ফ্যাটি লিভার আধুনিক মানুষের রোগ

ফ্যাটি লিভার, ন্যাশ এবং লিভার সিরোসিস

জনাব রফিকুল ইসলাম একজন ব্যবসায়ী। পুরোনো ঢাকার ব্যস্ত মার্কেটে তার কাজ মূলত বসে থেকে ব্যবসার তদারকী করা। ভোজনরসিক রফিক সাহেব ধূমপানের মত বদ অভ্যাস না করলেও একটু ভালো খাবারের লোভ সামলাতে পারেন না। এজন্য তার ওজন বেড়েছে বল্গাহীনভাবে। তার বিএমআই এখন ৩০। ডাক্তারদের ভাষায় অবিজ। একটু বাড়তি ওজন ছাড়া রফিক সাহেবের হিসেবে এতদিন সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিলো। কিন্তু, গত এক মাস যাবৎ তিনি শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করছেন। মাঝে মাঝে পেটের উপরিভাগে ব্যথাও হচ্ছে। প্রস্রাবের চাপটাও বেড়েছে। টিভিতে স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রোগ্রাম থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে ডায়াবেটিসের লক্ষণ হল শারীরিক দুর্বলতা, বেশী বেশী ক্ষুধা এবং ঘন ঘন প্রস্রাব। তাই তিনি মেডিসিন বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেন। চিকিৎসক তাকে রক্তের সুগার, লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করতে বলেন এবং পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে দেন। ওবেসিটির পাশপাশি ধরা পড়ে ডায়াবেটিস, হাই-ব্লাড প্রেসার এবং ফ্যাটি লিভার।  

প্রাদুর্ভাব

ফ্যাটি লিভার ডিজিজ। শব্দগুলো থেকেই বুঝা যাচ্ছে লিভারে ফ্যাটি জমা হয়ে সৃষ্ট রোগের নামই হচ্ছে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ তথা ফ্যাটি লিভার। যদি ফ্যাটের কারণে  লিভারে ফ্যাট দুটি কারণে জমা হতে পারে। এক, অ্যালকোহল পান  এবং দুই, অ্যালকোহল ব্যতীত অন্য কারণ। প্রথমটিকে বলা হয় অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এবং দ্বিতীয়টিকে বলা হয় নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ। বাংলাদেশে যেহেতু অ্যালকোহল পান এখনও লুকিয়ে লুকিয়ে এবং অনিয়মিত ফেনোমেনা সেহেতু অ্যালকোহলজনিত ফ্যাটি লিভার এ দেশে এখনও প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি। তবে সারা বিশ্বের ন্যায় নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (এন.এ.এফ.এল.ডি) বাড়ছে আশংকাজনক হারে। লিভারের কোষ হেপাটোসাইটের ৫%-এর বেশী জুড়ে যদি লিপিড (তথা ফ্যাট) জমা হয় বা লিভারের মোট ওজনের ৫% যদি ফ্যাট হয় তখন একে বলা হয় নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ। বোঝার সুবিধার্থে আমরা প্রবন্ধের বাকি অংশে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারকে শুধু ফ্যাটি লিভার বলব।

পৃথিবী জুড়ে প্রতি ১০০ জনে প্রায় ২৫ জন লোক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। পাশ্চাত্যে দীর্ঘ মেয়াদী লিভার রোগের প্রধানতম কারণ হল ফ্যাটি লিভার। ফ্যাটিলিভারের প্রাদুর্ভাবের দিকে দিয়ে উন্নত দেশগুলোর এক সময় এগিয়ে থাকলেও দক্ষিণ এশিয়াও এখন পিছিয়ে নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় ফ্যাটি লিভারের প্রাদুর্ভাব ৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তন্মধ্যে, বাংলাদেশ আছে সবচাইতে এগিয়ে। হ্যা, এখানে ফ্যাটি লিভারের প্রাদুর্ভাব ৪ থেকে প্রায় ৩৪ শতাংশ।

