মলিকুলার বায়োলজির নতুন নতুন গবেষণা ও আবিস্কারের মধ্য দিয়ে পরিস্কার হয়ে গেছে যে ডিএনএ হচ্ছে তথ্য ধারণ করার একটি মাধ্যম যা জীবজগতের গঠনের তথ্য ধারণ করে। কোন ধরনের ‘র্যানডম’ প্রক্রিয়ায় যে ডিএনএ-তে ‘নতুন কার্যকরী’ তথ্য যোগ হয় না সেটিও পানির মত পরিস্কার। কিন্তু, তারপরও বিবর্তনবাদীরা কেন এই আবিস্কারগুলোকে সহজ ভাবে মেনে নিয়ে তাদের চিন্তাচেতনার আড়ষ্টতা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না?
প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যাবে ‘সেমেলওয়াইস রিফ্লেক্স’-এ। সেমেলওয়াইস রিফ্লেক্স হল বিজ্ঞানের জগতে প্রচলিত বিশ্বাস বা প্যারাডাইম-কে প্রশ্নবিদ্ধকারী নতুন জ্ঞানকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি।
১৮৪৬ সালের কথা। তখনও জীবাণু সংক্রমনের মাধ্যমে ইনফেকশন ছড়ানোর বিষয়টি অজ্ঞাত ছিলো। ভিয়েনা হাসপাতালের প্রসূতি মহিলাদের দুটো ক্লিনিক ছিলো। একটি ক্লিনিকে ‘চাইল্ডবেড ফিভার’-এর কারণে মাতৃমৃত্যু বেশী হচ্ছিল। অন্য ক্লিনিকে মাতৃমৃত্যু হার কম ছিলো।
ডা: ইগনাজ সেমেলওয়াইস উক্ত ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়লেন। তিনি গবেষণা করতে গিয়ে আবিস্কার করলেন যে, যে ক্লিনিকে মা’দের মৃত্যু বেশী হচ্ছিল ঐ ক্লিনিকের পাশেই মৃত লাশের ডিসেকশন করা হত এবং ঐ মৃত লাশ থেকেই ‘কিছু একটা’ চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীদের হাতকে অপরিস্কার করে দিচ্ছে যা থেকে মায়ের শরীরে ‘চাইল্ডবেড ফিভার’ ছড়িয়ে পড়ছে।
তিনি তার ছাত্র ও নার্সদের বলে দিলেন যেন তারা কাজ করার আগে তার আবিস্কৃত এন্টিসেপ্টিকদিয়ে হাত পরিস্কার করে ধুয়ে যায়। ফলে ১৮৪৮ সালে উক্ত ক্লিনিকে মাতৃমৃত্যুর হার ১১.৪ শতাংশ থেকে নেমে ১.২৭ শতাংশে চলে আসে। এরপরও তার কলিগ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং বৈজ্ঞানিক কমিউনিটি এই তত্ত্বটিকে মেনে নেয়নি। তাকে হাসপাতাল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিলো। কিন্তু, ২০ বছর পর বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর যখন ‘জীবাণু তত্ত্ব’ আবিস্কার করেন তখন বিজ্ঞানজগত বুঝতে পারে যে ডা: সেমেলওয়াইসি-এর আবিস্কার ঠিক ছিলো। (১)
ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিলো যখন আলফ্রেড ভেগনার ১৯১২ সালে প্রথম ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’ থিওরীর অবতারণা করেন। কন্টিডেন্টাল ড্রিফটতত্ত্ব মতে পৃথিবীর মহাদেশগুলো কতগুলো প্লেটের মত চলমান আছে। মহাদেশগুলোর ম্যাপ পাশাপাশি রাখলে সীমানাগুলো খাপে খাপে মিলে যায়। ভেগনার এটি লক্ষ্য করে তত্ত্বটি দেন, তবে এর বিস্তারিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি প্রথম কোন ধারণা দিতে পারেননি। ফলে, প্রথমদিকের ভুগোলবিদরা তার এই তত্ত্বকে রিজেক্ট করেন। কিন্ত, পরবর্তীতে আরও তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেলে তার এই তত্ত্ব সর্বসাধারনের (বিজ্ঞানী) মাঝে গৃহীত হয় এবং ‘প্লেট টেকটনিক’ নামক বিভাগের জন্ম হয়। (২) উইকিপিডিয়া বলছে:
“[W]ithout detailed evidence and a force sufficient to drive the movement, [Wegener’s] theory was not generally accepted: the Earth might have a solid crust and mantle and a liquid core, but there seemed to be no way that portions of the crust could move around. Distinguished scientists, such as Harold Jeffreys and Charles Schuchert, were outspoken critics of continental drift.” (৩)
বারবারা ম্যাকক্লিনটক ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী, প্ররিশ্রমী এবং ঠান্ডা মাথার বিজ্ঞানী। ভূট্টার বিভিন্ন প্রকরণ এবং ক্রোমোজোমের গঠন সম্পর্কে তার এত বেশী জ্ঞান ছিল যে ভূট্টার বিভিন্ন দানার রঙ্গের প্যাটার্ণের ভিত্তি করে তিনি বলে দিতে পারতেন যে ক্রোমোজমের ভিতর কি ধরনের জেনেটিক পুনর্গঠন হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, তিনি ভূট্টার ক্রোমোজমের উপর গবেষণা করছিলেন ১৯৪০ সালে এবং ডিএনএ আবিস্কার হয় আরও পরে ১৯৫৩ সালে।
ম্যাকক্লিনটক ট্রান্সপজিশন নামক একটি কোষীয় প্রক্রিয়া আবিস্কার করেন এবং এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান। ট্রান্সপজিশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোষ নিজে তার ডিএনএ-এর ক্ষতিগ্রস্থ অংশ পুনঃপ্রকৌশলের মাধ্যমে মেরামত করে। ম্যাকক্লিনটক ১৯৫১ সালে যখন কোল্ড স্প্রিং হারবর-এর একটি সিম্পোজিয়ামে এই অসাধারণ আবিস্কারটি বর্ণনা করছিলেন তখন বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়া ছিলো সেমেলওয়াইস রিফ্লেক্স-এর ন্যায়। অর্থাৎ, তারা তাদের সময়ের চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে থাকা এই তত্ত্বটিকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেনি। পরবর্তীতে ম্যাকক্লিনটকের কলিগ জেমস স্যাপিরো যখন ব্যাকটেরিয়াতেও একই প্রক্রিয়া আবিস্কার করেন তখন ‘ট্রান্সপজিশন’ তত্ত্বটি জনপ্রিয়তা পায়। (১)
খুবই সম্প্রতি একই ধরনের ঘটনা ঘটছে ‘বুদ্ধিদীপ্ত প্রকল্প তথা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ তত্ত্ব ও ‘তৃতীয় পথ তথা দ্য থার্ড ওয়ে’-এর প্রবক্তাদের বেলায়। ডারউইনবাদী বিজ্ঞানী এবং তার সাগরেদরা মাটি কামড়ে পড়ে আছে তাদের পুরোনো হয়ে যাওয়া ‘ডারউইনতত্ত্বে’ যার মূল বক্তব্য হল এলোপাতাড়ি (র্যানডম) মিউটিশনের মাধ্যমে ডিএনএ-তে নতুন তথ্য যোগ হচ্ছে এবং এর ফলে সৃষ্টি বৈচিত্রের কারণে বিবর্তন হচ্ছে। অথচ, অনিয়ন্ত্রিত এলোপাতাড়ি মিউটেশন সংক্রান্ত অসংখ্য পরিক্ষনিরীক্ষা এখন পর্যন্ত ডিএনএ-র ক্ষতি বৈ উপকার করতে পারেনি।
আমরা দেখলাম যে ডারউইনবাদী কর্তৃক তাদের তত্ত্বকে প্রশ্নবৃদ্ধকারী নতুন সত্যকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছা অভিনব কিছু নয়। একটি নতুন সত্য কখনও আগের তত্ত্বকে আকড়ে ধরে থাকা বিজ্ঞানীদের চিন্তাচেতনার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় না, প্রতিষ্ঠিত হয় তরুণ বিজ্ঞানীদের উক্ত তত্ত্ব গ্রহণ করা এবং পুরোনো বিজ্ঞানীদের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে। এটিকে বলে প্ল্যাঙ্ক’স প্রিন্সিপাল। আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাংক বলছেন:
“A new scientific truth does not triumph by convincing its opponents and making them see the light, but rather because its opponents eventually die and a new generation grows up that is familiar with it” — Max Planck, Scientific autobiography, 1950, p. 33 (৪)
যখন পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলে জ্ঞানের জগতে একটি নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টান্ত স্থানান্তর (প্যারাডাইম শিফট) হয় তখন তাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ থমাস কুন-এর ভাষায় বলা হয় ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব (Scientific revolution)’ । (৫)
মলিকুলার বায়োলজি, জেনেটিক্স, ইনফরমেশন থিওরী প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক শাখাগুলোর নতুন নতুন আবিস্কারের মধ্যদিয়ে এটি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীবজগত ডারউইনের সময়ে ধারণাকৃত কতগুলো ‘সরল’ কোষের সমন্বয়ে গঠিত নয়। এক একটি কোষ এক একটি বিস্ময় এবং তার ভিতরের জগৎটা আরো ‘প্রকৌশলী’ বিস্ময়ে ভরপুর। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও কোন এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ায় কোন ‘কোড’ তৈরী হয়ে যায়নি।
সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন, মানুষের ডিএনএ-এর ‘৯৮%’-কে আবর্জনা (জাংক) আখ্যাদানকারী (৬) বিবর্তনবাদীরা তাদের জরজীর্ণ চিন্তাচেতনা নিয়ে উটপাখির ন্যায় মাটির নিচে মাথা গুঁজে পড়ে থাকবে এবং তরুণ সতেজ মস্তিস্কের বিজ্ঞানীরা ‘ডিএনএ’-এর কোডের পিছনের কোডারকে সচেতনভাবে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাবে, যেদিন ডারউইনের বস্তবাদী প্যারডাইমকে শিফট করে ডিজাইনভিত্তিক ‘তৃতীয়’ প্যারাডাইম বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিবে। ইনশা আল্লাহ।
সেদিনের অপেক্ষায়…
রেফারেন্স:
১. Perry Marshall, Blade#1: Transposition-The 70-Year-Old Nobel prize-winning discovery, in ‘Evolution 2.0’ ২. David Klinghoffer, ‘How to Think About Minority Science Views — The Case of Plate Tectonics’. [Accessed: 01.11.2017] Available from:https://evolutionnews.org/…/how-to-think-about-minority-sc…/ ৩. ‘Development of the theory’ in ‘Plate tectonics’. [Accessed: 01.11.2017] Available from https://en.wikipedia.org/wiki/Plate_tectonics… ৪. ‘Planck’s principle’. [Accessed: 01.11.2017] Available from:https://en.wikipedia.org/wiki/Planck%27s_principle ৫. Thomas S. Kuhn, (1962) “The structure of scientific revolutions” ৬. Ohno S (1972) ‘So much “junk” DNA in our genome.’ In: Smith HH, editor. Evolution of Genetic Systems. New York: Gordon and Breach. pp. 366–370.
[বি.দ্র.: এই লেখাতে মূলত জীবজগতের গাঠনিক ভাষা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।]
ছোটবেলায় আমাদের অনেকের মা-বাবা আমাদের বর্ণমালা শেখানোর জন্য এক ধরণের খেলনা কিনে দিতেন। প্লাস্টিকের তৈরী চৌকা (বর্গক্ষেত্র) আকৃতির খেলনাগুলোতে বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষর লিখা থাকতো। উদ্দেশ্য, আমরা খেলাচ্ছলে বর্ণমালা শিখে নেবো। সাথে, বর্ণ ব্যবহার করে শব্দ গঠনও করতে পারবো।
ধরুন, আপনাকে এ ধরণের কয়েক সেট বর্ণমালা দেয়া হয়েছে। বর্ণমালায় স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জন বর্ণের পাশাপাশি ‘কার’ চিহ্নিত চৌকা আছে। এ অবস্থায় আপনি সবগুলো চৌকা হাতে নিয়ে যদি টেবিলে ফেলেন তাহলে কি অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে? অবশ্যই না। হ্যাঁ, হতে পারে অর্থপূর্ণ ছোট দু’একটি শব্দ হয়ে গেল। যেমন: বল, কলম ইত্যাদি। কিন্তু, শব্দে অক্ষরের এবং ‘কার’-এর সংখ্যা যতই বাড়বে ততই ‘বাই চান্স’ অর্থপূর্ণ শব্দ তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। যেমন: ‘আকাশ’ ও ‘হতবিহ্বল’ শব্দ দু’টিতে যথাক্রমে ৫টি ও ৭টি চৌকা লাগবে। অন্যদিকে, ‘বল’ ও ‘কলম’ শব্দ দু’টিতে যথাক্রমে ২টি ও ৩টি চৌকা লাগবে। ফলে, ‘আকাশ’ ও ‘হতবিহ্বল’ শব্দ দুটি বাই চান্স তথা র্যাণ্ডমলি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
আবার, চৌকাগুলো র্যাণ্ডমলি ফেললে যদি কতগুলো অর্থপূর্ণ শব্দ তৈরী হয়েও যায়, তথাপি তা একটি অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন করবে না। যেমন: মনে করি, টেবিলে দেখা গেলো ‘বল কলম আকাশ’, এটা কোন অর্থপূর্ণ বাক্য প্রকাশ করলো না। তবে, এক্ষেত্রেও ছোট ছোট অর্থপূর্ণ বাক্য প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। যেমন: আমি যাই। কিন্তু বাক্য যতই বড় হবে ততই র্যাণ্ডমলি তৈরী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে চৌকাগুলো র্যাণ্ডমলি ফেলে রাখা হয়েছে তাতে দু’অক্ষরের একাধিক অর্থপূর্ণ শব্দ (যেমন: GO, TO) পাওয়া যাচ্ছে। ভালমত খুঁজলে দু-একটি তিন অক্ষরের অর্থপূর্ণ শব্দও পাওয়া যেতে পারে। তবে, চার অক্ষরের যে শব্দটি (LOVE) ওপরের দিকে আছে, তা দেখামাত্রই বলে দেয়া যায় যে কেউ একজন এগুলো এভাবে সাজিয়েছে, র্যাণ্ডমলি হয়নি। চার অক্ষরের দুটো শব্দ মিলে যে শব্দটি (HAND-MADE) তৈরী করেছে সেটি র্যাণ্ডমলি হওয়া যে প্রায় অসম্ভব, তা বলাই বাহুল্য।
এবার মনে করুন, আপনার চৌকাগুলোতে এক বিশেষ ধরণের চুম্বক লাগানো আছে, যাতে আপনার চৌকাগুলোর একটি আরেকটির সাথে সুনির্দিষ্ট তথা স্পেসিফিক নিয়মে লেগে যাওয়ার প্রবণতা আছে। ধরি, ‘ক’ চিহ্নিত চৌকার প্রবণতা হলো ‘ল’ এর সাথে পাশাপাশি লেগে যাওয়া। তাহলে, এ ধরণের বর্ণমালা দিয়ে ‘বাই চান্স’ তো দূরে থাক, আপনি নিজে থেকে কি কোন শব্দ লিখতে পারবেন? উত্তর: না। কারণ, ‘ক’-এর পরে ‘স’ যুক্ত করতে প্রয়োজন হলেও আপনি আটকে যাবেন। কিন্তু, চৌকাগুলোর প্রবণতা যদি এমন হতো যে একটির সাথে আরেকটি স্পেসিফিক ভাবে না লেগে পাশাপাশি যেকোন বর্ণের সাথে হালকা ভাবে লাগে, তাহলে আপনার যেকোন শব্দ তৈরী করতে কোন সমস্যা হতো না এবং র্যাণ্ডমলি যে ছোট শব্দ বা বাক্যগুলো হতো সেগুলোও সাধারণ চৌকার মত বিচ্ছিন্ন না থেকে একটু লেগে থাকতো, অর্থাৎ স্থায়ী হতো। তবে এক্ষেত্রে ‘বাই চান্স’ হওয়া মানে আরেক সমস্যা। কারণ, দেখা যেত, যখনই ‘কলম’ লেখাটা তেরী হয়েছে পরক্ষণেই ‘ব’ এবং ‘শ’ বা অন্য যেকোন অক্ষর পাশে এসে ‘বকলমশ’ বানিয়ে ফেলেছে, তথা অর্থহীন করে ফেলেছে। অর্থাৎ, এমতাবস্থায় অর্থপূর্ণ শব্দগুলোকে পাশাপাশি রাখার জন্য একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির সার্বক্ষণিক অবস্থান প্রয়োজন হয়ে পড়ত।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে পারলাম তা হলো:
১. আমরা যদি কোন প্রক্রিয়ায় কোন তথ্য সংরক্ষণ করতে চাই, সেই প্রক্রিয়াটিতে এমন কতিপয় পৃথক পৃথক অংশ থাকবে যেগুলোকে যেকোন ভাবে সাজানো যায়।
২. উক্ত অংশগুলোর পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণ থাকতে পারে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট ‘আকর্ষণ’ থাকা যাবে না।
৩. এ ধরণের পৃথক পৃথক অংশগুলো র্যাণ্ডমলি যুক্ত হয়ে অর্থপূর্ণ কোন শব্দ এবং বাক্য গঠন করার একটি সীমা আছে। তবে, সেই সীমা খুবই সংকীর্ণ তথা ছোট।
এবার আসুন এ ধরণের একটি তথ্যসংরক্ষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানি যা প্রতিনিয়ত আমরা ব্যবহার করে চলেছি। তা হলো কম্পিউটার। হ্যাঁ, কম্পিউটারে ‘বাইনারী’ নাম্বার দিয়েই বিভিন্ন ধরণের তথ্য, যেমন: প্রোগ্রামের নির্দেশনা, ডকুমেন্ট, ইমেজ ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়।
আমরা জানি, আমরা যে অংক ব্যবহার করে হিসেব নিকেশ করি সেটি হলো ‘দশমিক’ বা ‘ডেসিমাল’ সংখ্যা। অর্থাৎ, ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গিয়ে এরপর আবার ১,২,৩.. যোগ করে তথা ১১, ১২, ১৩… এভাবে সংখ্যা গননা করতে থাকি। কিন্তু সংখ্যা গননা ইচ্ছা করলে এভাবেও করা যায়, ১,১১,১১১,১১১১,…..,১১১১১১১১১১ (তথা ১,২,৩,৪,…….১০)। একে বলে ‘ইউনারী’ সংখ্যা। এভাবে একশ লিখতে গেলে পরপর একশটি ১ বসাতে হবে। অর্থাৎ এভাবে হিসেব করা সহজ হলেও স্থান অনেক বেশী দরকার হয়ে পড়ে। আবার, সংখ্যাকে ‘দ্বিমিক’ বা ‘বাইনারী’ আকারেও প্রকাশ করা যায়। অর্থাৎ, ০,১,১০,১১,১০০,….১০১০ (তথা, ০,১,২,৩,৪,….১০)। দেখা যাচ্ছে এভাবে সংখ্যা প্রকাশ করলে যায়গা তুলনামূলক কম লাগছে। ‘দশমিক’ সংখ্যাকে ‘দ্বিমিক’ সংখ্যায় রূপান্তর করা যায় আবার বিপরীতটাও করা যায়।
লক্ষ্যণীয়, বিদ্যুতের উপস্থিতি অনুপস্থিতির উপর ভিত্তি করে আমরা ইচ্ছে করলে দ্বিমিক সংখ্যাকে সংরক্ষণ করতে পারি। সিলিকন ট্রানজিস্টরের মধ্যে এ ধরণের একটি পদ্ধতি তৈরী করা হয়। যেখানে বিদ্যুতের উপস্থিতি হচ্ছে ‘১’ এবং বিদ্যুতের অনুপস্থিতি ‘০’। এভাবে তৈরীকৃত অনেকগুলো ট্রানজিস্টরকে যদি একসাথে পাশাপাশি রাখা যায় তাহলে সেগুলোতে সংখ্যা সংরক্ষণ করা যাবে।
কিন্তু কতগুলো ট্রানজিস্টরকে একসাথে রেখে আমরা একটি ‘একক’ ধরবো? কারণ, যদি একটি ট্রানজিস্টরকে একক ধরি তাহলে মাত্র দুটো সংখ্যা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে ০ এবং ১। কিন্তু যদি ৮টি ট্রানজিস্টরকে একত্রে রাখা যায় তাহলে সর্বোচ্চ যে সংখ্যাটি রাখা যাবে তা হলো: ১১১১১১১১, দশমিকে যার মান ২৫৫। তুলনামূলক বড় সংখ্যা। আরও বেশী ট্রানজিস্টরকে একত্রে রাখা সম্ভব, কিন্তু সেক্ষেত্রে জায়গা বেশী লেগে যাবে। ফলে, সাধারণত ৮টি ট্রানজিস্টরকে একত্রে রাখা হয়। এর প্রতিটিকে এক ‘বিট’ বলে এবং পুরো ৮টি বিটকে একত্রে বলে ‘বাইট’।
চিত্রে একটি ৮ বিট শিফট রেজিস্টার দেখা যাচ্ছে। ৮ বিটের মেমোরী আইসিগুলোও (ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট) অনেকটা এভাবেই সাজানো হয়।
৮টি বিট দিয়ে না হয় সংখ্যা সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু, আমি যদি অক্ষর সংরক্ষণ করতে চাই? তা-ও সম্ভব। কীভাবে? এটা বুঝা যায়, সাংকেতিক ভাষা ব্যবহারের উদাহরণ থেকে। আমরা অনেকেই ছোট বেলায় এরকম খেলেছি যে, আমি একটি শব্দ লিখব তবে সে শব্দে ‘খ’ বলতে ‘ক’ বুঝাবো এবং এভাবে বর্ণমালার অক্ষরগুলোকে এক অক্ষর করে পিছিয়ে দেবো। এভাবে কোন শব্দ লিখলে আমি কী ধরণের নিয়ম ব্যবহার করেছি সেটি যে জানবে তার পক্ষে শব্দটির অর্থ বুঝা সহজ হবে। অর্থাৎ, আমরা ইচ্ছে করলে ‘ক’ বর্ণটিকে অন্য কিছু দিয়ে প্রকাশ করতে পারি। ঠিক একইভাবে, একটি বাইটের মধ্যে যদি বিভিন্নভাবে বর্ণমালাকে জুড়ে দেয়া যায় তাহলেও লেখা সংরক্ষণ করা যাবে। American Standard Code for Information Interchange, সংক্ষেপে ASCII হচ্ছে এ ধরণের একটি নীতিমালা যেটি অনুযায়ী কম্পিউটারের বিভিন্ন ইন্সট্রাকশনগুলো, যেমন: ‘কী-বোর্ডের’ বিভিন্ন ‘কী’-গুলো বাইনারী নাম্বারের সাথে চিহ্নায়িত করা থাকে। (http://www.ascii-code.com/) অর্থাৎ, আপনি যখন কী-বোর্ডে ‘A’ লিখেন, র্যামে তা ‘০১০০০০০১’ হিসেবে সংরক্ষিত হয়।
আমেরিকান স্ট্যাণ্ডার্ড কোড ফর ইনফরমেশন ইন্টারচেঞ্জ। লক্ষ্যণীয়, A-এর কোড হচ্ছে ‘1000001’। এখানে ৭টি বিট আছে। প্রথম বিটটিকে (তথা অষ্টম) রাখা হয় অংকের মাইনাস বা প্লাস বুঝানোর জন্য।
হার্ডডিস্কে কীভাবে সংরক্ষণ হয়? বিষয়টি খুবই মজার। আমরা জানি, চৌম্বক পদার্থগুলোর ভিতরে ডাইপোল থাকে। তড়িৎক্ষেত্র প্রবাহিত করে যেগুলোর পোলারিটি ঘুরিয়ে দেয়া যায়। এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘনকাকৃতির চৌম্বক পদার্থ (যেমন: হার্ডডিস্কে ব্যবহৃত কোবাল্ট ভিত্তিক সংকর ধাতু)-কে যদি পাশাপাশি সাজানো যায় তাহলেও বাইনারী ডিজিট সংরক্ষণ করা যাবে। সেক্ষেত্রে ধরুন: ‘>’-কে ‘এক’ এবং ‘<’ কে ‘শূণ্য’ ধরা হলো। সেক্ষেত্রে, ‘A’ লিখলে হার্ডডিস্কে তা ‘<><<<<<>’ এভাবে সংরক্ষিত থাকবে।
চিত্রে হার্ডডিস্কের কোবাল্ট বেজ্ড্ ম্যাগনেটিক অ্যালয় দিয়ে কীভাবে বাইনারী তথ্য রেকর্ড করা এবং পড়া হয় তা দেখা যাচ্ছে।
যাই হোক, এবার লক্ষ্য করুন, হার্ডডিস্কে কিংবা র্যামে আমরা ডাটা সংরক্ষণ করতে পারছি কারণ ডাটা সংরক্ষণের ক্ষুদ্র অংশগুলো পরস্পরের সাথে সুনিদিষ্ট আকর্ষণে আবদ্ধ নয়। স্পষ্টতই, হার্ডডিস্কের উপর দিয়ে যদি কোন র্যাণ্ডম ম্যাগনেটিক ঝড় বয়ে যায় সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য সংরক্ষণ হবে না। আবার, র্যাণ্ডম প্রক্রিয়ায় যদি একটি বিট পরিবর্তন হয়ে যায়, গুছানো তথ্য ধ্বংস হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সংক্ষিপ্ত সীমার বাইরে অর্থবহ তথ্য যুক্ত হবে না।
এবার চলুন আমরা এরকম আরও মজার একটি বর্ণমালা নিয়ে কথা বলি। হ্যাঁ, তা আর কিছু নয় জীবজগতের গাঠনিক ব্লুপ্রিন্ট সংরক্ষণকারী বর্ণমালা- ‘ডিএনএ’।
ডিএনএ-র বর্ণমালায় বর্ণ মাত্র চারটি এবং কোন যতি চিহ্ন নেই। এডেনিন (A), থায়ামিন (T), গুয়ানিন (G) এবং সাইটোসিন (C)। এই চারটি অণু এমন যে, এগুলো পরস্পর পাশাপাশি ফসফেট বন্ধনে যুক্ত হয়। কিন্তু, এই বন্ধনে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের পারস্পরিক স্পেসিফিক এফিনিটি কাজ করে না। স্পেসিফিক এফিনিটি কাজ করলে ডাটা সংরক্ষণ করা যায় না, উপরে আমরা তা দেখেছি। লক্ষ্যণীয় যে, উপরোক্ত প্রতিটি অনুকে বলে নাইট্রোজেন বেজ। উক্ত নাইট্রোজেন বেজগুলো ডিঅক্সিজেনেটেড রাইবোজ-এর সাথে সংযুক্ত থাকে, যাদেরকে বলে নিউক্লিওসাইড। প্রতিটি নিউক্লিওসাইডের রাইবোজ সুগারে ফসফেট যুক্ত হলে গঠিত হয় নিউক্লিওটাইড। মূলত এই নিউক্লিওটাইড-ই হলো ডি-অক্সিরাইবো-নিউক্লিইক-এসিড তথা ডিএনএ-র গাঠনিক একক। অর্থাৎ, এরকম একেকটি নিউক্লিওটাইড অণু পাশাপাশি যুক্ত হয়ে যে পলিনিউক্লিওটাইড চেইন গঠন করে তাকেই বলে ডিএনএ।
আমরা চিত্রটির ডানদিকে ডিএনএ ডাবল হেলিক্স-এর অংশ দেখতে পাচ্ছি। বামদিকে দেখানো হয়েছে যে, ডিএনএ-তে কীভাবে নিউক্লিওটাইডগুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়। লক্ষ্যণীয়, ডাবল হেলিক্স গঠনের ক্ষেত্রে পাশাপাশি দুটো চেইনের একটির A অপরটির T এর সাথে এবং একটির C অপরটির G এর সাথে ও ভাইস ভারসা হাইড্রোজেন বন্ধন দিয়ে যুক্ত হয়।
প্রশ্ন হলো, ATGC বর্ণগুলোকে তো বিভিন্ন ভাবে সাজানো যেতে পারে, সেক্ষেত্রে আমরা তথ্য সংরক্ষণের একক হিসেবে কোনটি ঠিক করবো? এটি নির্ভর করছে আমি কী ধরণের তথ্য সংরক্ষণ করতে চাই এবং কী ধরণের ‘সংকেত’ চিহ্নিত করতে চাই তার উপর। উপরের কম্পিউটারের উদাহরণে আমরা দেখেছি, বাইনারী ডিজিটে বর্ণ দুটি, ‘০’ এবং ‘১’। আমি যদি দুটি নিয়ে একক করি তাহলে সাজানো যাবে এইভাবে: ০০,০১,১০,১১; তিনটি করে নিলে: ০০০,০০১,০১০,০১১,১০০,১০১,১১০,১১১; অর্থাৎ খুব বেশী সংকেত চিহ্নিত করা যাবে না। অন্যদিকে, আমি যেহেতু অনেকগুলো পৃথক নির্দেশনা বা অক্ষর চিহ্নিত করতে চাচ্ছি, সেহেতু ‘একক’টি এমন হলে ভাল হয় যে বেশী বড়ও না আবার এমন ছোটও না যে সবগুলো সংকেত সংরক্ষণ করা যাবে না। এ হিসেবে কম্পিউটারের একক হলো ‘০০০০০০০০’ তথা ‘৮’ বিট।
ডিএনএ-র ক্ষেত্রে আমার সংকেতগুলো হলো অ্যামাইনো এসিড। যদিও প্রকৃতিতে অনেক অ্যামাইনো এসিড আছে, আমি বিশটির বেশী ব্যবহার করবো না। এখন, ATGC থেকে যদি দুটো করে বর্ণ নিই, তাহলে মাত্র ষোল ভাবে সাজানো যায়: AA,AT,AG,AC,TA,TT,TG,TC,GA,GT,GG,GC,CA,CT,CG এবং CC। অর্থাৎ বিশটি অ্যামাইনো এসিডকে নির্দেশিত করতে পারছি না। চারটি করে নিলে সাজানো যাবে ২৫৬ ভাবে। এত বেশী একক আমার প্রয়োজন পড়ছে না। তদুপরি, চারটি করে সাজালে আমার জায়গা বেশী লেগে যাচ্ছে। কিন্তু, তিনটি করে নিলে ৬৪ উপায়ে সাজানো যায়। এ প্রক্রিয়ায় ২০টি অ্যামাইনো এসিডকে খুব সহজেই চিহ্নায়িত করা যাচ্ছে। এছাড়াও, অনেকগুলো অ্যামাইনো এসিডকে আমি একাধিক ‘কোডন’ দিয়ে চিহ্নিত করতে পারছি। (লক্ষ্যণীয়, ডিএনএ-তে ৩টি অক্ষরের এই একককে কোডন বলে)।
প্রশ্ন হলো, আমি একটি অ্যামাইনো এসিডের বিপরীতে কোন্ কোডনকে চিহ্নায়িত করবো? যেমন: GGG কোড করে গ্লাইসিনকে, GAG কোড করে গ্লুটামিক এসিডকে। কিন্তু, GGG এলানিনকে কোড না করে গ্লাইসিনকে কোড করবে এটা কেন নির্ধারণ করবো? ওয়েল, এক্ষেত্রে আমার পরিকল্পনা হবে কোষ বিভাজন হওয়াকালীন ডিএনএ কপি করার সময় যদি র্যাণ্ডমলি একটি অক্ষর পরিবর্তন হয়ে যায় (মিউটেশন) সেক্ষেত্রে অ্যামাইনো এসিড যেন পরিবর্তন না হয় (সাইলেন্ট মিউটেশন)। আবার, বিশ ধরণের অ্যামাইনো এসিডে কতগুলো পোলার, কতগুলো নন-পোলার, কতগুলো এসিডিক এবং কতগুলো বেসিক, কতগুলোতে ‘রিং’ আকৃতির সাইড চেইন আছে কতগুলোতে নেই। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন নির্মাণ এবং ফাংশন নির্ধারণে এই বিভিন্ন ধরণের অ্যামাইনো এসিডগুলোর সুনির্দিষ্ট গাঠনিক ও রাসায়নিক ভূমিকা আছে। এ কারণে আমি চেষ্টা করবো কোডনগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করতে যেন মিউটেশনের কারণে যদি অ্যামাইনো এসিড পরিবর্তন হয়েও যায়, তথাপি যেন একই ধরণের অন্য একটি এমাইনো এসিডে পরিবর্তন হয়। মজার বিষয় হলো, জীবজগতে যে কোডন পাওয়া গেছে তা এই ধরণের বৈশিষ্ট্যগুলোকে মাথায় রেখে নির্ধারণ করা হয়েছে। তদুপরি, জীবজগতের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই কোডনের নীতিমালা সুনির্দিষ্ট অর্থাৎ ইউনিভার্সাল। কারণটা খুব সহজ- একাধিক ভাষা ব্যবহার করার চেয়ে একটি ভাষা ব্যবহার করাই সুবিধাজনক।
উপরে আমরা ইউনিভার্সাল জেনেটিক কোডের চার্ট দেখতে পাচ্ছি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোডন সিস্টেমটি এমনভাবে সিলেক্ট করা হয়েছে যেন মিউটেশনের ইফেক্ট সর্বোচ্চ মিনিমাইজ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ফিনাইল এলানিনকে (Phe) কোড করে UUU এবং UUC। অর্থাৎ UUU মিউটেশন হয়ে UUC হয়ে গেলেও এমাইনো এসিড একই থাকবে। আবার, যদি UUU পরিবর্তন হয়ে UAU হয়ে যায় তাহলে ফিনাইল এলানিন পরিবর্তন হয়ে টাইরোসিন (Tyr) হবে, যা কাছাকাছি গঠনযুক্ত। কিংবা, যদি CUU হয়ে যায় সেক্ষেত্রে হচ্ছে লিউসিন (Leu)। এটিও ত্রিমাত্রিক গঠনের দিক দিয়ে ফিনাইল এলানিনের কাছাকাছি।
এই যে একটি কোডনের সাথে একটি অ্যামাইনো এসিডকে আমি ‘অ্যাসাইন’ করছি, তা কি র্যাণ্ডমলি একা একা হতে পারবে? যে কোন সচেতন পাঠকের কাছে পরিস্কার যে তা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে, একটি বিষয়ের সাথে আরেকটি বিষয়কে এসাইন বা সম্পর্কযুক্ত করার তথা একটি বিষয়ে আরেকটি বিষয়ের অর্থ নির্ধারণ করে দেয়া ‘বুদ্ধিমান’ স্বত্তার কাজ। কোন অন্ধ প্রক্রিয়ায় তা কখনও হয় না। এর মধ্যে আবার তা যদি হয় ‘অপটিমাম’ বা ‘বেস্ট’ কোডন নির্ণয় করা, তাহলে তো আরও সম্ভব নয়।
এছাড়াও, এই বর্ণগুলো যদি পরস্পরের সাথে স্পেসিফিক এফিনিটি দেখাতো তাহলেও তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো না। অর্থাৎ, A কেবল G-এর পাশে বসতে পারবে, C কেবল T-এর পাশে বসতে পারবে, অণুগুলোর রাসায়নিক আসক্তি এমন হলে তা কোন অ্যামাইনো এসিডকে কোড করতে পারতো না।
এবারে আসি প্রোটিনের কথায়। প্রোটিনকেও আরেক ধরণের ভাষা বলা যায় যার বর্ণমালায় বর্ণ আছে ২০টি। পোলারিটি, অম্ল-ক্ষার বৈশিষ্ট্য, বেনজিন রিং-এর উপস্থিতি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের আলোকে প্রতিটি অ্যামাইনো এসিড বর্ণ বিভিন্ন অর্থ ধারণ করে। আর এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে তৈরী হয় একেকটি বাক্য তথা অ্যামাইনো এসিডের সরলরৈখিক সিকোয়েন্স। একে আবার প্রোটিনের প্রাইমারী স্ট্রাকচার বলা হয়। উক্ত সিকোয়েন্স, অ্যামাইনো এসিডের বিভিন্ন মাত্রার কেমিক্যাল এফিনিটির উপর ভিত্তি করে আলফা হেলিক্স, বিটা শিট ইত্যাদি বিশেষায়িত গঠন তৈরী করার মধ্য দিয়ে প্রোটিনের সেকেণ্ডারী স্ট্রাকচার তৈরী করে। এরপর, নির্দিষ্ট আকৃতিতে ভাঁজ (ফোল্ড) হয়ে তৈরী করে সুনির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিক গঠন বা টারসিয়ারী স্ট্রাকচার। এ রকম দুটো বা ততোধিক প্রোটিন সমন্বয়ে তৈরী হয় কোয়ার্টারনারী স্ট্রাকচার। এনজাইমগুলো সাধারণত একটি প্রোটিন দিয়ে গঠিত হয়, আর বিভিন্ন গাঠনিক কাঠামো যেমন: আয়ন চ্যানেল তৈরী হয় একাধিক প্রোটিনের সমন্বয়ে।
ইলাস্ট্রেশনটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি জীবজগতে প্রাপ্ত ২১ ধরণের এমাইনো এসিড। তন্মধ্যে, সেলেনোসিস্টিন অল্প কিছু বিশেষায়িত প্রোটিনে পাওয়া যায় বিধায় সাধারণভাবে প্রোটিনের গাঠনিক একক পড়ার সময় এর উল্লেখ দেখা যায় না।
লক্ষ্যণীয়, কম্পিউটারের ভাষার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি বাইনারী ভাষা দিয়ে ইংরেজী ভাষা সংরক্ষণ করা হয়। অন্যকথায়, একটি ভাষা দিয়ে আরেকটি ভাষা সংরক্ষণ করা যায়। তেমনি প্রোটিনের ভাষাকে সংরক্ষণ করে ডিএনএ-র ভাষা। আরও লক্ষ্যনীয়, প্রোটিনের ভাষায় বর্ণ ২০টি হওয়ায় এবং উক্ত বর্ণগুলোর আণবিক বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন হওয়ায় ভাব প্রকাশের সীমানা অনেক বেড়ে গেলো। অর্থাৎ প্রোটিনের ২০টি অণু দিয়ে অনেক বৈচিত্রপূর্ণ ত্রিমাত্রিক গঠন সম্ভব। ফলে, প্রোটিন এনজাইম থেকে শুরু করে কোষের বিভিন্ন গাঠনিক উপাদান তৈরীতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু, ডিএনএ-র বর্ণমালার বর্ণের আণবিক বৈশিষ্ট্য ও সংখ্যা সীমিত হওয়ায় ডিএনএ বৈচিত্রপূর্ণ ত্রিমাত্রিক গঠন তৈরী করতে পারে না।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে কীভাবে অ্যামাইনো এসিডগুলো একটার পাশে আরেকটা যুক্ত হয়ে চূড়ান্ত ত্রিমাত্রিক প্রোটিন তৈরী করে। বিষয়টি যত সহজ শুনতে ততটাই কঠিন বাস্তবে, কী বলেন?
