি হারের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষায়িত হাড় যোগ হতে হবে। কিন্তু মাছের এমন কোন জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি যার দ্বারা জানা যাবে যে কীভাবে উভচর প্রাণীর ‘পেলভিস’ গঠিত হয়েছিল। যদি মাছের শিরদাঁড়াকে পেলভিসে রূপান্তরিত হতে হয় তাহলে কোন উভচর প্রাণীতে, যেমন ব্যাঙে সম্পূর্ণ শিরদাঁড়াকে এমনভাবে রূপান্তরিত হবে যে তাতে শিরদাঁড়ার কোন অস্তিত্বই থাকবে না। এছাড়াও এদের মাথার হাড়ও এক রকম নয়। মাছের ডানাকে হতে হবে গিড়াসম্পন্ন ও পেশিময় হাত বা পায়ে। মাছের ফুলকাকে হতে হবে ফুসফুস। এছাড়া মাছ ও উভচর প্রাণীর ইন্দ্রীয়সমূহের মধ্যেও সুস্পষ্ট পার্থক্য আসতে হবে। অনেক কসরত করা হয়, উভচরকে কোন মাছের অধস্তন বানাতে। সফল হওয়া যায়নি। লাংফিশ নামক এক মাছকে উভচরের পূর্বপুরুষ বানাতে কসরত করা হয়। এর ফুলকা ছাড়াও রয়েছে সাঁতরানোর জন্য ব্লাডার যা, মাছটি ডাঙায় উঠলে সাময়িকভাবে শ্বাস নিতে ব্যবহার করে। [২৪]
তৌফিক বলল, “এখন তাহলে সরীসৃপের সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। সরীসৃপ উভচর প্রাণী থেকে এসেছে এটা কি সম্ভব?” রাজীব ভাই বললেন, “আসলে, একটি অর্ধ মাছ অর্ধ উভচর প্রাণী যেরূপ অসম্ভব তেমনি অসম্ভব একটি অর্ধ উভচর অর্ধ সরীসৃপ। এমনকি জীবাশ্ম রেকর্ডের উক্ত দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ নেই।”
থমাস হাক্সলি বলেছেন, “পাখি হল মহিমান্বিত সরীসৃপ। অর্থাৎ সরীসৃপ পর্যায়ক্রমে পাখিতে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কী?” রাকিব ওমর ভাইয়ের দিকে মুখ ফেরালো। ওমর ভাই উত্তর দিলেন, “একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, সরীসৃপের আদৌ পাখিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। বিবর্তনবাদীরা বলে যে, সরীসৃপ (যেমন: কিছু কিছু ডাইনোসর) উড়ন্ত পোকামাকড় শিকার করতে গেলে তাদের সামনের পা দু’টি পাখায় পরিণত হতে শুরু করে, পরে তা উড়তে শিখে এবং পাখিতে পরিণত হয়। অথচ কোন পাখির পাখা পুরোপুরিভাবে গঠিত না হয়ে আংশিক গঠিত হলে তা কখনই উড়তে সক্ষম হবে না। আবার পাখির উড়ার জন্য এর হাড়গুলোকে হালকা হতে হবে। বিশেষ ধরণের ফুসফুস তৈরি হতে হবে। সরীসৃপের আঁশ ও পাখির পালকের তফাৎ আকাশ পাতাল। সুতরাং এ সবকিছুতেই এক মহাপরিকল্পনার সন্ধান পাওয়া যায়। যা কেবলমাত্র একজন মহামহিম পরিকল্পনাকারীর পক্ষেই সম্ভব।”
ওমর ভাই আরও বললেন, “বিবর্তনবাদীরা সাধারণ মানুষকে মানুষের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ধোঁকাগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের দাবি বানর জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে। আর এক্ষেত্রে মানুষের সবচেয়ে নিকটবর্তী হল বনমানুষ বা এপ। ডারউইনবাদীরা দাবি করে যে, আধুনিক মানুষ এক ধরণের এপ (বনমানুষ জাতীয় প্রাণী) থেকে বিবর্তিত হয়েছে। ৫ থেকে ৬ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হওয়া এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার মানুষ ও তার পূর্বসূরিদের মধ্যে কিছু অবস্থান্তর প্রাপ্তিকালীন প্রজাতি পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়। এই কার্যত সম্পূর্ণ কাল্পনিক চিত্রে নিচের চারটি মৌলিক প্রকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে:
১. Australopithecus
২. Homo habilis
৩. Homo erectus
৪. Homo sapience
