আমি ভেবেছিলাম শুধু বাংলাদেশের নাস্তিকরাই বুঝি কলা বিভাগ থেকে বিজ্ঞান চর্চা করে। কিন্তু, সমগ্র পৃথিবীতেই যে এই ধরনের নাস্তিকের অভাব নেই, তার প্রমাণ পেলাম গত পরশু এক ফেসবুক পেইজ থেকে। ল্যাডবাইবেল নামক পেইজে একটা নিউজ শেয়ার করে যে এক চাইনিজ সার্জন Dr. Xiaoping Ren এবং ইতালিয়ান নিউরোসার্জন Dr. Sargio Canavero তাদের টিম সহ প্রথম সফলভাবে মানুষের মাথা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছেন। লিংকের নিচে কমেন্ট বক্সে দেখি আস্তিকতা নাস্তিকতার ঝড় উঠেছে।
যাই হোক, আমার কাছে মনে হল ‘There is something fishy’. কারণ, আপনি হেড ট্রান্সপ্ল্যান্ট করবেন, অথচ ওটা নিয়ে সায়েন্টিফিক জার্নালে কোন আর্টিকেল না ছাপিয়ে আগে সাংবাদিকদের ডেকে সম্মেলন করবেন, এটা অন্তত পশ্চিমা বিশ্বে সম্ভব না।
নিউজের ভিতরে ঢুকে দেখি ব্যপারটা আসলেই তাই। এক সার্জন একটা মৃত মানুষের মাথার সাথে আরেকটি মৃত মানুষের শরীর জাস্ট স্টিচ করেছে মাত্র, এর চেয়ে বেশী কিছু না। হ্যা, তাদের পরিকল্পনা আছে জীবিত মানুষকে নিয়ে করার। কিন্তু, আগে করুন। আর্টিকেল ছাপুন। আপনার ফেলো সায়েন্টিস্টদের বলুন এটা নিয়ে সমালোচনা করতে। তাদের সমালোচনার সফল উত্তর দিন। তারপর, দাবী করুন যে আপনি সফল ভাবে হেড ট্রান্সপ্ল্যান্ট (নাকি ‘বডি ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ কোনটা বলবেন?) করেছেন । অথচ, পত্রিকা ইতোমধ্যে প্রচার করছে সফল হেড ট্রান্সপ্ল্যান্ট। ‘সফলতার’ সংঙ্গা কোথায় গিয়ে নেমেছে?
আমি একটি মৃত হাতের সাথে আরেকটি মৃত হাতের কবজি লাগিয়ে যদি বলি সফল হাতের অপারেশন হয়েছে তাহলে কি আপনার আমার স্যানিটি নিয়ে প্রশ্ন রাখবেন না? যদি না রাখেন তাহলে আপনাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমার প্রশ্ন রাখতে হবে।
আরও বিস্ময়কর হল নাস্তিকদের এই তথাকথিক হাস্যকর সফলতার নিউজ নিয়ে উল্লম্ফন। স্টুপিডিটি ও মিথ্যাচারের লিমিটকেও ক্রস করে যাচ্ছে মিডিয়া এবং নাস্তিকরা।
অধিকন্তু, আপনি কেন মাথা ট্রান্সপ্ল্যান্ট বলছেন? আসলে তো বলার কথা বডি ট্রান্সপ্ল্যান্ট। কারণ, এখানে একজন জীবিত কিন্তু ঘাড় থেকে নিচ পর্যন্ত অকেজো মানুষের মাথার নিয়ে একজন ব্রেইন ডেড মানুষের ঘাড় থেকে নিচ পর্যন্ত শরীরটা লাগানো পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, জীবিত শরীরে ‘মাথা প্রতিস্থাপন’ কোন সহজ বিষয় না। সামান্য একটি কিডনী ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে গেলেও এইচ-এল-এ টাইপিং ম্যাচ করতে হয়। নাহলে শরীর উক্ত কিডনীকে রিজেক্ট করে। এমনকি এক ব্যাগ রক্ত দিতে গেলেও গ্রুপ মিলিয়ে নিতে হয়। আর, মাথা আসলে একটি অঙ্গ না, অনেকগুলো অঙ্গের সমষ্টি। ফলে একটি শরীর একটি মাথাকে রিজেক্ট করার সম্ভাবনা অনেক বেশী।