আমরা জানি, ডিএনএ-তে দুটি পলিনিউক্লিওটাইড চেইন পাশাপাশি থেকে প্যাঁচানো মই-এর মত গঠন তৈরী করে, যাকে ইংরেজীতে বলে ডাবল হেলিক্স। ডিএনএ থেকে প্রোটিন তৈরীর প্রক্রিয়ায় প্রথমে ডিএনএ থেকে সম্পূরক ম্যাসেঞ্জার আরএনএ তৈরী হয়। এ প্রক্রিয়ায় শুরুতে ডিএনএ ডাবল হেলিক্স এর মধ্যে বন্ধন খুলে একটি চেইনকে পড়ার জন্য উন্মুক্ত করতে হয়। এ প্রক্রিয়াটি করে একটি বিশেষায়িত প্রোটিন তথা এনজাইম। এরপর আরেকটি বিশেষায়িত এনজাইম এসে উক্ত চেইনকে পড়ে সম্পূরক আরএনএ চেইন তৈরী করে। অতঃপর, একটি এনজাইম লাগে উন্মুক্ত করা অংশ পুনরায় জোড়া লাগাতে, একটি এনজাইম লাগে প্রুফ রিড করতে, দুটি লাগে জোড়া লাগানোর সময় বেশী পেঁচিয়ে গেলে প্যাঁচ খুলতে। প্রসঙ্গত, আরএনএ-এর সাথে ডিএনএ-র পার্থক্য হল- আরএনএ-এর নিউক্লিওটাইডে তথা আরএনএ-র বর্ণমালার অক্ষরগুলোতে একটি অক্সিজেন অণু বেশী থাকে এবং আরএনএ-তে থাইমিনের (T) পরিবর্তে ইউরাসিল (U) থাকে। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, তথ্য পরিবহন করে নেয়ার জন্য ডিএনএ-র পরিবর্তে আরএনএ-কে কেন বাছাই করা দরকার হলো? একটি উত্তর হলো, যে পদ্ধতিটির মধ্যে আমি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রাখতে চাই স্বাভাবিক ভাবেই তাকে আমি আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে চাইব। তদুপরি, আরএনএ-র আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি ডিএনএ-র চেয়ে একটু বেশী বৈচিত্রের গঠন তৈরী করতে পারে।
এক নজরে ডিএনএ থেকে প্রোটিন সংশ্লেষ পদ্ধতি। ছবিটিতে সংশ্লেষের কাজে অংশগ্রহণকারী এনজাইমগুলোকে দেখানো হয়নি।
এরপর, ম্যাসেঞ্জার আরএনএ থেকে রাইবোজোম নামক আণবিক মেশিনের সহায়তায় প্রোটিন সংশ্লেষ হয়। রাইবোজোম নামক মেশিনটি তৈরী হয় রাইবোজোমাল আরএনএ ও অনেকগুলো প্রোটিনের সমন্বয়ে। প্রোটিন তৈরীর প্রক্রিয়ায় আর এক ধরণের আরএনএ সাহায্য করে- ট্রান্সফার আরএনএ বা টি-আরএনএ । এদের কাজ হলো রাইবোজোমের কাছে অ্যামাইনো এসিড বহন করে নিয়ে যাওয়া। বিশটি অ্যামাইনো এসিডের জন্য এরকম বিশ ধরণের সুনির্দিষ্ট ট্রান্সফার আরএনএ থাকে। আবার, প্রত্যেক ধরণের টি-আরএনএ-র সাথে তৎসংশ্লিষ্ট অ্যামাইনো এসিড সংযুক্ত করার জন্য বিশটি সুনির্দিষ্ট ও পৃথক এনজাইম (অ্যামাইনো এসাইল ট্রান্সফারেজ) থাকে। এছাড়াও, রাইবোজোমে দুটো পাশাপাশি অ্যামাইনো এসিডের বন্ধন তৈরী করার জন্য কাজ করে আলাদা এনজাইম।
উপরের বর্ণনা থেকে লক্ষ্যণীয়, ডিএনএ-তে প্রোটিন তৈরী তথ্য ধারণ করা থাকে। আবার, উক্ত তথ্যকে কাজে লাগিয়ে প্রোটিন তৈরী করার জন্য দরকার অনেকগুলো আরএনএ এবং সুনির্দিষ্ট প্রোটিন (এনজাইম)। যদি প্রশ্ন করা হয়, কীভাবে আদিম পরিবেশে কোষের উদ্ভব হল? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, কোন্টা আগে আসলো- ডিএনএ নাকি প্রোটিন নাকি আরএনএ? আমরা দেখছি তিনটি জিনিস একসাথে ও পরস্পরজড়িতভাবে উদ্ভব না হলে এই সিস্টেমটি চালুই হচ্ছে না। ইনটুইটিভলি, কোন প্রকার র্যাণ্ডম অনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় তা সম্ভব নয়।
প্রোটিন (তথা এনজাইম) আগে আসবে? রিডিং টেমপ্লেট (অর্থাৎ ডিএনএ) না থাকলে প্রোটিন কাজ করবে কার উপর? তদুপরী, ১৫০টি অ্যামাইনো এসিড দিয়ে নির্মিত একটি মাঝারি সাইজের সুনির্দিষ্ট প্রোটিন আসাও গাণিতিকভাবে অসম্ভব একটি ব্যাপার। ডগলাস এক্স-এর হিসেবে অনুযায়ী এর সম্ভাব্যতা ১০১৬৪। [১] অন্যদিকে, বিল ডেম্বস্কি দেখিয়েছেন বিশ্বজনীন সম্ভাব্যতার সীমা ১০১৫০। [২] অর্থাৎ, যে কোন র্যাণ্ডম ঘটনা এই সীমাকে ছাড়িয়ে গেলে আমাদের মহাবিশ্বে তা ঘটার সম্ভাবনা নেই। একটি মাঝারি সাইজের প্রোটিনের এই অবস্থা। অথচ, আরএনএ পলিমারেজ এনজাইম ১০০০-এর বেশী অ্যামাইনো এসিড যুক্ত তিনটি প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
ডিএনএ আগে আসবে? ডিএনএ থেকে তথ্য পড়বে কে? যদি ডিএনএ অণু এমন কোন গঠন তৈরী করতে সক্ষম হত যা এনজাইমের মত কাজ করে তাহলেও চিন্তা করার সুযোগ থাকতো। কিন্তু, আমরা আগেই বলেছি ডিএনএ বৈচিত্রপূর্ণ গঠন তৈরী করতে পারে না। সুতরাং বাকী রইল আরএনএ। আরএনএ কি কেমিকেল এভল্যুশন তথা এবায়োজেনেসিসকে উদ্ধার করতে পারবে?
বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরীতে এমন এক ধরণের আরএনএ সংশ্লেষ করতে পেরেছেন যা নিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট পরিবেশে এনজাইম হিসেবে কাজ কোরে আরএনএ পলিমারাইজেশনেকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ, একটি সম্পূরক আরএনএ টেমপ্লেট-এর বিপরীতে নিউক্লিওটাইড (A এর বিপরীতে U, U এর বিপরীতে A, G এর বিপরীতে C, এবং C এর বিপরীতে G) যোগ করার মাধ্যমে নিজের একটি কপি তৈরী করতে পারে। এই বিশেষ ধরণের আরএনএকে বলে রাইবোজাইম। এর মাধ্যমে তারা বলতে চাচ্ছেন যে, আদিম পরিবেশে এ ধরণের একটি রাইবোজাইম আসার মাধ্যমে সেল্ফ-রেপ্লিকেশনের সূচনা হয়েছে এবং পরবর্তীতে ‘কোন একটি উপায়ে’ কোষের উপরোক্ত বর্ণিত বিষয়গুলো আবির্ভাব হয়েছে! যেকেউ একটু মাথা খাটালেই বুঝবে এ ধরণের চিন্তা কতখানি অ্যাবসার্ড! কিন্তু কেন?
এক, পৃথিবীর আদিম পরিবেশ ল্যাবরেটরীর মত নিয়ন্ত্রিত ছিলো না।
দুই, ‘রাইবোজাইম নিজের একটি কপি তৈরী করতে পারে’ এই অবস্থা থেকে ‘আরএনএ প্রোটিনের তথ্য ধারণ করে এবং তা প্রোটিন সংশ্লেষ করে’ এই অবস্থায় যাওয়ার কোন পথ নেই। কারণ, উপরে আমরা ডিএনএ-র ক্ষেত্রে যে রকম বলেছি ঠিক তেমনি কোন্ কোডনটি কোন্ অ্যামাইনো এসিডের জন্য নির্ধারিত হবে সেটি নির্বাচন করা একটি বুদ্ধিমান ‘মাইণ্ড’-এর কাজ। তদুপরি, যদি অপটিমাম ইউনিভার্সাল কোডনের জন্য র্যাণ্ডম অনুসন্ধান করা সম্ভবও হতো, সেক্ষেত্রে প্রতি সেকেণ্ডে ১০৫৫টি অনুসন্ধান চালাতে হতো। কিন্তু, বায়োফিজিসিস্ট হার্বাট ইওকি হিসেব করে দেখিয়েছেন র্যাণ্ডম অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় ১.৪০ x ১০৭০টি সম্ভাব্য কোডনের মধ্যে উক্ত অপটিমাম কোডন সিস্টেমকে খুঁজে বের করতে হবে এবং হাতে সময় পাওয়া যাবে ৬.৩ x ১০১৫ সেকেণ্ড। [৩] এছাড়াও, রাইবোজোমে যে প্রোটিন সিনথেসিস হয় তাতে অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট প্রোটিন ও আর-আরএনএ-র নির্দিষ্ট অবস্থানগত ও তড়িৎ-রাসায়নিক ভূমিকা আছে। অথচ, আরএনএ প্রোটিনগুলোর মত বিভিন্ন ধরণের স্ট্রাকচার গঠন করতে পারে না। কারণ, আরএনএ-র বর্ণ সংখ্যা সীমিত এবং বর্ণের কেমিক্যাল স্ট্রাকচারও অ্যামাইনো এসিডের ন্যায় বৈচিত্রপূর্ণ নয়।
তিন, রাইবোজাইম নিজের কপি করতে পারে তখনই যখন তার সম্পূরক একটি টেমপ্লেট থাকে। অর্থাৎ, আদিম পরিবেশে সেল্ফ রেপ্লিকেটিং রাইবোজাইম আসতে হলে রাইবোজাইম ও তার সম্পূরক টেমপ্লেট দুটো অণুরই একসাথে আসতে হবে। জনসন ও তার সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে, আংশিকভাবে নিজের কপি তৈরী করতে পারে এরকম একটি রাইবোজাইমের নিউক্লিওটাইডের সংখ্যা ১৮৯। সুতরাং, উক্ত স্পেসিফিক রাইবোজাইম এবং তৎসংশ্লিষ্ট সম্পূরক ও সুনির্দিষ্ট টেমপ্লেট-এর একসাথে আসার সম্ভাব্যতা ৪১৮৯ x ৪১৮৯ তথা ৪(১৮৯+১৮৯=৩৭৮) তথা প্রায় ১০২৭৭, যা বিশ্বজনীন সম্ভাব্যতার সীমা ১০১৫০ কে ছাড়িয়ে যায় (অর্থাৎ, অসম্ভব)। অথচ, পুরোপুরি কপি করতে পারে এরকম একটি রাইবোজাইমে নিউক্লিওটাইড সংখ্যা লাগবে আরও বেশী। অন্যদিকে, অর্গেল ও জয়েস দেখিয়েছেন যে, এরকম দুটি আরএনএ খুজে পাওয়ার জন্য ১০৪৮ টি অণু খুঁজতে হবে যা পৃথিবীর মোট ভরকে অতিক্রম করে যায়। [৪] অর্থাৎ, আমরা দেখতে পেলাম আরএনএ এবায়োজেনেসিসকে উদ্ধার করতে কোন অবস্থাতেই সক্ষম নয়।
উপরের দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা তথ্য প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ভাষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারলাম। ভাষার ব্যবহারে ইন্টেলিজেন্স-এর গুরুত্ব সম্পর্কে অভহিত হলাম। জীবজগতের ভাষার সৌষ্ঠব, বৈচিত্র ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম। পরিশেষে, এ সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হলাম যে, কোন প্রকার অন্ধ, র্যাণ্ডম, অনিয়ন্ত্রিত, বস্তুগত ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জীবজগতের ভাষার আগমন অসম্ভব এবং জীবজগতের ভাষার আগমন ঘটাতে দরকার একজন বুদ্ধিমান স্বত্তার কার্যক্রম।
রেফারেন্স: ১. Meyer SC. Signature in the Cell. HarperCollins Publisher Inc. 2009; Page: 172
২. Dembsky WA. The Design Inference. Cambridge University Press. 1998; Page: 209
৩. Rana F. The Cell’s Design. Baker Books. 2009; Page: 175
৪. Stephen C. Meyer. Signature in the Cell. HaperCollins Publisher Inc. 2009; Page: 250
বিবর্তনবাদীরা বিবর্তনের উদাহরণ দিতে গিয়ে এমন কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করেন যেগুলোকে মাইক্রোইভলুশন বলা যায়। কোন সন্দেহ নেই যে, ন্যাচারাল সিলেকশন এবং মিউটেশনের মধ্য দিয়ে মাইক্রোইভলুশন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দৃশ্যমান উদাহরণগুলো থেকে মাইক্রোইভলুশন ক্রমে ক্রমে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ম্যাক্রোইভলুশন করে- এই সিদ্ধান্তে আসা যাবে কি-না? চলুন, কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করি।
প্রথমেই জেনে নিই মাইক্রোইভলুশন এবং ম্যাক্রোইভলুশন কী? নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে আগেরটি ছোট ছোট পরিবর্তনকে বুঝায় এবং পরেরটি বড় পরিবর্তনকে বোঝায়। (সে হিসেবে আমরা এ প্রবন্ধে মাইক্রোইভলুশনকে ছোট-বিবর্তন এবং ম্যাক্রোইভলুশনকে বড়-বিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করব।)
এককোষী ও বহুকোষী জীবের সাপেক্ষে এ দু’টো প্রক্রিয়ার উদাহরণে পার্থক্য আছে। এককোষী জীব যেমন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তনের উদাহরণ হল: ব্যাকটেরিয়ায় ড্রাগ রেজিস্টেন্স তৈরী, এইচআইভি কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন-এর আগমন। অন্যদিকে, এককোষী জীবে বড়-বিবর্তনের উদাহরণ হবে, ফ্ল্যাজেলামবিহীন ব্যাকটেরিয়াতে ফ্ল্যাজেলার আগমন, কিংবা একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেকটি প্রজাতির (তথা ভিন্ন বাহ্যিক গঠনের) ব্যাকটেরিয়া তৈরী।
প্রসঙ্গত, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের তথা এককোষেী জীব ও বহুকোষী জীব যাদের যৌন প্রজনন হয় না তাদের ক্ষেত্রে ‘প্রজাতি’ চেনা হয় গাঠনিক আকার, আকৃতি, কোষপ্রাচীরের আনবিক উপাদানের সাদৃশ্য ও গ্লাইকোক্যালিক্স এবং ফ্ল্যাজেলামের উপস্থিতি (ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে) ইত্যাদি উপায়ে। বহুকোষী জীবের মধ্যে যাদের যৌন প্রজনন হয় তাদের ক্ষেত্রে ‘প্রজাতি’ চেনা হয় ‘যৌন প্রজনন’ করতে পারার যোগ্যতার ভিত্তিতে, অর্থাৎ উক্ত জীব সমগোত্রীয় যে জীবগুলোর সাথে যৌন প্রজনন করতে পারে তাদের নিয়ে তৈরী করে একটি ‘প্রজাতি’।
কিন্তু, বহুকোষী প্রাণীর ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তনের উদাহরণ হল: বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে ক্ষুদ্র পরিবর্তন। যেমন: গায়ের রং এবং ডিজাইন, পশমের পরিমাণ, চোখের মনির রঙ, উচ্চতা, মাংসপেশীর তারতম্য, কণ্ঠ ও সুরের ধরণ ইত্যাদি। অন্যদিকে, বহুকোষী প্রাণীর ক্ষেত্রে বড়-বিবর্তনের উদাহরণ হল: স্পঞ্জ-এর ক্ষেত্রে নিডোসাইট নামক কোষের আগমন, সরিসৃপে পাখার আগমন, মাছের পাখনা থেকে পা-এর আগমন ইত্যাদি।
মজার ব্যপার হল, এককোষী জীব, যেমন: ব্যাকেটিরিয়ার ক্ষেত্রে মাইক্রোইভলুশন প্রজাতির পরিবর্তন করছে না, বরং নতুন স্ট্রেইন তৈরী করছে। অন্যদিকে, যৌন প্রজননের ভিত্তিতে প্রজাতির সংজ্ঞার ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তন দিয়েই প্রজাতি বা উপপ্রজাতি তৈরী হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় বিবর্তনবাদীদের উপস্থাপিত প্রজাতি (তাদের মতে, আসলে হবে উপ-প্রজাতি) তৈরীর (যাকে স্পেশিয়েশন বলে) সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিয়ে। ক্যালিফোর্নিয়ার সালামান্দার সার্কেল দিয়ে প্রজাতির (উপ-প্রজাতি) উদ্ভব ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
উপরের ছবিটিতে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সালামান্দার প্রজাতি Ensatina eschschoitzi-এর ৭টি উপপ্রজাতি যুক্তরাস্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী স্যান জাওকিন ভ্যালির আশেপাশে বাস করে। উপ-প্রজাতিগুলোর মূল পার্থক্য তাদের গায়ের রঙ-এর নকশা (প্যাটার্ন) এবং সম্ভবত ফেরোমোন। সালামান্দারের গায়ের রং-এর নকশা পরিবর্তন হয় হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন-এর মাধ্যমে। সহজ কথায়, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরী হওয়ার এক পর্যায়ে এক জোড়া ক্রোমোজামের মধ্যে ক্রসিংওভার নামক একটি ঘটনা ঘটে। এ প্রক্রিয়ায় জিনোমের কিছু সুনির্দিষ্ট অংশের আদান প্রদান এবং পুনঃবিন্যাস হয়। মনে রাখা দরকার, এ প্রক্রিয়াটি কিছু বৈশিষ্ট্যে ভ্যারিয়েশন তৈরী করতে প্রাণীর কোষে নির্মিত সুনিয়ন্ত্রিত একটি প্রক্রিয়া। যদিও রিকম্বিনেশন হচ্ছে র্যাণ্ডমভাবে, কিন্তু তা হচ্ছে একটি নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যে।
বিবর্তনবাদীদের ইন্টারপ্রিটেশন অনুযায়ী, এভাবে সৃষ্ট ভ্যারিয়েশনের মাধ্যমে ভ্যালীর উত্তরে অবস্থিত Ensatina eschschoitzi picta উপ-প্রজাতিটি দক্ষিণ দিকে এসে এমন দুটো উপ-প্রজাতি Ensatina eschschoitzi klauberi এবং Ensatina eschschoitzi eschschoitzii–তে পরিণত হয়েছে, যারা পরস্পর যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না। সালামান্দার প্রজাতি যৌনক্রিয়ার জন্য বিপরীত লিঙ্গ বাছাই করতে সাধারণত ফেরোমোন নামক শরীর থেকে নিঃসৃত বিশেষ গন্ধ উৎপাদনকারী পদার্থ ব্যবহার করে। (এছাড়া, কোন কোন প্রজাতি স্পর্শ এবং কোন কোন প্রজাতি দৃষ্টি-সম্বন্ধীয় সূত্র তথা ভিজুয়্যাল কিউ ব্যবহার করে থাকে)। সে হিসেবে Eschschoitzi klauberi এবং Ensatina eschschoitzi eschschoitzii উপ-প্রজাতি দুটোতে ক্রসিং ওভারের মধ্য দিয়ে রং এবং ফেরোমোনের যথেষ্ট পার্থক্য হয়ে যাওয়ায় তারা প্রজাতির সংজ্ঞানুযায়ী আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। (আবার, এ-ও হতে পারে যে তাদের রিপ্রোডাকশন না করার কারণ আচরণগত।)
পাঠক, লক্ষ্য করে দেখুন, এখানে কার্যত ছোট-বিবর্তন সংঘটিত হল এবং ছোট বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি প্রজাতি (উপ-প্রজাতি) দুটো প্রজাতিতে (উপ-প্রজাতিতে) পরিণত হল। অন্যদিকে, এককোষী জীবে নতুন প্রজাতি আসতে হলে এর মূল গঠনের মধ্যে পরিবর্তন আসতে হবে।
বিবর্তনবাদীরা ছোট-বিবর্তনের উপরোক্ত উদাহরণগুলো থেকে বলতে চাচ্ছে যে, মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে এই ধরণের ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো একত্রিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন গঠনের বড়-বিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব? আমরা উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখলাম, এককোষী জীব এবং বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে প্রজাতির সংজ্ঞা ভিন্ন হওয়ায় বিষয়টি পৃথকভাবে বিবেচনা করতে হবে। (আলোচনার সুবিধার্তে ধরে নিচ্ছি বহুকোষী জীব মাত্রই যৌন প্রজনন করে এবং ভাইরাস এককোষী জীবের মত আচরণ করে)।
পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে পাঠকের জন্য একটি চিন্তার খোড়াক দেয়া যাক। ধরুন, আপনি সমুদ্রতীরে আছেন। তীরে হাটার সময় আপনি লক্ষ্য করলেন দূরে বালুর একটি স্তুপ তৈরী হয়েছে। আপনি স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা করবেন ওখানে কেউ একজন বালুর স্তুপ জমা করে রেখেছে অথবা হঠাৎ কোন ঘূর্ণায়মান বায়ুর প্রবাহ ওদিকে দিয়ে যাওয়ায় স্তুপ তৈরী হয়েছে। আপনি ইচ্ছে করলে ভাবতে পারতেন যে, সমুদ্রের ঢেউ ধীরে ধীরে বালু জমা করতে করতে স্তুপ তৈরী করেছে। কিন্তু আপনি তা ভাবলেন না। কেন? কারণ, আপনি দেখছেন সমুদ্রের ঢেউ অনেকটা জায়গা জুড়ে আসছে। অতএব, ঢেউয়ের কারণে বালুর বিন্যাস হলে তীরে ঘেষে অনেকখানি জায়গা জুরে হতো। অতঃপর, আপনি যখন বালুর স্তুপটির আরও কাছে গেলেন, আপনি দেখতে পেলেন ওখানে বালুর স্তুপ নয় বরং বালু দিয়ে ঘরের মত তৈরী করা হয়েছে। এ অবস্থায় আপনার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত হবে যে, এটি একজন দক্ষ মানুষ নির্মান করেছে, ঘুর্ণায়মান বায়ুর কারণে এটি তৈরী হয়নি। আপনাকে কেউ যদি জোড় করেও বলে যে কোটি কোটি বছরের ব্যবধানে আস্তে আস্তে এই ঘর তৈরী হয়েছে, তারপরও আপনি বিশ্বাস করবেন না। এমনকি, এর পক্ষে যদি পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানী এক হয়ে যায় তারপরও আপনি তার বিপরীতে একা থাকবেন। কারণ, বালুর ঘরটির বৈশিষ্ট্য হলো এটি অনিয়মিত (ইরেগুলার) আকৃতিসম্পন্ন এবং এই ইরেগুলারিটি এলোমেলো তথা র্যাণ্ডম নয়, সুনির্দিষ্ট ও সুশৃংখল। অর্থাৎ, সমুদ্রের ঢেউ এবং এ জাতীয় যে কোন জিনিস যা কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম বা সূত্র মেনে চলে সেগুলো ক্রমে ক্রমে একটি নিয়মিত গঠন (Order) তৈরী করতে পারে, কিন্তু অনিয়মিত সুশৃংখল গঠন (Organization) তৈরী করতে পারে না। আবার, র্যাণ্ডম প্রক্রিয়া হয়ত এলোমেলো জটিল গঠন (Complexity) তৈরী করতে পারে, কিন্তু অনিয়মিত সুশৃংখল ও জটিল গঠন (Organized Complexity) তৈরী করতে পারে না। যত সময়ই দেয়া হোক না কেন, সমুদ্র তীরে বালু জমে একা একা ঘর তৈরী হবে না। শীতলস্থানে পানি একা একা ঠাণ্ডা হয়ে বরফ হলেও কোটি বছরেও বরফের ভাস্কর্য তৈরী হবে না। ঠিক একই ভাবে, র্যাণ্ডম মিউটেশন ও ন্যাচারাল সিলেকশনের কাজ করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানলেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যত সময়ই অতিবাহিত হোক না কেন তা বড়-বিবর্তন ঘটাতে পারে না।
আমরা জানি, AIDS রোগের জন্য দায়ী HIV ভাইরাস এবং Flu রোগের জন্য দায়ী Influenza ভাইরাস এন্টিভাইরাল ঔষধ এবং মানুষের শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে পারে এ ধরণের স্ট্রেইন দ্রুত তৈরী করে। বিবর্তনবাদীরা এ ঘটনাকে বিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে প্রচার করেন। দুটি ভাইরাসের ক্ষেত্রেই মিউটেশনের মধ্য দিয়ে এ ধরণের পরিবর্তন আসে। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, মিউটেশন হয় মূলত জিনোমের এমন একটি জায়গায় যা সংশ্লিষ্ট অনুটির গাঠনিক অখণ্ডতাকে নষ্ট করে না। এ ধরণের জায়গাকে বলে ‘হাইপার ভ্যারিয়েবল’ রিজিওন। যেমন: ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বেলায় এ ধরণের মিউটেশন হয় হিমাগ্লুটিনিন নামক অণুর হাইপারভ্যারিয়েবল রিজিওনে। কিন্তু একই অণুর অন্যান্য রিজিওনে মিউটেশন হলে গাঠনিক অখণ্ডতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভাইরাস আক্রমন করতে পারে না, তথা অকার্যকর হয়ে পড়ে। Jewetz, Melnick ও Adelberg তাদের Medical Microbiology বইয়ে হিমাগ্লুটিনিন (HA)-এর গঠন সম্পর্কে বলছেন:
The HA molecule is folded into a complex structure. Each linked HA 1 and HA 2 dimer forms an elongated stalk capped by a large globule. The base of the stalk anchors it is the membrane. Five antigenic sites on the HA molecule exhibit extensive mutations. These sites occur at regions exposed on the surface of the structure, are apparently not essential to the moleule’s stability, and are involved in viral neutralization. Other regions of the HA molecule are conserved in all isolates, presumably because they are necessary for the molecules to retain its structure and function. [১]
অর্থাৎ, মিউটেশন যদি গঠনের এমন জায়গায় হয় যেখানে মিউটেশন হলে ভাইরাস তার ইনফেকটিভিটি তথা আক্রমণ করার ক্ষমতা না হারিয়েও টিকে থাকতে পারে তখনই কেবল ভাইরাস উক্ত মিউটেশনের মধ্য দিয়ে রেজিসটেন্ট স্ট্রেইন তৈরী করতে পারবে। অথচ, আমরা উপরে জেনেছি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে প্রজাতি সংজ্ঞায়িত হয় আকার, আকৃতি, গাঠনিক উপাদানের সাদৃশ্য দ্বারা। অর্থাৎ, ভাইরাসকে ভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত করতে হলে তাকে ত্রিমাত্রিক গঠন পরিবর্তন করতে হবে। অন্যদিকে, যে মিউটেশনগুলো গঠনকে পরিবর্তন করে দেয় সেগুলো ভাইরাসকে অকেজো করে ফেলে। ফলে, ভাইরাস ভিন্ন আকৃতি তৈরী করার জন্য বাঁচতে পারবে না।
এইডস ভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এইডস ভাইরাসের জিনোমে পাঁচটি হাইপারভ্যারিয়েবল রিজিওন আছে। এ কারণেই দেখা যায়- র্যাণ্ডম মিউটেশন সব জায়গায় টোলারেট করতে পারলে, ভাইরাসে রিপ্রোডাকশন রেট বেশী হওয়ায় এইডস ভাইরাস এতদিনে পরিবর্তন হয়ে অন্য ভাইরাস হয়ে যেত, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং এর গাঠনিক অখণ্ডতা রক্ষা করে উচ্চমাত্রার ভিন্নতা তৈরীর ক্ষমতা (স্ট্রাকচারাল প্লাস্টিসিটি) থাকায় একটার পর একটা ড্রাগ রেজিসটেন্ট স্ট্রেইন তৈরী করে যাচ্ছে।
উপরোক্ত ছবিতে দেখা যাচ্ছে এইচআইভি ভাইরাসের গ্লাইকোপ্রোটিন-১২০ প্রোটিনের পাঁচটি হাইভ্যারিয়েবল রিজিওন (V দিয়ে চিহ্নিত) এবং ৫টি অপরিবর্তনশীল তথা কনস্টেন্ট রিজিওন (C দিয়ে চিহ্নিত)। ছবিসূত্র: http://jvi.asm.org/content/78/7/3279.full
এই উদাহরণ দুটো থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, মিলিয়ন বছর সময় দিলেও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বা এইডস ভাইরাস অন্য ভাইরাসে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমাদের সিদ্ধান্তকে আরো পোক্ত করে এমন ভাইরাসের উদাহরণ যেগুলোকে বৈশ্বিকভাবে নিশ্চিহ্ন ঘোষণা করা হয়েছে। ৮-ই মে ১৯৮০ সালে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গ্যানাইজেশন স্মল পক্সকে নিশ্চিহ্ন ঘোষণা করেছে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হল? উত্তর: স্মল পক্সের জিনোমে হাইপারভ্যারিবেল রিজিওন নামে কোন স্থান ছিল না। ফলে স্মল পক্সের বিপরীতে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করে একে বিলুপ্ত করে দেয়া গেছে। বিবর্তন একে রক্ষা করতে পারেনি। ঠিক একইভাবে ইয়েলো ফিবার, পোলিও, মিজেলস ইত্যাদি ভাইরাসের বিপরীতে একবার ভ্যাক্সিনেশন করলে পুরো জীবন তা প্রোটেকশন দিতে পারে। কারণ, এই ভাইরাসগুলোর জিনোমেও এমন কোন রিজিওন নেই, যা গাঠনিক একাগ্রতা ঠিক রেখে ইনফেকভিটি মেইনেটেইন করতে পারবে।
ব্যাকেটেরিয়া বিভিন্নভাবে ড্রাগ রেজিসটেন্ট স্ট্রেইন তৈরী করতে পারে। সংক্ষেপে এগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: ১. ড্রাগটিকে কোষ থেকে বের করে দেয়া, ২. ড্রাগটিকে এনজাইমের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া এবং ৩. ড্রাগটি কোষের যে স্থানে (তথা টার্গেটে) বন্ধন তৈরীর মাধ্যমে কাজ করে সে স্থানটিতে আকৃতির পরিবর্তন সাধন করা। প্রথম দুটি পদ্ধতি সংঘটিত করার জন্য যে এনজাইমগুলো কাজ করে, সেগুলোর প্রয়োজনীয় জেনেটিক তথ্য থাকে প্লাজমিডে। লক্ষ্যণীয়, প্লাজমিড ব্যাকটেরিয়ার মূল জেনেটিক এলিমেন্ট থেকে পৃথক এবং ব্যাকটেরিয়া গঠনে কোন প্রভাব না ফেলে কাজ করতে পারে। তৃতীয় পদ্ধতিটি সংঘটিত হয় মিউটেশনের মাধ্যমে। যদি মিউটেশনের ফলে টার্গেট এনজাইমে এমন ধরণের পরিবর্তন আসে যা এনজাইমের মূল কাজকে অক্ষত রেখে ওষুধের সুনির্দিষ্ট আনবিক লক্ষ্যস্থলে সামান্য পরিবর্তন আনে তাহলে ওষুধটি আর কাজ করতে পারে না। কিন্তু, মিউটেশন যদি মূল এনজাইমের গঠন ও কর্মক্ষমতাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয় তাহলে ব্যাকটেরিয়াটি ধ্বংস হবে এবং ড্রাগ রেজিস্টেন্ট স্ট্রেইন তৈরী হবে না। ব্যাকটেরিয়াতে যেকোন এনজাইমের ফাংশন মূলত ‘অপটিমাম’ হয়। অর্থাৎ, এনজাইমটি খুব বেশী কাজও করে না আবার একেবারেই কম কাজও করে না। মিউটেশনের মাধ্যমে যে এনজাইমটি তৈরী হচ্ছে তা মূল এনজাইমটির মত কাজে দক্ষ হয় না। ফলে, ব্যাকটেরিয়ার ড্রাগ রেজিস্টেন্স স্ট্রেইন ওয়াইল্ড টাইপ স্ট্রেইন থেকে দুর্বল তথা কম ফিটনেস ফাংশন যুক্ত হয়।
প্রথম দুটো প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া যে রেজিসটেন্ট জিন ব্যবহার করছে তা মূলত এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ছিল। ব্যাকটেরিয়ার একটি বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। এ প্রক্রিয়ায় একটি ব্যাকটেরিয়া অন্য ব্যাকটেরিয়া থেকে জিনোম সংগ্রহ করতে পারে। এভাবেই মূলত উপরোক্ত দু’ধরণের রেজিসটেন্ট জিন এক ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেক ব্যাকটেরিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু উক্ত জিনগুলো কীভাবে উদ্ভব হল, তা এই প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারে না। অন্যদিকে, তৃতীয় প্রক্রিয়াটিকে প্রকৃত নিও-ডারউইনিয়ান প্রক্রিয়া বলা যায়। কারণ, মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যে স্ট্রেইন তৈরী হচ্ছে, ওষুধ-যুক্ত পরিবেশে তা প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিবর্তনের এই উদাহরণ থেকে কি ব্যাকটেরিয়ার আকার, আকৃতি ও আনবিক গঠনে কোন পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়? উত্তর: না। কারণ, গাঠনিক আকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেলে ব্যাকটেরিয়া তার গাঠনিক একাগ্রতা হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর রিপ্রোডাকশন যদি না করতে পারে সে পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তিত গঠন প্রবাহ করবে কীভাবে? নতুন প্রজাতি-ই বা গঠন করবে কীভাবে?