জনাব রফিক ফ্যাটি লিভারের রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন লিভার বিশেষজ্ঞের চেম্বারে। সিরিয়াল আসার অপেক্ষায় বসে বসে ফ্যাটি লিভার সংক্রান্ত একটা পুস্তিকা পড়ছিলেন। রফিক সাহেবের মনে মনে ভাবলেন- তার মানে বাংলাদেশে প্রায় ১০০ জনে ৩৪ জন মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত? কিন্তু, কেন হচ্ছে এই রোগ? পরের পৃষ্ঠা উল্টোতেই পেলেন তার প্রশ্নের জবাব।

রিস্ক ফ্যাক্টর

চিকুনগুনিয়া

চিকুনগুনিয়ার অন্যতম লক্ষণ হল জ্বর, অস্থি:সন্ধি তথা গিড়ায় ব্যাথা, স্কিন র‍্যাশ, মাংসপেশীর ব্যাথা, মাথাব্যাথা, চুলকানী এবং শরীর ফুলে যাওয়া। সাধারনত চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হলে জ্বর দিয়ে লক্ষণ শুরু হয়, অতঃপর অন্যান্য লক্ষণগুলো আসে। তবে, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে  ৭০%-এর বেশী রোগীর সমস্যা শুরু হয়েছে জ্বরের আগে গিড়া ব্যাথা দিয়ে । পরবর্তীতে শতভাগ রোগীই ব্যাথায় আক্রান্ত হন। পঁচাশি শতাংশ রোগী তীব্র ব্যাথার কথা বলেন।

আমাদের গবেষণায়, ব্যাথার তীব্রতা পরিমাপ করতে নিউমেরিকাল পেইন রেটিং-স্কেল নামক একটি স্বীকৃত পরিমাপক ব্যবহার করা হয়েছে। এই স্কেল অনুযায়ী রোগীকে ব্যাথার তীব্রতা অনুপাতে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত যে কোন একটি নাম্বার দিতে বলা হয়। ব্যাথার তীব্রতা কম হলে ১ এবং ব্যতার তীব্রতা বেশী হলে ১০। এই স্কেল অনুসারে আমাদের গবেষণায় রোগীদের গড় ব্যাথার তীব্রতা ছিলো ৮.৩।

প্রায় ৫৬% রোগীর চার-এর অধিক গিড়া আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছে এবং প্রায় ৪০% রোগীর ক্ষেত্রে আক্রান্ত গিড়ার সংখ্যা ছিলো দুই থেকে চারটি। দেহের বিভিন্ন গিড়ার মধ্যে পায়ের গোড়ালী এবং হাতের কবজির সন্ধি আক্রান্ত হয়েছিলো সবচেয়ে বেশী।  রোগী ব্যাথার জন্য প্রায় ৭০% রোগীর দৈনন্দিন কাজে ব্যঘাত ঘটে এবং প্রায় ৬৬ শতাংশ রোগীর ঘুমে ব্যঘাত ঘটে।

আমাদের গবেষণায় বয়স, লিঙ্গ এবং পূর্বাপর শারিরীক অবস্থার উপর ভিত্তি করে রোগের লক্ষনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পনের বছরের নিচের বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দুই থেকে চারটি গিড়ায় ব্যাথা এবং স্কিন র‍্যাশ বেশী দেখা যায়। অন্যদিকে ষাটোর্ধ্ব রোগীদের ক্ষেত্রে গিড়া ফুলে যাওয়া ছিলো অন্যতম প্রধান লক্ষণ। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ব্যথার তীব্রতা অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশী।

এ গবেষণা দেখা গেছে চিকুনগুনিয়ার কারণে ৯৫% রোগী বিছানায় পড়ে আছেন। আক্রান্ত রোগী কাজে যেতে পারছেন না, ঘরের কাজ করতে পারছেন না এবং বাচ্চার স্কুলে যেতে পারছে না। প্রায় ৪০ শতাংশ রোগী ১০ দিন পর্যন্ত কোন কাজই ঠিক মত করতে পারেন নি। এ মহামারীতে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশী চাপে ছিলো তারা যাদের মাসিক আয় ২৫০০০ টাকার কম।  এমন কি দীর্ঘদিন কাজে অনুপস্থিত থাকার কারণে কারও কারও ক্ষেত্রে চাকুরী চলে যাওয়ার ঘটনাও পাওয়া গেছে।

বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ও বহুল ব্যবহৃত প্রশ্নমালা দিয়ে জীবনযাত্রার মান যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে যাদের বয়স ৬০-এর বেশী, যাদের মাসিক আয় ৫০০০০ টাকার বেশী, চাকুরীজীবি এবং ব্যবসায়ীদের জীবনযাত্রার মান অন্যদের তুলনায় বেশী কমে গিয়েছিলো। 

আমাদের এ গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের চিকুনগুনিয়ার প্রধান লক্ষনগুলো চিহ্নিত করেছি এবং জীবনযাত্রার উপর এর প্রভাব নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক অধ্যয়ন করেছি। আমরা আশা করছি এই গবেষণা জাতীয় পর্যায়ে চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে নীতিনির্ধারনে সহায়ক হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দালিলীক অবদান হিসেবে থেকে যাবে।         

ঢাকা শহরে গতবছর চিকুনগুনিয়ার বড় আকারের মহামারী হয়ে গেল। এ সময়  আমরা চেষ্টা করেছি চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের লক্ষণ, জীবনযাত্রার মান( Quality of Life) এবং রোগাক্রান্ত থাকার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে গবেষণা করার।  আমাদের গবেষণায় আমরা ১৩২৬ জন চিকুনগুনিয়া রোগী থেকে তথ্য নিয়েছি। যেটি আমাদের জানামতে বিশ্বে এ সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় কাজ।

চিকুনগুনিয়ার অন্যতম লক্ষণ হল জ্বর, অস্থি:সন্ধি তথা গিড়ায় ব্যাথা, স্কিন র‍্যাশ, মাংসপেশীর ব্যাথা, মাথাব্যাথা, চুলকানী এবং শরীর ফুলে যাওয়া। সাধারনত চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হলে জ্বর দিয়ে লক্ষণ শুরু হয়, অতঃপর অন্যান্য লক্ষণগুলো আসে। তবে, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে  ৭০%-এর বেশী রোগীর সমস্যা শুরু হয়েছে জ্বরের আগে গিড়া ব্যাথা দিয়ে । পরবর্তীতে শতভাগ রোগীই ব্যাথায় আক্রান্ত হন। পঁচাশি শতাংশ রোগী তীব্র ব্যাথার কথা বলেন।

আমাদের গবেষণায়, ব্যাথার তীব্রতা পরিমাপ করতে নিউমেরিকাল পেইন রেটিং-স্কেল নামক একটি স্বীকৃত পরিমাপক ব্যবহার করা হয়েছে। এই স্কেল অনুযায়ী রোগীকে ব্যাথার তীব্রতা অনুপাতে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত যে কোন একটি নাম্বার দিতে বলা হয়। ব্যাথার তীব্রতা কম হলে ১ এবং ব্যতার তীব্রতা বেশী হলে ১০। এই স্কেল অনুসারে আমাদের গবেষণায় রোগীদের গড় ব্যাথার তীব্রতা ছিলো ৮.৩।

প্রায় ৫৬% রোগীর চার-এর অধিক গিড়া আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছে এবং প্রায় ৪০% রোগীর ক্ষেত্রে আক্রান্ত গিড়ার সংখ্যা ছিলো দুই থেকে চারটি। দেহের বিভিন্ন গিড়ার মধ্যে পায়ের গোড়ালী এবং হাতের কবজির সন্ধি আক্রান্ত হয়েছিলো সবচেয়ে বেশী।  রোগী ব্যাথার জন্য প্রায় ৭০% রোগীর দৈনন্দিন কাজে ব্যঘাত ঘটে এবং প্রায় ৬৬ শতাংশ রোগীর ঘুমে ব্যঘাত ঘটে।

আমাদের গবেষণায় বয়স, লিঙ্গ এবং পূর্বাপর শারিরীক অবস্থার উপর ভিত্তি করে রোগের লক্ষনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পনের বছরের নিচের বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দুই থেকে চারটি গিড়ায় ব্যাথা এবং স্কিন র‍্যাশ বেশী দেখা যায়। অন্যদিকে ষাটোর্ধ্ব রোগীদের ক্ষেত্রে গিড়া ফুলে যাওয়া ছিলো অন্যতম প্রধান লক্ষণ। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ব্যথার তীব্রতা অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশী।