বামে একটি AI 444-2 Australopithecus afarensis খুলি, এবং ডানে একটি আধুনিক শিম্পাঞ্জির খুলি। এখানে যে পরিষ্কার সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে তা এ বিষয়টির প্রামাণিক নিদর্শন যে Afarensis একটি সাধারণ বন মানুষের প্রজাতি, এতে মানুষের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। যতটুকু গাঠনিক পার্থক্য দৃশ্যমান হচ্ছে তা, একই প্রজাতির বিভিন্ন দল-উপদল তথা রেস-এ যতটুকু পার্থক্য (variation) প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়, তারই অনুরূপ।
বিবর্তনবাদী জীবাশ্মবিদদের প্রবণতা হল নতুন কোন জীবাশ্ম কঙ্কাল আবিষ্কার হলেই হয় তাকে এপদের নিকটবর্তী বা মানুষের নিকটবর্তী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা। অথচ জীবশ্মটি যে এ্যপ বা মানুষের বিলুপ্ত কোন জাতি হতে পারে সে ব্যাপারটি তারা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় একটি দাঁতের ওপর ভিত্তি করে পুরো একটি নতুন মধ্যবর্তী প্রজাতি দাঁড় করিয়ে দেয়। আবার মুখমণ্ডলের কঙ্কালের ওপর যে ফেসিয়াল রিকন্সট্রাকশন করা হয় তাও সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিকর। কেননা কারও কারও মুখমণ্ডলের গঠন চর্বি ও মাংসপেশীর পরিমাণ ও তুলনামূলক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং শুধুমাত্র প্রাপ্ত কঙ্কালের ওপর ভিত্তি করে মুখমণ্ডলের সঠিক আকৃতি দেয়া সম্ভব নয়।
তদুপরী, জীবাশ্মবিদরা বিভিন্ন সময়ে তাদের আবিস্কৃত একটি কঙ্কালের অসম্পূর্ণ অংশবিশেষের উপর ভিত্তি করে পুরো একটি প্রজাতি দাঁড় করিয়ে দেন। কোন কোন সময় প্রতারণাপূর্ণ রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠিত রাখার চেষ্টা করেন। যেমন: ১৯১২ সালে চিকিৎসক ও অ্যামেচার প্যালেওন্টোলিস্ট চার্লস ডাউসন ইংল্যাণ্ডের পিল্টডাউন এলাকায় একটি মাথার খুলির অংশবিশেষ, কয়েকটি দাঁত এবং একটি চোয়ালের হাড় আবিস্কার করেন। মাথার খুলির অংশ এবং দাঁত ছিল মানুষের উক্ত অংশের মতো এবং চোয়ালের হাড় ছিল এপ-এর হাড়ের মতো। তিনি কঙ্কালটির নাম দেন ‘Piltdown man.’ এর বয়স হিসেবে করা হয় ৫০০,০০০ বছর এবং একে ৪০ বছর যাবৎ বিভিন্ন মিউজিয়ামে মানুষের বিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে দেখানো হতে থাকে। কিন্তু নতুন ফসিল ডেটিং টেকনোলজি আবিস্কার হওয়ার পর একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেন যে, উক্ত মাথার খুলি ৫০০ বছর পুরোনো একজন মানুষের এবং চোয়ালের হাড় সম্প্রতি মৃত একটি এপ-এর। [৩৫] এরকম আরও দুটি উদাহরণ হলো একটি শুকরের দাঁতের উপর ভিত্তি করে চিত্রিত ‘নেব্রাস্কা ম্যান’ [৩৬] এবং একটি লেমুরের কঙ্কালের উপর ভিত্তি করে নির্মিত মানুষের পূর্ববতী প্রজাতি ‘ইদা’। [৩৭, ৩৮]
১,০০,০০০ বছর আগে ইউরোপে মানুষের আবির্ভুত একটি জাতি হলো নিয়াণ্ডারথাল (Neanderthal; Homo sapience neanderthalensis), যারা দ্রুত অন্যান্য জাতির সাথে মিশে যায় কিংবা হারিয়ে যায়। এরা ৩৫,০০০ বছর আগ পর্যন্ত জীবত ছিল। তাদের সাথে আধুনিক মানুষের একমাত্র পার্থক্য হল, তাদের কঙ্কালগুলো আরও বলিষ্ঠ এবং তাদের মাথার ধারণ ক্ষমতা একটু বেশি। বিবর্তনবাদীরা এ জাতিটিকে মানুষের আদিম প্রজাতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিল তথাপি সকল আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, আধুনিক বলিষ্ঠ মানুষ থেকে পৃথক কিছু নয়। উপরে, একবারে বাঁ দিকের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, নিয়াণ্ডারথ্যালদের ব্যবহৃত ছাব্বিশ হাজার বছর পুরোনো সূঁচ; এই আবিস্কার থেকে বোঝায় যায় যে নিয়াণ্ডারথাল-রা ১০০০০ বছর আগেও পোশাক বুনন করতে জানতো। একেবারে ডানে দেখা যাচ্ছে, হাড় দিয়ে তৈরী নিয়াণ্ডারথাল বাঁশি। হিসেব করে দেখা যায় ছিদ্রগুলো এমনভাবে করা হয়েছে যেন সঠিক উপসুর পাওয়া