অর্থাৎ, ছোট-বিবর্তনের এই উদাহরণ থেকে বড়-বিবর্তনকে ইনফার করা যাচ্ছে না। তদুপরি, আমরা যদি ব্যাকটেরিয়া ফ্ল্যাজেলামের কথা চিন্তা করি, ফ্ল্যাজেলামে প্রায় চল্লিশটি ভিন্ন ধরণের প্রোটিন থাকে, তাহলে উপরোক্ত চল্লিশটি প্রোটিনের জিন সুনির্দিষ্টভাবে জিনোমে বিন্যস্ত হতে হবে। এই পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়াশীল প্রোটিনযুক্ত গঠনটির একটি প্রোটিনের অবর্তমানে সে তার কাজ সঠিকভাবে করতে পারবে না। অর্থাৎ ফ্ল্যাজেলামকে কাজ করতে হলে পুরোপুরি একসাথে আসতে হবে। কিন্তু, উপরের মিউটেশনের উদাহরণ থেকে আমরা দেখেছি, মিউটেশন শুধু ইতোমধ্যে বিদ্যমান জেনেটিক তথ্যকে কিছুটা ওলটপালট করতে পারে। কিন্তু, নতুন জেনেটিক তথ্য যোগ করতে পারে না।
এছাড়াও, ব্যাকটেরিয়া যেহেতু খুব দ্রুত রিপ্রোডাকশন করতে পারে, সেহেতু ব্যাকটেরিয়াতে মিউটেশনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনগুলোও দ্রুত হবে। যদি প্রতি এক ঘন্টায় একটি রিপ্রোডাকশন হয়েছে ধরা হয়, এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লক্ষ ব্যাকটেরিয়ার জেনারেশন তৈরী হয়েছে। মানুষের রিপ্রোডাকটিভ স্কেলে যা প্রায় ১০ মিলিয়ন বছরের ইকুইভ্যালেন্ট। অথচ, এই দীর্ঘ সময়ে ব্যাকটেরিয়াগুলোর প্রজাতি পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ, নতুন প্রজাতি আসেনি। [২] রিচার্ড লেনস্কি ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ ইভলুশন এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন। ১৯৮৮ সাল থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত ৫০০০০ জেনারেশন পার হয়েছে। ই. কোলাই-এর বিভিন্ন স্ট্রেইন তৈরী হয়েছে কিন্তু ই. কোলাই প্রজাতি পরিবর্তিত হয়ে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হয়নি। [৩]
বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে আমরা উপরে দেখেছি যে, প্রজাতির সংজ্ঞা গঠনের উপর নির্ভর করে না। ফলে, ছোট পরিবর্তনও প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারে। একই সাথে আমরা এও দেখেছি যে, প্রজাতির জিনোমে যে ভ্যারিয়েশনগুলো হয়, তা ইতোমধ্যে বিদ্যমান তথ্যের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে জেনেটিক রিকম্বিনেশনের মধ্য দিয়ে। এছাড়াও মিউটেশনের মধ্য দিয়ে ভ্যারিয়েশন তৈরী হতে পারে। তবে সেটি হয় কোন একটি বৈশিষ্ট্য নষ্ট হওয়ার মাধ্যমে। যেমন: একটি নির্দিষ্ট অ্যামাইনো এসিড পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের সাধারণ হিমোগ্লোবিন পরিবর্তন হয়ে হিমোগ্লোবিন এস তৈরী হয়। হিমোগ্লোবিন এস-এর বৈশিষ্ট্য হল এটি সুনির্দিষ্ট ট্রিগার পেলে কাঁচির মত আকৃতি ধারণ করে পাতিত হয় এবং সাথে উক্ত হিমোগ্লোবিনযুক্ত লোহিত রক্ত কণিকাগুলোর আকৃতিও কাঁচির মত হয়ে যায়। ফলে লোহিত রক্ত কণিকাগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। মানবদেহের স্প্লিনের কাজ হল অকেজো রক্ত কণিকাকে গ্রহণ করে নষ্ট করে ফেলা। অন্যদিকে, ম্যালেরিয়া জীবাণু তার জীবনচক্রের একটি পর্যায় অতিক্রম করে লোহিত রক্ত কণিকায়। এমতাবস্থায় লোহিত রক্তকণিকাগুলো মারা যাওয়া অর্থ হলো ম্যালেরিয়ার জীবাণু মারা যাওয়া। এভাবে, যে সকল সিকল সেল এনেমিয়া ট্রেইটের রুগীদের জিনোমে হিমোগ্লোবিন এস-এর একটি অ্যালিলি থাকে তারা ম্যালেরিয়ার জীবাণুর বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রাকৃতিক রেজিসটেন্স তৈরী করে এবং সাধারণ মানুষদের তুলনায় বেশী বেঁচে থাকে এবং রিপ্রোডাকশন করতে পারে। কিন্তু, স্পষ্টতই সিকল সেল এনেমিয়া পরিবর্তিত পরিবেশে রুগীদের সামান্য উপকার করতে পারলেও, সাধারণ মানুষদের তুলনায় এরা প্রকৃতপক্ষে কম যোগ্য (ফিট)।
তবে বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে বড়-বিবর্তন হতে হলে ব্যাখ্যা করতে হবে সম্পূর্ণ নতুন একটি বৈশিষ্ট্যের আগমন। যেমন: পাখির ডানা। পাখির ডানা আসতে গেলে আসতে হবে পাখির ডানার সুনির্দিষ্ট গঠন, যেমন: পালক; ডানার সাথে সংশ্লিষ্ট মাংসপেশী, রক্তসংবাহী নালী, নার্ভের জাল ও তার সাথে মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন এবং পাখার গতি ও দিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যালগরিদম। স্বাভাবিকভাবেই, এগুলো আসার অর্থ হল জিনোমে সুনির্দিষ্ট ও সুশংখলভাবে নতুন জেনেটিক তথ্য আসা। সুতরাং, বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে ছোট-বিবর্তনের যে উদাহরণ আনা হচ্ছে, যত সময়ই অতিবাহিত হোক না কেন তা উপরোক্ত সুনির্দিষ্ট জেনেটিক তথ্যের সমাগম ব্যাখ্যা করতে পারে না। অর্থাৎ এই ধরণের ছোট-বিবর্তন কোটি বছর ধরে হলেও বড়-বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম।
পাঠক, আমরা উপরের দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে কয়েকটি জিনিস বুঝতে পারলাম। এক, প্রজাতির সংজ্ঞা এককোষী জীব এবং বহুকোষী জীব যা যৌন প্রজনন করে তা-র ক্ষেত্রে ভিন্ন। দুই, ছোট-বিবর্তন এককোষী জীবে প্রজাতি তৈরী করে না বরং একই প্রজাতির বিভিন্ন স্ট্রেইন তৈরী করে, অন্যদিকে বহুকোষী জীবে উপ-প্রজাতি তৈরী করে। সে হিসেবে একজন বিবর্তনবাদী যদি বলে বিবর্তন প্রজাতি তৈরী করছে তাহলে তার বক্তব্য মিথ্যা হবে না, তবে অস্পষ্ট হবে। তিন, ছোট-বিবর্তন প্রকৃতপক্ষে বড়-বিবর্তনের পক্ষে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করে না। ছোট-বিবর্তন শারীরিক গঠনের উপাদানে না হলে বড় পরিবর্তন আসার মাধ্যমে নতুন প্রজাতি আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু, ছোট-বিবর্তন শারীরিক উপাদানে হলে প্রজাতির মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বা কম-কর্মক্ষম প্রজাতি তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। অথচ, প্রাকৃতিক নির্বাচন শুধু অধিকতর যোগ্য প্রজাতিকে নির্বাচিত করে। সে হিসেবে কম-কর্মক্ষম প্রজাতি প্রতিকূল পরিবেশে আপাত সুবিধে দিলেও পুরো পপুলেশনের সাপেক্ষে কোন উত্তম ভ্যারিয়েশন প্রবাহ করতে পারছে না। এ কারণে, কোটি কোটি বছর পার হলেও এগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আগমন ঘটাতে সক্ষম নয়।
সর্বশেষ কথা হল, বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা ছোট-বিবর্তনের উদাহরণ এনে ‘কোটি বছরের’ ধোঁয়াটে আবেদন দিয়ে বড়-বিবর্তনকে সত্য ধরে নিচ্ছেন এবং প্রচার করছেন। কিন্তু আদৌ এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ আছে কি না সেই বিশ্লেষণে গেলে তারা ব্যাখ্যাকে স্পষ্ট করছেন না। বরং, বিবর্তনবাদকে সত্য ধরে নিয়ে করা রিসার্চ দেখিয়ে তারা তত্ত্বটিকে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এর পেছনের উদ্দেশ্যটি কি বৈজ্ঞানিক? না-কি আদর্শিক?
আপনারা যারা বিবর্তনবাদীদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছেন বা নিজেরা ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন তারা ‘ফাইলোজেনেটিক্স’ সম্পর্কে জেনে থাকবেন। আপনারা হয়তো বিভিন্ন সময় লক্ষ্য করে থাকবেন এমন কতগুলো ছবি, যেখানে আছে কয়েকটি সরলরেখার গাছ (Phylogenetic Tree) যেগুলোর একপ্রান্তে আছে কতগুলো প্রজাতি এবং আরেকপ্রান্তে সরলরেখাগুলো একটি মূল তৈরী করেছে। উক্ত মূলে আছে একটি সম্ভাব্য ‘কাল্পনিক’ প্রজাতি (Hypothetical Last Common Ancestor)।
বিবর্তনবাদীদের প্রদর্শিত ফাইলোজেনেটিক ট্রি দেখলে মনে হয় যেন তারা বিবর্তনের বিশাল এক প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে একটি প্রজাতির সাথে আরেকটি প্রজাতির ‘বিবর্তনীয় সম্পর্ক’ (Evolutionary Relationship) এমনভাবে প্রকাশ করা হয় যেন তা বিবর্তনের ইতিহাস সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে।
বিবর্তনবাদীদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো বিজ্ঞানের মোড়কে প্রতারণা। তাদের এই স্ট্র্যাটেজি বুঝা আরও সহজ হয় যখন ফাইলোজেনেটিক্স বিষয়টির একটু গভীরে যাওয়া যায়। ফাইলোজেনেটিক্স তৈরী করতে যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর জটিলতা অনেক। জটিল এবং সাধারণের জন্য দূর্বোধ্য কতগুলো শব্দের ব্যবহার আছে। যেমন: Maximum Parsimony Analysis, Maximum Likelihood Analysis, Distance Based Methods (Bayesian Analysis, UPGMA etc) ইত্যাদি। কিন্তু এত জটিল জটিল শব্দের পিছনে আছে একটি সহজ ‘ধারণা’ (Assumption)।
(এবার একটু লক্ষ্য করে) উক্ত ধারণাটি হলো: ‘যে প্রজাতিগুলোর সাদৃশ্যপূর্ণ গঠন আছে (Homologous Structure) সে প্রজাতিগুলো বিবর্তনীয়ভাবে পরস্পরের নিকটবর্তী।’ হ্যাঁ পাঠক ভাল মত খেয়াল না করলে হয়ত আপনি বিষয়টি ধরতে পারবেন না। বিবর্তনবাদীরা এখানে ‘সাদৃশ্যপূর্ণ গঠন’কে বিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে ধরে নিয়েছেন!! অথচ, সাদৃশ্যপূর্ণ গঠন কখনই বিবর্তনবাদের প্রমাণ নয়। কারণ সাদৃশ্যপূর্ণ গঠনের আরেকটি বিকল্প ব্যাখ্যাকে তারা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন। সেটি হলো ‘Common Design’। হ্যাঁ, এই বিকল্প ব্যাখ্যাকে বাতিল করতে হলে দেখাতে হবে জেনেটিক লেভেলে বিবর্তনের ম্যাকানিজমগুলো কাজ করে। অর্থাৎ দেখাতে হবে যে, ‘মিউটেশন’ এমন কিছু ভ্যারিয়েশন তৈরী করতে পারে ধাপে ধাপে যেগুলো নতুন কার্যকরী প্রোটিনসমষ্টি তৈরী করতে সক্ষম, তথা বাহ্যিকভাবে নতুন ‘বডি প্ল্যান’ তৈরী করতে সক্ষম। অথবা, দেখাতে হবে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত বিভিন্ন ফাইলোজেনেটিক ট্রিগুলো সংগতিপূর্ণ (Congruent)।
যারা মিউটেশন সম্পর্কে পড়ালেখা করেছেন তারা জেনে থাকবেন মিউটেশন ধাপে ধাপে নতুন ও সম্পূর্ণ ভিন্ন ফাংশনের প্রোটিন তৈরী করতে পারে না। [১] বরং একটি এনজাইমকে (প্রোটিন) ভিন্ন ফাংশনের এনজাইমে পরিবর্তন হতে হলে অনেকগুলো মিউটেশন একসাথে হতে হবে। ডগলাস এক্স ও এন গজার দেখিয়েছেন যে, একটি ফাংশনাল এনজাইমকে আরেকটি ফাংশনাল এনজাইমে পরিণত করতে ৫টি বা তার অধিক সাইমালটেনিয়াস ও স্পেসিফিক মিউটেশন লাগবে। [২] মাইকেল বিহের স্টাডি থেকে আমরা জানি, একই সাথে চারটির বেশী মিউটেশন প্রয়োজন হলে এবং তা র্যাণ্ডমলি হতে হলে পৃথিবীর বয়স সীমা পার হয়ে যায়। [৩] কিন্তু কোষের নতুন কোন কাজ একটি এনজাইমের উপরতো নির্ভর করেই না, বরং অনেকগুলো এনজাইমের সামগ্রিক সহযোগিতায় একটি নতুন ফাংশন তৈরী হয়। এরূপ অনেকগুলো নতুন ফাংশনযুক্ত কোষের সমন্বয়ে তৈরী হয় নতুন ফাংশন বা বৈশিষ্ট্য-যুক্ত টিস্যু। আর এ ধরণের টিস্যুগুলোর পারস্পরিক সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত যোগাযোগের মাধ্যমেই শুধু হবে রিঅর্গ্যানাইজেনশ, এবং রিঅর্গ্যানাইজেশন ছাড়া নতুন বডি প্ল্যান আসা সম্ভব নয়। এমনকি অন্যান্য জেনেটিক ম্যাকানিজমগুলোও প্রজাতিতে ইতোমধ্যে বিদ্যমান জেনেটিক তথ্য ওলট-পালট করা ছাড়া নতুন কার্যকরী তথ্য যোগ করতে অপারগ।
যাই হোক, বিবর্তনবাদীরা ফাইলোজেনেটিক এনালাইসিসে কি করে তা বুঝার জন্য ‘ম্যাক্সিমাম পার্সিমনি এনালাইসিস’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ধরুন আপনি তিনটি প্রাণী ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ নিয়ে তুলনা করবেন। এক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’ প্রাণীত্রয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য ঠিক করতে হবে। ধরি, একটি বৈশিষ্ট্য প্রত্যেকটি প্রাণীর-ই আছে সেটিকে দেই নাম্বার ‘১’। অতঃপর, আরেকটি বৈশিষ্ট্য শুধু ‘খ’ এবং ‘গ’-এর আছে, এদের দেই নাম্বার ‘২’। আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে শুধু ‘গ’-এর নাম্বার দেই ‘৩’। এখন আমাদের কাজ হবে প্রাণী ‘ঘ’ এর সাথে এদের তুলনা করা। প্রাণী ‘ঘ’ হলো আমাদের গ্রুপের বাইরের (Outgroup) প্রাণী। ‘ঘ’-র তিনটি বৈশিষ্ট্যের কোনটিই নেই। এভাবে চিহ্নায়িত করে আমরা নিচের ছকটি পাব:
১ ২ ৩
ঘ ০ ০ ০
ক ১ ০ ০
খ ১ ১ ০
গ ১ ১ ১
সুতরাং আমাদের ফাইলোজেনেটিক ‘ট্রি’ হবে এরকম:
অর্থাৎ, আমাদের ফাইলোজেনেটিক ট্রি অনুসারে, ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ একটি ‘হাইপোথিটিক্যাল কমন এনসেস্টর’ থেকে এসেছে। এরপর ‘ক’ এবং ‘খ’ ও ‘গ’-এর বিবর্তনীয় লিনিয়েজ ভাগ হয়ে গেছে। ‘খ’ এবং ‘গ’-এর হাইপোথিটিক্যাল কমন এনসেস্টর থেকে পরবর্তীতে ‘খ’ এবং ‘গ’ ভাগ হয়ে গেছে। জ্বি ভাই/বোন, অবাক হবেন না। এভাবেই তৈরী হয় ফাইলোজেনেটিক ট্রি। আর গাছের প্রতিটি শাখার গোড়ায় লাগিয়ে দেয়া হয় ‘হাইপোথিটিক্যাল কমন এনসেস্টর’। [৪]
এবার উপরের ছবিটি দেখুন। [৫] এটাকে বলে ‘Consensus Phylogeni of All Life’। লক্ষ্য করে দেখুন, রেখাগুলো যেখানে বিভক্ত হয়েছে, সেই জায়গাগুলোর হাইপোথিটিকাল প্রজাতিগুলোর ফসিল কিন্তু এখনও কাল্পনিক পর্যায়েই আছে।
মজার ব্যাপার হলো, এই অধিকাংশ ‘হাইপোথিটিক্যাল কমন এনসেস্টর’দের কোন ফসিল এভিডেন্স নেই। একটি বিষয় ভেবে দেখুন, আপনি যদি এরকম একটি ফাইলোজেনেটিক ট্রি নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে আপনি আশা করবেন ফসিল এভিডেন্সে যতই আমরা পিছনের দিকে যাব ততই এমন কতগুলো ফসিল পাবো যেগুলোর আকার আকৃতির সাথে বর্তমান কোন প্রাণীর আকার আকৃতির মিল নেই। অন্য কথায় আমরা বর্তমানে যে জীবগুলো পাচ্ছি সেগুলোর বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন (হেটারোজেনাস), কিন্তু পেছনের দিকে গেলে ফসিলে আমরা এমন কতগুলো জীব পাব যেগুলোতে হয় উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয় আছে অথবা তারা একই ধরণের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন (হোমজেনাস)। অর্থাৎ জিওলজিকাল হিস্ট্রির প্রথম দিকে আমরা কখনই জীবজগতের ‘পর্ব’ (Phylum) গুলোকে আলাদা করতে পারবো না, বরং যতই সময় যাবে পর্বগুলো তাদের পৃথক বৈশিষ্ট্যসহ স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করবে। কিন্তু ক্যামব্রিয়ান পিরিয়ডে মাত্র ৩০ মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে (৫৩০ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছর পূর্ব) প্রায় ২৫টি পর্ব পাওয়া যায়। জিওলজিক্যাল পিরিয়ডে এটি খুবই সংক্ষিপ্ত সময়।
মলিকিউলার ফাইলোজেনি-ও অনেকটা উপরোক্ত নিয়মে করা হয়। এক্ষেত্রে, দুটো প্রজাতির ‘হোমোলোগাস’ প্রোটিনের এমাইনো এসিড সিকোয়েন্স অথবা তাদের জিন সিকোয়েন্স নিয়ে এনালাইসিস করে ইভলুশনারী ট্রি তৈরী করা হয়। যেমন ধরুন বিভিন্ন প্রজাতির থেকে ‘হিমোগ্লোবিন’-এর এমাইনো এসিড সিকোয়েন্স নিয়ে ফাইলোজেনেটিক স্টাডি করা হলো। এক্ষেত্রে উক্ত প্রজাতিগুলো কবে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তাদের ‘হাইপোথেটিকাল লাস্ট কমন এনসেস্টর’ কত বছর আগে জীবিত ছিলো এগুলোর একটি হিসাব বেরিয়ে আসে। মজার বিষয় হলো উক্ত প্রজাতিগুলো থেকেই যদি অন্য একটি এনজাইম (যেমন: সাইট্রোক্রোম সি) নিয়ে স্টাডি করা হয় তাহলে দেখা যায় তাদের ফাইলোজেনেটিক ট্রি একই ধরণের ফলাফল বা সময়সীমা দেখাচ্ছে না। একইভাবে, প্রজাতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে ফাইলোজেনেটিক ট্রিগুলো তৈরী করা হয়েছে সেক্ষেত্রেও দেখা গেছে ভিন্ন ভিন্ন ফাইলোজেনেটিক ট্রি-র মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। অথচ, বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন ‘বডি প্ল্যান’ তৈরী হয়ে থাকলে প্রজাতির যে বৈশিষ্ট্য নিয়েই ফাইলোজেনেটিক ট্রি করা হোক না কেন, সেগুলো একই ধরণের বা সামঞ্জস্যপূর্ণ চিত্র দেখানোর কথা, একই সময়ে গিয়ে লাস্ট কমন এনসেস্টরকে নির্দেশ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা পাওয়া যায় না। স্টিফেন সি. মেয়ার তার বই ‘Darwin’s Doubt‘-এ বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন। [৬]
অতএব পাঠক, বুঝে নিন আপনার সামনে যদি ফাইলোজেনি নামক কোন শব্দ প্রকাশ করা হয়, অবুঝের মত বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই। ফাইলোজেনী ডারউইনবাদকে প্রমাণ করে না।
সংযোজন(১২/০৫/২০১৪): পাঠক, প্রথমোক্ত ছবিটার দিকে আবার লক্ষ্য করুন। ছবিটা থেকে ইচ্ছা করলে এভাবেও চিন্তা করার সুযোগ আছে যে, যদিও আমরা চূড়ান্ত ‘লাস্ট কমন এনসেস্টর’ সম্পর্কে জানি না, কিন্তু ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ এর লাস্ট কমন এনসেস্টর হিসেবে ‘ক’-কে বিবেচনা করতে পারি। সেক্ষেত্রে এভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যায় যে, কোন এক সময় ‘ক’ প্রজাতির পপুলেশনের একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বা পৃথক হয়ে গেছে, এরপর উক্ত প্রজাতির মধ্যে সৃষ্ট ভ্যারিয়েশনের মধ্য দিয়ে বৈশিষ্ট্য ‘২’-এর আবির্ভাব ঘটেছে এবং ‘খ’ প্রজাতি তৈরী হয়েছে, যা প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়ে টিকে গেছে। ঠিক একই ভাবে ‘খ’ থেকে একটি সাবপপুলেশন ‘গ’-তে পরিণত হয়েছে। সমস্যা হলো, এ ধরনের ‘ট্রি’ কনস্ট্রাকশনে বৈশিষ্ট্য ‘১’ ‘২’ ও ‘৩’-এর আবির্ভাবকে ‘বিবর্তনের’ ফসল হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। কিন্তু উপরে আমরা দেখেছি র্যানডম আনগাইডেড বিবর্তন আনবিক পর্যায়েই নতুন ফাংশনযুক্ত এনজাইম বা প্রোটিন তৈরী করতে অক্ষম। সুতরাং, নতুন একটি বৈশিষ্ট্য (যেমন: পাখির ডানার মাংসপেশী, নার্ভ ইত্যাদি)তৈরী করতে যে পরিমান নতুন সুসংগঠিত তথ্য জিনোমে সুশৃংখলভাবে প্রবেশ করাতে হবে তা আনগাইডেড বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়।
এবার আমরা দ্বিতীয় ছবিটা পুনরায় দেখি। ছবি অনুযায়ী, বহুকোষী প্রাণী স্পঞ্জ-এর একটি সাবপপুলেশনে প্রথম সুগঠিত ‘অঙ্গ’ হিসেবে স্নায়ুতন্ত্র এবং/অথবা সংবহনতন্ত্র (আদিমপ্রকৃতির) আবির্ভূত হয়ে অন্যান্য জীবের বিবর্তন হয়। এছাড়াও স্পঞ্জের পরেই সুগঠিত দৈহিক আকৃতি ও বডি সিমেট্রির আবির্ভাব হয়। আমরা জানি স্পঞ্জ পরিফেরা পর্বের অন্তর্ভূক্ত এবং এর কাছাকাছি পর্ব হল নিডারিয়া (জেলি ফিস, হাইড্রা, কোরাল, সামুদ্রিক এনেমোন) । পরিফেরা ও নিডারিয়ার পর্বের দুটো সরলতম প্রজাতির মধ্যেও কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। যেমন: নিডারিয়া পর্বের বৈশিষ্ট্য হল ‘নিডোসাইট’ কোষের উপস্থিতি, সরলতম স্নায়ু জাল, মুখবিবরের অবস্থান, সুনির্দিষ্ট শারীরিক আকৃতি(Body Shape)ইত্যাদি। আবার পরিফেরা পর্বের টানেল সিস্টেম নিডারিয়াতে নেই। সুতরাং একটি সরলতম স্পঞ্জকেও বিবর্তিত হয়ে নিডারিয়াভুক্ত প্রাণীতে পরিনত হতে হলে জিনোমে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর সুবিন্যস্ত আবির্ভাব ঘটাতে হবে। মজার ব্যপার হলো ‘হোক্স’ জিন ক্লাস্টার যা এমব্রায়োনিক ডেভেলপমেন্টের সময় শারীরিক আকৃতি তৈরী নিয়ন্ত্রণ করে, তার প্রথম আবির্ভাব নিডারিয়াতে। কোন র্যানডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যে এ ধরনের জেনোমিক ইনফরমেশন ইনফিউশন সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য।
চলুন, আমরা জোনাথান বার্ডের সাথে স্পঞ্জ (পরিফেরা) এবং কোরাল (নিডারিয়া)-এর বৈচিত্রপূর্ণ জগতে ঘুরে আসি।
স্পঞ্জ
কোরাল
রেফারেন্স:
[১] Behe MJ. Experimental Evolution, Loss-of-function Mutations, and “The First Rule of Adaptive Evolution”. The Quarterly Review of Biology. 2010 December (Cited 2014 May 11]; 85(4):419-45. Available at: http://www.lehigh.edu/~inbios/pdf/Behe/QRB_paper.pdf
[২] Gauger, A., Axe, D.. The Evolutionary Accessibility of New Enzymes Functions: A Case Study from the Biotin Pathway. BIO-Complexity, North America, 2011, apr. 2011. Available at: http://bio-complexity.org/ojs/index.php/main/article/view/BIO-C.2011.1.
[৩] Michael J. Behe, Edge of Evolution, FreePress, NY, 2008, p-142.
[৪] Greg Krukonis, Tracy Barr; Phylogenetics: Reconstructing the Tree of Life; Evolution for Dummies; Wiley Publishing Inc. Indianapolis, Indiana.
মানবজাতির ইতিহাসে মিথ্যাচার, প্রতারণা ও তথ্যগোপনের অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। তবে বর্তমান সময়ের চেয়ে বেশী সমগ্র ইতিহাসকে একত্রিত করলেও পাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র বিজ্ঞানেই বিবর্তনবাদের ভূত যে পরিমাণ মিথ্যাচার, প্রতারণা ও তথ্যগোপন করেছে এবং করে চলেছে তা-ই বর্ণনাতীত।
বিবর্তনবাদীরা এপ থেকে মানুষ আসার দাবী করতে গিয়ে তাদের ব্রেইনের আকারের পার্থক্যকে হাইলাইট করে। বিষয়টি যেহেতু সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য নয় সেহেতু ব্রেইনের আকারের পার্থক্য দিয়ে ধোঁকা দেয়াটা সহজ। কিন্তু যখন থেকে মানুষের নিউরোএনাটমি বুঝতে শুরু করেছি, তখন থেকেই বিষয়টিতে আমার খটকা লেগেছে।
কারণ, ব্রেইনের পার্থক্যটা হয় মূলত অর্গ্যানাইজেশনে, আকারে নয়। [১] হ্যাঁ, আকার বড় হয় ততটুকু, যতটুকু অর্গ্যানাইজেশন পরিবর্তন করতে গিয়ে। কিন্ত আকার ছোট রেখেও অর্গ্যানাইজেশন এক রাখলে বিচারবুদ্ধিও একই থাকে। মানুষের ব্রেইনের আকার সর্বনিম্ন ৮০০ সিসি থেকে ২২০০ সিসি পর্যন্ত হতে পারে। [২] তার মানে এই না যে ৮০০ সিসি আকারের মাথার বুদ্ধি কম।
মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জির ব্রেইনের মূল পার্থক্য ফ্রন্টালকর্টেক্স নামক ব্রেইনের অগ্রভাগের অংশে স্পষ্ট। কিন্তু শুধু ফ্রন্টালকর্টেক্সের আকার যদি বাড়িয়ে দেয়া হয় তাহলেই কি এপ জাতীয় প্রাণী মানুষে পরিণত হবে? না। যারা এই ধরণের দাবী করেন তারা ‘তথ্যগোপন’ করেন বা এড়িয়ে যান।
ফ্রন্টাল কর্টেক্স বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলে তারা ফ্রন্টাল কর্টেক্সের সাথে ব্রেইনের অন্যান্য অংশের সুসংগঠিত যোগাযোগগুলোর কথা বলেন না। ফ্রন্টাল কর্টেক্স মানুষের ব্রেইনের কমপ্লেক্স ফাংশন করতে গিয়ে, প্রাইমারী ও সাপ্লিমেন্টারী মোটর এরিয়া ও সেনসরি এরিয়া, ভিজুয়েল কর্টেক্স, অডিটরি কর্টেক্স, ভারনিক্স এরিয়া, লিম্বিক সিস্টেম, কর্পাস স্ট্রায়েটাম,ডায়েনসেফালন এবং পেছনের ব্রেইনের সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং ব্রেইনের এই জটিল গঠন তৈরী করতে যে জটিল রিঅর্গ্যানাইজেশন প্রয়োজন, অনিয়ন্ত্রিত (unguided) বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে গেলে এগুলোর ব্যাখ্যা করতে হবে।
আর বিবর্তনবাদীদের দাবী অনুসারে আনগাইডেড বিবর্তন হয় ‘র্যাণ্ডম মিউটেশন’ এর ফলে যদি কোন ‘নতুন ফাংশনাল ভ্যারিয়েশন’ তৈরী হয় তার ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এর মধ্য দিয়ে। সমস্যা হলো, প্রাণীদেহের অধিকাংশ ফাংশনই ‘জিন’-এর সাথে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ সম্পর্কযুক্ত না। অর্থাৎ একটি জিন একটি ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করছে (মনোজেনিক) এ রকম নয়। বরং অনেকগুলো জিন একত্রে একটি বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় (পলিজেনিক); সুতরাং উপরোক্ত দাবী ব্যাখ্যা করতে গেলে অসংখ্য Simultaneous এবং Exact মিউটেশন একসঙ্গে হতে হবে। তদুপরি এমব্রায়ো থেকে ডেভেলপমেন্টের সময় জেনেটিক সুইচ (ডিএনএ মিথাইলেশন প্যাটার্ন)-ও বিভিন্ন হওয়ায় ব্যাখ্যা করতে হবে এপিজেনেটিক রিঅর্গ্যানাইজেশন। [৩]
অথচ এরিক ডেভিডসনের ডেভেলপমেন্টাল জিন রেগুলেটরী নেটওয়ার্কে (dGRN) মিউটেশন নিয়ে পরীক্ষা থেকে আমরা জানি এগুলো হাইলি কনজার্ভড, অর্থাৎ সামান্য মিউটেশন মারাত্মক জেনেটিক ডিফেক্ট তৈরী করে। [৪] অন্যদিকে মাইকেল বিহের স্টাডি থেকে আমরা জানি, একই সাথে চারটির বেশী মিউটেশন প্রয়োজন হলে এবং তা র্যাণ্ডমলি হতে হলে পৃথিবীর বয়স সীমা পার হয়ে যায়। [৫] আবার ডগলাস এক্স ও এন গজার দেখিয়েছেন একটি ফাংশনাল এনজাইমকে আরেকটি ফাংশনাল এনজাইমে পরিণত করতে ৫টি বা তার অধিক সাইমালটেনিয়াস ও স্পেসিফিক মিউটেশন লাগবে। [৬] কিন্তু কোষের নতুন কোন কাজ একটি এনজাইমের উপরতো নির্ভর করে না। অনেকগুলো এনজাইমের সামগ্রিক সহযোগিতায় একটি নতুন ফাংশন তৈরী হয়। এরূপ অনেকগুলো নতুন ফাংশনযুক্ত কোষের সমন্বয়ে তৈরী হয় নতুন ফাংশন বা বৈশিষ্ট্য-যুক্ত টিস্যু। আর এ ধরণের টিস্যুগুলোর পারস্পরিক সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত যোগাযোগের মাধ্যমেই শুধু হবে রিঅর্গ্যানাইজেনশ।
[৪] Stephen C. Meyer, Darwin’s Doubt, HarperCollins publishers, Seattle, WA, 2013, p-265.