এ গবেষণা দেখা গেছে চিকুনগুনিয়ার কারণে ৯৫% রোগী বিছানায় পড়ে আছেন। আক্রান্ত রোগী কাজে যেতে পারছেন না, ঘরের কাজ করতে পারছেন না এবং বাচ্চার স্কুলে যেতে পারছে না। প্রায় ৪০ শতাংশ রোগী ১০ দিন পর্যন্ত কোন কাজই ঠিক মত করতে পারেন নি। এ মহামারীতে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশী চাপে ছিলো তারা যাদের মাসিক আয় ২৫০০০ টাকার কম।  এমন কি দীর্ঘদিন কাজে অনুপস্থিত থাকার কারণে কারও কারও ক্ষেত্রে চাকুরী চলে যাওয়ার ঘটনাও পাওয়া গেছে।

বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ও বহুল ব্যবহৃত প্রশ্নমালা দিয়ে জীবনযাত্রার মান যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে যাদের বয়স ৬০-এর বেশী, যাদের মাসিক আয় ৫০০০০ টাকার বেশী, চাকুরীজীবি এবং ব্যবসায়ীদের জীবনযাত্রার মান অন্যদের তুলনায় বেশী কমে গিয়েছিলো। 

আমাদের এ গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের চিকুনগুনিয়ার প্রধান লক্ষনগুলো চিহ্নিত করেছি এবং জীবনযাত্রার উপর এর প্রভাব নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক অধ্যয়ন করেছি। আমরা আশা করছি এই গবেষণা জাতীয় পর্যায়ে চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে নীতিনির্ধারনে সহায়ক হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দালিলীক অবদান হিসেবে থেকে যাবে।         

হাঁপানি রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য উপদেশ

যাদের হাঁপানি আছে তাদের জন্য কিছু স্বাস্থ্য উপদেশ। কিছু কিছু উপদেশ আমাদের সবার ফুসফুসের স্বাস্থ্যের জন্যই মেনে চলা দরকার।

  • আপনার হাঁপানির মাত্রা বেড়ে যায় এমন প্রভাবকগুলো পরিহার করুন। যেমন: অ্যালার্জেন, বায়ুদূষণ, ধূমপান এবং ঠান্ডা বাতাস।
  • স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ খাবার গ্রহণ করুন। আপনার সুস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য খাবারের মধ্যে ফল, সবজি, আস্ত শস্য দানা এবং তেলমুক্ত প্রোটিন রাখার চেষ্টা করুন।  
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। কারণ, অতিরিক্ত ওজন এবং একটি শারীরিক পরিশ্রমের অভাব আপনার রোগের লক্ষণ বৃদ্ধি করতে পারে।
  • শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এড়ানোর জন্য পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। যেমন- নিয়মিত হাত ধৌত করুন, সংক্রামক রোগের আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান করুন। হাঁচি বা কাশি দেয়ার  সময় নাক এবং মুখ রুমাল বা টিস্যু বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন।
  • আপনার ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নিয়মিত পরীক্ষা করুন।
  • আপনার বাড়ি এবং কাজের জায়গা পরিষ্কার রাখুন।
  • আপনার ডাক্তার আপনাকে যে হাঁপানির ওষুধ দিয়েছে তা গ্রহন করতে থাকুন। এমনকি যদি আপনি ভালও অনুভব করেন, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া তা গ্রহন বন্ধ করবেন না।
  • সুযোগ থাকলে ঘরের বা অফিসের বাতাসের সর্বোত্তম আর্দ্রতা মাত্রা বজায় রাখার জন্য একটি হিউমিডিফাইয়ার ব্যবহার করুন। কারণ, অতিরিক্ত বা খুব কম আর্দ্রতা আপনার শ্বাসকষ্টের সমস্যাগুলোকে উদ্দিপিত করতে পারে।

করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি টেস্ট কেমন হতে হবে- সেনসিটিভ না স্পেসিফিক?

কোন টেস্টের সেনসিটিভিটি কি?