যায়। অন্য কথায় বাঁশিটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা হয়েছে। মাঝের ছবিটিতে গবেষক বব ফিন্ক-এর বাঁশি সংক্রান্ত হিসেবটি দেখা যাচ্ছে। বিবর্তনবাদী প্রচারণার বিপরীতে এই আবিস্কারগুলো প্রমাণ করে যে, নিয়াণ্ডারথাল মানুষ সভ্য জাতি ছিল, তারা কোনো আদিম গুহা মানব ছিল না। [৩৯] বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিবর্তনবাদীরা নিয়াণ্ডারথালকে সেমি-এপ জাতীয় সৃষ্টি হিসেবে চিত্রিত করে দেখিয়ে এসেছে। এরপর যখন সূঁচ ও বাঁশি আবিস্কার হয় National Geographic-এর মতো বিবর্তনবাদী প্রকাশনাগুলোতে তাদেরকে সভ্য জাতি হিসেবে দেখানো শুরু করে।
মজার বিষয় হলো, যখন কোন মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের তথাকথিত ‘মিসিং লিংক’ আবিস্কার হয় তখন সায়েন্স ম্যাগাজিনগুলো ফলাও করে তা প্রচার করলেও যখন পরবর্তী গবেষক দ্বারা তা ভুল প্রমাণিত হয় তখন একই মিডিয়াগুলো হয় রহস্যময় নিরবতা অবলম্বন করে অথবা ‘Retrogred confession of ignorance’ তথা ‘আগে তথ্য জানা ছিল না তাই ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিল’ ধরণের স্বীকারক্তি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। এসব থেকে স্পষ্ট যে, আবিস্কৃত ফসিলগুলো বিবর্তনবাদের দিকে নির্দেশ না করলেও তারা বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ ডারউইনবাদকে টিকিয়ে রাখার কারণ বৈজ্ঞানিক নয় বরং আদর্শিক।
আধুনিক মানুষের জাতিসমূহের মধ্যে কঙ্কালগত পার্থক্য: বিবর্তনবাদী জীবাশ্মবিদা Homo erectus, Homo sapience neanderthalensis এবং Archaic homo sapience মানব জীবাশ্মগুলোকে বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন প্রজাতি বা উপপ্রজাতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। তারা উক্ত ফসিল কঙ্কালগুলোর পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে এই পার্থক্যের মধ্যে আছে মানুষের বিভিন্ন জাতির মধ্যকার বৈচিত্র্য যে জাতিগুলোর কতক বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর কতক মিশে গেছে অন্যান্য জাতির সাথে। সময়ে সময়ে জাতিগুলো যখন একে অপরের সংস্পর্শে আসতে থাকে তখন এ পার্থক্যগুলো ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়াও বর্তমান যুগের মানবজাতিগুলোর মধ্যেও উল্লেখ্যযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উপরের ছবিটিতে আধুনিক জাতিগুলোর যে কঙ্কালগুলো দেখানো হয়েছে তা উক্ত জাতিগত পার্থক্যের উদাহরণ। অতীতের অতিক্রান্ত জাতি সমূহের অনুরূপ পার্থক্য উপস্থাপন করে সেগুলোকে বির্বতনের প্রমাণ হিসেবে সব্যস্ত করার প্রচেষ্টা পক্ষপাতিত্ব ছাড়া কিছুই নয়।
লক্ষ্যণীয়, মানুষের কঙ্কালকে দাঁড়িয়ে হাঁটার উপযুক্ত করে নকশা করা হয়েছে। অপরদিকে এপদের ছোট পা, লম্বা হাত এবং সম্মুখে ঝুঁকে দাঁড়ানোর ভঙ্গি চার পায়ে চলার জন্য উপযুক্ত। এটা সম্ভব নয় যে, এপজাতীয় প্রাণী ও মানুষের একটি মধ্যবর্তী রূপ (Transitional form) থাকবে। কেননা দ্বিপদী অবস্থাটা বিবর্তন প্রক্রিয়ার ‘উন্নততর অবস্থার দিকে যাওয়ার নীতি’ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় (Bipedalism problem)।
এছাড়াও, এপ-হিউম্যান সিনারিওতে প্রাণীদ্বয়ের জেনেটিক কোডের সমতুল্যতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। সময়ে সময়ে অনেক বিবর্তনবাদী এ দাবি করেন যে, মানুষ ও এপ এর মধ্যে ৯৯% জেনেটিক সমতুল্যতা রয়েছে। বিবর্তনবাদীদের প্রতিটি সাহিত্যকর্মে, তুমি এ ধরণের লেখা পড়বে। আমরা শিম্পাঞ্জির ৯৯ শতাংশ অনুরূপ অথবা মাত্র ১ শতাংশ অনুরূপ অথবা মাত্র ১ শতাংশ ডিএনএ আমাদের মানুষ বানায় ইত্যাদি। বরং ২০০২ সালের অক্টোবর একটি সমীক্ষায় প্রকাশিত হয় যে, জেনেটিক সমতুল্যতা ৯৯% নয় বরং ৯৫%। [২৫]