[৫] Michael Behe, Edge of Evolution, FreePress, NY, 2008, p-142.
[৬] Gauger, A., Axe, D.. The Evolutionary Accessibility of New Enzymes Functions: A Case Study from the Biotin Pathway. BIO-Complexity, North America, 2011, apr. 2011. Available at: http://bio-complexity.org/ojs/index.php/main/article/view/BIO-C.2011.1.
ঢাকা মেডিক্যালের প্রথম বর্ষের ছাত্র রাকিব। সে এইচএসসি’তে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় এবং মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পায়। রাকিবের বিজ্ঞানের প্রতি রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। তাই সে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও নতুন নতুন ক্ষেত্র সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। জ্যোতির্বিদ্যা ও জীববিজ্ঞানে তার আলাদা দুর্বলতা আছে। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সে তার চারপাশের পরিবেশ ও মানুষ নিয়ে চিন্তা করে। মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা তাকে ভাবায়।
তৌফিক রাকিবের খুব ভালো বন্ধু। সেও রাকিবের মতো নটরডেম কলেজ থেকে সর্বোচ্চ স্কোর নিয়ে উত্তীর্ণ হয়। এখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগের ছাত্র। এরা দু’জনে সে সকল ছাত্রদের মতো নয়, যারা শুধু মাত্র সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য পড়ে। বরং তারা প্রতিটি বিষয় নিয়ে যুক্তি-ভিত্তিক চিন্তা করতে ভালোবাসে। তৌফিক আর রাকিবের মাঝে প্রায়ই বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথোপকথন হয়। গত দিনের মতো আজকেও তারা ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসিতে এসেছে। পাশের ক্যাফেটেরিয়া থেকে দু’জনে দু’কাপ কফি নিয়ে কাছের বেঞ্চটার নিকটে গেল।
“রাকিব একটা বিষয় ইদানীং আমাকে খুব চিন্তিত করে রেখেছে। কয়েকদিন ধরেই ব্যাপারটা বলব বলে ভাবছি। বলি বলি করে আর বলা হয়ে ওঠেনি।” রাকিব ফুঁ দিয়ে বসার জায়গাটা পরিষ্কার করতে করতে বলল, “কোন্ বিষয়টা, দ্রুত বলে ফেল।”
“বিষয়টা হলো মানুষের আদি উৎস। তোর কী মনে হয়? মানুষের আদি উৎস কী? বিজ্ঞানের বইগুলোতে মানুষের আদি উৎসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার The Origin of Species বইয়ে প্রাণী জগতের উদ্ভব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের অবতারণা করেন। বিবর্তনবাদ মতে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে বানর জাতীয় মানুষ (Australopithecines) থেকে পর্যায়ক্রমে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে। আবার ধর্মতত্ত্বানুসারে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই গঠন ও আকৃতি দিয়ে, যে গঠন ও আকৃতি এখন দেখা যায়।” তৌফিক কফির কাপে চুমুক দিল। রাকিব বলল, “তাহলে প্রশ্নের অবতারণা হয় যে আমরা কোন্ তত্ত্বটিকে মেনে নেব। যদি বিবর্তনবাদ তত্ত্ব মেনে নিই তাহলে এটা মেনে নিতে হয় যে, মানুষ ও অন্যান্য জীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্রমান্বয়ে উদ্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে ধর্ম প্রস্তাবিত কথাগুলোকে অস্বীকার করা ছাড়া উপায় থাকে না। আবার যদি এটা মেনে নিই যে মানুষকে তার বর্তমান আকৃতিতেই সৃষ্টি করা হয়েছে তাহলে বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করতে হয়। ঠিক এ প্রশ্নটাই আমার মাথায়ও এসেছিল। তাই আমি এ বিষয়ে কিছুটা পড়েছিও।” রাকিবকে একই বিষয়ে ভাবতে দেখে তৌফিক মনে মনে খুশি হল। সে প্রশ্ন করল, “কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব কিভাবে সত্য হয়? বানর থেকে মানুষ আসার বিষয়টি সাধারণ জ্ঞানেই তো বোধগম্য হয় না!”
Finch পাখির ঠোঁট: ডারউইন এগুলোকে গালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে দেখেছিলেন এবং তার তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরেছিলেন। আসলে, পাখির ঠোঁটের এ বিভিন্নতার কারণ হলো Genetic Variation, কোন Macro-evolution নয়।
“ব্যাপারটা স্পষ্ট। বিবর্তন তত্ত্বটি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন কর্তৃক প্রস্তাবিত একটা ধারণা বা মতবাদ। কিন্তু এই মতবাদটি ডারউইনের বইয়ে যখন প্রথম অবতারণা করা হয় এরপর থেকে গত ১৫০ বছর যাবৎ তত্ত্বটিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ধারণাটি এখনও হাইপোথিসিস হিসেবেই রয়ে গেছে। বরং অনুসন্ধানের ফলে এর বিপরীতে যত প্রমাণ বের হয়ে এসেছে তা এর পক্ষে উপস্থাপিত প্রমাণের চেয়ে অনেক বেশি। এরপরও পশ্চিমা বিজ্ঞানজগতের বিভিন্ন প্রকাশনা, ডকুমেন্টারি দেখলে মনে হয় বিবর্তনকে একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। এমনকি সমগ্র বিশ্বেই এটিকে স্কুল কলেজগুলোর পাঠ্যক্রমে একটি প্রমাণিত সত্য হিসেবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। যদিও আমাদের দেশে সৌভাগ্যক্রমে সে পরিমাণটা খুবই সামান্য!”
“তাহলে বিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে বিবর্তন মতবাদটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে প্রতিটি জীবকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি জীব যদি সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে বিজ্ঞান জগতে স্রষ্টায় অবিশ্বাসীর সংখ্যা এত বেশি কেন?” তৌফিক প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকালো।
“বিবর্তনবাদ মতবাদটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলেও বস্তুবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রভাবিত সমাজব্যবস্থায় এখনও এ মতবাদটিকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত রাখার ফলে উক্ত সমাজে গড়ে ওঠা বিজ্ঞানীরা নাস্তিক হয়ে বড় হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে বিবর্তনবাদ নিজেই একটি বিশ্বাসের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এর সাথে বিজ্ঞানের ন্যূনতম সম্পর্কও নেই।” রাকিব কফিটা শেষ করতে করতে উত্তর করল।
তৌফিক হঠাৎ করে পাশের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে তুই বলছিস এখানে বিশ্বাস বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে, বিজ্ঞান দ্বারা জ্ঞান পরিমার্জিত হয়নি? বিজ্ঞানের ওপর অন্ধবিশ্বাসের জয় হয়েছে?” রাকিব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। সে তার হাতের কফির কাপটাকে মোচড়াতে মোচড়াতে বলল, “তবে সাধারণে এটা প্রচলিত যে, ধর্ম শুধুমাত্র বিশ্বাসের ব্যাপার আর বিজ্ঞান হলো পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা লব্ধ জ্ঞান। সুতরাং এখানে বিশ্বাসের কোন প্রশ্নই আসে না। এ ধারণাটাকে পুঁজি করে যদি বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে উপস্থাপন করা যায় তাহলেই বস্তুবাদীদের কার্যোদ্ধার হয়। আর সে কাজটাই করেছে প্রচারমাধ্যম। ফলে দেখা যায়, জীববিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মানব ইতিহাস এমনকি অর্থনীতি রাজনীতিও বিবর্তনবাদ দ্বারা প্রভাবিত এবং এ সংক্রান্ত রচনা ও প্রবন্ধের বইগুলোতে বিবর্তনবাদকে প্রমাণিত সত্য ধরে নিয়ে লিখা হয়।”
তৌফিক কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “বিবর্তনবাদ না হয় জীববিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিতে বিবর্তনবাদের প্রভাবের ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারছি না!”
“কেন তুই কী আমাদের মাধ্যমিক সমাজবিজ্ঞান বইয়ে পড়িসনি- প্রস্তরযুগ, ব্রোঞ্জযুগ, লৌহযুগের কথা? মানব ইতিহাসের এ পর্যায়গুলো তো বিবর্তনবাদী চিন্তাধারারই ফসল। এ সম্বন্ধে জানার জন্য আমাদের বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কী বলে? কীভাবে এটি প্রমাণ উপস্থাপন করে? কীভাবে বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আলোকে এটি ভুল প্রমাণিত হয়? বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের আদি উৎস সম্পর্কে কী বলে?”
রাকিব আর তৌফিক দু’জনই বেঞ্চ থেকে উঠে দোয়েল চত্বরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। রাকিব বলতে থাকে, “আমার পরিচিত এক বড় ভাই আছে। তার নাম রাজীব। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তার এ ব্যাপারে ভালো পড়াশোনা করা আছে। মাঝে মধ্যেই তার সাথে আমার আলাপ হয়। চল আমরা একদিন তার কাছে যাই।”
“দোস্ত আগামীকালই যাওয়া যায় কি-না দেখ। ব্যাপারটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।”
“ঠিক আছে আমি আজ ফোন করে রাজীব ভাইয়ের কাছে থেকে সময় চেয়ে নেব।”
ফোনের কথা বলতে না বলতেই তৌফিকের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। তৌফিক ফোনে কথা শেষ করে বলল, “রাকিব বাসা থেকে ফোন এসেছে। জরুরি কাজ আছে বাসায় ফিরতে হবে। আজ আসি।”
রাকিব আর তৌফিক সালাম বিনিময় করে বিদায় নিল। তৌফিক একটা রিকশা করে সেগুনবাগিচার দিকে গেল আর রাকিব শাহবাগের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
দুই.
“আগামীকাল বিকেলে রাজীব ভাই সময় দিয়েছেন। তুই প্রস্তুতি নিয়ে আসিস,” তৌফিককে ফোনে জানাল রাকিব। বিবর্তনবাদ যদি প্রমাণিত না-ই হয় তাহলে বৈজ্ঞানিক সমাজ কেন এটাকে গ্রহণ করে আছে? বিবর্তনবাদ সমাজবিজ্ঞানে কীভাবে প্রভাব রাখল? প্রস্তরযুগ, লৌহযুগ, ব্রোঞ্জযুগের সত্যতাটা কী? কীভাবে বিবর্তনবাদ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মতবাদগুলোকেও প্রভাবিত করল? এরকম নানা প্রশ্ন তৌফিকের মনে তৈরি হতে থাকে। পরদিন বিকেলে রাকিব তৌফিককে নিয়ে বকশিবাজার ডা. ফজলে রাব্বি হলে আসে। হলের গেটে রাজীব ভাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। গেটে সালাম বিনিময়ের পর রাজীব ভাই ওদের নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। রাকিব এর আগেও এখানে এসেছিল। তার কাছে কোন কিছু নতুন নয়। অন্য দিকে তৌফিক হোস্টেলটির সাথে নিজের হোস্টেলের পার্থক্য আর মিলগুলো খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। রাজিব ভাই যে রুমে থাকে সেটি গেট দিয়ে ঢুকতে দুই নম্বর বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায়। রুম নং বি-৪। রাজীব ভাই জানালেন এ বিল্ডিংকে ব্লক বলে। কথোপকথনের শুরুতে রাজীব ভাই তৌফিকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জেনে নিলেন। এরপর তিনি তার শেল্ফ থেকে কয়েকটি বই বের করলেন।
“বিবর্তনবাদকে বুঝতে হলে আমাদের জানা দরকার- বিজ্ঞানী ডারউইনের বই Origion of Species-এ বিবর্তন সম্পর্কে যে ধারণাটি পেশ করা হয়েছে তা কী? সেটি হল, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তি বা অস্তিত্বের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যোগ্যতমের উর্দ্ধতন। তার তত্ত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো হলো-
১. দৈবাৎ স্বয়ংক্রিয় ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবের উৎপত্তি।
২. প্রাকৃতিক নির্বাচন।
৩. বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম।
আরেকটু বিস্তারিত বললে- প্রথমত, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব অনুসারে জীবন্ত বস্তু অস্তিত্বে এসেছে দৈবাৎ কাকতালীয়ভাবে এবং পরবর্তীতে উন্নত হয়েছে আরও কিছু কাকতালীয় ঘটনার প্রভাবে। প্রায় ৩৮ বিলিয়ন বছর আগে, যখন পৃথিবীতে কোন জীবন্ত বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না, তখন প্রথম সরল এককোষী জীবের (আদিকোষ) উদ্ভব হয়। সময়ের পরিক্রমায় আরও জটিল এককোষী এবং বহুকোষী জীব অস্তিত্বে আসে। অন্য কথায় ডারউইনের তত্ত্বানুসারে প্রাকৃতিক শক্তি সরল প্রাণহীন উপাদানকে অত্যন্ত জটিল এবং খুঁতহীন পরিকল্পনাতে পরিণত করেছে! [১]
দ্বিতীয়ত, ডারউইনবাদের মূলে ছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা।… প্রাকৃতিক নির্বাচন এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য একটি সার্বক্ষণিক সংগ্রাম বিদ্যমান। এটা সে সকল জীবকে অগ্রাধিকার দেয় যাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সবচেয়ে শক্তিশালী, ফলে প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে সবচেয়ে বেশি খাপ খাওয়ানো প্রজাতিটি বেঁচে থাকে। যে সকল হরিণ সবচেয়ে বেশি দ্রুতগামী তারাই শিকারী পশুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। অবশেষে হরিণের পালটিতে শুধু দ্রুতগামী হরিণগুলোই টিকে থাকবে।
(কিন্তু লক্ষ্য রাখবে, যত সময় ধরেই উক্ত প্রক্রিয়াটি চলুক না কেন এটা সেই হরিণগুলোকে অন্য প্রজাতিতে পরিণত করবে না। দুর্বল দূরীভূত হবে, শক্তিশালী জয়ী হবে কিন্তু জেনেটিক ডাটাতে কোন পরিবর্তন সূচিত না হওয়ায় প্রজাতিতে কোন পরিবর্তন আসবে না।)
হরিণের উদাহরণটি সকল প্রজাতির জন্যই সত্য। প্রাকৃতিক নির্বাচন শুধুমাত্র যারা দুর্বল অথবা যারা প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না, তাদেরকে দূরীভূত করে। এটা নতুন কোন প্রজাতি, কোন জেনেটিক তথ্য কিংবা কোন অঙ্গ তৈরি করে না। অর্থাৎ এটা কোন কিছুকে বিবর্তিত করতে সাহায্য করে না। ডারউইনও এই সত্যটাকে স্বীকার করেছিলেন এই বলে যে, “প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না যদি অগ্রাধিকার যোগ্য স্বাতন্ত্র পার্থক্য ও বৈচিত্র্য না ঘটে।” [২]
তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের প্রয়োজনীয় ধারণা অনুযায়ী প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য একটি ভয়ানক সংগ্রাম চলছে এবং প্রতিটি জীব শুধু নিজেকে নিয়েই চিন্তা করে। ডারউইন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাসের মত (idea) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ম্যালথাস মনে করতেন যে, মানবজাতিতে সন্দেহাতীতভাবে একটি সার্বক্ষণিক সংগ্রাম চলছে। তার চিন্তাভাবনার ভিত্তি ছিল এই যে, জনসংখ্যা এবং সেই সাথে খাদ্যের প্রয়োজন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, অন্যদিকে খাদ্যর ভাণ্ডার বাড়ছে গাণিতিক হারে। এর ফলে জনসংখ্যার আকৃতি অপরিহার্যভাবে প্রাকৃতিক নিয়ামক, যেমন ক্ষুধা ও রোগ, দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ডারউইন মানবজাতিতে ‘বাঁচার জন্য প্রচণ্ড সংগ্রাম’ সংক্রান্ত ম্যালথাসের দৃষ্টিভঙ্গিকে বড় আকারে একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করেন এবং বলেন যে, ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এ লড়াইয়ের ফল।
যদিও পরবর্তীতে অনুসন্ধানে প্রকাশিত হয় যে, প্রকৃতিতে জীবনের জন্য সেরকম কোন লড়াই সংঘটিত হচ্ছে না যেরূপ ডারউইন স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিয়েছিলেন। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ সালে একজন ব্রিটিশ প্রাণিবিজ্ঞানী ভি.সি. উইনে অ্যাডওয়ার্ডস এ উপসংহার টানেন যে, জীবজগৎ একটি কৌতুহলোদ্দীপক পন্থায় তাদের জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করে। “…. প্রাণীরা তাদের সংখ্যা কোন প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নয় বরং প্রজনন কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে করে।” [৩]
রাজীব ভাই এ পর্যন্ত বলার পর তৌফিক প্রশ্ন করল, “বিবর্তনবাদ ধারণাটিকে বিজ্ঞানী চালর্স ডারউইনই কি প্রথম উপস্থাপন করেন?”
রাজীব ভাই তার ডায়েরিটা খুলে নোট করা কিছু লেখা তৌফিক ও রাকিবকে দেখালেন। তিনি বললেন, “প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব নতুন কিছু নয়। বরং বহু প্রাচীন কালেই এ তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছিল।” এবার তিনি তার কিছু নোট করা লেখা পড়তে পড়তে বললেন, তুর্কী দার্শনিক হারুন ইয়াহিয়া লিখেন-
“(বিবর্তনবাদের) ধারণাটি প্রাচীন গ্রিসের কতিপয় নাস্তিক বহুশ্বেরবাদী দার্শনিক প্রথম প্রস্তাব করেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে সময়ের বিজ্ঞানীরা এমন একজন স্রষ্টায় বিশ্বাস করত, যিনি সমগ্র মহাবিশ্বের স্রষ্টা, ফলে এ সকল দার্শনিকদের ধারণা টিকতে পারেনি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর বস্তুবাদী চিন্তাধারার অগ্রগতির সাথে সাথে বিবর্তনবাদী চিন্তা পুনর্জীবন লাভ করে। [৪]
গ্রিক মাইলেশিয়ান দার্শনিকরা, যাদের কিনা পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা কিংবা জীববিদ্যার কোন জ্ঞানই ছিল না, তারাই ডারউনইবাদী চিন্তাধারার উৎস। থেলিস, অ্যানাক্সিম্যানডার, এমপোডোক্লেসদের মতো দার্শনিকদের একটি মত ছিল জীবন্ত বস্তু প্রাণহীন বস্তু থেকে তথা বাতাস, আগুন এবং পানি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এ তত্ত্ব মতে প্রথম জীবন্ত জিনিসটিও পানি থেকে হঠাৎ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয় এবং পরে কিছু জীব পানি থেকে মাটিতে উঠে এসে বাস করতে শুরু করে। [৫]
মাইলেশিয়ান গ্রিক দার্শনিক থেলিস (Thales) প্রথম স্বয়ং উৎপত্তিসংক্রান্ত ধারণার মত প্রকাশ করেন। অ্যাক্সিম্যানডার তার সময়কালের ঐতিহ্যগত ধারণা যে, জীবন কিছু সূর্যরশ্মির সাহায্যে ‘Pre-biotic Soap’ থেকে উৎপন্ন হয়, তা উপস্থাপন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রথম প্রাণীটির উদ্ভব হয়েছে সূর্যরশ্মির দ্বারা বাষ্পীভূত সামুদ্রিক আঠালো কাদা মাটি (Seaslime) থেকে।
বস্তুপূজারীদের মতো ডারউইনবাদীরা বিশ্বাস করে যে দৈবাৎ পানির মধ্য থেকে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে। এই অবোধগম্য দাবি অনুসারে ছবিতে প্রদর্শিত তথাকথিত ‘Pre-biotic soap’ থেকে কতগুলো জ্ঞানহীন পরমাণু একত্রিত হয় এবং জীবন গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
চার্লস ডারউইনের ধারণাও উক্ত বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ডারউইনের ‘প্রজাতির মধ্যে অস্তিত্বের লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন’ ধারণাটির মূল নিহিত রয়েছে গ্রিক দর্শনে। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের থিসিস অনুযায়ী জীবজগতে সার্বক্ষণিক লড়াই সংঘটিত হচ্ছে। [৬]
আবার, গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস বিবর্তনবাদ তত্ত্বের প্রস্তুতিতে ভূমিকা রাখেন, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যেই বস্তুবাদী চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত তিনি তার ভিত্ রচনা করেন। তার মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছোট ছোট বস্তুকণা দ্বারা গঠিত এবং বস্তুছাড়া অন্য কিছুরই অস্তিত্ব নেই। পরমাণু সবসময়ই বিরাজমান ছিল যা সৃষ্টি ও ধ্বংসহীন। [৭]
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলও ডারউইনবাদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরিস্টটলের মতে জীব প্রজাতিসমূহকে সরল থেকে জটিলের দিকে একটি হাইয়ারার্কিতে সাজানো যায় এবং তাদেরকে মইয়ের মতো একটি সরল রেখায় আনা যায়। তিনি এ তত্ত্বটিকে বলেন- ‘Scala Naturae’। এরিস্টটলের এ ধারণা অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের চিন্তাচেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং পরে তা ‘The Great Chain of Being’- এ বিশ্বাসের উৎসে পরিণত হয়, পরবর্তীতে যেটা বিবর্তনবাদ তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়।
‘The Great Chain of Being’-একটি দার্শনিক ধারণা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এ বিশ্বাস অনুসারে ছোট ছোট জীব ধাপে ধাপে বড় জীবে পরিণত হয়। উক্ত ‘chain’-এ প্রতিটি জীবেরই একটি অবস্থান আছে। এ ধারণা অনুসারে পাথর, ধাতু, পানি এবং বাতাস ক্রমে কোন প্রকার বাঁধা ছাড়াই জীবন্ত বস্তুতে পরিণত হয়, তা থেকে হয় প্রাণী ও প্রাণী থেকে হয় মানবজাতি।
‘The Great Chain of Being’ ধারণাটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে রেনেসাঁ পর্যন্ত বেশ বিখ্যাত ছিল এবং সে যুগের বস্তুবাদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল। ফরাসি বিবর্তনবাদী কোঁতে ডি বুফন (Comte de Bufon) অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্যতম বহুল পরিচিত বিজ্ঞানী ছিলেন। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় যাবৎ তিনি প্যারিসের ‘রয়াল বোটানিক্যাল গার্ডেন’-র পরিচালক ছিলেন। ডারউইন তার তত্ত্বের একটি বড় অংশ বুফনের কাজের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেন। বিজ্ঞানী ডারউইনের (তত্ত্ব উপস্থাপন করতে) যে সকল উপাদান ব্যবহার করা দরকার ছিল তা (কোঁতে ডি বুফনের) ৪৪ খণ্ডের পুস্তক ‘Historie Naturelle’-তে পাওয়া যায়। ডি বুফন এবং লামার্ক দু’জনেরই বিবর্তনসংক্রান্ত তত্ত্বের ভিত্তি ছিল ‘Great Chain of Being’-র ধারণা।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব প্রাচীন গ্রিক উপকথা ‘The Great Chain of Being’-র আধুনিক রূপান্তর ছাড়া কিছুই নয়। ডারউইনের আগেও বিবর্তনবাদী ছিল এবং তাদের তথাকথিত ধারণা ও প্রমাণাদি উক্ত মতবাদে পাওয়া যেত। ডি বুফন ও লামার্ক ‘Great Chain of Being’-কে বিজ্ঞান জগতে একটি নতুন আকারে প্রকাশ করেন যা ডারউইনকে প্রভাবিত করেছিল।
…. লরেন আইসল তার Darwin’s Century-বইতে উল্লেখ করেন, “অষ্টাদশ শতাব্দীর অস্তিত্বের ক্রমবিকাশের ধারণাকে ডারউইন তার বই Origin of Species-এ ব্যবহার করেন এবং এ ধারণাটিও সেখান থেকে উৎপত্তি লাভ করে যে সমগ্র জৈব পদার্থ পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।” [৮] রাজীব ভাই এ পর্যন্ত পড়ে শোনালেন।
রাকিব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখছিলো। আছরের আজান হয়ে গেছে। ওরা বের হয়ে হলের মসজিদের দিকে নামাজ আদায় করার জন্য এগোতে থাকলো। নামাজের পর রাজীব ভাই রাকিব আর তৌফিককে নাশতা করালেন। চা খেতে খেতে তৌফিক বলল, “রাজীব ভাই, আপনি এতক্ষণ যা বললেন তাতে বোঝা যায় যে বিবর্তনবাদী চিন্তাধারা অনেক বছর ধরেই সমাজে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছিল। আর এ ব্যাপারে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিজ্ঞানী লামার্কের বিশেষ অবদান ছিল।”
“তুমি ঠিকই বলেছ, বিবর্তনবাদ তত্ত্বের মূল প্রাচীন গ্রিসে নিহিত হলেও এটিকে বিজ্ঞান জগতের মনোযোগের বিষয় পরিণত করা হয উনবিংশ শতাব্দীতে। ফ্রেঞ্চ জীববিজানী জন ব্যাপটিস্ট লামার্ক তার Zoological Philosophy (১৮০৯) গ্রন্থে বিবর্তনবাদ সম্পর্কিত সবচেয়ে বিস্তারিত দর্শন প্রকাশ করেন। লামার্ক ভেবেছিলেন যে, প্রতিটি জীবের মধ্যেই একটি জীবনী শক্তি (vital force) কাজ করে যেটি তাদেরকে জটিল গঠনের দিকে বিবর্তনের জন্য চালিত করে। তিনি এটাও ভেবেছিলেন যে, জীবেরা তাদের জীবনকালে অর্জিত গুণাবলি তাদের বংশধরে প্রবাহিত করতে পারে। এ ধরণের যুক্তি পেশ করার একটি উদাহরণ হল লামার্কের জিরাফ সম্পর্কিত প্রস্তাবনা। তিনি বলেছিলেন- জিরাফের লম্বা ঘাড় বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে তখন, যখন তাদের পূর্ববর্তী কোন খাটো ঘাড়ের প্রজাতি ঘাসে খাবার খোঁজার পরিবর্তে গাছের পাতা খুঁজতে থাকে। কিন্তু লামার্কের এই বিবর্তনবাদী মডেল বংশানুক্রমিকতার জিনতত্ত্বীয় মডেল দ্বারা বাতিল প্রমাণিত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যবতী সময়ে ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কারের ফলে প্রকাশিত হয় যে, জীবিত বস্তুর কোষের নিউক্লিয়াস বিশেষ ধরণের জৈবিক সঙ্কেত ধারণ করে এবং এ তথ্য অন্য কোন অর্জিত গুণ দ্বারা পরিবর্তনযোগ্য নয়। অন্য কথায় জিরাফের জীবনকালে জিরাফ যদি গাছের উপরের শাখাগুলোর দিকে ঘাড় লম্বা করতে গিয়ে তার ঘাড়কে কিছুটা লম্বা করে ফেলতে সক্ষম হয়ও তবুও তা তার বংশধরে পৌঁছাবে না। সংক্ষেপে লামার্কের তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার দ্বারা বাতিল হয়ে গেছে এবং তা একটি ত্রুটিপূর্ণ ধারণা হিসেবে ইতিহাসে রয়ে গেছে।” [৯]
তৌফিকরা নাশতা শেষ করলে রাজীব ভাই আবার তাদের রুমে নিয়ে গেলেন। তৌফিক বলল, “আপনার কথা থেকে মনে হচ্ছে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব কিছু পর্যবেক্ষণের ওপর নির্মিত একটি দর্শন বা মতবাদ, যা কিনা গ্রিক দার্শনিকরা প্রথম প্রস্তাব করেন এবং ক্রমান্বয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের হাতে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের রূপ লাভ করে।”
“কিন্তু, রাজীব ভাই, সকল জীব প্রজাতিকে যদি সরল থেকে ক্রমান্বয়ে জটিলের দিকে সাজানোই যায়, তাহলে এ সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, জীব প্রজাতি ক্রমাগত বিবর্তনের মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছে।” রাকিব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রাজীব ভাইয়ের দিকে তাকালো।
রাজীব ভাই বললেন, “ঠিক! এমনকি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ মতবাদের কট্টর সমর্থক ও প্রচারক Earnst Hackel এ সংক্রান্ত একটি স্কেচও করেন, যা ‘Tree of Life’ নামে অভিহিত। তোমরা হয়তো উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান বইয়ে এটি দেখে থাকবে।
তৌফিক জিজ্ঞাসা করলো, “Tree of Life কী?”