একজন মানুষের পা নষ্ট হয়ে গেলে যদি তার পা কেটে (অ্যাম্পিউট) করে ফেলা হয় তখনও তার কেটে ফেলা পায়ের মধ্যে সে ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। একে ‘ফ্যানটম লিম্ব পেইন’ বলে। অনুরুপ একজন মানুষের মাথার সাথে পুরো নতুন শরীর যুক্ত করলেও তার ব্রেইন উক্ত শরীরকে নিজের হিসেবে রেজিস্ট্রার করবে না, ফলে সে পুরো শরীরে এক্সক্রুসিয়েটিং পেইন অনুভব করবে এবং সে একসময় উক্ত বডিকে কেটে ফেলতে বলতে পারে।
ধরুন, আপনি আপনার সমস্ত ঘরের তার যেখানে একত্রিত হয়েছে ওগুলো কেটে দিয়ে আরেকটি ঘরে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের সাথে জাস্ট যুক্ত করে দিলেন, তাহলেই কি আপনার ঘরে ঠিকঠাক বিদ্যুৎ পাবেন? না, পাবেন না। কারণ, আপনার সুনির্দিষ্ট ভাবে সংযোগগুলো লাগাতে হবে। ঠিক একই ব্যাপার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও। স্পাইনাল কর্ডকে আপনি এরকম বিলিয়নের অধিক তারের সমষ্টি হিসেবে চিন্তা করতে পারেন। মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের সময় শুধুমাত্র একজনের স্পাইনাল কর্ডের সাথে আরেকজনেরটা বাইরে লাগিয়ে দেয়া হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে যেন সুনির্দিষ্ট ভাবে ও একা একাই প্রতিটি তার একটি আরেকটির সাথে লেগে যায়।
অথচ, অন্যান্য প্রাণীতে যে সকল তথাকথিত সফল হেড ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছিলো তাতে সর্বচ্চো সফলতা বলতে যেটা দেখা গেছে তা হল মাথাটা হয়তো শরীরের সাথে লেগে কয়েকদিন ( সর্বচ্চো বিশ দিন) বেঁচে ছিলো, কিন্তু স্পাইনাল কর্ড ঠিক মত জোড়া লাগেনি। ফলে, উক্ত প্রানী নড়াচড়াহীন অবস্থায়ই বেঁচে ছিলো অল্প কয়েকদিন।
সফল শরীর প্রতিস্থাপন আপনি তখনই বলতে পারেন যখন আপনি একজন স্পাইনাল এট্রফির মানুষের মাথা আরেকজনের বডির সাথে যুক্ত করার পর সে আরেকজনের বডিতে গিয়ে পুরোপুরি নাড়াচাড়া করতে পারবে এবং মাত্র ‘বিশ দিন’ বা ‘এক বছর’ বেঁচে থাকবে না, বরং অনেকদিন বেঁচে থাকবে কোন প্রকার কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র বা অন্যান্য সাপোর্ট ছাড়াই। আপনি যে স্পাইনাল এট্রফির মানুষটাকে মাথা কেটে অপারেশন করবেন, সে যদি বিশদিনের বেশী না বাঁচে, অথচ তাকে হয়ত কৃত্রিমভাবে স্টিফেন হকিং-এর মত অনেক দিন বাঁচানোর সুযোগ আছে, তাহলে যে ‘ইথিকাল’ ইমপ্লিকেশন তৈরী হয় সেদিকে কি লক্ষ্য রাখছেন? নাকি চাইনিজ মানুষের জন্য ইথিক্স নাই (যার ওপর সার্জারী করার চিন্তা করা হচ্ছে সে একজন চাইনিজ)।
চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আপনি এমন কিছু আবিস্কার করুন যাতে উক্ত স্পাইনাল এট্রফির-ব্যাক্তির স্পাইনাল কর্ড পুনরায় সচল হয়ে যায়। সেটা না করে ‘নাম-করার’ জন্য আপনি ‘কলা বিজ্ঞান’ করছেন বা ‘সাংবাদিক বিজ্ঞানী’ হয়ে যাচ্ছেন, এটাকে বিজ্ঞান বলে না, বলে অপ-বিজ্ঞান।