কিছু বেসিক প্রোটিনের গঠন শুধু শিম্পাঞ্জি নয় অন্যান্য প্রজাতিতেও মানুষের প্রোটিনের অনুরূপ। উদাহরণ স্বরূপ নেমাটোড কৃমির সাথে মানুষের ৭৫% ডিএনএ-র সমতুল্যতা রয়েছে। তার মানে এটা নিশ্চয়ই নয় যে, মানুষ ও কৃমির মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ পার্থক্য? [২৮] প্রকৃতপক্ষে এ সমতুল্যতার কারণ বির্বতন নয় বরং একই ধরণের পরিকল্পনা। আবার যেহেতু বিবর্তনবাদ অনুসারে বনমানুষ পর্যায়ক্রমে মানুষে পরিণত হয়েছে তাই এদের মধ্যবর্তী প্রজাতি থাকার কথা এবং অসংখ্য এরূপ জীবাশ্ম পাওয়ার কথা। বিবর্তনবাদীরা এ জন্য পুরোদমে জীবাশ্ম অনুসন্ধান ও গবেষণা করেন। তারা তাদের তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে কিছু জীবাশ্মকে মধ্যবর্তী প্রজাতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। এ জন্য তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ধোঁকাবাজি, চিত্রাঙ্কন ও প্রচারমাধ্যমের আশ্রয়ও নেন। কিন্তু দেখা যায় একটি মধ্যবর্তী প্রজাতির আবিষ্কার বলে প্রচার করার কয়েকদিন পরেই তা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।” [৩২]
তৌফিক বলল, “এ সকল বিষয় থেকে তো এটা স্পষ্ট যে বিবর্তন সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি মতবাদ। এটি কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়, একটি কল্পনা যাকে বস্তুবাদী নাস্তিকরা অর্থ-সমর্থন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।”
ওমর ভাই বললেন, “বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসকে মৌলিক চেতনা ধরে নেয়া হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানীরা আগে বস্তুবাদী তারপর বিজ্ঞানী। যদি তারা আগে বিজ্ঞানী হতেন তাহলে বিজ্ঞানের আলোকে সুস্পষ্ট সত্যকে অস্বীকার করার কোন প্রশ্নই উঠতো না।”
রাজীব যোগ করলেন, “শুধু তাই নয়। উনবিংশ শতাব্দীতে বিবর্তনকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে শিক্ষা দেয়ার ফলে পৃথিবীর মানব ইতিহাসে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে তা ঔপনিবেশিকতা, নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের হিংস্রতা ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
আমরা আগেই জেনেছি বিবর্তনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল, প্রকৃতিতে সৃষ্টির উৎকর্ষ সাধন। ডারউইনের মতে প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য সার্বক্ষণিক একটি সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রামে শক্তিশালীরা সবসময় দুর্বলের উপর বিজয়ী হয় আর এর ফলে সম্ভব হয় উন্নতি। ডারউইনের বই ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ এর সাবটাইটেলে এই কথাটিকে পেশ করা হয়েছে এভাবে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রজাতির উৎপত্তি বা জীবনযুদ্ধে উপযুক্ত জাতির সংরক্ষণ’।
এ ব্যাপারে ডারউইন থমাস ম্যালথাসের বই An Esssay on the Principle of Population থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। এই বইতে দেখানো হয় যে মানবজাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ম্যালথাস গণনা করেছিলেন যে, মানবজাতিকে তার নিজের ওপর ছেড়ে দিলে এরা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। প্রতি ২৫ বছরে সংখ্যাটি দ্বিগুন হতে থাকবে। কিন্তু খাদ্য সরবরাহ কোন ভাবেই সে হারে বাড়বে না। এই তত্ত্বানুসারে, এই অবস্থায় মানবজাতি