Tree of Life: বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী Earnst Hackel কর্তৃক অঙ্কিত ‘Tree of Life’
রাজীব ভাই বললেন, “এ বিষয়টি জানার আগে আমাদের জানা থাকা দরকার, তোমরা হয়তো ইতোমধ্যে জেনেও থাকবে যে, সমগ্র জীবজগৎকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে কতগুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে জীবজগতে একটি জীবের শ্রেণীবিন্যাসগত যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে থাকে- জগৎ (Kingdom), পর্ব (Phylum), শ্রেণী (Class), বর্গ (Order), গোত্র (Family), গন (Genus) এবং প্রজাতি (Species)।
আমরা জানি, সমগ্র জীবজগৎকে মোটামুটি ৫টি জগতে ভাগ করা যায়। এরা হলো প্রাণীজগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, ছত্রাক, প্রোটিস্টা এবং মনেরা। তন্মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ হলো প্রাণীজগৎ। প্রাণীজগতে ৩৫টির মতো পর্ব রয়েছে। তার মধ্যে প্রোটোজয়া, নিডোফোরা, প্লাটিহেলমিনথেস, নেমাটোডা, মলাস্ক, আর্থ্র্রোপোডা এবং কর্ডাটা সম্পর্কে আমরা পড়েছি কিন্তু আমরা এও জানি যদিও প্রজাতিগুলোর কতগুলো সমবৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এগুলোকে বিভিন্ন পর্বে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তথাপি প্রতিটি প্রজাতিই স্বতন্ত্র। প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে এই বিষয়গুলো আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন কর্ডাটা পর্বের মামালিয়া উপপর্বের দু’টি প্রজাতি হলো বানর ও বেবুন। যদিও এরা দেখতে প্রায় একই রকম কিন্তু এদের মধ্যে সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র পার্থক্য আছে।” [১০]
তৌফিক কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “যদি প্রজাতিগুলোর মধ্যে বিবর্তন প্রক্রিয়াটি সত্যিই সংঘটিত হয়ে থাকে তাহলে তো দু’টি কাছাকাছি প্রজাতির মধ্যে একটি অবস্থান্তরবর্তী (Transitional) প্রজাতি থাকার কথা। বিবর্তনবাদীরা যেমন বলে যে মাছ থেকে সরীসৃপ হয়েছে। সেক্ষেত্রে মাছ ও সরীসৃপের মধ্যবর্তী প্রজাতি থাকার কথা।”
রাজীব ভাই বললেন, “এক্স্যাক্টলি, তাহলে প্রশ্ন হয় যে বর্তমানে এ ধরণের প্রজাতি নেই কেন? এর উত্তরে ডারউইন বলেন, প্রাকৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে উন্নত প্রজাতি বাছাই হয়ে গেলে বিবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী সে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে জীবাশ্মের মধ্যে সেই অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির সন্ধান পাওয়ার কথা। এ ব্যাপারটি ডারউইন নিজেও অনুভব করেছিলেন। তার বইয়ের Difficulties of the theory অধ্যায়ে তিনি নিজেই এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন এভাবে- কিন্তু যদিও এ তত্ত্বানুসারে অসংখ্য মধ্যবর্তী রূপ (Transitional Form) থাকার কথা তথাপি আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠে তাদের অগণিত সংখ্যায় প্রোথিত পাচ্ছি না কেন?” [১১]
“ডারউইন তার উত্থাপিত প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন এই বলে যে, জীবাশ্ম রেকর্ড খুবই অসম্পূর্ণ। কিন্তু ডারউইন এ তত্ত্ব দেয়ার পর গত ১৫০ বছর যাবৎ মিলিয়ন মিলিয়ন জীবাশ্ম উদ্ধার করে রেকর্ড করা হয়েছে। জীবাশ্ম রেকর্ড এখন প্রায় সম্পূর্ণ। কিন্তু এখনও ডারউইনের উক্ত প্রশ্নের কোন সমাধান হয়নি। এ ব্যাপারে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জীবাশ্মবিদ্যায় পারদর্শী একজন একনিষ্ঠ বিজ্ঞান রবার্ট ক্যারোল স্বীকার করেন যে, ডারউইনের মৃত্যুর পর একশত বছরের ব্যাপক সংগ্রহ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অসংখ্য মধ্যবর্তী সংযোজনকারী প্রজাতির যে চিত্র আশা করা হচ্ছিল তা দেখা যাচ্ছে না।” [১২]
“বিবর্তনবাদীদের এ ধরণের মন্তব্য থেকে লক্ষণীয় যে, তারা সুস্পষ্টভাবে তাদের তত্ত্বের ভিত্তি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে অন্ধবিশ্বাসী হয়ে আছে। আর হ্যাঁ, ট্রি অব লাইফ-এর ধারণা সম্পর্কে হারুণ ইয়াহিয়া লিখেন, ট্রি অফ লাইফ অনুযায়ী পর্বসমূহ (Phylum) পর্যায়ক্রমে স্তরে স্তরে আবির্ভূত (Emerge) হয়েছে। ডারউইনবাদ অনুসারে, প্রথমে একটি পর্বকে অবশ্যই আবির্ভূত হতে হবে এবং তারপর অন্য পর্বসমূহ ব্যাপক সময়ের ব্যবধানে অল্প অল্প করে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হতে থাকবে। নিচের চিত্রটিতে ডারউইনবাদীদের চোখে প্রাণীর পর্বের সংখ্যার পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির ব্যাপারটি দেখানো হয়েছে। বিবর্তনবাদ অনুসারে জীবন এভাবেই তৈরী হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তাই? নিশ্চয় না। বরঞ্চ, প্রাণীরা তাদের আবির্ভাবকাল থেকেই সম্পূর্ণ পৃথক ও জটিল গঠনের অধিকারী ছিল। বর্তমানে জ্ঞাত সকল প্রাণী পর্বসমূহ (Animal Phyla) জিওলজিকাল পিরিওডের ঠিক মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হয়। এ সময়টিকে বলা হয় ক্যামব্রিয়ান এরা (Cambrian Era)। ক্যামব্রিয়ান এরা হলো জিওলজিকাল পিরিয়ডের ৬৫ মিলিয়ন বছর দীর্ঘ একটি সময় যার বিস্তৃতি ৫৭০ থেকে ৫০৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত। কিন্তু অধিকাংশ প্রাণী পর্বসমূহের হঠাৎ আবির্ভাবকে ক্যামব্রিয়ানের মধ্যবর্তী আরও ক্ষুদ্র সময়ের একটি দশায় স্থাপন করা যায়, যা ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশন নামে অভিহিত।…. এ সময়ের আগে, এককোষী জীব ও কিছু আদিম (Primitive) কিন্তু জটিল বহুকোষী জীব যেমন ট্রাইলোবাইট, এনোমেলোক্যারিস ইত্যাদি ছাড়া কোন জীবাশ্ম পাওয়া যায় না। সকল প্রাণী পর্বসমূহ সম্পূর্ণ সুগঠিতভাবে একই সঙ্গে আবির্ভূত হয় অতি ক্ষুদ্র এই সময়টিতে।” [১৩]
জীবাশ্ম রেকর্ড বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করে
বিবর্তনবাদ বলে জীবজগতের বিভিন্ন দলসমূহ একই পূর্ব-পুরুষ (প্রজাতি) থেকে এসেছে এবং সময়ের পরিক্রমায় পৃথক হয়ে গেছে। উপরের ছবিটি এই দাবিটি উপস্থাপন করে। ডারউইনবাদীদের মতে জীবসমূহ পরস্পর থেকে গাছের শাখা প্রশাখার মত পৃথক হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ফসিল রেকর্ড তার বিপরীত অবস্থাই প্রদর্শন করে। উপরের চিত্রটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, জীবজগতের বিভিন্ন দলসমূহ তথা পর্বসমূহ হঠাৎ তাদের বিভিন্ন গঠনসহ আবির্ভূত হয়। Cambrian era-তে ১০০টির মতো পর্ব হঠাৎ উত্থিত (Emerge) হয়। পরবর্তীতে সংখ্যাটা না বেড়ে কমতে থাকে। কেননা কিছু পর্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। (From: www.arn.org)
রাকিব রাজীব ভাইয়ের সাথে সংযুক্ত করল, “ডারউইন প্রাণীর সঙ্করায়ণের ওপর পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, এ প্রক্রিয়ায় অধিক উৎপাদনশীল প্রাণী (যেমন অধিক উৎপাদনশীল গরু) উৎপন্ন হচ্ছে। এর ওপর ভিত্তি করে তিনি বলেন যে, এভাবে ক্রমাগত একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের অবস্থার মধ্যে থাকতে থাকতেই কোন প্রজাতিতে পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে। কিন্তু তাতে যত পরিবতন হোক গরু তো গরুই থাকছে। এটাই বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। এ ব্যাপারে মাওলানা আব্দুর রহীম তার বিবর্তনবাদ ও স্রষ্টাতত্ত্ব বইয়ে লিখেছেন, “জীবজন্তুর বংশবৃদ্ধিজনিত অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দৈহিক আঙ্গিকতার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের দ্বিতীয় রূপ। ডারউইনের বিশেষ মতদার্শের প্রাসাদ এর-ই ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বংশবৃদ্ধিতত্ত্বে পারদর্শী লোকেরা ঘোড়া, গরু, মেষ, হাঁস-মুরগির বিভিন্ন বিশেষত্ব সম্পন্ন বহু উত্তম ও উন্নতমানের বংশ উদ্ভাবন করে থাকেন। এ বিশেষত্বসমূহ বংশানুক্রমিক হয়। মুরগির বংশবৃদ্ধি তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। বেশি বেশি ডিম দানে সক্ষম কিংবা বেশি হৃষ্টপুষ্ট মুরগি অধিক গোশতসম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদনে সক্ষম হয়। এ থেকে ডারউইন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছেন যে, লালন পালন পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করে অধিক উন্নতমানের বংশ উদ্ভাবন করা সম্ভব। আর এ বিশেষত্ব বংশানুক্রমিকতার সাহায্যে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।
এ কথা অনেকটা সত্য এবং অনস্বীকার্য, কিন্তু তা যতটা পর্যবেক্ষণে আসে ততটাই, তার বেশি নয়। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিভিন্ন জীববংশে সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উন্নতি ও উৎকর্ষ বিধান এবং তা অধস্তন বংশে সংক্রমণ করাই ছিল আসল লক্ষ্য। তার কার্যক্রম ও পদ্ধতি কী হতে পারে তা-ই ছিল প্রশ্ন। কিন্তু যে প্রাণীগুলোর মধ্যে আদৌ কোন বিশেষত্ব নেই সেগুলোকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।
এ জন্য কেবলমাত্র বাছাই করা ও উন্নতমানের বংশকেই গ্রহণ করা হয়েছে। খারাপ ও অনুন্নতমানের বংশ নিয়ে কখনও এ প্রচেষ্টা চালানো হয়নি নিতান্ত নিষ্ফল ও পণ্ডশ্রম মনে করে। এ জন্য বংশানুক্রমিকতার বিধান ও খাদ্যের বিশেষ অধ্যয়ন চলছে। কিন্তু এসবের মূলে দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কোনরূপ মৌলিক ও আঙ্গিক পরিবর্তন সাধন কখনও লক্ষ্য ছিল না। আঙ্গিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কখনই এরূপ করা হয়নি।
অবস্থিত মৌলিক বিশেষত্বে উন্নতি বিধান ও উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যেই এ সব করা হয়েছে। কিন্তু বংশবৃদ্ধি তত্ত্বে পারদর্শীদের এসব অভিজ্ঞতাকে দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাঠামো পরিবর্তন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার চিন্তা কেবলমাত্র ডারউইনের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত এবং তাকে বংশানুক্রমিক বলে তার মতাদর্শের ওপর ভিত্তি উপস্থাপন করা তার-ই অভিনব ও হাস্যকর বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। অথচ চেষ্টালব্ধ বিশেষত্ব চিরকালই ক্ষণস্থায়ী, তা কখনো বংশানুক্রমিক হয় না। প্রকৃতপক্ষে সংকরায়ণের মাধ্যমে উত্তম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব উৎপাদন করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে জীবগুলো উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এটাকে সহজভাবে বুঝতে হলে মনে করি অধিক দুধ দিতে সক্ষম দুটো প্রজাতির গরুতে সংকরায়ণ করা হলো। এভাবে যে বাছুরটি জন্ম নেবে সে পরবর্তীতে আরও বেশী দুধ দিবে। পরবর্তীতে এ ধরণের দুটো গরুতে পুনরায় বংশবৃদ্ধি করা হলো। পরবর্তী গরুটি হয়ত আরও দুধ দিতে সক্ষম হবে কিন্তু প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি পরবর্তী বংশধর তৈরীর প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দেহে পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ কোথায়। বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা তাদের বক্তব্যে এ বিষয়টি চতুরতার সাথে এড়িয়ে যায়।”
মাওলানা আরও লিখেন, “কিন্তু উত্তরাধিকার বিধান সম্পর্কে ডারউইন চরমভাবে অজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ। মেন্ডেলের বৈজ্ঞানিক গবেষণা তার জ্ঞান বহির্ভূত। নিছক চিন্তাবিলাস ও আকাশ কুসুম কল্পনাই তার একমাত্র মূলধন। যে জিনিসকে তিনি বংশানুক্রমিক বলে অভিহিত করেছেন, তা যে আদৌ বংশানুক্রমকি নয় তাও তার অজানা।
উইলিয়াম বেক লিখেছেন: ‘জীবজন্তুর বংশে কোন-কোন পরিবর্তন বা পার্থক্য সূচিত হতে থাকে প্রকৃতপক্ষে এ ধারণাই ক্রমবিকাশ তত্ত্বের ভিত্তি। ডারউইন মেন্ডেলের গবেষণা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তার গ্রন্থ অরিজিন অব স্পিসিজ থেকে স্পষ্ট মনে হয়, উপার্জিত পরিবর্তনসমূহ বংশানুক্রমিক হবে- এ কল্পনাকে বাস্তব প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ডারউইন দৈহিক পরিবর্তনসমূহকে খুব ভয়ে ভয়ে ও সঙ্কোচসিদ্ধ পেঁচানো পন্থায় পেশ করেছেন।’ [৩৩] কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেন্ডেলের গবেষণা ফল যখন আত্মপ্রকাশ করল এবং তিনি যখন বংশানুক্রমিকতার বিধান ব্যাখ্যা করলেন তখন ডারউইনের কল্পনার ভিত্তিহীনতা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। আর চেষ্টা সাধনা ও দ্বন্দ্ব সংগ্রামলব্ধ উপার্জিত বিশেষত্ব যে বংশানুক্রমিক হয় না তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকল না।
বস্তুত জীবদেহের প্রতিটি কোষে এক বিশেষ ধরণের জীবাণু থাকে। তার নাম ক্রোমাসোম। প্রত্যেক প্রজাতির জীবের জন্য ক্রোমোসমের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন। মানবদেহের প্রতিটি কোষে তেইশ জোড়া (৪৬টি) ক্রোমোসোম থাকে। ইউরোপের উন্নতমানের সংস্কৃতিসম্পন্ন শ্বেতাঙ্গ মানুষ কিংবা আফ্রিকার বৃহদাকার আরণ্যিক অথবা পিতবর্ণের চৈনিক বা রেড ইন্ডিয়ান যেই হোক, সকলের ক্ষেত্রেই এ কথা সমানভাবে সত্য। আর এ ক্রোমোসোমই হয় উত্তরাধিকারমূলক গুণের ধারক। তা-ই হয় জীবন স্থির রাখার নিরামক।
গর্ভধারণের মাধ্যমে জীবন সংক্রমণের জন্যও তা-ই দায়ী। গ্রেগর মেন্ডেলের আবিষ্কার এবং পরবর্তীকালের গবেষণায় এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে প্রতিটি ক্রোমোসোমে থাকে জিন, যা বংশগতির তথ্য ধারণ করে রাখে। জিনের মধ্যে কোন পরিবর্তন না হলে কোন জীবের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসমূহের কোনটাই পরিবর্তিত হওয়া সম্ভব নয়।” [১৪]
রাকিব তার সাথে নিয়ে আসা ডায়েরি থেকে কথাগুলো পড়ে শোনাল। তৌফিক বললো- “ডারউইনের সময়ে যে অনুন্নত অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছিল তাতে প্রতিটি কোষকে একটি প্রকোষ্ঠ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের ফলে একটি সাধারণ কোষের গঠন যে কত জটিল তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অতএব, স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন পদার্থ থেকে কোষের উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণা স্পষ্টতই অযৌক্তিক।”
তৌফিকের কথা শেষ হতে হতে মাগরিবের আজান পড়ে গেল। নামাজ আদায়ের পর রাজীব ভাই তৌফিক ও রাকিবের সাথে ঠিক করলেন আজকের মতো এখানেই তাদের আলোচনা সমাপ্ত। তবে আগামী শুক্রবার তারা আবার বসুন্ধরা সিটির আট তলায় মিলিত হবেন।
তিন.
শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় বসুন্ধরা সিটির নিচে পানির ফোয়ারার কাছে দাঁড়িয়ে রাজীব ভাই অপেক্ষা করছিলেন রাকিব ও তৌফিকের জন্য। বাদ আসর তাদের মিলিত হওয়ার কথা। রাজীব ভাই আজকে তার সাথে তার এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন। নাম ওমর। ওমর ভাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল সেমিস্টারে আছেন। কিছুক্ষণ পরই রাকিব ও তৌফিক পূর্ব দিক হতে এসে রাজীব ভাইয়ের সাথে মিলিত হলে তারা ওমর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিল। লেভেল এইটে ওঠার জন্য তারা এলিভেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ‘বসুন্ধরা সিটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম শপিং কমপ্লেক্স। এত বড় লাক্সারিয়াস মার্কেট বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। আবার এ ধরণের একটি শপিং কমপ্লেক্স বাংলাদেশে হওয়াটাও একটা বিশাল ব্যাপার, প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু। যাই হোক, একটা বিষয়কে কত দিক থেকে যুক্তি দিয়ে বুঝানো যায়। লজিক আর এন্টি-লজিক সবসময় সমান তালে চলে। কিন্তু সঠিক যুক্তিগুলো তো সত্যের ওপর ভিত্তি করেই হয়ে থাকে। যেমন নিউটোনিয়ান বলের সূত্র একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। কেউ যদি বলে, ‘আমাদের ওজনের সমপরিমাণ বিপরীত বল আমাদের ওপর ক্রিয়া করার ফলেই আমরা কোন তলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি’ তাহলে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য জগতের সবক্ষেত্রে তার কথাটি ঠিক এবং বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। সুতরাং এর বিপরীতে অনেক যুক্তি দেয়া হলেও তা সুযুক্তি হবে না।’ রাকিব কথাগুলো মনে মনে ভাবছিল। এলিভেটর নিচে চলে এসেছে। ভেতর থেকে বিভিন্ন মানুষ বের হয়ে এল। রাকিবরা ভেতরে প্রবেশ করল। তাদের গন্তব্য লেভেল ৮। এলিভেটরের কাছের দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাকিব দেখল হঠাৎ করে মাথায় একটা চাপ অনুভূত হয়ে এলিভেটর ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। নিচের জগৎটা ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। লেবেল ৮-এ পৌঁছে রাজীব ভাই সবাইকে নিয়ে একটা খাবারের দোকানের কাছে গিয়ে বসলেন। সবার আগে ওমর ভাই মুখ খুললেন-
“আসলে বুয়েটে প্রথম বর্ষে পড়াকালীন আমি নাস্তিকতাবাদে বিশ্বাসী ছিলাম। আমার অন্য কয়েকজন বন্ধুর মতো আমারও কিছু বইয়ের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। মানুষের আদি উৎসের ব্যাপারে আমারও বিবর্তনবাদেই বিশ্বাস ছিল। আমার মনে হতো বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তত্ত্ব। ফলে আমিও মনে করতাম পৃথিবীর আদি প্রকৃতিতে একদিন হঠাৎ দুর্ঘটনাক্রমে আদি কোষ তৈরি হয়। আগে ধর্মসমূহকে মানুষের তৈরি মনে হতো, পরে আমার এক বন্ধুর দেয়া কিছু বই পড়ে আমার চিন্তার বন্ধ দ্বার খুলে যায়। আমি উপলব্ধি করতে পারি যে, বিশ্বজগতের এই বিশাল জটিল ও অসাধারণ উপাদানসমূহ কোন দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্টি হয়নি। বরং একজন বুদ্ধিদীপ্ত সত্তা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তখন আমি নিজের ধর্ম ইসলাম সম্বন্ধেও জানার চেষ্টা করলাম। আমার কাছে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা আমাদের শুধু সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি, বরং আমাদের জীবনকে সুন্দর ও শান্তিময় করার জন্য প্রতি যুগেই কিছু সুস্পষ্ট বিধান দিয়ে তিনি নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছিলেন। আর এটাও বুঝতে সক্ষম হই মানুষ পরবর্তীতে আল্লাহর দেয়া বিধানকে পরিবর্তন করে নিজেদের অধীন বানিয়ে নিয়েছে। সে যাই হোক, আমি রাজীবের কাছ থেকে তোমাদের আলোচনা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। খুবই ভালো। সৃষ্টি কি দুর্ঘটনা? এ ব্যাপারে তাফহিমুল কুরআনে বলা হয়েছে- “প্রথমে সৃষ্টিকর্তা নিজের প্রত্যেক সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি করেন এবং তারপর সেই মানুষের বংশ বিস্তারে এমন শক্তি সৃষ্টি করে দেন যার ফলে তার শুক্র থেকে তারই মত মানুষের জন্ম হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভূমির সারবস্তু একত্র করে একটি নির্দেশের মাধ্যমে তার মধ্যে এমন জীবন চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তি সৃষ্টি করে দেন যার মাধ্যমে মানুষের মতো একটি আশ্চর্যজনক সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করে। এটি ছিল একটি কর্মকুশলতা। আবার দ্বিতীয় কর্মকুশলতা হচ্ছে আগামীতে আরো মানুষ তৈরি করার জন্য এমন একটি অদ্ভুত কাঠামো মানুষের নিজের কাঠামোতেই রেখে দেন। যার গঠন প্রকৃতি ও কার্যধারা দেখে মানবীয় বিবেকবুদ্ধি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়।
ডারউইনের যুগের বিজ্ঞানীগণ এ চিন্তাধারার ব্যাপারে নাসিকা কুঞ্চন করে আসছেন এবং ডারউইনবাদকে বৈজ্ঞানিক মতবাদ গণ্য করে অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরে একে প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে থাকেন। কিন্তু মানুষের ও জীবের সমস্ত প্রজাতির না হোক অন্ততপক্ষে সর্বপ্রথম জীবনকোষের সরাসরি সৃষ্টি থেকে তো তারা নিজেদের চিন্তাকেই মুক্ত করতে পারবে না। এ সৃষ্টিকে মেনে না নিলে এ ধরণের একদম বাজে কথা মেনে নিতে হবে যে, জীবনের সূচনা হয় নিছক একটা দুর্ঘটনাক্রমে অথচ শুধুমাত্র এককোষসম্পন্ন জীবের মধ্যে জীবনের সবচেয়ে সহজ অবস্থাও এতটা জটিল ও সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কারুকাজে পরিপূর্ণ যাকে একটি দুর্ঘটনার ফল বলে গণ্য করা একেবারেই অযৌক্তিক। এটা ক্রমবিবর্তন মতবাদের প্রবক্তারা ‘সৃষ্টি মতবাদ’-কে যতটা অবৈজ্ঞানিক মনে করেন তার চেয়ে লাখো গুণ বেশি অবৈজ্ঞানিক। আর মানুষ যদি একবার এ কথা মেনে নেয় যে, জীবের প্রত্যেক প্রজাতির প্রথমজন স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপর তার বংশধারা প্রজনন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে চলে আসছে তাহলে এমন অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, ডারউইনের পতাকাবাহীদের সকল বৈজ্ঞানিক কাব্যচর্চা সত্ত্বেও তাদের ক্রমবিবর্তনবাদী মতবাদের যেগুলোর কোন সমাধান হয়নি।”” [১৫]
রাজীব ভাই বললেন, “আণবিক জীববিদ্যার গবেষণা দ্বারা এটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে জীবনকে যেরূপ সরল মনে করা হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সেটি তার চেয়ে বহুগুনে জটিল। এতে অসংখ্য জটিল অণু বিদ্যমান। আমরা জানি, কোষ বিভিন্ন ধরণের কার্বোহাইড্রেট (শর্করা), প্রোটিন (আমিষ), লিপিড (চর্বি), ভিটামিন ও মিনারেল এবং পানি দিয়ে গঠিত। এ ছাড়া কোষে প্রতিনিয়ত অনেক পরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ আণবিক প্রক্রিয়া সর্বদা সংঘটিত হচ্ছে। মাইকেল ডেন্টন তার Evolution: A theory in crisis গ্রন্থে লিখেন: ‘আণবিক জীববিদ্যা জীবনের যে বাস্তবতা প্রকাশ করেছে সেটি অনুধাবন করতে হলে, আমাদের একটি কোষকে শতকোটি গুন বড় করে দেখতে হবে যতক্ষণ না তা এত বড় করে দেখা হয় যে, তা বিশ কিলোমিটার ব্যাস ধারণ করে এবং গোটা লন্ডন বা নিউইয়র্ক শহরকে ঢেকে দেয়ার মত বিশাল উড়োজাহাজের অনুরূপ আকৃতি লাভ করে। আমরা তখন যা দেখতে পাব তা হলো, একটি উপযুক্ত নকশা ও অসামান্য জটিলতার বস্তু। উপরিতলে আমরা দেখতে পাব একটি বিশাল মহাকাশ যানে আলো বাতাস ঢোকার জন্য যে ছিদ্র রাখা হয় তার মতো লক্ষ লক্ষ ছিদ্র যেগুলো অনবরত খুলছে ও বন্ধ হচ্ছে এবং কোষের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ভেতরে ঢোকানোর ও বাইরে বের করে দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আমরা যদি রন্ধ্রগুলোর একটিতে ঢুকতে চাইতাম তাহলে আমরা আমাদেরকে এক সর্বোৎকৃষ্ট প্রযুক্তি ও বিস্ময়কর জটিলতার জগতে দেখতে পেতাম- এটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য যে এলোপাতাড়ি কতগুলো প্রক্রিয়া এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যার ক্ষুদ্রতম উপাদানটিও (যেমন প্রোটিন বা জিন) এতটাই জটিল যা আমাদের নিজেদের সৃষ্টিশীল যোগ্যতার বাইরে? বরং (এই জটিলতাটাই) এমন একটি বাস্তবতা, যা ‘দৈবাৎ সৃষ্টি’ হওয়ার মতবাদের বিপরীত তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে এবং যেটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে তৈরি যে কোন জিনিসের জটিলতাকে ছাড়িয়ে যায়।’ [১৬] ইংলিশ জোতির্বিদ এবং গাণিতিক স্যার ফ্রেড হোয়েল একজন বিবর্তনবাদী হওয়া সত্ত্বেও বলেন, ‘(একটি) উচ্চতর বৈজ্ঞানিক গঠন অকস্মাৎ তৈরি হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা এর সাথে তুলনীয় যে, একটি টর্নেডো কোন লোহা-লক্করের স্তূপের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান প্রস্তুত হয়ে গেল।’ [১৭]
অন্যদিকে বিবর্তনবাদীরা একটি কোষ তো দূরে থাক বরং কোষের গাঠনিক উপাদান যেমন একটি প্রোটিনের উৎপত্তি পর্যন্ত ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। প্রোটিনের গাঠনিক একক অ্যামাইনো এসিড। সবচেয়ে সরলতম প্রোটিনটিও ৫০টি অ্যামাইনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, কোন প্রোটিনে একটি অ্যামাইনো এসিডও যদি যোগ বা বিয়োগ অথবা পরিবর্তন করা হয় তবে প্রোটিনটি একটি অব্যবহারযোগ্য অণু স্থূপে পরিণত হয়। [১৮]
সাইটোক্রোম সি প্রোটিনের জটিল ত্রিমাত্রিক গঠন। ছোট ছোট বলগুলো অ্যামাইনো এসিডকে বুঝাচ্ছে। অ্যামাইনো এসিডের ক্রম ও আপেক্ষিক অবস্থানে ন্যূনতম ব্যত্যয় ঘটলে পুরো প্রোটিনটিই অকার্যকর হয়ে যাবে। অথচ বিবর্তনবাদীদের ধারণা এ ধরণের অসংখ্য প্রোটিন নাকি কোন প্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই দৈবাৎ দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে তৈরী হয়ে গেছে।
প্রোটিন গঠিত হয় ২০ ধরণের এমাইনো এসিড দিয়ে এবং প্রোটিনের গঠন খুবই স্পেসিফিক। ধরা যাক, দুটো এমাইনো এসিড পরস্পর পেপটাইড বণ্ড দিয়ে যুক্ত হবে। তাহলে সম্ভাব্য সমাবেশ হতে পারে, ২০x২০ তথা ৪০০ ধরণের। তিনটি হলে ২০x২০x২০ তথা ৮০০০ ধরণের, ৪টি হলে ২০৪ = ১৬০০০০ ধরণের। অথচ, কোষের ভিতর ছোট আকৃতির একটি কার্যকরী (ফাংশনাল) প্রোটিন গড়ে ১৫০টি এমাইনো এসিডের সমন্বয়ে তৈরী হয়। সুতরাং ১৫০ ঘরে বিন্যাস হবে ২০১৫০ তথা ১০১৯৫ ধরণের। যার মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক বিন্যাসই কার্যকরী প্রোটিন গঠন করতে পারে। এই সংখ্যাটা কত বড় তা বুঝানোর জন্য বলা যায়, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে ১০৮০টি মৌলিক কণা আছে এবং আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১০১৬ সেকেণ্ড। সুতরাং র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে কি প্রোটিন আসা সম্ভব? ক্যালিফর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করার সময় ডগলাস এক্স এ বিষয়টি পরীক্ষামূলক ভাবে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরী অব মলিকিউলার বায়োলজিতে এলান ফার্স্ট-এর অধীনে রিসার্চের সুযোগ পেয়ে যান। তিনি ও তার সহযোগিরা ১৫০ এমাইনো এসিডের সম্ভাব্য সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
প্রসঙ্গত প্রোটিন শুধু মাত্র এমাইনো এসিডের চেইন হিসেবে থাকে না। প্রোটিন তিনটি ধাপে ভাঁজ (ফোল্ড) হয়। এদেরকে প্রাইমারী, সেকেণ্ডারী এবং টারশিয়ারী স্ট্রাকচার বলে। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক ফোল্ড সঠিক হওয়ার উপরই এর ফাংশন নির্ভর করে। সকল এমাইনো এসিড সিকোয়েন্স-এ যেমন ত্রিমাত্রিক ফোল্ড হয় না আবার সকল ত্রিমাত্রিক ফোল্ড ফাংশনাল হয় না। ডগলাস এক্স প্রাথমিক ভাবে দেখতে পান যেই সংখ্যক সিকোয়েন্স ফাংশনাল ফোল্ড গঠন করে তাদের সম্ভাব্যতা ১০৭৪ এর মধ্যে ১ বার। (মিল্কি ওয়েতে পরমাণুর সংখ্যা ১০৬৫) এর মধ্যে যেই ফোল্ডগুলো কার্যকরী তাদেরকে হিসেবে নিলে সম্ভাব্যতা দাঁড়ায় ১০৭৭। [২৯]
তদুপরি, এমাইনো এসিড দু-ধরণের হতে পারে, বাঁহাতি অথবা ডানহাতি, কিন্তু প্রোটিনে প্রাপ্ত এমাইনো এসিড শুধু বাঁহাতি ধরণের। ফলে, শুধু বাঁহাতী এমাইনো এসিড প্রোটিনে আসার সম্ভাব্যতা ২১৫০ তথা ১০৪৫ এর মধ্যে একবার। অন্যদিকে, প্রোটিনে এমাইনো এসিড শুধুমাত্র পেপটাইড বন্ধন নামক বিশেষ রাসায়নিক বন্ধনে যুক্ত হয়। কিন্তু এমাইনো এসিডসমূহ অন্যান্য বন্ধনেও পরস্পর যুক্ত হতে পারে। অতএব, শুধু পেপটাইড বন্ধনযুক্ত রাসায়নিক যৌগ পাওয়ার সম্ভাব্যতা আবারও ২১৫০ তথা ১০৪৫ এর মধ্যে একবার। এসবগুলো হিসেবকে যুক্ত করলে ১৫০টি অ্যামাইনো এসিডের একটি প্রোটিন আসার সম্ভাব্যতা দাড়ায় ১০৭৪ গুনন ১০৪৫ গুনন ১০৪৫ তথা ১০৭৪+৪৫+৪৫ বা ১০১৬৪ এর মধ্যে একবার।
ডিসকভারি ইনস্টিটিউটের ড. উইলিয়াম আলবার্ট ডেম্বসকি (সংক্ষেপে বিল ডেম্বসকি) একটি এলোমেলো (র্যাণ্ডম) ও অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া একা একাই হয়ে যেতে পারবে কি-না তা নির্ণয় করার জন্য সম্ভাব্যতার একটি সীমা হিসেব করেছেন। তিনি একে বলেন বিশ্বজনীন সম্ভাব্যতার সীমা (Universal Probability Bound)। ডেম্বস্কির এই বাউন্ড বা সীমার হিসাবটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন হিসাব বা মাত্রা থেকে পাওয়া যায়। মাত্রা তিনটি হল:
১) ১০৮০, যা হল আমাদের অবজারভেবল ইউনিভার্স বা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের (observable universe) আনুমানিক সর্বোচ্চ এলিমেন্টারি পার্টিকেল বা প্রাথমিক উপাদান সংখ্যা।
২) ১০৪৫, যা হল প্রতি সেকেন্ডে পদার্থের রূপান্তরের সর্বোচ্চ পরিমাণ অথবা প্ল্যাঙ্ক টাইমের (Planck time) ইনভারস বা বিপরীত।
৩) ১০২৫, যা হল আমাদের মহাবিশ্বের বয়স সেকেন্ডে হিসাব করলে যে মান হয় তার থেকে ১ বিলিওন গুন বেশি একটি মান।
এখন, ইউনিভার্সাল প্রোবাবিলিটি বাউন্ড = অবজারভেবল ইউনিভার্সের সর্বোচ্চ অ্যাপ্রক্সিমেট এলিমেন্টারি পার্টিকেল x প্রতি সেকেন্ডে পদার্থের রূপান্তরের সর্বোচ্চ পরিমাণ x সেকেন্ডের হিসাবে আমাদের মহাবিশ্বের বয়স = ১০৮০ x ১০৪৫ x ১০২৫ = ১০১৫০
এই হিসাবটি দিয়ে কী বোঝা যায়? এই হিসাবটি দ্বারা আসলে বোঝা যায় যে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রতি সেকেন্ডে যদি পদার্থের সর্বোচ্চ পরিমাণ রূপান্তর বা পরিবর্তন হয় অর্থাৎ প্রতিটি কণা যদি প্ল্যাঙ্ক সেকেন্ডে পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া (interaction) করে তাহলে তারা বর্তমান সময় পর্যন্ত আনুমানিক সর্বোচ্চ ১০১৫০টি মিথস্ক্রিয়া (interaction) ঘটাতে পারবে। তার মানে মহাবিশ্বে এখনও পর্যন্ত মোট প্রায় ১০১৫০টি বেসিক ঘটনা ঘটেছে। [৩০]
অথচ আমরা জেনেছি একটি মাঝারি আকৃতির প্রোটিন একা একা তৈরী হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা ১০১৬৪ এর মধ্যে একবার। অর্থাৎ মহাবিশ্বের ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাবে কিন্ত ততক্ষণে একটি প্রোটিনও তৈরী হবে না। অথচ একটি কোষে শুধুমাত্র সহস্রাধিক প্রোটিন-ই থাকে না, থাকে নিউক্লিয়িক এসিড, শর্করা, লিপিড, ভিটামিন এবং আরো অনেক রাসায়নিক দ্রব্য যেমন আয়নসমূহ যা গাঠনিক ও কার্যকরী দিক থেকে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে পরিকল্পিতভাবে ভারসাম্যতা বজায় রেখে অবস্থান করে। … নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রবার্ট শাকিরো একটি ব্যাকটেরিয়াতে প্রাপ্য ২০০০ প্রোটিনের কাকতালীয়ভাবে একইসঙ্গে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা হিসাব করেন। তিনি যে সংখ্যাটি পান তা হল ১০৪০০০০ এর ভেতর ১ বার! (অবিশ্বাস্য, তাই না? অনুরূপ একজন মানুষের একটি কোষেও সহস্রাধিক বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন থাকে।)
ওয়েল্স ইউনিভার্সিটির কলেজ কার্ডিফের প্রায়োগিক গণিত ও জোতির্বিদ্যার অধ্যাপক চন্দ্র বিক্রমাসিংহে মন্তব্য করেন: জীবনের প্রাণহীন বস্তু থেকে তৈরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হলো ১ এর পরে ৪০০০০ শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয় তার মধ্যে ১। … এটা এমন বড় একটা সংখ্যা যা ডারউইন ও তার বিবর্তন তত্ত্বকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য যথেষ্ট। না, পৃথিবীতে কোন আদি অর্গানিক সুপ ছিল না, অন্য কোথাও না। এবং যদি জীবনের শুরু দৈবাৎ না হয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই কোন উদ্দেশ্যপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তৈরি হয়ে থাকবে। [১৯]
স্যার ফ্রেড হয়েল এই অযৌক্তিক সংখ্যার ব্যাপারে এভাবে মন্তব্য করেন: ‘বস্তুত (একজন বুদ্ধিমান সত্তা দ্বারা জীবন প্রস্তুত হওয়ার) তত্ত্বটি এতটাই সুস্পষ্ট যে, একজন অবাক হয় যে কেন এটি স্বতঃপ্রমাণিত হিসেবে ব্যাপকভাবে গৃহীত হচ্ছে না? (আসলে) এটি গ্রহণ না করার পেছনের কারণটি বৈজ্ঞানিক নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক।’ [৩১]
বিবর্তনবাদের বড় বড় প্রবক্তারাও জীবনের প্রথম অধ্যায়ে এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিবর্তনবাদের অসারতার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু এটাই বিস্ময়কর যে, তাদের তত্ত্বের সম্পূর্ণ অযৌক্তিকতা দেখার পরও তারা কীভাবে ঔদ্ধত্যের সংগে সংশ্লিষ্ট থাকে? প্রকৃতপক্ষে এটি সম্পূর্ণ আদর্শিকভাবে স্থিরীকৃত হয়েছে।
এতক্ষণ তো শুধুমাত্র প্রোটিন নিয়ে আলোচনা করা হল। কিন্তু প্রোটিন কি একাই তৈরি হয়? না। বরং প্রোটিন তৈরির জন্য আছে একটি মেশিনারি। যাতে থাকে ডিএনএ ও আরএনএ। কিন্তু ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন পরস্পরের পরিপূরক। ডিএনএ ও আরএনএ ছাড়া যেমন সম্ভব নয় প্রোটিন তৈরি হওয়া তেমনি কতগুলো প্রোটিন এনজাইম ছাড়া সম্ভব নয় ডিএনএ রেপ্লিকেশন অথবা আরএনএ সংশ্লেষণ (ট্রান্সক্রিপশন)।
সুতরাং একটি কোষকে সক্রিয় হতে হলে ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন একই সাথে বর্তমান থাকতে হবে। আর এ ছাড়া কার্বোহাইড্রেট, লিপিড, ভিটামিন ও অন্যান্য আয়নতো আছেই। সর্বোপরি এ সকল বিষয় একত্রে নিয়ে যদি একটি কোষের স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বিচার করা হয় তাহলে যে সংখ্যা দাঁড়াবে তা হয়তো কাগজে লিখেও স্থান দেয়া সম্ভব হবে না।” [২০] রাজীব ভাই তার নোট থেকে কথাগুলো পড়ে শোনালেন।
একটি কোষের গঠনের রূপ জটিলতা দেখে তৌফিক অবাক হল। বিবর্তনবাদ সম্পর্কে তার সন্দেহ যেন আরও প্রগাঢ় হল। রাকিব মেডিক্যালে পড়ায় মানবদেহ সম্পর্কে ইতোমধ্যেই অনেক জেনেছে। কিন্তু রাজীব ভাইয়ের কথায় সে যেন মানবদেহের গঠনের জটিলতা ও সামঞ্জস্য নতুনভাবে আবিষ্কার করল। যেখানে একটি ছোট্ট কোষের গঠনই এত জটিল সেখানে মানবদেহের মত অসংখ্য আন্তঃসম্পর্কিত প্রক্রিয়াপূর্ণ গঠনের জটিলতা যে মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ রইল না।
রাকিব বলল, “প্রথম সৃষ্টি সময়কালে যে পরিবেশের কথা চিন্তা করা হয় তাতে কোন জীবন্ত বস্তুর ন্যূনতম টিকে থাকার সম্ভাবনাই শূন্য। সুতরাং রাসায়নিক বিবর্তনবাদ একটি অর্থহীন মতবাদ ছাড়া কিছুই হতে পারে না। (রাসায়নিক বিবর্তনবাদকে এখন এবায়োজেনেসিস বলা হয়।)
ওমর ভাই বললেন, “এ বিষয়গুলো বিবর্তনবাদী বস্তুবাদীদের কাছে স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের প্রমাণস্বরূপ জীবাশ্ম থেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে যদিও জীবাশ্ম রেকর্ডে অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়ার কথা কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তার বিপরীত। এরপরও তারা কোন কোন সময় উদ্ধার করা ফসিলকে দু’টি প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতি হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন এবং তা ফলাওভাবে প্রচার করা হয়। তারা ধারণা করেন যে, মাছ হয়ে যায় উভচর প্রাণী আর কোন কোন উভচর প্রাণী হয়ে যায় সরীসৃপ। সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী ও পাখির জন্ম। আর সব শেষে স্তন্যপায়ী থেকে মানুষের উদ্ভব। এক্ষেত্রে সংক্ষেপে আমরা প্রজাতির উৎপত্তির প্রকৃত ইতিহাস বিবেচনা করতে পারি। তোমরা রাজীবের কাছ থেকে ইতোমধ্যেই হয়তো জেনে গেছ যে, জীবাশ্ম রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিবর্তনবাদীরা রেকর্ডে যেরূপ “Tree of Life”- এর উপাত্ত পাবেন বলে ধারণা করেছিলেন অনুরূপ কোন উপাত্ত পাওয়া যায় না। বরং এক্ষেত্রে কোন নিকটবর্তী প্রজাতির জীবাশ্ম ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ প্রজাতির স্বতন্ত্র জীবাশ্ম একই সাথে পাওয়া যায়, যেগুলো জীবাশ্ম রেকর্ডে হঠাৎ আবির্ভূত হয়। তোমরা জেনেছ, এই সময়টিকে বলা হয় ক্যামব্রিয়ান এরা এবং উক্ত ঘটনাটকে বলা হয় ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশন। এ সম্পর্কে Science News Magazin-এর রিচার্ড মনটারস্কি বলেন, ‘প্রায় অর্ধ বিলিয়ন বছর আগে…. প্রাণিকুলের উল্লেখযোগ্য জটিল আকার, যা এখন আমরা দেখি, তা হঠাৎ আবির্ভূত হয়। মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর ক্যামব্রিয়ান পিরিয়ডের এই মুহূর্তটি সেই বৈবর্তনিক বিস্ফোরণকে নির্দেশ করে যখন সমুদ্রগুলো পৃথিবীর জটিলতম সৃষ্টি দ্বারা পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।’ [২১]
বিবর্তনবাদীরা প্রতিটি পর্বকে অন্য পর্বের বিবর্তনের ফল মনে করে। তারা দাবি করে কর্ডাটা পর্বটি একটি অমেরুদণ্ডী পর্ব থেকে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এসেছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য ব্যাপার হলো কর্ডাটা পর্বের প্রায় প্রতিটি সদস্যই ক্যামব্রিয়ান এরাতে আবির্ভূত হয় যা উক্ত দাবিকে শুরুতেই বাতিল করে দেয়। কর্ডাটা পর্বের প্রাচীনতম সদস্যটি হল পিকিয়া (Pikia) যেটি একটি সামুদ্রিক জীব। (প্রথম দর্শনে পিকিয়াকে একটি কৃমির মতো মনে হয়) পিকিয়ার পূববর্তী প্রজাতি হিসেবে প্রস্তাবনা রাখা যায় এমন একটি প্রাণীর সাথে পিকিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে একই সময়ে।
….আবার, বিবর্তনবাদীরা মনে করে পিকিয়া প্রজাতিটি ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়ায় মাছে পরিণত হয়েছে। মাছের বিবর্তন তত্ত্বটিরও কোন জীবাশ্ম প্রমাণ পাওয়া যায় না। মিলিয়ন মিলিয়ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং মিলিয়ন মিলিয়ন মাছের জীবাশ্ম থাকলেও মাছ এবং অমেরুণ্ডী প্রাণীর মধ্যবর্তী পরিবর্তনকালীন (ট্রানজিশনাল ফর্ম) একটি অবিতর্কিত জীবাশ্মও নেই।
ব্যাঙের উৎপত্তির কোন বিবর্তন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়নি। জ্ঞাত সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাঙটি মাছ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল এবং এর সকল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সহকারে আবির্ভূত হয়। আমাদের সময়কার ব্যাঙও ঠিক একই ধরণের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ডমিনিকান রিপাবলিকে প্রাপ্ত অ্যামবারে সংরক্ষিত ব্যাঙ ও উক্ত ব্যাঙের বর্তমানে প্রাপ্ত জীবিত নমুনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
রবার্ট ক্যারোল প্রথম দিককার মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে কয়েকটি প্রাণীর উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদীদের কোণঠাসা অবস্থার কথা স্বীকার করেন বলেন, ‘Cephalochordate এবং Craniate-র অবস্থান্তরকালীন (Transitional) প্রজাতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। যথার্থরূপে নির্ণয় করা প্রাচীতনতম মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে ক্র্যানিয়েটের যে সকল বৈশিষ্ট্য আমরা জীবাশ্মে আশা করি, তার সবই পাওয়া যায়। এমন কোন জীবাশ্ম সম্বন্ধে জানা নেই যেটাকে চোয়ালযুক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীদের উৎপত্তির প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।’ বরং মাছ ও উভচর প্রাণীর মধ্যে দাবিকৃত ট্রানজিশনাল ফর্মগুলো এইজন্য ট্রানজিশনাল নয় যে, তাদের মধ্যে খুব কমই পার্থক্য আছে; বরং এজন্য যে, তারা একটি বিবর্তনীয় চিত্রকল্পের জন্য প্রিয় বিষয়। রবার্ট ক্যারোল, তার Pattern and process of vertebrate evolution গ্রন্থে এ দু’টি প্রজাতি সম্পর্কে লিখেন- Eusthenopteron এবং Acanthostega-র মধ্যে ১৪৫টি অ্যানাটমিকাল বৈশিষ্ট্যের ৯১টির মধ্যেই ভিন্নতা আছে। অথচ বিবর্তনবাদীরা বিশ্বাস করে যে এই সবগুলোই ১৫ মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে ডিজাইন হয়েছে। এই ধরণের একটা কল্পকাহিনীতে বিশ্বাস করা বিবর্তবাদের পক্ষে সম্ভব হলেও এটা বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ ঘটনাটি সকল মাছ-উভচর প্রাণী বিবর্তন চিত্রকল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।” [২২]
রাজীব ভাই বলেন, “বিবর্তনবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী স্থলচর চতুষ্পপদী প্রাণীসমূহ সমুদ্রে বসবাসকারী মাছ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রমাণ হলো কিছু মাছের ডানাগুলো মাংসল। এ মাছগুলো যখন স্থলে অলক্ষিতভাবে প্রবেশ করতে শুরু করে তখন মাছের ডানাগুলো পর্যায়ক্রমে পায়ে পরিণত হয়। এর বিপরীতে কী প্রমাণ আছে?”