ধরুন, আপনি জানেন ১০০ জন ব্যক্তির করোনা আছে। আপনি একটি নতুন টেস্ট ‘ক’ তৈরী করেছেন যার সেনসিটিভিটি আপনি দেখতে চান। আপনি উপরোক্ত ১০০ ব্যক্তির রক্ত নিয়ে আপনি নতুন পরীক্ষাটি করলেন এবং দেখলেন যে ৮০ জন ব্যক্তির করোনা পজিটিভ এবং ২০ জন ব্যক্তির করোনা নেগেটিভ।

তাহলে উক্ত ৮০ জন ব্যক্তির জন্য টেস্ট ‘ক’ ট্রু পজিটিভ এবং ২০ জন ব্যক্তির জন্য ফল্স নেগেটিভ। এখানে সেনসিটিভিটি হলো উক্ত ১০০ জন করোনা রোগীর মধ্যে কতজনকে কে সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে। সে হিসেবে আমাদের টেস্ট ‘ক’ এর সেনসিটিভিটি হল ৮০%। কারণ, সে ৮০ জনের ক্ষেত্রে সঠিক ভাবে করোনা ধরতে পেরেছে।

করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি টেস্ট কেমন হতে হবে

কোন টেস্টের স্পেসিফিসিটি কি?

ধরুন, আপনি একই টেস্ট এমন ১০০ জন মানুষের মধ্যে করলেন যাদের ক্ষেত্রে আপনি rt-PCR করে নিশ্চিত হয়েছেন যে করোনা নেই। এদের মধ্যে আপনার টেস্টটি ৯০ জনের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস নেগেটিভ বললো এবং ১০ জনের ক্ষেত্রে (ভুলভাবে) করোনা ভাইরাস পজিটিভ বললো।

তাহলে উক্ত ৯০ জন হল ট্রু নেগেটিভ এবং ১০ জন হল ফল্স পজিটিভ। এখানে স্পেসিফিসিটি হলো উক্ত ১০০ জন সুস্থ মানুষের মধ্যে কতজনকে সঠিকভাবে সুস্থ বলতে পারলো। অর্থাৎ, আমাদের টেস্ট ‘ক’ এর স্পেসিফিসিটি হল ৯০%।

এখন করোনা রোগ নির্ণয় করে এমন কোন টেস্ট যদি ৮০% সেনসিটিভ হয় তার অর্থ হল উক্ত টেস্ট একশ জনে ২০ জন রোগীর করোনা নির্ণয় করতে পারে না। অর্থাৎ, ২০ জনের ক্ষেত্রে ফলস নেগেটিভ আসে। এটা একটা সমস্যা। আমাদের টেস্ট যদি করোনা রোগী ধরতে না পারে, তার অর্থ অনেক রোগী করোনা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে এবং ছড়াতে থাকবে।

সুতরাং, আমরা যদি করোনা ভাইরাস নির্ণয়ের কোন র‍্যাপিড টেস্ট ডেভেলোপ করি (খরচ ও সময় বাঁচানোর উদ্দেশ্যে) তাহলে ঐটার সেনসিটিভিটি যত ভালো হয় তত উত্তম। এ ধরনের একটি টেস্ট হল করোনা ভাইরাসে এন্টিজেন টেস্ট।

অ্যান্টিবডি টেস্ট-এর ক্ষেত্রে কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ?

প্রশ্ন হল, আমি যদি এমন একটি টেস্ট ডেভেলোপ করি যেটা আসলে করোনা ভাইরাসকে নির্ণয় না করে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের সৃষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিণয় করে, তাহলেও কি তার সেনসিটিভিটি গুরুত্ব রাখে? চলুন একটু ভেবে দেখি।

এ ধরনের একটি টেস্ট হতে পারে করোনা ভাইরাসের বিপরীতে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি নির্ণয়। উপরের উদাহরণটা চিন্তা করুন। ধরুন, আমাদের টেস্ট ‘ক’ ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জনের রক্তে অ্যান্টিবডি নির্ণয় করতে পারে এবং ২০ জনের ক্ষেত্রে ভুল করে। এটার অর্থ দাড়াবে এই যে, আমাদের টেস্ট ৮০ জনের ক্ষেত্রে বলতে পারে যে অ্যান্টিবডি তৈরী হয়েছে। কিন্তু, ২০ জনের ক্ষেত্রে ভুলভাবে বলবে যে অ্যান্টিবডি তৈরী হয়নি। ভাল ব্যপার হল, ২০ জনের ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে অ্যান্টিবডি আছে। কিন্তু, আমার টেস্ট তাদের রক্তে নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে।