অপরিবর্তনীয় ক্ষুধামন্দায় পতিত হওয়ার বিপদের সম্মুখীন ছিল। যে সকল শক্তি মানবজাতির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করছিল তা হল প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন যুদ্ধ, দূর্ভিক্ষ এবং রোগব্যাধি। সংক্ষেপে, কিছু মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন ছিল অপরকিছু মানুষের মৃত্যু। বাঁচার অর্থ বলতে বুঝাতো ‘সার্বক্ষাণিক যুদ্ধ’। ডারউইন ঘোষণা করেন যে ম্যালথাসের বই থেকে প্রভাবিত হয়েই তিনি ‘বাঁচার জন্য সংগ্রামে’ ধারণা প্রদান করেন। তিনি বাঁচার জন্য সংগ্রামের ধারণাকে সকল প্রাণ সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ এর ক্ষেত্রে তথা পুরো প্রকৃতিতে প্রয়োগ করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ম্যালথাসের চিন্তাধারা ইউরোপের ওপরের শ্রেণীর লোকদের প্রভাবিত করে। তারা গরীব ও নীচু শ্রেণীর তথা অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ লোকদের সংখ্যা কমানোর জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের চিন্তাভাবনা শুরু করে। এরই ফলশ্রুতিতে ইংল্যাণ্ডে কমবয়সী শ্রমিকদের দৈনিক তিন-চতুর্থাংশ সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়। গরিব লোকদের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের পরিবর্তে কীভাবে আরও নোংরা পরিবেশে রাখা যায় তার ব্যবস্থা করা হয়।
বংশবৃদ্ধি করতে থাকলে ক্রমান্বয়ে আরও শক্তিশালী মানবজাতির আবির্ভাব হবে এরূপ ডারউইনবাদী ধারণার বশবর্তী হয়ে হিটলার ইউজেনিক্সের নীতি অবলম্বন করে যেখানে পঙ্গু ও মানসিক ভারসাম্যহীনদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ডারউইনবাদী নীতির ফলেই ইউরোপিয়ান সাদা চামড়ার লোকেরা আফ্রিকান নিগ্রো, রেড ইণ্ডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদেরেকে পশ্চাৎপদ বা অনগ্রসর (underdeveloped) আখ্যায়িত করে এবং তাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিবর্তনবাদ বস্তুবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের ভিত্তিকে শক্ত করে। [৪০] ডারউইনবাদের ফলে যখন এ ধারণা প্রগাঢ় হয় যে, বস্তু থেকে পর্যায়ক্রমে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে, তখন ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়। ধর্মকে মানব রচিত বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা ধর্মকে আফিম বলতেও দ্বিধান্বিত হননি। অন্যকথায়, ডারউইনবাদের প্রবর্তনের ফলেই মানুষে মানুষে হানাহানি বৃদ্ধি পায়, যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হয়, মানুষের মধ্য হতে দয়া অনুগ্রহ ও সহানুভূতি হ্রাস পায় এবং মানুষের নৈতিকতার চরম অধঃপতন ঘটে। [২৬]
তৌফিক এ কথা শুনে শিওরে উঠলো, ডারউইনবাদের ভয়াবহতা বুঝতে সক্ষম হল এবং তার মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর যেন পরিস্কার হয়ে যেতে থাকলো। রাকীব বলল, “আমি চিন্তা করে দেখলাম, মানব ইতিহাসকে বিবর্তনবাদীরা সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করেছে। তাদের ধারণা এই যে মানুষ এক সময়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, এরপর দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে শেখে। এ সময়ে তারা শিকার জীবিকা নির্বাহ করত, তখন ছিল প্রস্তর যুগ। পর্যায়ক্রমে আসে ব্রোঞ্জযুগ, তারপর লৌহযুগ। মানুষ যখন প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখে তখন থেকে সভ্যতার সূচনা হয়। যে সকল ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে এ সব হয় তাতে সাধারণত অকাট্য কিছু যুক্তিকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। যেমন: লোহা দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায়। সুতরাং তথাকথিত প্রস্তুর যুগে লোহা ব্যবহার হয়ে থাকলেও তা পাওয়া যাবে না। আবার ব্রোঞ্জ তৈরির জ্ঞানতো লোহা ব্যবহারের জ্ঞানের চেয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা। সে হিসেবে লৌহযুগ ব্রোঞ্জেরে যুগের আগে আসার কথা, পরে নয়। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রস্তরযুগের মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন পাথর কিংবা হাড় নির্মিত অলংকার ও যন্ত্রপাতি দেখলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এসব জিনিসের নিখুঁত গঠন ও ডিজাইন করতে হলে পাথর হতে মজবুত কোন পদার্থ যেমন, লোহা বা স্টিলের তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু যেহেতু লোহা দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায় সেহেতু সে যন্ত্রগুলো এখন আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অথচ বিবর্তনবাদীরা এ সকল অকাট্য যুক্তি সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। আবার বিবর্তনবাদীরা বিভিন্ন গুহায়প্রাপ্ত বিভিন্ন অঙ্কন দেখে বলে যে, এগুলো আদিম গুহা মানবদের তৈরী। সে চিত্রগুলো আঁকতে যে রঙ ব্যবহার করা হয়েছে তা এমনকি রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ যে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পার হয়ে যাওয়া এবং যে সাদৃশ্যজ্ঞান পাওয়া যায় তা শুধুমাত্র অত্যন্ত দক্ষ ও শিক্ষিত শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। [৩৪]
উপর থেকে নিচে প্রদর্শিত প্রথম ছবিটির ব্রেসলেটদ্বয়ের বাম পাশেরটি মার্বেল দিয়ে তৈরী এবং ডান পাশেরটি তৈরী ব্যাসাল্ট দিয়ে। এ দুটোর সময়কাল হলো ৮৫০০ এবং ৯০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। বিবর্তনবাদীরা দাবি করেন সে সময় শুধু পাথর নির্মিত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ব্যাসাল্ট এবং মার্বেল অত্যন্ত কঠিন বস্তু। এগুলোকে বাঁকা এবং গোল করে সংযোগ করতে অবশ্যই স্টিলের ব্লেড ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। স্টিলের যন্ত্রপতি ছাড়া এগুলোকে কাটা ও নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়া অসম্ভব। আপনি যদি কাউকে একটি পাথরের তৈরী যন্ত্র দেন এবং তাকে দেয়া ব্যাসাল্ট থেকে উপরের মতো ব্রেসলেট তৈরী করতে বলেন তারা কতটুকু সফল হবে? একটা পাথরকে আরেকটার সাথে ঘষলে অথবা একটিকে অপরটার সাথে সংঘর্ষ করালে নিশ্চয়ই অনুরূপ কোন ব্রেসলেট তৈরী হবে না। বরং উপরে প্রদর্শিত আর্টিফেক্টগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে এগুলো যারা তৈরী করতো তাদের যথেষ্ট সৌন্দর্য্যবোধও ছিল। মাঝখানের এবং সবচেয়ে নিচের ছবি দুটিতে হাড় ও অবিসিডিয়ানের তৈরী হস্তশিল্প, আংটা ও পাথর নির্মিত বিভিন্ন বস্তু দেখা যাচ্ছে। স্পষ্টতই, কেউ এ ধরণের সুগঠিত আকার শুধুমাত্র পাথর দিয়ে কাঁচামাল আঘাত করে প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে না। আঘাতে হাড় ভেঙ্গে যাবে। ফলে, প্রত্যাশিত গঠনটি পাওয়া যাবে না। একইরূপে, গ্রানাইট এবং ব্যসাল্টের মতো সর্বাধিক শক্তিশালী পাথর দিয়ে নির্মিত যন্ত্র দিয়েও তীক্ষ্ণ ও ধারালো পার্শ্ব ও সূচালো প্রান্ত তৈরী করা সম্ভব নয়। এই পাথরগুলো ফল কাটার মতই খুব নিয়মিত ভাবে কাটা হয়েছে। এদের উজ্জ্বলতা এদেরকে পালিশ করার ফলেই হয়েছে। যারা এইগুলো তৈল করেছে তাদের কাছে এর জন্য প্রয়োজনীয় স্টীল কিংবা লোহার মাধ্যম অবশ্যই ছিল। শক্ত পাথরের খণ্ডকে অনুরূপ সুচারুপে কাটা শুধুমাত্র এর চেয়ে মজবুত ও ধারালো কোন পদার্থ যেমন স্টিলের পক্ষে সম্ভব।