“লক্ষ্য রাখা দরকার বিবর্তবাদীদের ঐ দাবিটি একটা কাল্পনিক ব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই নয়, কারণ এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। বরঞ্চ এই যুক্তির ধরণ লামার্কের যুক্তির মতো। অথচ স্থলে চলতে যে ধরণের সুগঠিত পায়ের প্রয়োজন তার সম্পর্কে না মাছের জানা ছিল, না বুদ্ধিহীন প্রকৃতির জানা আছে। ডানা এবং পায়ের কঙ্কালতন্ত্রে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান,’’ ওমর ভাই উত্তর করলেন।
রাকিব যোগ করল, ‘‘শুধু তা-ই নয় জলচর থেকে স্থলচর প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে হলে আরও যে সকল সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায় তা হল-
১. ভার বহন: জলচর প্রাণীদের শুধুমাত্র তাদের নিজেদের ওজন বহন করতেই ৪০ শতাংশ শক্তি ব্যয় করতে হয়। সুতরাং পানি থেকে মাটিতে পৌঁছানোর জন্য কোন প্রাণীকে একই সাথে নতুন মাংসপেশি ও কঙ্কালতন্ত্র গঠন করতে হবে এবং এটা কোন প্রকার দৈবাৎ মিউটেশনের মাধ্যমে অসম্ভব।
২. তাপ ধারণ: তাদেরকে স্থলের দ্রুত পরিবর্তনশীল তাপমাত্রার সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযুক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সহকারে পানি থেকে মাটিতে আসতে হবে।
৩. রেচনতন্ত্র: স্থলচর প্রাণী ও জলচর প্রাণীদের রেচনতন্ত্রের হঠাৎ আবির্ভাব হতে হবে। কারণ রেচনতন্ত্রে অল্প অল্প পরিবর্তন সম্ভব নয়।
৪. শ্বসনতন্ত্র: জলচর প্রাণীদের স্থলচর প্রাণীতে পরিণত হতে হলে পূর্ণরূপে প্রস্তুত ফুসফুস নিয়ে আবির্ভূত হতে হবে। [২৩]
যখন তাদের কাছে কোয়েলাকান্থ (Coelacanth)-এর শুধু ফসিল ছিল, প্রত্যেক বিবর্তনবাদী জীবাশ্মবিদ সেগুলো সম্পর্কে কিছু ডারউইনবাদী ধারণা উপস্থাপন করেন; যাই হোক যখন এর জীবিত নমুনা পাওয়া গেল, উক্ত ধারণাগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। উপরের চিত্রে জীবিত কোয়েলাকান্থ-এর উদাহরণ দেখানো হয়েছে। উপরের দিকে থেকে সর্বশেষ ছবিটি ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় প্রাপ্ত কোয়েলাকান্থের সর্বশেষ নমুনা।
একটি জলচর প্রাণীকে স্থলচর প্রাণীতে পরিণত হতে হলে এ সকল শর্ত একই সঙ্গে পূরণ হতে হবে। কোন মাছের উভচর প্রাণীতে পরিণত হতে হলে এর কঙ্কালতন্ত্রে ‘পেলভিস’ তথা পশ্চাতদেশে ইলিয়াম, ইশ্চিয়াম ও পিউবিস নামক তিনটি হারের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষায়িত হাড় যোগ হতে হবে। কিন্তু মাছের এমন কোন জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি যার দ্বারা জানা যাবে যে কীভাবে উভচর প্রাণীর ‘পেলভিস’ গঠিত হয়েছিল। যদি মাছের শিরদাঁড়াকে পেলভিসে রূপান্তরিত হতে হয় তাহলে কোন উভচর প্রাণীতে, যেমন ব্যাঙে সম্পূর্ণ শিরদাঁড়াকে এমনভাবে রূপান্তরিত হবে যে তাতে শিরদাঁড়ার কোন অস্তিত্বই থাকবে না। এছাড়াও এদের মাথার হাড়ও এক রকম নয়। মাছের ডানাকে হতে হবে গিড়াসম্পন্ন ও পেশিময় হাত বা পায়ে। মাছের ফুলকাকে হতে হবে ফুসফুস। এছাড়া মাছ ও উভচর প্রাণীর ইন্দ্রীয়সমূহের মধ্যেও সুস্পষ্ট পার্থক্য আসতে হবে। অনেক কসরত করা হয়, উভচরকে কোন মাছের অধস্তন বানাতে। সফল হওয়া যায়নি। লাংফিশ নামক এক মাছকে উভচরের পূর্বপুরুষ বানাতে কসরত করা হয়। এর ফুলকা ছাড়াও রয়েছে সাঁতরানোর জন্য ব্লাডার যা, মাছটি ডাঙায় উঠলে সাময়িকভাবে শ্বাস নিতে ব্যবহার করে। [২৪]
তৌফিক বলল, “এখন তাহলে সরীসৃপের সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। সরীসৃপ উভচর প্রাণী থেকে এসেছে এটা কি সম্ভব?” রাজীব ভাই বললেন, “আসলে, একটি অর্ধ মাছ অর্ধ উভচর প্রাণী যেরূপ অসম্ভব তেমনি অসম্ভব একটি অর্ধ উভচর অর্ধ সরীসৃপ। এমনকি জীবাশ্ম রেকর্ডের উক্ত দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ নেই।”
থমাস হাক্সলি বলেছেন, “পাখি হল মহিমান্বিত সরীসৃপ। অর্থাৎ সরীসৃপ পর্যায়ক্রমে পাখিতে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কী?” রাকিব ওমর ভাইয়ের দিকে মুখ ফেরালো। ওমর ভাই উত্তর দিলেন, “একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, সরীসৃপের আদৌ পাখিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। বিবর্তনবাদীরা বলে যে, সরীসৃপ (যেমন: কিছু কিছু ডাইনোসর) উড়ন্ত পোকামাকড় শিকার করতে গেলে তাদের সামনের পা দু’টি পাখায় পরিণত হতে শুরু করে, পরে তা উড়তে শিখে এবং পাখিতে পরিণত হয়। অথচ কোন পাখির পাখা পুরোপুরিভাবে গঠিত না হয়ে আংশিক গঠিত হলে তা কখনই উড়তে সক্ষম হবে না। আবার পাখির উড়ার জন্য এর হাড়গুলোকে হালকা হতে হবে। বিশেষ ধরণের ফুসফুস তৈরি হতে হবে। সরীসৃপের আঁশ ও পাখির পালকের তফাৎ আকাশ পাতাল। সুতরাং এ সবকিছুতেই এক মহাপরিকল্পনার সন্ধান পাওয়া যায়। যা কেবলমাত্র একজন মহামহিম পরিকল্পনাকারীর পক্ষেই সম্ভব।”
ওমর ভাই আরও বললেন, “বিবর্তনবাদীরা সাধারণ মানুষকে মানুষের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ধোঁকাগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের দাবি বানর জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে। আর এক্ষেত্রে মানুষের সবচেয়ে নিকটবর্তী হল বনমানুষ বা এপ। ডারউইনবাদীরা দাবি করে যে, আধুনিক মানুষ এক ধরণের এপ (বনমানুষ জাতীয় প্রাণী) থেকে বিবর্তিত হয়েছে। ৫ থেকে ৬ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হওয়া এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার মানুষ ও তার পূর্বসূরিদের মধ্যে কিছু অবস্থান্তর প্রাপ্তিকালীন প্রজাতি পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়। এই কার্যত সম্পূর্ণ কাল্পনিক চিত্রে নিচের চারটি মৌলিক প্রকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে:
১. Australopithecus
২. Homo habilis
৩. Homo erectus
৪. Homo sapience
বামে একটি AI 444-2 Australopithecus afarensis খুলি, এবং ডানে একটি আধুনিক শিম্পাঞ্জির খুলি। এখানে যে পরিষ্কার সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে তা এ বিষয়টির প্রামাণিক নিদর্শন যে Afarensis একটি সাধারণ বন মানুষের প্রজাতি, এতে মানুষের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। যতটুকু গাঠনিক পার্থক্য দৃশ্যমান হচ্ছে তা, একই প্রজাতির বিভিন্ন দল-উপদল তথা রেস-এ যতটুকু পার্থক্য (variation) প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়, তারই অনুরূপ।
বিবর্তনবাদী জীবাশ্মবিদদের প্রবণতা হল নতুন কোন জীবাশ্ম কঙ্কাল আবিষ্কার হলেই হয় তাকে এপদের নিকটবর্তী বা মানুষের নিকটবর্তী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা। অথচ জীবশ্মটি যে এ্যপ বা মানুষের বিলুপ্ত কোন জাতি হতে পারে সে ব্যাপারটি তারা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় একটি দাঁতের ওপর ভিত্তি করে পুরো একটি নতুন মধ্যবর্তী প্রজাতি দাঁড় করিয়ে দেয়। আবার মুখমণ্ডলের কঙ্কালের ওপর যে ফেসিয়াল রিকন্সট্রাকশন করা হয় তাও সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিকর। কেননা কারও কারও মুখমণ্ডলের গঠন চর্বি ও মাংসপেশীর পরিমাণ ও তুলনামূলক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং শুধুমাত্র প্রাপ্ত কঙ্কালের ওপর ভিত্তি করে মুখমণ্ডলের সঠিক আকৃতি দেয়া সম্ভব নয়।
তদুপরী, জীবাশ্মবিদরা বিভিন্ন সময়ে তাদের আবিস্কৃত একটি কঙ্কালের অসম্পূর্ণ অংশবিশেষের উপর ভিত্তি করে পুরো একটি প্রজাতি দাঁড় করিয়ে দেন। কোন কোন সময় প্রতারণাপূর্ণ রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠিত রাখার চেষ্টা করেন। যেমন: ১৯১২ সালে চিকিৎসক ও অ্যামেচার প্যালেওন্টোলিস্ট চার্লস ডাউসন ইংল্যাণ্ডের পিল্টডাউন এলাকায় একটি মাথার খুলির অংশবিশেষ, কয়েকটি দাঁত এবং একটি চোয়ালের হাড় আবিস্কার করেন। মাথার খুলির অংশ এবং দাঁত ছিল মানুষের উক্ত অংশের মতো এবং চোয়ালের হাড় ছিল এপ-এর হাড়ের মতো। তিনি কঙ্কালটির নাম দেন ‘Piltdown man.’ এর বয়স হিসেবে করা হয় ৫০০,০০০ বছর এবং একে ৪০ বছর যাবৎ বিভিন্ন মিউজিয়ামে মানুষের বিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে দেখানো হতে থাকে। কিন্তু নতুন ফসিল ডেটিং টেকনোলজি আবিস্কার হওয়ার পর একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেন যে, উক্ত মাথার খুলি ৫০০ বছর পুরোনো একজন মানুষের এবং চোয়ালের হাড় সম্প্রতি মৃত একটি এপ-এর। [৩৫] এরকম আরও দুটি উদাহরণ হলো একটি শুকরের দাঁতের উপর ভিত্তি করে চিত্রিত ‘নেব্রাস্কা ম্যান’ [৩৬] এবং একটি লেমুরের কঙ্কালের উপর ভিত্তি করে নির্মিত মানুষের পূর্ববতী প্রজাতি ‘ইদা’। [৩৭, ৩৮]
১,০০,০০০ বছর আগে ইউরোপে মানুষের আবির্ভুত একটি জাতি হলো নিয়াণ্ডারথাল (Neanderthal; Homo sapience neanderthalensis), যারা দ্রুত অন্যান্য জাতির সাথে মিশে যায় কিংবা হারিয়ে যায়। এরা ৩৫,০০০ বছর আগ পর্যন্ত জীবত ছিল। তাদের সাথে আধুনিক মানুষের একমাত্র পার্থক্য হল, তাদের কঙ্কালগুলো আরও বলিষ্ঠ এবং তাদের মাথার ধারণ ক্ষমতা একটু বেশি। বিবর্তনবাদীরা এ জাতিটিকে মানুষের আদিম প্রজাতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিল তথাপি সকল আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, আধুনিক বলিষ্ঠ মানুষ থেকে পৃথক কিছু নয়। উপরে, একবারে বাঁ দিকের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, নিয়াণ্ডারথ্যালদের ব্যবহৃত ছাব্বিশ হাজার বছর পুরোনো সূঁচ; এই আবিস্কার থেকে বোঝায় যায় যে নিয়াণ্ডারথাল-রা ১০০০০ বছর আগেও পোশাক বুনন করতে জানতো। একেবারে ডানে দেখা যাচ্ছে, হাড় দিয়ে তৈরী নিয়াণ্ডারথাল বাঁশি। হিসেব করে দেখা যায় ছিদ্রগুলো এমনভাবে করা হয়েছে যেন সঠিক উপসুর পাওয়া যায়। অন্য কথায় বাঁশিটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা হয়েছে। মাঝের ছবিটিতে গবেষক বব ফিন্ক-এর বাঁশি সংক্রান্ত হিসেবটি দেখা যাচ্ছে। বিবর্তনবাদী প্রচারণার বিপরীতে এই আবিস্কারগুলো প্রমাণ করে যে, নিয়াণ্ডারথাল মানুষ সভ্য জাতি ছিল, তারা কোনো আদিম গুহা মানব ছিল না। [৩৯] বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিবর্তনবাদীরা নিয়াণ্ডারথালকে সেমি-এপ জাতীয় সৃষ্টি হিসেবে চিত্রিত করে দেখিয়ে এসেছে। এরপর যখন সূঁচ ও বাঁশি আবিস্কার হয় National Geographic-এর মতো বিবর্তনবাদী প্রকাশনাগুলোতে তাদেরকে সভ্য জাতি হিসেবে দেখানো শুরু করে।
মজার বিষয় হলো, যখন কোন মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের তথাকথিত ‘মিসিং লিংক’ আবিস্কার হয় তখন সায়েন্স ম্যাগাজিনগুলো ফলাও করে তা প্রচার করলেও যখন পরবর্তী গবেষক দ্বারা তা ভুল প্রমাণিত হয় তখন একই মিডিয়াগুলো হয় রহস্যময় নিরবতা অবলম্বন করে অথবা ‘Retrogred confession of ignorance’ তথা ‘আগে তথ্য জানা ছিল না তাই ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিল’ ধরণের স্বীকারক্তি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। এসব থেকে স্পষ্ট যে, আবিস্কৃত ফসিলগুলো বিবর্তনবাদের দিকে নির্দেশ না করলেও তারা বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ ডারউইনবাদকে টিকিয়ে রাখার কারণ বৈজ্ঞানিক নয় বরং আদর্শিক।
আধুনিক মানুষের জাতিসমূহের মধ্যে কঙ্কালগত পার্থক্য: বিবর্তনবাদী জীবাশ্মবিদা Homo erectus, Homo sapience neanderthalensis এবং Archaic homo sapience মানব জীবাশ্মগুলোকে বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন প্রজাতি বা উপপ্রজাতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। তারা উক্ত ফসিল কঙ্কালগুলোর পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে এই পার্থক্যের মধ্যে আছে মানুষের বিভিন্ন জাতির মধ্যকার বৈচিত্র্য যে জাতিগুলোর কতক বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর কতক মিশে গেছে অন্যান্য জাতির সাথে। সময়ে সময়ে জাতিগুলো যখন একে অপরের সংস্পর্শে আসতে থাকে তখন এ পার্থক্যগুলো ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়াও বর্তমান যুগের মানবজাতিগুলোর মধ্যেও উল্লেখ্যযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উপরের ছবিটিতে আধুনিক জাতিগুলোর যে কঙ্কালগুলো দেখানো হয়েছে তা উক্ত জাতিগত পার্থক্যের উদাহরণ। অতীতের অতিক্রান্ত জাতি সমূহের অনুরূপ পার্থক্য উপস্থাপন করে সেগুলোকে বির্বতনের প্রমাণ হিসেবে সব্যস্ত করার প্রচেষ্টা পক্ষপাতিত্ব ছাড়া কিছুই নয়।
লক্ষ্যণীয়, মানুষের কঙ্কালকে দাঁড়িয়ে হাঁটার উপযুক্ত করে নকশা করা হয়েছে। অপরদিকে এপদের ছোট পা, লম্বা হাত এবং সম্মুখে ঝুঁকে দাঁড়ানোর ভঙ্গি চার পায়ে চলার জন্য উপযুক্ত। এটা সম্ভব নয় যে, এপজাতীয় প্রাণী ও মানুষের একটি মধ্যবর্তী রূপ (Transitional form) থাকবে। কেননা দ্বিপদী অবস্থাটা বিবর্তন প্রক্রিয়ার ‘উন্নততর অবস্থার দিকে যাওয়ার নীতি’ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় (Bipedalism problem)।
এছাড়াও, এপ-হিউম্যান সিনারিওতে প্রাণীদ্বয়ের জেনেটিক কোডের সমতুল্যতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। সময়ে সময়ে অনেক বিবর্তনবাদী এ দাবি করেন যে, মানুষ ও এপ এর মধ্যে ৯৯% জেনেটিক সমতুল্যতা রয়েছে। বিবর্তনবাদীদের প্রতিটি সাহিত্যকর্মে, তুমি এ ধরণের লেখা পড়বে। আমরা শিম্পাঞ্জির ৯৯ শতাংশ অনুরূপ অথবা মাত্র ১ শতাংশ অনুরূপ অথবা মাত্র ১ শতাংশ ডিএনএ আমাদের মানুষ বানায় ইত্যাদি। বরং ২০০২ সালের অক্টোবর একটি সমীক্ষায় প্রকাশিত হয় যে, জেনেটিক সমতুল্যতা ৯৯% নয় বরং ৯৫%। [২৫]
কিছু বেসিক প্রোটিনের গঠন শুধু শিম্পাঞ্জি নয় অন্যান্য প্রজাতিতেও মানুষের প্রোটিনের অনুরূপ। উদাহরণ স্বরূপ নেমাটোড কৃমির সাথে মানুষের ৭৫% ডিএনএ-র সমতুল্যতা রয়েছে। তার মানে এটা নিশ্চয়ই নয় যে, মানুষ ও কৃমির মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ পার্থক্য? [২৮] প্রকৃতপক্ষে এ সমতুল্যতার কারণ বির্বতন নয় বরং একই ধরণের পরিকল্পনা। আবার যেহেতু বিবর্তনবাদ অনুসারে বনমানুষ পর্যায়ক্রমে মানুষে পরিণত হয়েছে তাই এদের মধ্যবর্তী প্রজাতি থাকার কথা এবং অসংখ্য এরূপ জীবাশ্ম পাওয়ার কথা। বিবর্তনবাদীরা এ জন্য পুরোদমে জীবাশ্ম অনুসন্ধান ও গবেষণা করেন। তারা তাদের তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে কিছু জীবাশ্মকে মধ্যবর্তী প্রজাতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। এ জন্য তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ধোঁকাবাজি, চিত্রাঙ্কন ও প্রচারমাধ্যমের আশ্রয়ও নেন। কিন্তু দেখা যায় একটি মধ্যবর্তী প্রজাতির আবিষ্কার বলে প্রচার করার কয়েকদিন পরেই তা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।” [৩২]
তৌফিক বলল, “এ সকল বিষয় থেকে তো এটা স্পষ্ট যে বিবর্তন সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি মতবাদ। এটি কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়, একটি কল্পনা যাকে বস্তুবাদী নাস্তিকরা অর্থ-সমর্থন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।”
ওমর ভাই বললেন, “বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসকে মৌলিক চেতনা ধরে নেয়া হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানীরা আগে বস্তুবাদী তারপর বিজ্ঞানী। যদি তারা আগে বিজ্ঞানী হতেন তাহলে বিজ্ঞানের আলোকে সুস্পষ্ট সত্যকে অস্বীকার করার কোন প্রশ্নই উঠতো না।”
রাজীব যোগ করলেন, “শুধু তাই নয়। উনবিংশ শতাব্দীতে বিবর্তনকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে শিক্ষা দেয়ার ফলে পৃথিবীর মানব ইতিহাসে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে তা ঔপনিবেশিকতা, নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের হিংস্রতা ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
আমরা আগেই জেনেছি বিবর্তনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল, প্রকৃতিতে সৃষ্টির উৎকর্ষ সাধন। ডারউইনের মতে প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য সার্বক্ষণিক একটি সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রামে শক্তিশালীরা সবসময় দুর্বলের উপর বিজয়ী হয় আর এর ফলে সম্ভব হয় উন্নতি। ডারউইনের বই ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ এর সাবটাইটেলে এই কথাটিকে পেশ করা হয়েছে এভাবে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রজাতির উৎপত্তি বা জীবনযুদ্ধে উপযুক্ত জাতির সংরক্ষণ’।
এ ব্যাপারে ডারউইন থমাস ম্যালথাসের বই An Esssay on the Principle of Population থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। এই বইতে দেখানো হয় যে মানবজাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ম্যালথাস গণনা করেছিলেন যে, মানবজাতিকে তার নিজের ওপর ছেড়ে দিলে এরা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। প্রতি ২৫ বছরে সংখ্যাটি দ্বিগুন হতে থাকবে। কিন্তু খাদ্য সরবরাহ কোন ভাবেই সে হারে বাড়বে না। এই তত্ত্বানুসারে, এই অবস্থায় মানবজাতি অপরিবর্তনীয় ক্ষুধামন্দায় পতিত হওয়ার বিপদের সম্মুখীন ছিল। যে সকল শক্তি মানবজাতির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করছিল তা হল প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন যুদ্ধ, দূর্ভিক্ষ এবং রোগব্যাধি। সংক্ষেপে, কিছু মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন ছিল অপরকিছু মানুষের মৃত্যু। বাঁচার অর্থ বলতে বুঝাতো ‘সার্বক্ষাণিক যুদ্ধ’। ডারউইন ঘোষণা করেন যে ম্যালথাসের বই থেকে প্রভাবিত হয়েই তিনি ‘বাঁচার জন্য সংগ্রামে’ ধারণা প্রদান করেন। তিনি বাঁচার জন্য সংগ্রামের ধারণাকে সকল প্রাণ সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ এর ক্ষেত্রে তথা পুরো প্রকৃতিতে প্রয়োগ করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ম্যালথাসের চিন্তাধারা ইউরোপের ওপরের শ্রেণীর লোকদের প্রভাবিত করে। তারা গরীব ও নীচু শ্রেণীর তথা অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ লোকদের সংখ্যা কমানোর জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের চিন্তাভাবনা শুরু করে। এরই ফলশ্রুতিতে ইংল্যাণ্ডে কমবয়সী শ্রমিকদের দৈনিক তিন-চতুর্থাংশ সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়। গরিব লোকদের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের পরিবর্তে কীভাবে আরও নোংরা পরিবেশে রাখা যায় তার ব্যবস্থা করা হয়।
বংশবৃদ্ধি করতে থাকলে ক্রমান্বয়ে আরও শক্তিশালী মানবজাতির আবির্ভাব হবে এরূপ ডারউইনবাদী ধারণার বশবর্তী হয়ে হিটলার ইউজেনিক্সের নীতি অবলম্বন করে যেখানে পঙ্গু ও মানসিক ভারসাম্যহীনদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ডারউইনবাদী নীতির ফলেই ইউরোপিয়ান সাদা চামড়ার লোকেরা আফ্রিকান নিগ্রো, রেড ইণ্ডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদেরেকে পশ্চাৎপদ বা অনগ্রসর (underdeveloped) আখ্যায়িত করে এবং তাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিবর্তনবাদ বস্তুবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের ভিত্তিকে শক্ত করে। [৪০] ডারউইনবাদের ফলে যখন এ ধারণা প্রগাঢ় হয় যে, বস্তু থেকে পর্যায়ক্রমে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে, তখন ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়। ধর্মকে মানব রচিত বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা ধর্মকে আফিম বলতেও দ্বিধান্বিত হননি। অন্যকথায়, ডারউইনবাদের প্রবর্তনের ফলেই মানুষে মানুষে হানাহানি বৃদ্ধি পায়, যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হয়, মানুষের মধ্য হতে দয়া অনুগ্রহ ও সহানুভূতি হ্রাস পায় এবং মানুষের নৈতিকতার চরম অধঃপতন ঘটে। [২৬]
তৌফিক এ কথা শুনে শিওরে উঠলো, ডারউইনবাদের ভয়াবহতা বুঝতে সক্ষম হল এবং তার মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর যেন পরিস্কার হয়ে যেতে থাকলো। রাকীব বলল, “আমি চিন্তা করে দেখলাম, মানব ইতিহাসকে বিবর্তনবাদীরা সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করেছে। তাদের ধারণা এই যে মানুষ এক সময়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, এরপর দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে শেখে। এ সময়ে তারা শিকার জীবিকা নির্বাহ করত, তখন ছিল প্রস্তর যুগ। পর্যায়ক্রমে আসে ব্রোঞ্জযুগ, তারপর লৌহযুগ। মানুষ যখন প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখে তখন থেকে সভ্যতার সূচনা হয়। যে সকল ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে এ সব হয় তাতে সাধারণত অকাট্য কিছু যুক্তিকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। যেমন: লোহা দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায়। সুতরাং তথাকথিত প্রস্তুর যুগে লোহা ব্যবহার হয়ে থাকলেও তা পাওয়া যাবে না। আবার ব্রোঞ্জ তৈরির জ্ঞানতো লোহা ব্যবহারের জ্ঞানের চেয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা। সে হিসেবে লৌহযুগ ব্রোঞ্জেরে যুগের আগে আসার কথা, পরে নয়। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রস্তরযুগের মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন পাথর কিংবা হাড় নির্মিত অলংকার ও যন্ত্রপাতি দেখলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এসব জিনিসের নিখুঁত গঠন ও ডিজাইন করতে হলে পাথর হতে মজবুত কোন পদার্থ যেমন, লোহা বা স্টিলের তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু যেহেতু লোহা দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায় সেহেতু সে যন্ত্রগুলো এখন আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অথচ বিবর্তনবাদীরা এ সকল অকাট্য যুক্তি সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। আবার বিবর্তনবাদীরা বিভিন্ন গুহায়প্রাপ্ত বিভিন্ন অঙ্কন দেখে বলে যে, এগুলো আদিম গুহা মানবদের তৈরী। সে চিত্রগুলো আঁকতে যে রঙ ব্যবহার করা হয়েছে তা এমনকি রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ যে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পার হয়ে যাওয়া এবং যে সাদৃশ্যজ্ঞান পাওয়া যায় তা শুধুমাত্র অত্যন্ত দক্ষ ও শিক্ষিত শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। [৩৪]
উপর থেকে নিচে প্রদর্শিত প্রথম ছবিটির ব্রেসলেটদ্বয়ের বাম পাশেরটি মার্বেল দিয়ে তৈরী এবং ডান পাশেরটি তৈরী ব্যাসাল্ট দিয়ে। এ দুটোর সময়কাল হলো ৮৫০০ এবং ৯০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। বিবর্তনবাদীরা দাবি করেন সে সময় শুধু পাথর নির্মিত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ব্যাসাল্ট এবং মার্বেল অত্যন্ত কঠিন বস্তু। এগুলোকে বাঁকা এবং গোল করে সংযোগ করতে অবশ্যই স্টিলের ব্লেড ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। স্টিলের যন্ত্রপতি ছাড়া এগুলোকে কাটা ও নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়া অসম্ভব। আপনি যদি কাউকে একটি পাথরের তৈরী যন্ত্র দেন এবং তাকে দেয়া ব্যাসাল্ট থেকে উপরের মতো ব্রেসলেট তৈরী করতে বলেন তারা কতটুকু সফল হবে? একটা পাথরকে আরেকটার সাথে ঘষলে অথবা একটিকে অপরটার সাথে সংঘর্ষ করালে নিশ্চয়ই অনুরূপ কোন ব্রেসলেট তৈরী হবে না। বরং উপরে প্রদর্শিত আর্টিফেক্টগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে এগুলো যারা তৈরী করতো তাদের যথেষ্ট সৌন্দর্য্যবোধও ছিল। মাঝখানের এবং সবচেয়ে নিচের ছবি দুটিতে হাড় ও অবিসিডিয়ানের তৈরী হস্তশিল্প, আংটা ও পাথর নির্মিত বিভিন্ন বস্তু দেখা যাচ্ছে। স্পষ্টতই, কেউ এ ধরণের সুগঠিত আকার শুধুমাত্র পাথর দিয়ে কাঁচামাল আঘাত করে প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে না। আঘাতে হাড় ভেঙ্গে যাবে। ফলে, প্রত্যাশিত গঠনটি পাওয়া যাবে না। একইরূপে, গ্রানাইট এবং ব্যসাল্টের মতো সর্বাধিক শক্তিশালী পাথর দিয়ে নির্মিত যন্ত্র দিয়েও তীক্ষ্ণ ও ধারালো পার্শ্ব ও সূচালো প্রান্ত তৈরী করা সম্ভব নয়। এই পাথরগুলো ফল কাটার মতই খুব নিয়মিত ভাবে কাটা হয়েছে। এদের উজ্জ্বলতা এদেরকে পালিশ করার ফলেই হয়েছে। যারা এইগুলো তৈল করেছে তাদের কাছে এর জন্য প্রয়োজনীয় স্টীল কিংবা লোহার মাধ্যম অবশ্যই ছিল। শক্ত পাথরের খণ্ডকে অনুরূপ সুচারুপে কাটা শুধুমাত্র এর চেয়ে মজবুত ও ধারালো কোন পদার্থ যেমন স্টিলের পক্ষে সম্ভব।
এটা সুস্পষ্ট যে, মানব ইতিহাসে প্রস্তরযুগ লৌহযুগের ধারাবাহিতকতা আনার চেষ্টা করা হয় বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যই। প্রকৃতপক্ষে, না ছিল প্রস্তরযুগ না ছিল আদিম মানুষ। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে সকল মানবজাতি প্রাথমিকভাবে সভ্য ছিল। কিন্তু আমার ধারণা পরবর্তীতে তাদের নিকট প্রেরিত রাসূলদের অনুসরণ না করার কারণে স্রষ্টা তাদেরকে অসভ্য ও আদিম বানিয়ে দিয়েছেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের অস্তিত্ব যখন পৃথিবীর জন্য হুমকিরস্বরূপ হয়ে গেছে তখন তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।”
ওমর ভাই বললেন, “বস্তবাদী, ভোগবাদী দর্শনকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য বিবর্তনবাদকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ১৯৬৬ সালের এক রিপোর্টে Confession of a Professed Atheist শীর্ষক প্রবন্ধে Aldous Huxley নিজেই স্বীকার করেছেন: ‘পৃথিবীকে না বুঝবারই ইচ্ছা আমার ছিল। পরিণতি হিসেবে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, এ ধারণা কারোর নেই এবং ধারণার যথেষ্ট কারণ বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না। আমার নিজের কথাই বলি, আমার অধিকাংশ সমসাময়িক লোকের কোনই সন্দেহ নেই যে, অর্থহীনতাই ছিল মুক্তি লাভের একটা অপরিহার্য হাতিয়ার। আমরা যুগপৎ নিষ্কৃতি চেয়েছিলাম বিশেষ ধরণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে এবং এক বিশেষ ধরণের নৈতিকতা থেকে। আমরা নৈতিকতা ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছি। কেন না তা আমাদের যৌন স্বাধীনতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছিলো।’ মাওলানা আব্দুর রহীম হাক্সলির এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে লিখেন- ‘বস্তুত নৈতিক বাধাবন্ধন ও বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছা ও প্রবণতাই হলো ক্রমবিকাশবাদে বিশ্বাস করার মৌল কারণ। আর ক্রমবিকাশ দর্শনে বিশ্বাসীদের-যারা নিজেদের ইতর প্রাণী ও হীন জীবজন্তুর বংশধর বলে মনে করে-কোন নৈতিকতাই থাকতে পারে না। বর্তমান দুনিয়ার ক্রমবিকাশবাদে বিশ্বাসীদের নৈতিক অবস্থা দেখলেই তা অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে।’ [২৭] কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের আবিস্কার ও সচেতন চিন্তাভাবনা এ বিষয়টি পরিস্কার করে তুলেছে যে, প্রতিটি প্রাণহীন বস্তু ও প্রতিটি জীবকেই সৃষ্টি করা হয়েছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভারসাম্যপূর্ণভাবে। অকাট্য ও খুঁতবিহীন পরিকল্পনার মাধ্যমে। তাই আমাদের উচিত সেই সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করা, যিনি আমাদের অর্থহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আর এ জন্য মহান আল্লাহ প্রেরিত ১৪০০ বছর ধরে অপরিবর্তিত লিটারারী মির্যাকল কোরআনতো আছেই, সাথে আছে হাদিসে রাসূল। এজন্যই আল্লাহ বলেন: “সত্য সমাগত এবং মিথ্যা অপসৃত। মিথ্যাতো অপসৃত হতে বাধ্য।” (আল কোরআন, বনী ইসরাইল, আয়াত ৮১)
তথ্যসূত্র:
[১] Harun Yahya, Darwinism Refuted, Goodword books, India, p.20.