লক্ষ্য করুন, আমরা চাই একজন ব্যক্তির অ্যান্টিবডি তৈরী হয়ে যাক। সুতরাং, আমার র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি ডিটেক্টিং টেস্ট যদি ২০ জনের ক্ষেত্রে নাও নির্ণয় করে আমাদের সমস্যা নেই। কারণ, উক্ত ২০ জনের ক্ষেত্রে ইতমধ্যে অ্যান্টিবডি আছে, সুতরাং করোনা ভাইরাস নতুন করে আক্রমণ করলেও সে প্রোটেক্টেড থাকবে (আশা করা যায়)*।

কিন্তু, আমার অ্যান্টিবডি টেস্ট তখন ঝামেলা করবে যখন তার স্পেসিফিসিটি কম হবে। কারণ, যদি আমার টেস্ট ‘ক’-এর ৯০% স্পেসিফিসিটি থাকে এটি ১০ জন ব্যক্তিকে বলবে যে তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরী হয়েছে আসলে যাদের শরীরের করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী হয়নি (ফলস পজিটিভ)। সেক্ষেত্রে উক্ত ১০ জনের ক্ষেত্রে একটি মিথ্যা নিরাপত্তাবোধ তৈরী হবে। কিন্তু, আমি কোন ভাবেই চাইবো না কোন সুস্থ ব্যাক্তির করোনা ভাইরাসের বিপরীতে অ্যান্টিবডি না থাকলেও তাকে বলা যে তার অ্যান্টিবডি আছে। কেননা সেক্ষেত্রে সে প্রতিরোধের ব্যপারে শিথিল হয়ে করোনা ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে।

সুতরাং, যে কোন অ্যান্টিবডি ডিটেকশন টেস্ট-এর ক্ষেত্রে আমরা চাইবো তা যেন সর্বোচ্চ স্পেসিফিক হয়**।

অন্যদিকে যে কোন করোনা ভাইরাস ডিটেকশন টেস্টের ক্ষেত্রে আমরা চাইবো তা যেন সবোর্চ্চ সেনসিটিভ হয়।

*যদি ডেঙ্গুর মত (ভিন্ন স্ট্রেইন দিয়ে) অ্যান্টিবডি ডিপেনডেন্ট এনহেন্সমেন্ট নামক ঘটনা ঘটে তাহলে অবশ্য সমস্যা।

** তবে আমি যদি অ্যান্টিবডি টেস্ট দিয়ে পরোক্ষভাবে করোনা ভাইরাস জনিত রোগ কোভিড-১৯ নির্ণয় করতে চাই, অর্থাৎ একজন ব্যক্তির রক্তে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখে জানতে চাই যে তার করোনা ভাইরাস ইনফেকশন হয়েছিলো কি না, সেক্ষেত্রে আমার জন্য উক্ত টেস্টে সেনসিটিভিটি গুরুত্বপূর্ণ হবে।

……

কিছু টেকনিক্যাল কথা (যারা জানে তাদের জন্য)-

আমরা জানি কোন ইভেন্টের প্রিভ্যালেন্স বেশী হলে পজিটিভি প্রেডিক্টিভ ভ্যালু বেশী হয়। সুতরাং, করোনা ভাইরাসের এন্টিবডি যদি ওয়াইডস্প্রেড হয়ে থাকে (যা আমরা এই মূহুর্তে জানি না), তার অর্থ হল এন্টিবডি ডিটেকশন কিটের পজিটিভি প্রেডিক্টিভ ভ্যালু বেশী হবে। সুতরাং, ফলস পজিটিভ কম হবে । ফলস পজিটিভ কম হলে তার স্পেসিফিসিটি বেশী থাকবে। সুতরাং, আমাদের টেস্টের এন্টিবডি ডিটেকশন সেনসিটিভিটি কম্প্রোমাইজড হলেও এন্টিবডির প্রিভ্যালেন্স বেশী হয়ে থাকলে আমাদের এন্টিবডি ডিটেকশন কিট খুবই হেল্পফুল হবে।