এটা সুস্পষ্ট যে, মানব ইতিহাসে প্রস্তরযুগ লৌহযুগের ধারাবাহিতকতা আনার চেষ্টা করা হয় বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যই। প্রকৃতপক্ষে, না ছিল প্রস্তরযুগ না ছিল আদিম মানুষ। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে সকল মানবজাতি প্রাথমিকভাবে সভ্য ছিল। কিন্তু আমার ধারণা পরবর্তীতে তাদের নিকট প্রেরিত রাসূলদের অনুসরণ না করার কারণে স্রষ্টা তাদেরকে অসভ্য ও আদিম বানিয়ে দিয়েছেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের অস্তিত্ব যখন পৃথিবীর জন্য হুমকিরস্বরূপ হয়ে গেছে তখন তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।”
ওমর ভাই বললেন, “বস্তবাদী, ভোগবাদী দর্শনকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য বিবর্তনবাদকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ১৯৬৬ সালের এক রিপোর্টে Confession of a Professed Atheist শীর্ষক প্রবন্ধে Aldous Huxley নিজেই স্বীকার করেছেন: ‘পৃথিবীকে না বুঝবারই ইচ্ছা আমার ছিল। পরিণতি হিসেবে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, এ ধারণা কারোর নেই এবং ধারণার যথেষ্ট কারণ বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না। আমার নিজের কথাই বলি, আমার অধিকাংশ সমসাময়িক লোকের কোনই সন্দেহ নেই যে, অর্থহীনতাই ছিল মুক্তি লাভের একটা অপরিহার্য হাতিয়ার। আমরা যুগপৎ নিষ্কৃতি চেয়েছিলাম বিশেষ ধরণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে এবং এক বিশেষ ধরণের নৈতিকতা থেকে। আমরা নৈতিকতা ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছি। কেন না তা আমাদের যৌন স্বাধীনতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছিলো।’ মাওলানা আব্দুর রহীম হাক্সলির এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে লিখেন- ‘বস্তুত নৈতিক বাধাবন্ধন ও বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছা ও প্রবণতাই হলো ক্রমবিকাশবাদে বিশ্বাস করার মৌল কারণ। আর ক্রমবিকাশ দর্শনে বিশ্বাসীদের-যারা নিজেদের ইতর প্রাণী ও হীন জীবজন্তুর বংশধর বলে মনে করে-কোন নৈতিকতাই থাকতে পারে না। বর্তমান দুনিয়ার ক্রমবিকাশবাদে বিশ্বাসীদের নৈতিক অবস্থা দেখলেই তা অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে।’ [২৭] কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের আবিস্কার ও সচেতন চিন্তাভাবনা এ বিষয়টি পরিস্কার করে তুলেছে যে, প্রতিটি প্রাণহীন বস্তু ও প্রতিটি জীবকেই সৃষ্টি করা হয়েছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভারসাম্যপূর্ণভাবে। অকাট্য ও খুঁতবিহীন পরিকল্পনার মাধ্যমে। তাই আমাদের উচিত সেই সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করা, যিনি আমাদের অর্থহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আর এ জন্য মহান আল্লাহ প্রেরিত ১৪০০ বছর ধরে অপরিবর্তিত লিটারারী মির্যাকল কোরআনতো আছেই, সাথে আছে হাদিসে রাসূল। এজন্যই আল্লাহ বলেন: “সত্য সমাগত এবং মিথ্যা অপসৃত। মিথ্যাতো অপসৃত হতে বাধ্য।” (আল কোরআন, বনী ইসরাইল, আয়াত ৮১)
তথ্যসূত্র:
[১] Harun Yahya, Darwinism Refuted, Goodword books, India, p.20.
[২] Ibid, p.20.
[৩] Ibid, p.22.
[৪] Harun Yahya, The Dark Spell of Darwinism, Global Pulishing, Turkey, p.11
[৫] Harun Yahya, The Religion of Darwinism: A pagan doctrine from ancient times prevalent until today, Abul-Qasim Publishing House, Jeddah, SA, p.11.