[২] Ibid, p.20.
[৩] Ibid, p.22.
[৪] Harun Yahya, The Dark Spell of Darwinism, Global Pulishing, Turkey, p.11
[৫] Harun Yahya, The Religion of Darwinism: A pagan doctrine from ancient times prevalent until today, Abul-Qasim Publishing House, Jeddah, SA, p.11.
[৬] Ibid, p.19.
[৭] Ibid, p.20.
[৮] Ibid, p.21.
[৯] Ibid, p. 22.
[১০] Ibid, p.12.
[১১] Charles Darwin, The origin of species, W.R. Goyal publishers & distributors, India, p.159.
[১২] Robert L. Caroll, Pattern and Process of Vertebrate Evolution; Cambridge edition, p.151.
[১৩] Harun Yahya, Darwinism Refuted, Goodword books, India, p.54
ডারউইন যখন প্রথম তার থিওরী প্রদান করেন তখন তার থেকে শতগুনে যোগ্য একজন সমসাময়িক প্যালেওন্টোলজিস্ট লাওইস আগাসিজ ফসিল রেকর্ডের আলোকে ডারউইনের হাইপোথিসিসকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ডারউইন যেহেতু তার তত্ত্বের আলোকে জীবের উৎপত্তির একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন এবং যেহেতু পশ্চিমা বিশ্বে চার্চের সাথে বিজ্ঞানের যুদ্ধ চলছিল, ডারউইনের এই মতবাদ পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক না হয়েও পরবর্তীতে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
ডারউইন কৃত্রিম সংকরায়ণের উপর পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলেন প্রজাতিতে যে ভ্যারিয়েশন হয় সেগুলো প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হতে পারে এবং যথেষ্ট সময় দিলে তা নতুন প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। তার এই প্রকল্পের বিপরীতে তিনি ফসিল রেকর্ডকেও দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফসিল রেকর্ডে দুটো সমস্যা তার দৃষ্টিতেই বাঁধা মনে হচ্ছিল:
১. ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোসন, এবং
২. গ্র্যাজুয়্যাল ইভলিউশনের জন্য ফসিল রেকর্ডে গ্র্যাজুয়্যাল ফসিল এভিডেন্সের অভাব।
তিনি এ দুটো ব্যাখ্যার অপূর্ণতার জন্য দায়ী করেছিলেন তৎকালীন ফসিল রেকর্ডের অপূর্ণতাকে। কিন্তু গত ১৫০ বছরের ফসিল অভিযান এই অপূর্ণতাকে সমাধান করেনি বরং আরও তীব্র করেছে।
ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোসন হল জিওলজিকাল টাইম স্কেলে খুব ক্ষুদ্র একটি সময় (৫৩০ মিলিয়ন বছর থেকে ৫২০ মিলিয়ন বছর পূর্বে) যখন ভূস্তরে প্রাণীজগতের প্রায় ২০টি পর্বের (Phylum) একত্রে আগমন ঘটে। লক্ষ্যণীয় প্রাণীজগতের শ্রেণীবিন্যাসের যে ছয়টি স্তর আছে তার মধ্যে Phylum বা পর্ব হল উপরে। এরপর যথাক্রমে Class, Order, Family, Genus, Species. একটি স্পিসিসের সাথে আরেকটি স্পিসিসে গাঠনিক পার্থক্য খুবই কম। এমনকি শুধু রঙের পার্থক্য ও রিপ্রোডাকটিভ আইসোলেসনের কারণে একটি স্পিসিস আরেক স্পিসিস থেকে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু শ্রেণীবিন্যাসের ক্রমে যত উপরের দিকে উঠা যায় ততই প্রাণীদের গাঠনিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে পর্ব ও শ্রেণী পর্যায়ে প্রাণীদের স্পষ্টভাবে আলাদা করা যায়। পর্বগুলোর পার্থক্য হলো তাদের সম্পূর্ণ পৃথক ‘Body Plan’। ডারউইনিয়ান পদ্ধতি সঠিক হলে ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোসনের আগে প্রি-ক্যামব্রিয়ান পিরিয়ডে (এডিয়াকারান পিরিয়ড) পর্যায়ক্রমিক জটিলতর ‘বডি প্ল্যানের’ অনেক ফসিল পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রিক্যামব্রিয়ান স্তরে এ ধরণের ফসিল এভিডেন্স নেই। আছে শুধু এককোষী জীব এবং স্পঞ্জ জাতীয় প্রাণীর ফসিল।
ক্যামব্রিয়ান নিয়ে ডারউইনের এই সন্দেহ গত ১৫০ বছরের ফসিল রেকর্ডের আবিস্কার, প্রি-ক্যামব্রিয়ান ফসিল না থাকার বিভিন্ন ব্যাখ্যার (যেমন: আর্টিফ্যাক্ট হাইপোথিসিস) ব্যর্থতা এবং জেনেটিক্স ও মলিকিউলার বায়োলজির বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির আলোকে আরো প্রকট হয়ে ডারউইনবাদের জন্য ‘সন্দেহ’ থেকে ‘বিপরীত’ এভিডেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কেন এবং কীভাবে তা হলো সেটা নিয়েই, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ফিলোসফি অব সায়েন্সে ডক্টরেট স্টিফেন সি. মায়ার তার বই ‘Darwin’s Doubt’ লিখেছেন।
বইটিতে একদিকে যেমন ডারউইনবাদের সাথে ফসিল এভিডেন্সের অসংলগ্নতা নিয়ে তথ্য-ভিত্তিক আলোচনা আছে, তেমনি জেনেটিক্সের সাথে ডারউইনবাদের আধুনিক সংকরণ নিও-ডারউইনিজমের ব্যর্থতা নিয়েও আলোচনা আছে।
প্রসঙ্গত, ডারউইন যখন প্রথম মতবাদ দেন, তখন তিনি জিন ব্যাপটিস্ট লামার্কের তত্ত্ব থেকে কিছু ধারণা তার চিন্তায় ঢুকিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল প্রজাতিতে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রয়োজনে বৈশিষ্ট্যে কিছু বংশানুক্রমে সঞ্চালনযোগ্য (হেরিটেবল) পরিবর্তন সূচিত হয় এবং প্রাকৃতিকভাবে তা নির্বাচিত হয়ে ধীরে ধীরে প্রজাতিতে পরিবর্তন আসে। কিন্ত গ্রেগ্রর জোহানস মেন্ডেল যখন দেখালেন জীবের ভিতর জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো জিন হিসেবে থাকে এবং বিভিন্ন জিন থাকার কারণে বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নতা তৈরী হয়। তখনও মিউটেশন আবিস্কার হয়নি। ফলে ডারউইনবাদ প্রাথমিকভাবে সমস্যায় পড়ে যায়। কিন্তু যখন মিউটেশন আবিস্কার হয় এবং দেখা যায় মিউটেশন প্রজাতির জিনে ক্ষতি সাধন করতে পারে তখন ডারউইনবাদকে জেনেটিক্সের সাথে মিশিয়ে নতুন সিনথেসিস করা হয় ১৯৪২ সালে, যার নাম নিও-ডারউইনিজম। এতে নেতৃত্ব দেন আর্নেস্ট মায়ার, থিওডসিয়াস ডবঝানস্কি, থমাস হাক্সলি প্রমুখ। নিও-ডারউইনিজমের মূল কথা- র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে প্রজাতিতে ভ্যারিয়েশন তৈরী হয় এবং ন্যাচারাল সিলেকশনের মধ্য দিয়ে ফেবরেবল ভ্যারিয়েশন বাছাই হয়। এভাবে মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে একটি প্রজাতি আরেকটি প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।
এরপর ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমস ওয়াটসন আবিস্কার করেন- ডিএনএ। আবিস্কার হয় কম্পিউটার যেমন বাইনারী নাম্বারে কোড ধারণ করে, ঠিক তেমনি ডিএনএ প্রোটিন গঠনের তথ্য কোড হিসেবে ধারণ করে। এডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থায়ামিন এই চার ধরণের নাইট্রোজেন বেজ দিয়ে গঠিত হয় ডিএনএ কোড। প্রতি তিনটি নিউক্লিওটাইড একটি এমাইনো এসিডকে কোড করে। জীবে প্রাপ্ত প্রোটিন গঠিত হয় ২০ ধরণের এমাইনো এসিড দিয়ে। অন্যদিকে ৪টি নিউক্লিওটাইড ৩টি পজিশনে মোট ৪^৩ তথা ৬৪ রকমে বসতে পারে। সুতরাং দেখা গেল, একেকটি এমাইনো এসিড একাধিক নিউক্লিউটাইড কম্বিনেশন দিয়ে কোড হতে পারে।
সময়ের সাথে সাথে জানা যায় মিউটেশন হলো নিউক্লিওটাইড সাবস্টিটিউশন, ইনসারশন, ডিলেশন ইত্যাদি ধরণের। মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যদি এমন একটি নিউক্লিওটাইড সাবস্টিটিউশন হয় যে এমাইনো এসিড অপরিবর্তিত থাকে তাহলে প্রোটিনের গঠনে কোন পরিবর্তন হবে না। এ কারণে একই কাজ সম্পাদনকারী প্রোটিনের জেনেটিক কোডে পার্থক্য থাকতে পারে। এবং প্রজাতিভেদে ব্যাপারটা এরকমই পাওয়া যায়। এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে ‘মলিকিউলার ক্লক’ বা ‘ফাইলোজেনেটিক স্টাডি’। অর্থাৎ একটি প্রোটিন যা একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে, বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে উক্ত প্রোটিনটির জেনেটিক কোডে ভিন্নতা ও মিল হিসেব করা হয়। এরপর মিউটেশনের হার ইত্যাদির আলোকে দেখা হয় যে দুটো সমজাতীয় প্রজাতির কত বছর আগে পরস্পর থেকে পৃথক হয়েছে। (বিস্তারিত বইটিতে আছে।)
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যদি বিবর্তনের মাধ্যমে প্রজাতি এসে থাকে তাহলে বিভিন্ন জিন নিয়ে ফাইলোজেনেটিক স্টাডি করলে সমজাতীয় মলিকিউলার ট্রি পাওয়ার কথা, অথচ বিভিন্ন মলিকিউলার ইভোলিউশনারী বায়োলজিস্ট বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন প্রোটিন, বিভিন্ন পর্বের একই ধরণের জিন নিয়ে গবেষণা করে যে ‘ট্রি’গুলো দাঁড় করিয়েছেন তাতে ইভোলিউশনারী টাইমিং-এর কোন কনগ্রুয়েন্ট পিকচার নেই। এই বিষয়টি খুব সুন্দর চিত্রের আলোকে Darwin’s Doubt বইটিতে লেখক দেখিয়েছেন।
প্রোটিন গঠিত হয় ২০ ধরণের এমাইনো এসিড দিয়ে এবং প্রোটিনের গঠন খুবই স্পেসিফিক। ধরা যাক, দুটো এমাইনো এসিড পরস্পর পেপটাইড বণ্ড দিয়ে যুক্ত হবে। তাহলে সম্ভাব্য সমাবেশ হতে পারে, ২০x২০ তথা ৪০০ ধরণের। তিনটি হলে ২০x২০x২০ তথা ৮০০০ ধরণের, ৪টি হলে ২০^৪ = ১৬০০০০ ধরণের। অথচ, কোষের ভিতর ছোট আকৃতির একটি কার্যকরী (ফাংশনাল) প্রোটিন গড়ে ১৫০টি এমাইনো এসিডের সমন্বয়ে তৈরী হয়। সুতরাং ১৫০ ঘরে বিন্যাস হবে ২০^১৫০ তথা ১০^১৯৫ ধরণের। যার মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক বিন্যাসই কার্যকরী প্রোটিন গঠন করতে পারে। এই সংখ্যাটা কত বড় তা বুঝানোর জন্য বলা যায়, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে ১০^৮০টি মৌলিক কণা আছে এবং আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১০^১৬ সেকেণ্ড। সুতরাং র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে কি প্রোটিন আসা সম্ভব?
এই ‘কম্বিনেটরিয়াল ইনফ্লেশন’ নিয়ে প্রথম আগ্রহী হন MIT-র প্রফেসর অব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সায়েন্স মুরে এডেন, ১৯৬০ সালে। ১৯৬৬ সালে তিনিসহ আরো কয়েকজন ম্যাথমেটিসিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানী উইসটার ইন্সটিউট অব ফিলাডেলফিয়ায় একত্রিত হন। তারা প্রোটিনের গঠনের এই কম্বিনেটরিয়াল ইনফ্লেশনকে বিবেচনায় এনে নিও-ডারউইনিজমের সীমাব্ধতাগুলো তুলে ধরেন। তারা দেখান যে র্যাণ্ডম মিউটেশনের মধ্য দিয়ে একটি প্রোটিনও আসা সম্ভব নয়, সময় এবং রিসোর্সের সীমাব্ধতার কারণে। তবে কনফারেন্সে এই তথ্যটাও উঠে আসে যে প্রোটিনের এই সিকোয়েন্স স্পেসে প্রোটিনগুলোর গঠন যদি কাছাকাছি থাকে তাহলে হয়তো একটি সম্ভাবনা আছে যে নিও-ডারউইনিজম র্যাণ্ডম মিউটেশন দিয়ে প্রোটিনের বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারে। যদিও মুরে এডেন নিজেই এই সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেননি। কারণ, একটি ভাষায় থাকে সিনটেক্স, গ্রামার, কনটেক্সট ইত্যাদি। ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান জেনেটিসিস্টি মাইকেল ডেনটন দেখান, ইংরেজীতে একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বাক্যে বর্ণের সম্ভাব্য সকল কম্বিনেশনের মধ্যে অর্থযুক্ত বাক্যের (তথা সিকোয়েন্সের) সংখ্যা খুবই কম এবং দৈর্ঘ্য যত বড় হয় সংখ্যা ততই কমে যেতে থাকে। তিনি হিসেব করে দেখান ১২টি বর্ণের বাক্যে অর্থযুক্ত শব্দের সম্ভাব্যতা ১০^১৪ এর মধ্যে ১ বার। এভাবে ১০০টি বর্ণের বাক্যে ১০^১০০ এর মধ্যে একবার।
নিও-ডারউইনিস্টরা অবশ্য এ সুযোগটি গ্রহণ করে এবং আশাবাদী থাকে যে সিকোয়েন্সে স্পেসে প্রোটিনের অবস্থান কাছাকাছি হবে। ক্যালিফর্নিয়া ইন্সটিউট অব টেকনোলজি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করার সময় ডগলাস এক্স এ বিষয়টি পরীক্ষামূলক ভাবে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরী অব মলিকিউলার বায়োলজিতে এলান ফার্স্ট এর অধীনে রিসার্চের সুযোগ পেয়ে যান। তিনি ও তার সহযোগিরা ১৫০ এমাইনো এসিডের সম্ভাব্য সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
প্রসঙ্গত প্রোটিন শুধু মাত্র এমাইনো এসিডের চেইন হিসেবে থাকে না। প্রোটিন তিনটি ধাপে ভাঁজ (ফোল্ড) হয়। এদেরকে প্রাইমারী, সেকেণ্ডারী এবং টারশিয়ারী স্ট্রাকচার বলে। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক ফোল্ড সঠিক হওয়ার উপরই এর ফাংশন নির্ভর করে। সকল এমাইনো এসিড সিকোয়েন্স-এ যেমন ত্রিমাত্রিক ফোল্ড হয় না আবার সকল ত্রিমাত্রিক ফোল্ড ফাংশনাল হয় না। ডগলাস এক্স প্রাথমিক ভাবে দেখতে পান যেই সংখ্যক সিকোয়েন্স ফাংশনাল ফোল্ড গঠন করে তাদের সম্ভাব্যতা ১০^৭৪ এর মধ্যে ১ বার। (মহাবিশ্বের বয়স ১০^১৬ এবং মিল্কি ওয়েতে পরমাণু সংখ্যা ১০^৬৫) এর মধ্যে যেই ফোল্ডগুলো কার্যকরী তাদেরকে হিসেবে নিলে সম্ভাব্যতা দাঁড়ায় ১০^৭৭। ডগলাস এক্স দেখেন যে আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের ৩.৪ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১০^৪০। তিনি ধরে নেন যে প্রতিটি ব্যাকটেরিয়াতেই যদি একটি করে নিউক্লিওটাইড সাবস্টিটিউশন হয় (যা কখনোই হয় না) তাহলেও একটি ১৫০ এমাইনো এসিডের চেইনের প্রোটিন আসতে পারবে না। তবে, একটি বিদ্যমান প্রোটিনকে আরেকটি ফাংশনাল প্রোটিনে পরিণত করতে হলে র্যাণ্ডম মিউটেশনের জন্য কাজ কমে যায়। তখন শুধু একটি প্রোটিনকে আরেকটি প্রোটিনে পরিণত করতে কয়টি মিউটেশন লাগবে তা হিসেব করলেই হয়।
পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন এখানে মূল সমস্যাটি হল ডিএনএতে তথ্য যুক্ত করার সমস্যা। নিও-ডারউইনিস্টরা পপুলেশন জেনেটিক্স নামক ডিসিপ্লিন দিয়ে মিউটেশনের মাধ্যমে প্রজাতির জিনে নতুন ইনফরমেশন যুক্ত হওয়ার বিভিন্ন হিসেব নিকেষ কষে থাকেন। লেহাই ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর মাইকেল বিহে এবং ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের ফিজিসিস্ট ডেভিড স্নোক পপুলেশন জেনেটিক্সের উপর ভিত্তি করে একটি প্রোটিনকে আরেকটি ন্যাচারালী সিলেকটেবল প্রোটিনে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় মিউটেশন এবং তা আসতে প্রয়োজনীয় সময় হিসেব করেন। তারা দেখেন যে একটি প্রোটিন-প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইট থেকে আরেকটি প্রোটিন-প্রোটিন ইন্টারেকশন সাইট আসতে হলে একই সাথে কয়েকটি স্পেসিফিক মিউটেশন লাগবে (কমপ্লেক্স এডাপটেশন) এবং তারা হিসেব করে দেখান যে এর জন্য কমপক্ষে দুই বা ততোধিক মিউটেশন একই সাথে স্পেসিফিক সাইটে হতে হবে। বিহে এবং স্নোক বাস্তবিক উদাহরণের উপর ভিত্তি করে দেখান যে, পৃথিবীর বয়স সীমায় দুটি মিউটেশন একসাথে হতে পারে যদি স্পিসিসের পপুলেশন সাইজ অনেক বড় হয়। কিন্তু দুইয়ের অধিক মিউটেশন একসাথে প্রয়োজন হলে তা পৃথিবীর বয়স সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। অথচ, ডগলাক্স এক্স মলিকিউলার বায়োলজিস্ট এনে গজারকে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে, একটি প্রোটিন আরেকটি ভিন্ন ফাংশনের প্রোটিনে পরিণত করতে নূন্যতম ৫ বা তার বেশী সাইমালটেনিয়াস মিউটেশন তথা নিউক্লিউটাইড সাবস্টিটিউশন লাগবে।
র্যাণ্ডম মিউটেশনের এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে নিও-ডারউইনিস্ট বিজ্ঞানীরা জিনোম ভ্যারিয়েশন তৈরীর অন্যান্য মেকানিজম প্রস্তাব করেছেন। যেমন: জেনেটিক রিকম্বিনেশন, এক্সন শাফলিং, জিন ডুপ্লিকেশন, ইনভারশন, ট্রান্সলোকেশন, ট্রান্সপজিশন ইত্যাদি। স্টিফেন সি. মায়ার তার বইতে প্রত্যেকটি মেকানিজমের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন।
লক্ষ্যণীয়, কোষের ভিতর একটি প্রোটিন একা কাজ করে না। বরং কয়েকটি পরস্পর অন্তঃনির্ভরশীল প্রোটিনের নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করে। আবার ডিএনএতে প্রোটিনের প্রাথমিক গঠনের তথ্য ধারণ করলেও, প্রোটিনগুলো কিভাবে কোষের ভিতর এরেঞ্জ হবে সেই তথ্য কিন্তু ধারণ করে না। এককোষী জীব থেকে বিভিন্ন উচ্চতর প্রাণীর পর্বগুলোকে কীভাবে ভাগ করা করা হয়? উত্তর: কোষের প্রকারের উপর ভিত্তি করে। বহুকোষী জীব অনেক ধরণের কোষ নিয়ে গঠিত হয়। মজার ব্যাপার হলো প্রতিটি কোষই কিন্তু শরীরের পুরো জেনেটিক তথ্য ধারণ করে বলে আমরা এখন পর্যন্ত জানি। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে প্রতিটি কোষের একটি নির্দিষ্ট অংশ সাইলেন্সিং করা থাকে। সাইলেন্সিং-এর কাজ কীভাবে হয়?
এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করতে করতেই নতুন একটি শাখা খুলে গেছে যার নাম এপিজেনেটিক্স। এপিজেনেটিক্সের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে, কোষ যে শুধু ডিএনএ তথ্য ধারণ করে তা-ই নয় বরং কোষের ঝিল্লীর যে সুগার মলিকিউল আছে সেগুলোর পজিশনও খুব স্পেসিফিক। একে বলা হচ্ছে সুগার কোড। সুগার কোড নির্ধারণ করে একটি প্রোটিন তৈরী হওয়ার পর কোষের কোন্ অংশে সে যাবে। একই জীবদেহের কোষগুলোতে এই সুগার কোডটি কপি হয় রিপ্রোডাকর্টিভ সেল উওসাইট থেকে। এটি ডিএনএতে কোড করা থাকে না। আবার মাইক্রোটিউবিউল নামক কোষের ভিতরের যে পরিবহন নেটওয়ার্ক সেটার পরিজশনও ডিএনতে কোড করা থাকে না। সুতরাং একটি বহুকোষী প্রাণীর কোষ ডিফারেনসিয়েশনে এই সুগার কোডও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ শুধু ডিএনএ মিউটেশন দিয়ে এটি ব্যাখ্যা করা যাবে না। অন্যদিকে, জিন সাইলেন্সিং এর কাজটিও হয় ননকোডিং রিজিওনের বিভিন্ন তথ্য এবং হিস্টোন মিথাইলেশন, এসিটাইলেশন ও নিওক্লিওটাইড মিথাইলেশন ইত্যাদির মাধ্যমে। এপিজেনেটিক এই বিষয়গুলো কীভাবে নিও-ডারউইনিজমের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ড. মায়ার খুব সুন্দর ভাবে একটি চ্যাপ্টারে তা আলোচনা করেছেন।
একটি পুংজনন কোষ একটি স্ত্রীজনন কোষকে যখন নিষিক্ত করে তখন জাইগোট গঠিত হয়। এর পর জাইগোটটি বিভাজিত হতে শুরু করে। অনেকগুলো কোষের একটি গুচ্ছ তৈরী করার পর এটি পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন কোষে বিভাজিত হতে থাকে এবং কোষগুলোর সঠিক অবস্থানে, সঠিক সময়ে সুগঠিতভাবে এরেঞ্জ করার কাজটি চলতে থাকে যতক্ষণ না তা পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে পরিনত হয়। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় বিষয়টি কতটা জটিল এবং সুনিয়ন্ত্রিত। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিউট অব টেকনোলজির এরিক ডেভিডসন তার পুরো ক্যারিয়ারকে ব্যয় করেছেন এই ডেভেলপমেন্টাল জিন রেগুলেশনকে বের করতে। তিনি পর্যায়ক্রমিক জেনেটিক নিয়ন্ত্রণের এই হায়ারার্কির নাম দেন ডেভেলপমেন্টাল জিন রেগুলেশন নেটওয়ার্ক। তিনি তার গবেষণায় এও দেখান যে ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন পর্যায়ের মিউটেশনের ফলে কী ভয়াবহ পরিণতি হয়। অথচ কোন হেরিটেবল ভ্যারিয়েশন তৈরী হতে হলে রিপ্রোডাকটিভ কোষেই মিউটেশন হতে হবে।
নিও-ডারউইনিজমের এই সীমাবদ্ধতাগুলো দেখতে পেয়ে অনেক বিজ্ঞানীই নতুন নতুন ইভলিউশনের মডেল দিতে শুরু করেছেন। ফসিল রেকর্ডের সীমাবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে যেমন নাইলস এলড্রেজ এবং স্টিফেন জে গোল্ড ‘পাঙ্কচুয়েটেড ইকুইলিব্রিয়াম’ দাঁড় করিয়েছিলেন, তেমনি ‘পোস্ট-ডারউইনিয়ান ওয়ার্ল্ডে’ অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও অন্যান্য ইভলিউশনারী মডেল প্রস্তাব করেছেন: এভো-ডেভো, সেল্ফঅর্গ্যানাইজেশন মডেল, এপিজেনেটিক ইনহেরিটেন্স, ন্যাচারাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। ড. মায়ার দুটো চ্যাপ্টারে এই মডেলগুলোর সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা দুটো নিয়েই আলোচনা করেছেন।
আমরা যখন কোন সফটওয়্যার দেখি এর পিছনে একজন প্রোগ্রামারের কথা চিন্তা করি, যখন কোন গাড়ি দেখি এর পেছনে একজন বুদ্ধিমান গাড়ি তৈরীকারীর কথা ভাবি। ঠিক তেমনি যখন আমরা বায়োলজিক্যাল সিস্টেমে ডিজাইন দেখতে পাই, স্বাভাবিক ভাবেই একজন ডিজাইনারের কথা মাথায় আসে। সায়েন্টিফিক মেথডলজিতে ‘এবডাকটিভ ইনফারেন্স’ বলে একটি কথা আছে। বায়োলজিক্যাল বিঙ এর ডিজাইনে এই মেথডের প্রয়োগ আমাদের ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের কথাই বলে। কিন্তু ডারউইনিয়ান ওয়ার্ল্ডে কোন্ জিনিসটি এই হাইপোথিসিসকে গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে পাওয়া যায় ‘মেথডলিজক্যাল ন্যাচারালিজম’, যা সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে একটি অঘোষিত নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু মেথডলজিক্যাল ন্যাচারালিজমকে ইউনিফর্মিটারিয়ান রুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নেয়ার সুযোগ আছে কি?
স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিউটের ডাইরেক্টর রিচার্ড স্টার্নবার্গ যিনি ইভলিউশনারী বায়োলজি ও সিস্টেমিক বায়োলজিতে দুটো পিএইচডিধারী যখন স্টিফেন সি. মায়ারের ক্যামব্রিয়ান ইনফরমেশন এক্সপ্লোশন সংক্রান্ত একটি আর্টিকল ওয়াশিংটন বায়োলজি জার্নালে প্রকাশের সুযোগ করে দেন তখন নিও-ডারউইনিস্টরা তাকে ডিফেম করা শুরু করে, তার উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়, তার বিরুদ্ধে মিস-ইনফরমেশন ক্যাম্পেইন চালানো হয়, যতক্ষণ না তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। অথচ তখনও পর্যন্ত ড. মায়ারের আর্টিকলের যৌক্তিক সমালোচনা করে কোন আর্টিকেল জার্নালে ছাপানো হয়নি। এটাকেকি বিজ্ঞান বলে?
ড. স্টিফেন সি. মায়ার তার বইয়ের শেষের দিকে এই বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’কে প্রজাতির উৎপত্তির একটি মডেল হিসেবে কেন বিবেচনা করা যায় তার যুক্তিগুলো উপস্থাপন করার পাশাপাশি, নিও-ডারউইনিস্টদের সমালোচনাগুলোর জবাব দিয়েছেন।
লক্ষ্যণীয়, আমেরিকাতে গভার্নমেন্টের সমালোচনা করা গেলেও ডারউইনিজমের সমালোচনা করা যায় না, ঠিক যেমন আমাদের দেশে ডারউইনিজমের সমালোচনা করা গেলেও গভার্নমেন্টের সমালোচনা করা যায় না।
ইসলামের ইতিহাসে সবসময়ই বিজ্ঞানচর্চার সাথে ধর্ম কেন হারমোনি বজায় রেখেছে তা এই বইটি পড়লে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়।
বার্ডফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ও মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা নামক ভাইরাস দিয়ে। যাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আরএনএ-র গঠন এবং জেনেটিক ড্রিফট সম্পর্কে ধারণা নেই তারাই কেবল নতুন নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা স্ট্রেইন তৈরী হওয়াকে ডারউইনীয় বিবর্তন বলবে। তবে হ্যাঁ, বিবর্তন বলতে যদি শুধুমাত্র একই প্রজাতির মধ্যে পরিবর্তন বুঝায় তথা একটি প্রজাতির মধ্যে ভ্যারাইটি তৈরী হওয়া বুঝায় তাহলে এটাকে বিবর্তন বলা যায়। তবে এই বিবর্তন কখনোই ডারউইনীয় এককোষ থেকে মানুষের বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। অন্য কথায় মাইক্রোইভোলিউশন ম্যাক্রোইভোলিউশনকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জেনেটিক এলেমেন্ট হিসেবে আরএনএ থাকে (লক্ষ্যণীয়, ভাইরাসে জেনেটিক এলেমেন্ট হিসেবে ডিএনএ-র পরিবর্তে আরএনএ থাকতে পারে); মজার বিষয় হল এই ভাইরাসে আরএনএ একটি অবিচ্ছিন্ন চেইন হিসেবে থাকে না, বরং ৮টি খণ্ডে বিভক্ত থাকে। এই ভাইরাসের আক্রমণ করার ক্ষমতা নির্ভর করে হিমাগ্লুটিনিন ও নিউরামিনিডেজ নামক দুটি প্রোটিনের উপর। যে এন্টিভাইরাল ঔষধগুলো তৈরী করা হয় তা মূলত কাজ করে এদের উপর। (1) কোন কারণে যদি এই প্রোটিনদ্বয়ের এমাইনো এসিডের সিকোয়েন্সে সামান্য পরিবর্তন আসে তবে উক্ত ঔষধ আর কাজ করতে পারে না। আমরা বলেছি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ৮টি আরএনএ খণ্ড নিয়ে গঠিত। এই আরএনএ খণ্ডগুলোই হিমাগ্লুটিনিন ও নিউরামিনিডেজ প্রোটিনের জেনেটিক তথ্য ধারণ করে। বংশবৃদ্ধিকালীন আরএনএ রেপ্লিকেশনের সময় মিউটেশন (জেনেটিক এরর) হয়। মিউটেশন হওয়ার সময় যদি এমাইনো এসিড সিকোয়েন্সে এমন ক্ষুদ্র পরিবর্তন আসে যে তা হিমাগ্লুটিনিন ও নিউরামিনিডেজ-এর মূল গঠনকে ব্যহত না করে শুধুমাত্র যেই অংশটুকু ভাইরাসের আক্রমণের কাজে লাগে (এপিটোপ) তাতে সামান্য পরিবর্তন আনে তাহলে ভাইরাসটি আক্রমণ ক্ষমতা (ভিরুলেন্স) অক্ষুণ্ণ রেখে ঔষধের বিপরীতে রেজিস্টেন্স হয়ে যাবে। কারণ এই ভাইরাসের বিপরীতে যে ঔষধগুলো কাজ করে, সেগুলো ভাইরাসের উক্ত প্রোটিনদ্বয়ের নির্দিষ্ট অংশের সাথে ত্রিমাত্রিক গঠনে সম্পূরক ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করে। তবে এ প্রক্রিয়ায় কোন অবস্থাতেই ভাইরাসটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস থেকে অন্য ভাইরাসে পরিণত হবে না। কারণ যে মিউটেশনগুলো উক্ত প্রোটিনদ্বয়ে বা ভাইরাসের অন্যান্য গঠনে স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন এনে ফেলে সেগুলোতে প্রকৃতপক্ষে ভাইরাসগুলো মারা যায় (এটাকে বলে জেনেটিক এররের লিমিট ক্রস করে যাওয়া); Jewetz, Melnick ও Adelberg, তাদের Medical Microbiology বইতে হিমাগ্লুটিনিন (HA) এর গঠন সম্পর্কে এভাবে বলছেন:
The HA molecule is folded into a complex structure. Each linked HA 1 and HA 2 dimer forms an elongated stalk capped by a large globule. The base of the staclk anchors it is the membrane. Five antigenic sites on the HA molecule exhibit extensive mutations. These sites occur at regions exposed on the surface of the structure, are apparently not essential to the moleule’s stability, and are involved in viral neutralization. Other regions of the HA molecule are conserved in all isolates, presumably because they are necessary for the molecules to retain its structure and function. (2)
অর্থাৎ একটি ভাইরাসকে অন্য ভাইরাসে পরিণত করতে হলে শুধু একটি বা দুটি প্রোটিন নয়, পুরো স্ট্রাকচারের পরিবর্তন আনতে হবে। আসলে এমাইনো এসিড পরিবর্তনের এই ঘটনাকে বলে মাইক্রোইভোলিউশন, কিন্তু এ ঘটনা কোন অবস্থাতেই ম্যাক্রোইভোলিউশনের (অর্থাৎ মেজর ফাংশনাল চেঞ্জ) দাবীকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। এজন্য অসংখ্য নতুন তথ্য জিনোমে যোগ হতে হবে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ ভিরিয়ন
আমরা মাঝে মাঝে খবর পাই যে চীনে সোয়াইন ফ্লু আক্রমণ করেছে, কিংবা বাংলাদেশের অমুক জায়গায় বার্ড ফ্লু আক্রমণ করেছে। যারা সচেতন তারা খেয়াল করে থাকবেন- এই সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নতুন ‘স্ট্রেইন’ পাওয়া যায়, যেটার বিরুদ্ধে আগের ঔষধ কাজ করে না। এই নতুন স্ট্রেইন পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলা হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে জেনেটিক ড্রিফট হয়েছে। আসলে কী হয় জেনেটিক ড্রিফট-এ? আমরা জেনেছিলাম এই ভাইরাসের আরএনএ (তথা জিনোমিক এলেমেন্ট) খণ্ডিত। মোট ৮টি খণ্ড নিয়ে জেনেটিক এলেমেন্ট গঠিত। লক্ষ্য করে দেখবেন ইনফ্লুয়েঞ্জা যেমন পাখিকে আক্রমণ করে আবার শুকরকেও আক্রান্ত করে। পাখিকে আক্রমণকারী ভাইরাসের ‘স্ট্রেইন’ এবং শুকরকে আক্রমণকারী ভাইরাসের ‘স্ট্রেইন’ ভিন্ন। এদের হিমাগ্লুটিনিন (H) এবং নিউরামিনিডেজ (N) প্রোটিনের ধরণের উপর ভিত্তি করে এদের বিভিন্ন নাম দেয়া হয়। যেমন ধরুন H1N1, H2N3 ইত্যাদি। মনে করুন কোন ভাবে দুটো ভাইরাসই একটি হাঁসকে আক্রমণ করল। সুতরাং একটি ভাইরাসের ৮ খণ্ড আরএনএ যেমন হাঁসটিতে আছে তেমনি আরেকটি ভাইরাসের ৮ খণ্ড আরএনএ-ও আছে। (3) তবে এদের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে। এখন উক্ত হাঁসে ভাইরাসটি যখন বংশবৃদ্ধি করছে তখন প্রথমটার ৪টি খণ্ড ও পরেরটার ৪টি খণ্ড নিয়ে গঠিত হলো এবং প্রথমটার H1 এবং দ্বিতীয়টার N3 নিয়ে নতুন একটি স্ট্রেইন H1N3 তৈরী হল। এই স্ট্রেইনটির বিরুদ্ধে যেহেতু কোন ঔষধ নেই, এটা ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক তৈরী করতে পারে। এ ঘটনাটাই আমরা মাঝে মাঝে দেখতে পাই এবং এটাই হল জেনেটিক ড্রিফট।(4) লক্ষ্য করুন, এই পদ্ধতিতে ভাইরাসটি নতুন কোন ভাইরাসে পরিণত হলো না। কেননা H ও N কে তাদের পূর্ণাঙ্গ জেনেটিক তথ্য দিয়ে তৈরী করে না দেয়া পর্যন্ত জেনেটিক ড্রিফট ঘটার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং যারা এই উদাহরণ দিয়ে একটি কোষ থেকে ধাপে ধাপে মানুষ আসার গালগল্প শুনায় তাদের ‘উদ্দেশ্য’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা পেতে কোন কষ্ট হয় না। আপনারা কী বলেন?
কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি গ্রুপে Imran Hasan-র একটি আলোচনায় Pratim Lala নামক একজন ইসলামবিদ্বেষী বর্ণহিন্দু নাস্তিকতার ভেক ধরে মন্তব্য করছিল। কথোপকথন এর শুরুর দিকেই তার বক্তব্য অনেকটা এরকম ছিল,
“আমার মনে হচ্ছে, আপনারা কেউই বোধহয় এ সমন্ধে নিধার্মিকদের যুক্তি একেবারেই পড়ে দেখেননি।”
কথা হচ্ছিল স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ের আলোচনায় বিবর্তনবাদ চলে আসে। তাই আমি এভাবে শুরু করেছিলাম:
“একটি ফসিল ‘ক’ এবং একটি ফসিল ‘খ’ কে পাশাপাশি রেখে বলা যেতে পারে হয় ‘ক’ থেকে ‘খ’ বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এসেছে। আবার বলা যেতে পারে, ‘ক’ এর পরে ‘খ’ এসেছে তবে তাতে ‘ক’ এর ডিএনএকে রিপ্রোপ্রামিং করে ‘খ’ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন এ দুটো হাইপোথিসিস প্রমাণ করার জন্য দরকার ইনডাইরেক্ট এভিডেন্স। যেহেতু ‘ক’ এবং ‘খ’ এখন ইতিহাস এদের ট্রানজিসন অবজার্ভড নয়।
এমতাবস্থায় বিবর্তন প্রমাণ করতে হলে অন্তত একটি ম্যাক্রোইভ্যলিউশনের উদাহরণ আনা দরকার হবে। অর্থাৎ একটি ব্যাকটেরিয়া স্পিসিস, আরেকটি ব্যাকটেরিয়া স্পিসিসে ন্যাচারাল সিলেকশনের মধ্য দিয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ ধরণের কোন উদাহরণ নেই। তবে রিপ্রোগ্রামিং করে যে একটি সফটওয়্যারকে আরেকটি সফটওয়্যারে পরিণত করা যায় তার যথেষ্ট উদাহরণ আছে। অর্থাৎ ‘ক’ থেকে ‘খ’ আসার দ্বিতীয় তত্ত্বটির ইনডাইরেক্ট অবজারভেবল এভিডেন্স আছে।”
এখানে দুটো পয়েন্ট লক্ষণীয়, একটি হল যেই ঘোল দিয়ে দুধের স্বাদ মেটানোর চেষ্টা করা হয় সেই ফসিল দিয়ে বিবর্তনের প্রমাণ দেখানোর ভ্যালিডিটি টেস্টের পদ্ধতি ব্যক্ত করা হয়েছে এই বক্তব্যে, আরেকটি বিষয় হল ম্যাক্রোইভ্যলিউশনের উদাহরণ কেন আনতে হবে সে বিষয়টি এখানে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। (অর্থাৎ ম্যাক্রোইভ্যলিউশনের ডাইরেক্ট এভিডেন্স ডারউইনিয়ান ইভ্যলিউশনের ইনডাইরেক্ট এভিডেন্স হিসেবে কাজ করবে)
কিন্তু প্রতিম লালা উত্তর দিলেন এভাবে,
“আমাকে যদি এখানে বিবর্তনকে প্রমাণ করতে হয়, তাহলে তা হবে দুঃখজনক। //অর্থাৎ একটি ব্যাকটেরিয়া স্পিসিস, আরেকটি ব্যাকটেরিয়া স্পিসিসে ন্যাচারাল সিলেকশনের মধ্য দিয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ ধরণের কোন উদাহরণ নেই।// এসব মিথ্যাচার করে কি লাভ? আপনাকে কে বলল, এরকম কোন উদাহরণ নেই?”
এমন ভাব যেন দুনিয়ার সব বিজ্ঞান তিনি বুঝেন এবং তিনি উদাহরণ থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত। এখানে প্রকাশিত ‘অহংকার’ প্রায় প্রত্যেক বাঙ্গালী নাস্তিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
যাই হোক আমি তাকে সরাসরি বললাম: “উদাহরণ দেন।”
তিনি উত্তর করলেন: “প্রথমে বলে রাখি সময় নষ্ট করাচ্ছেন। আর দ্বিতীয় কথা হল, কিছু কিছু মুসলিম এখন কোরানে বিবর্তন আছে বলে নতুন ফতোয়া দিচ্ছে। এমনকি কোরান থেকে সুরা কোট করা হচ্ছে, এ বিষয়ে। দেখার বিষয় আপনারা কখন ওল্টান। অপেক্ষা করেন উদাহরণ দিচ্ছি।”
দেখুন কথা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়ার একটি চেষ্টা আছে। এ ধরণের উদাহরণ খুঁজতে গিয়ে সবচেয়ে ভাল যে উদাহরণটা আনা যাবে তা সম্পর্কে আমি তাকে ইঙ্গিত দিলাম এবং বুঝিয়ে দিলাম কেন সেটি ম্যাক্রোইভ্যলিউশনের কোন উদাহরণ নয়।
“রিচার্ড লেন্সকি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ইভ্যলিউশন এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন। ১৯৮৮ সাল থেকে চলমান প্রক্রিয়াটিতে ই. কোলাই এখনও ই. কোলাই আছে। (ডাইরেক্টলি অবজারভড এভিডেন্স দেয়ার অনুরোধ থাকল)”
পরের কমেন্টে আমি আরও ব্যাখ্যা করলাম এই এক্সপেরিমেন্ট থেকে একটি মাইক্রোইভ্যলিউশনের উদাহরণ দেয়া যায়, তবে সেটা ম্যাক্রোইভ্যলিউশনের ধারে কাছেও নয়।
“রিচার্ড লেন্সকির পরীক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবজারভেশন হল, অক্সিজেন মিডিয়ামে সাইট্রেট ইউটিলাইজিং ব্যাকটেরিয়ার আগমন। যার কারণ হল একটি ট্রান্সপোজন মেডিয়েটেড জিন ডুপ্লিকেশন ইভেন্ট। যার ফলে একটি প্রোমোটার একটি ইনএকটিভ জিনকে অতিক্রম করে একটি সাইট্রেট ইউটিলাইজিং এনজাইমের জিন যা অলরেডি ই. কোলাইতে ছিল, তার নিকটে চলে আসে। ফলে ব্যাকটেরিয়া সাইট্রেট ইউটিলাইজ করতে পারে। লক্ষ্যণীয় এটি হল মাইক্রোইভ্যলিউশন, ম্যাক্রো নয়।”
লক্ষণীয় বিবর্তনবাদীরা এই উদাহরণ টেনে, একটি কুমির বারবার দেখিয়ে সাতটি কুমির প্রমাণ দেয়ার ঘটনার অবতারণা করেন। মাইক্রো দেখিয়ে ম্যাক্রোকে প্রমাণ দেয়া দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টার মতই।
এরপর দেখুন মজা:
১. Pratim Lala: বাংলায় বন্যা আহমেদের চেয়ে ভাল ভাবে এ বিষয়ে আর কেউ লেখেনি বলে আমার ধারনা। তাই তার লেখার লিঙ্ক দিচ্ছি, সেখানেই প্রমাণ গুলি খুব পরিস্কার করে দেয়া আছে। বন্যা আহমেদের বইয়ের লিংক।
Pratim Lala: আপনি অবান্তর প্রস্নগ নিয়ে আসছেন
Abdullah Saeed Khan: বন্যা আহমেদের বই আমার পড়া হয়ে গেছে। তার বইয়ে এ ধরণের প্রমাণের কথা বলা হয়নি। ইন ফ্যাক্ট তার বইয়ে নিও-ডারউইনিজম নিয়ে কোন আলোচনা নেই বললেই চলে।
২. Pratim Lala: ঠিক আছে। আপনি pin down করেন আপনি কোন জিনিস জানতে চাইছেন। এবং কেন আপনার মনে হচ্ছে Direct Evidence না হলে আপনি মেনে নিতে পারছেন না।
৩. Pratim Lala: আর নিঊডারিনিজম বলত্রে আপনি কি বুঝচ্ছেন
Abdullah Saeed Khan: তাহলে আপনি ডাইরেক্ট এভিডেন্স দেখাতে পারছেন না। যখন দেখাতে পারবেন তখন ইনশাআল্লাহ সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। আপনার সঙ্গে আলোচনা করে ভাল লাগল। ধন্যবাদ।
৪. Pratim Lala: সবচেয়ে বড় কথা বিবর্তন একটি প্রতিষ্টিত ত্বত্ত। এর এখন কেবল Fine Tune করা সম্ভব। অসংখ্য উদাহরণ, Peer Reviewed Journal, তথ্য এ বিষয়ে রয়েছে। একে উড়িয়ে দেওয়ার কোন রাস্তা নেই। আর Direct evidence থাকবে না কেন? প্রচুর Intermediate ফসিল উদ্ধার হয়েছে। Google – এ খোঁজ নিলেই এদের পাওয়া যায়। তবে আপনি যে specific bacteria speciman নিয়ে বলছেন তা নিয়ে আমার জানা নেই। এটা স্বীকার করতে আমার কোন বাধা নেই। তবে নতুন করে জানতেও বাধা নেই।
৫. Pratim Lala: Since the experiment’s inception, Lenski and his colleagues have reported a wide array of genetic changes; some evolutionary adaptations have occurred in all 12 populations, while others have only appeared in one or a few populations. One particularly striking adaption was the evolution of a strain of E. coli that was able to use citric acid as a carbon source in an aerobic environment. তথ্য সুত্র ;http://myxo.css.msu.edu/ecoli/overview.html.
এবার আমার হাসি পাচ্ছে।
লক্ষ্য করুন, যে অহংকারী নাস্তিক এত স্পর্ধা নিয়ে বললেন উদাহরণ আনবেন, তিনি ১ নং কমেন্টে উদাহরণ পাশ কেটে গেছেন। ২ নং পয়েন্টে তিনি জানতে চাচ্ছেন কেন ম্যাক্রোইভ্যলিউশন গুরুত্বপূর্ণ, অথচ এটা কিন্তু প্রথম কমেন্টেই এক্সপ্লেইন করেছি। ৩ নং পয়েন্ট দেখে মনে হচ্ছে ‘নিও-ডারউইনিজম সম্পর্কে তার ধারণাই নেই। ৪ নং পয়েন্টে বিজ্ঞানীদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে বিবর্তনের প্রতি তাদের ‘অন্ধবিশ্বাস’ প্রকাশ করেছেন, এছাড়া কোন স্পেসিফিক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আমি ম্যাক্রোইভ্যলিউশনের উদাহরণ চাইনি বরং যে কোন উদাহরণ চেয়েছি এবং ৫ নং পয়েন্টে সাইট্রেট ইউটিলাইজিং ব্যাকটেরিয়ার ব্যপারটি আবিস্কার করে তিনি মনের আনন্দে ‘হাসছেন’ যে আস্তিকটা কত বড় গাধা এরকম প্রমাণ দেখেই নাই! অথচ এই সাইট্রেটের ঘটনাটা কেন হয়, কিভাবে হয় সেই ম্যাকানিজমসহ সংক্ষেপে আলোচনা কিন্তু এই ব্যাক্তির উপলব্ধির ১৮ মিনিট আগেই করা হয়েছে।
সুতরাং আপনারাই চিন্তা করুন এমতাবস্থায় কোরআনের এই আয়াতটি আমল করার বিকল্প আছে কি?
“রহমানের (আসল) বান্দা তারাই যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা তাদের সাথে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়, তোমাদের সালাম।” (সুরা ফুরকান, আয়াত ৬৩)
ফিলোসফার অব সায়েন্স কার্ল পপারের সুন্দর একটি কথা আছে-
If a proposal or hypothesis cannot be tested in a way that could potentially falsify the proposal, then the proposer can offer any view without the possibility of its being contradicted. In that case, a proposal can offer any view without being disproved. [১]
এ হিসেবে নাস্তিকদের ‘ডেটারমিনিস্ট ম্যাটেরিয়ালিস্ট’ মতবাদটি একটি ‘বিশ্বাস ব্যবস্থা’ তথা একটি ‘ধর্ম’, নাস্তিকরা এই ডেটারমিনিস্ট ম্যাটেরিয়ালিস্ট ব্যবস্থার উপর ‘বিশ্বাস’ স্থাপন করে আল্লাহকে অস্বীকার করছে। লক্ষ্য করবেন, এদের সঙ্গে কথায় মাঝে মাঝে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে উঠে। যেমন: এদেরকে ফাণ্ডামেন্টাল ফোর্সেস অব ইউনিভার্সের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে বলবে তা এমনি এমনি উদ্ভব হয়েছে। তাদের এই উত্তরটি যেমন তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করতে পারবে না, তেমনি তাদের এই উত্তরটিকে ভুল প্রমাণও করা যাবে না। কারণ এটি একটি ‘বিশ্বাস’।
প্রশ্ন হল ‘বিশ্বাস’ হলে অসুবিধে কী? অসুবিধে আছে। মুসলিমরা বিশ্বাস করে এই ফোর্সগুলো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং মুসলিমরা কখনও দাবী করেনি যে এটা পরীক্ষা করে প্রমাণ করা যাবে। বরং মুসলিমরা এটাই বলছে যে ‘এই ফোর্সগুলো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন’ এই কথাটায় ‘বিশ্বাস’ করাটাই ইসলামের দাবী।
“এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই ৷ এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্যযারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২-৩)
কিন্তু তথাকথিত নাস্তিকরা তাদের ‘বিশ্বাস’কে একটি সায়েন্টিফিক ডিসগাইজ দিতে চাচ্ছে। তারা তাদের ‘বিশ্বাস’কে বৈধতা দিতে বিজ্ঞানকে অপব্যবহার করছে। তারা এমন ভাবে বিজ্ঞানের কথা বলছে যেন তাদের এই ‘বিশ্বাস’ প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। অথচ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের এই ‘বিশ্বাস’গুলোও প্রমাণযোগ্য নয়।
ঈশ্বরকে মেনে নেয়ার দাবীটি বিশ্বাসের। সুতরাং যাদের মেনে নেয়া প্রমাণের উপর নির্ভরশীল, যেমন সৈকত চৌধুরী নামক একজন নাস্তিক রাহাত খানকে প্রতিমন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন:
কিন্তু কেউ যদি ঈশ্বরকে এখানে নিয়ে আসেন তবে তিনি তা প্রমাণ করুক…
তাদেরই বরং ‘ঈশ্বর নেই’ এটা প্রমাণ করা জরুরী। কেননা বিজ্ঞানের দাবী তারাই তুলছে।
এই তথাকথিত নাস্তিকরা যে চরম পর্যায়ের অন্ধ বিশ্বাসী তার প্রমাণ বিভিন্ন ভাবে পাবেন। যেমন বিবর্তনের ব্যাপারে বলতে গিয়ে যদি বলেন যে ‘অসংখ্য’ মধ্যবর্তী প্রজাতির ফসিল কোথায়। তারা বলবে প্যালিওন্টোলজী এখনও শুরুর পর্যায়ে, ভবিষ্যতে আবিস্কার হবে। অথচ গত দেড়শ বছরে ১০০ মিলিয়নের উপর ফসিল আবিস্কৃত হয়েছে, যাতে একটিও মধ্যবর্তী প্রজাতি নেই। [২]
সুপরিচিত ব্রিটিশ বিবর্তনবাদী ও জীবাশ্রমবিজ্ঞানী (প্যালেওন্টোলোজিস্ট) কলিন প্যাটারসন এই বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেন-
No one has ever produced a species by mechanisms of natural selection. No one has ever got near it and most of the current argument in neo-Darwinism is about this question.
Natural selection is not a mechanism that produces anything new and thus causes species to change, nor does it work miracles such as causing a reptile to gradually turn into a bird. In the words of the well-known biologist D’Arcy Wentworth Thompson, “… we are entitled … to see in natural selection an inexorable force, whose function is not to create but to destroy—to weed, to prune, to cut down and to cast into the fire.” [৩]
কেন ফসিল রেকর্ডে বিবর্তনের প্রমাণ নেই তা বিখ্যাত নিওডারউইনবাদী প্যালেওন্টোলজিস্ট স্টিভেন জে. গোল্ড এভাবে ব্যাখ্যা করেন-
The history of most fossil species includes two features particularly inconsistent with gradualism: 1. Stasis. Most species exhibit no directional change during their tenure on earth. They appear in the fossil record looking much the same as when they disappear; morphological change is usually limited and directionless. 2. Sudden appearance. In any local area, a species does not arise gradually by the steady transformation of its ancestors; it appears all at once and ‘fully formed. [৪]
অন্যদিকে প্যালিওন্টোলজিস্ট নাইল্স এলড্রেজ জীবাশ্ম রেকর্ড দেখে বিবর্তনবাদীদের হতাশা ব্যক্ত করেন এভাবে:
No wonder paleontologists shied away from evolution for so long. It seems never to happen. Assiduous collecting up cliff faces yields zigzags, minor oscillations, and the very occasional slight accumulation of change over millions of years, at a rate too slow to really account for all the prodigious change that has occurred in evolutionary history. [৫]
সুতরাং তাদের দাবীটির ভিত্তি হল ‘অন্ধবিশ্বাস’।
তারা বলবে মিউটেশনের মধ্য দিয়ে বিবর্তন হচ্ছে। অথচ অসংখ্য পরীক্ষাগারে কোটি কোটি মিউটেশনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত একটি উদাহরণও নেই যে মিউটেশনের মাধ্যমে একটি ব্যাকটেরিয়া প্রজাতি আরেকটি ব্যাকটেরিয়া প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত বড় প্রাণীদের ব্যাপারে তারা বলবে যেহেতু বিবর্তন হতে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পার হতে হয়, ফলে আমাদের পক্ষে এই বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। (যে কথাটা লুকিয়ে আছে: ‘বিবর্তন’ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলে কি হবে? আমরা ‘বিশ্বাস’ করে ধরেই নিয়েছি যে বিবর্তন হয়েছে) কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপারটাতে তাদের গল্পটি কী? ব্যাকটেরিয়ার ‘জেনারেশন টাইম’ তো খুব দ্রুত। (ব্যাকটেরিয়ার একটি নির্দিষ্ট কলোনী যে সময়ে সংখ্যায় ঠিক দ্বিগুন হয়ে যায় তাকে বলে জেনারেশন টাইম) পরীক্ষাগারে বিজ্ঞান জগতে খুব পরিচিত ব্যাকটেরিয়া E. coli এর জেনারেশন টাইম মাত্র বিশ মিনিট। অর্থাৎ যদি E. coli এর একটি ১০০ ব্যাকটেরিয়ার কলোনী নেয়া হয় তবে বিশ মিনিটের মধ্যে সেটি ২০০ ব্যাকটেরিয়ার কলোনীতে পরিণত হবে। [৬]
এখন পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়া নিয়ে ডারউইনবাদী বিবর্তনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি করেছেন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী রিচার্ড লেনস্কি। সেই ১৯৮৮ সাল থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে, এখনও চলছে। ২০১২ সাল নাগাদ E. coli-র ৫০০০০ জেনারেশন পার হয়েছে। এগুলো নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, প্রতি ৫০০ জেনারেশন পর E. coli-র স্ট্রেইনগুলো নিয়ে সেগুলোর জেনেটিক স্টাডি করা হয়েছে। অথচ, এখনও পর্যন্ত E. coli, E. coli-ই রয়ে গেছে! [৭]
তারপরও এই পরীক্ষা অব্যাহত রাখা হয়েছে, এই ‘বিশ্বাস’-এ যে ডারউইনবাদ প্রমাণিত হবেই। অথচ মিউটেশনের মধ্য দিয়ে আদৌ কি কোন ডারউইনবাদী বিবর্তন সম্ভব? বিজ্ঞানীরা খুব ভালমতই জানেন যে প্রাণীকোষে কোন ‘জেনেটিক ইরর’ হয়ে গেলে সেটা সংশোধনের জন্য প্রাণীকোষেই অত্যন্ত পরিকল্পিত সিস্টেম তৈরী করা আছে। ফলে কোন মিউটেশন হয়ে তা পরবর্তী জেনারেশনে সঞ্চালিত হওয়ার সম্ভবনা নগন্য। প্রকৃতপক্ষে, অধিকাংশ জ্বিনের মিউটেশনের হার হল প্রতি ১,০০,০০০-এ একটা এবং যে মিউটেশনগুলো হয় তার অধিকাংশই ক্ষতিকারক। [৮]
এরপরও যদি ধরে নেয়া হয় যে মিউটেশন উপকারী হতে পারে, তারপরও মিউটেশনের মাধ্যমে জ্বিন পরিবর্তন হয়ে একটি নতুন বৈশিষ্ট্য অভিযোজন হতে যে পরিমাণ সময় দরকার তা বিবর্তনবাদীদের কল্পনার জন্যও বেশী। অন্তত এম.আই.টি-র প্রফেসর মুরে এডেন এবং বিবর্তনবাদী জর্জ গেইলর্ড সিম্পসনের হিসেব থেকে সেটাই বোঝা যায়:
In a paper titled “The Inadequacy of Neo-Darwinian Evolution As a Scientific Theory,” Professor Murray Eden from the MIT (Massachusetts Institute of Technology) Faculty of Electrical Engineering showed that if it required a mere six mutations to bring about an adaptive change, this would occur by chance only once in a billion years – while, if two dozen genes were involved, it would require 10,000,000,000 years, which is much longer than the age of the Earth. [৯]
The evolutionist George G. Simpson has performed a calculation regarding the mutation claim in question. He admitted that in a community of 100 million individuals, which could hypothetically produce a new generation every day, a positive outcome from mutations would only take place once every 274 billion years. That number is many times greater than the age of the Earth, estimated to be at 4.5 billion years old. These, of course, are all calculations assuming that mutations have a positive effect on the generations which gave rise to them, and on subsequent generations; but no such assumption applies in the real world. [১০]
তথাপি নাস্তিকরা কেন মিউটশনকে বিবর্তন সংঘটনের ‘প্রভু’ মনে করে? উত্তর ‘অন্ধবিশ্বাস’; এছাড়া, বিলিয়ন বছরের ব্যবধানে কোন জীব মিউটেশনের মধ্য দিয়ে অন্য একটি জীবে পরিবর্তিত হয়নি তার প্রমাণ হল ৩.৫ বিলিয়ন বছর পুরোনো আর্কিয়া (বা আর্কিব্যাকটেরিয়া); বিলিয়ন বছর আগেও যেমন তাদের উত্তপ্ত ঝরণায় পাওয়া যেত, আজও তাদের গ্র্যাণ্ড প্রিজমেটিক লেকের মত উত্তপ্ত জলাশয়ে পাওয়া যায়। [১১]
বিবর্তনবাদীদের তথাকথিত প্রথম কোষটি কিভাবে উদ্ভব হল সে বিষয়ে তো এখনও প্রশ্ন করাই হয়নি। ‘কোষ’ বললে বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে যায়, ১৫০ অ্যামাইনো এসিড সম্বলিত একটি মাঝারি আকৃতির প্রোটিন কিভাবে দৈবাৎ দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এলো সেটাই না হয় ব্যাখ্যা করুক। অথচ,
ডগলাস এক্স যে বিষয়গুলো সম্ভাব্যতা কমাতে পারে সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে (অর্থাৎ বাদ দিয়ে) ১৫০টি অ্যামাইনো এসিডের একটি প্রোটিন তৈরী দূর্ঘটনাক্রমে হওয়ার সম্ভাব্যতা হিসেব করেছেন ১০ এর পরে ১৬৪টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি হয় (তথা ১০১৬৪) এর মধ্যে ১ বার। বিল ডেম্ব্সকি হিসেব করে দেখিয়েছেন আমাদের দর্শনযোগ্য মহাবিশ্বে ১০৮০টি এলিমেন্টারি পার্টিকল আছে, বিগব্যাং থেকে এখন পর্যন্ত ১০১৬ সেকেণ্ড পার হয়েছে এবং দুটো বস্তুর মধ্যে যে কোন বিক্রিয়া প্ল্যাঙ্কটাইম ১০-৪৩ সেকেণ্ড এর চেয়ে কম সময়ে হতে পারে না। এ সবগুলো সংখ্যাকে একত্রিত করলে দাড়ায় ১০১৩৯; অর্থাৎ মহাবিশ্বের বয়স, মহাবিশ্বের গাঠনিক এলিমেন্টারি পার্টিকেলের সংখ্যা এবং পার্টিকেলের মধ্যে বিক্রিয়া হতে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সময়কে একত্রে বিবেচনার পরও উপর্যুক্ত প্রোটিনটি তৈরী হওয়ার সম্ভাব্যতা ট্রিলিয়ন ভাগ পিছিয়ে পড়ে। সহজ কথায় উক্ত প্রোটিনটি তৈরী হতে এখন বিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেকেণ্ড (১০২৫বা ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ বা দশ লক্ষ কোটি কোটি সেকেণ্ড বা একত্রিশ কোটি বিলিয়ন বছর) অতিবাহিত হতে হবে। [১২, ১৩]
কিন্তু নাস্তিকরা বলে উঠবে ‘সম্ভাব্যতার বিষয়টা আপনি বুঝেননি’; কারণ, নাস্তিকদের অন্ধবিশ্বাস অনুযায়ী যে কোন অসম্ভব ঘটনা যা ঘটানোর জন্য সুপরিকল্পিত কাঠামো, ডিজাইন এবং জ্ঞান দরকার তা দূর্ঘটনাক্রমে (by chance) সম্ভব হয় (!)
রেজওয়ান আহমেদের সাথে ফেসবুকে আমার একটি তর্ক হয়েছিল বিবর্তনবাদ নিয়ে, শেষ পর্যায়ে এসে তার মন্তব্যটি এরকম:
Abdullah Saeed Khan: আপনি যতগুলো প্রানির নাম নিলেন, তাদের টিকে থাকার ইতিহাস খুজতে গেলে তো খবর আছে। আপনিয়েই বরং নিয়েন, তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে “survival the fittest” নিয়ামকটাই হয়ত এদের টিকে থাকার কারণ। আর আমি যা দেখছি আপনি বিবর্তনের সমালোচনা করতেছেন কিন্তু refuse করতেছেন না। বিজ্ঞানের মুল মজা তো যোগ্য সমালচনায়। যাই হোক আজকে আলোচনা করে ভাল লাগল। ভাল থাকিয়েন। [১৪]
সুতরাং কাদের বিশ্বাসটি যে ‘অন্ধবিশ্বাস’ সেটি স্পষ্ট বুঝা যায়। পরিশেষে নাস্তিকতা নামক অন্ধ বিশ্বাসের আরেকটি উদাহরণ দিয়ে পোস্টটি শেষ করছি:
In this philosophy (Determinist Materialist), observable matter is the only reality and everything, including thought, will, and feeling, can be explained only in terms of matter and the natural laws that govern matter. The eminent scientist Francis Crick (codiscoverer of the genetic molecular code) states this view elegantly (Crick and Koch, 1998): “You, your joys and your sorrows, your memories and your ambitions, your sense of personal identity and free will, are in fact no more than the behavior of a vast assembly of nerve cells and their associated molecules. As Lewis Carroll’s Alice might have phrased it: ‘You’re nothing but a pack of neurons (nerve cells).’” According to this determinist view, your awareness of yourself and the world around you is simply the by-product or epiphenomenon of neuronal activities, with no independent ability to affect or control neuronal activities.
Is this position a “proven” scientific theory? I shall state, straight out, that this determinist materialist view is a “belief system”; it is not a scientific theory that has been verified by direct tests. It is true that scientific discoveries have increasingly produced powerful evidence for the ways in which mental abilities, and even the nature of one’s personality, are dependent on, and can be controlled by, specific structures and functions of the brain. However, the nonphysical nature of subjective awareness including the feelings of spirituality, creativity, conscious will, and imagination, is not describable or explainable directly by the physical evidence alone. [১৫]