[৬] Ibid, p.19.
[৭] Ibid, p.20.
[৮] Ibid, p.21.
[৯] Ibid, p. 22.
[১০] Ibid, p.12.
[১১] Charles Darwin, The origin of species, W.R. Goyal publishers & distributors, India, p.159.
[১২] Robert L. Caroll, Pattern and Process of Vertebrate Evolution; Cambridge edition, p.151.
[১৩] Harun Yahya, Darwinism Refuted, Goodword books, India, p.54
[১৪] মাওলানা আব্দুর রহীম, বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, খায়রুন প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৪, পৃ.৫২.
[১৫] তাফহীমূল কোরআন, খণ্ড ১১শ, আধুনিক প্রকাশনী, পৃ.১৪৬.
[১৬] Harun Yahya, Darwinism Refuted, Goodword books, India, p.19.
[১৭] Ibid, p.193.
[১৮] Ibid, p.195, 196.
[১৯] Ibid, p.198.
[২০] Ibid, p.200.
[২১] Ibid, p.200.
[২২] Ibid, p.55.
[২৩] Ibid, p.55.
[২৪] মুহাম্মদ সিদ্দিক, বিবর্তনবাদ ও স্রষ্টাতত্ত্ব, মদীনা প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০০২।
[২৫] Harun Yahya, The Collapse of Theory of Evolution in 20 questions,Idarat Iswat-E-Diniyat publishers ltd, New Delhi, 2003, p.46.
[২৬] আরও জানতে পড়ুন: Harun Yahya, Disaster Darwinism Brought to Humanity, Al-Attique Publishers Inc. Canada, Canada, 2001.
[২৭] মাওলানা আব্দুর রহীম, বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, খায়রুন প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৪, পৃ.১৪৬.
[২৮] Harun Yahya, The Collapse of Theory of Evolution in 20 questions,Idarat Iswat-E-Diniyat publishers ltd, New Delhi, 2003, p.49.
[২৯] আবদুল্লাহ সাঈদ খান, বুক রিভিউ: Darwin’s Doubt; http://www.shodalap.org/saeeddmc/22298/
[৩০] পাভেল আহমেদ, বিবর্তনবাদ ও তার সমস্যা ১০ – সম্ভাবনার অসম্ভাব্যতা ৫ (বিশ্বজনীন সম্ভাব্যতার সীমা); http://www.shodalap.org/pavel/21326/
[৩১] Fred Hoyle, Chandra Wickramasinghe; Evolution from space; Sinor & schuter, New York. 1984, p.148.
[৩২] আরেকটু বিস্তারিত জানতে হারুন ইয়াহিয়ার Darwinism Refuted বইয়ের ১৪৭-১৮৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দেখুন।
[৩৩] William Samson Beck, Modern Science and the Nature of Life, McMillan Publishers, 1958, p.224
[৩৪] আরও জানতে পড়ুন- Harun Yahya, Stone Age: A Historical Life, Global publishing, Istambul, Turkey, 2006.
[৩৫] Kate Barlett, Piltdown Man: Britain’s Greatest Hoax; http://www.bbc.co.uk/history/ancient/archaeology/piltdown_man_01.shtml
[৩৬] Harun Yahya, Darwinism Refuted, Goodword books, India, p.187.
[৩৭] James Randerson, Fossil Ida: Extraordinary find is ‘missing link’ in human evolution; http://www.theguardian.com/science/2009/may/19/ida-fossil-missing-link
[৩৮] “MISSING LINK” FOUND: New Fossil Links Humans, Lemurs?; http://news.nationalgeographic.com/news/2009/05/090519-missing-link-found.html
[৩৯] The Nas’s Erros Regarding Neanderthal Man, The errors of National Academy of Science booklet; http://www.nationalacademyofsciencesrefuted.com/human_evolution_error.php
[৪০] শামস, ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স: গোড়ার কথা, http://www.shodalap.org/shams/7628/; এর প্রসার (১ম অংশ), http://www.shodalap.org/shams/7947/; এর প্রসার (২য় অংশ), http://www.shodalap.org/shams/8529/; সমাজতান্ত্রিক সম্পর্ক, http://www.shodalap.org/shams/9455/
চিত্রসূত্র: ব্লগে ব্যবহৃত চিত্রগুলোর অধিকাংশই ‘Darwinism Refuted’ বইটি থেকে এবং কিছু নেট থেকে সংগৃহীত।