ক্যান্সারের যম

ক্যান্সারের যম
একটি ক্যান্সার কোষ ও লিম্ফোসাইটের ত্রিমাত্রিক চিত্রায়ন

একটা শহরের কথা। এই শহরে মানুষের কাছে অস্ত্র রাখার অনুমতি আছে। একদিন একটা লোক কিছু অস্ত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে সে একটা গাড়ি ছিনতাই করলো এবং বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে একজন মানুষকে হত্যা করলো। তার বিরুদ্ধে এলাকার পুলিশ প্রথম স্তরের সতর্কতা জারি করলো। কিন্তু লোকটা সতর্কতা পরোয়া করে না। সে রাস্তায় বেরিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে মানুষ মারতে শুরু করলো। তার বিরুদ্ধে সরাসরি তৃতীয় স্তরের সতর্কতা জারি করা হল। পুলিশ তাকে ধাওয়া করতে শুরু করলে সে গুলি করে পুলিশকে মেরে ফেললো। সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে চার নম্বর স্তরের ইমারজেন্সি জারি হল এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে দেশব্যাপী সতর্কতা জারি হল। তাকে ধরতে দেশের স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সকে দায়িত্ব দেয়া হল। এরপর উক্ত সন্ত্রাসী গ্রেনেড লাঞ্চার বের করে আক্রমণ শুরু করলে দেশের নিরাপত্তা সতর্কতা পাঁচ স্টার এ উন্নীত হল এবং তার বিরুদ্ধে আর্মি নামানো হল।

যারা ছোট বেলায় গ্র্যান্ড থেফট অটো (জিটিএ) খেলেছেন তাদের হয়তো ঘটনাটি পরিচিত মনে হতে পারে। জিটিএর ভার্চুয়াল জগতে এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু, বিষয় সেটা না। বিষয়টি হল কোনও দেশে যখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হয় উক্ত দেশ কয়েক ধাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। প্রথমে লোকাল পুলিশ ঘটনা আমলে নেয়। তাতে কাজ না হলে স্পেশাল বাহিনী কাজে লেগে পরে। তাতেও কাজ না হলে আর্মিকেই নামিয়ে দেয়া হয়। অধিকন্তু, প্রতিটি বাহিনীর কিছু শাখা থাকে। কারও কাজ সরাসরি আক্রমণ, কারও কাজ তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দাগিরি এবং কারও কাজ গোপনে আক্রমণ।

তো আমাদের শরীরেও এরকম কয়েক ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী আছে। শরীরে যখন কোনও জীবাণু প্রবেশ করে, প্রথম ধাপে এগিয়ে আসে প্রবেশপথের নিরাপত্তা প্রহরী জাতীয় কিছু কোষ। এদের মধ্যে আছে ম্যাক্রোফাজ, নিউট্রফিল ও ন্যাচারাল কিলার সেল। আবার, এই কোষগুলো যদি একা সামলাতে না পারে নেমে আসে ‘টি’ সেল নামক বিশেষ বাহিনী। ‘টি’ সেলের কয়েকটি শাখা আছে। কারও কাজ সরাসরি আক্রমণ, কারও কাজ শত্রুকে চিনতে সাহায্য করা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ম্যাসেজ পাঠানো এবং কারও কাজ হচ্ছে কোল্যাটারাল ড্যামেজ চেক দিয়ে রাখা।

সাহায্যকারী ‘টি’ সেল আবার হেডকোয়ার্টারে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে বিশেষায়িত ‘বি’ সেল বাহিনীকে ডেকে পাঠাতে পারে। ‘বি’-সেল বাহিনীর কাজ হল শত্রুবাহিনীর দুর্বল জায়গা কে চিহ্নিত করে বিশেষ অস্ত্র তৈরি ও আক্রমণ। এছাড়াও ‌বি-সেল বাহিনীর একদল কোষ উক্ত দুর্বল জায়গার তথ্য ধারণ করে রাখে যেন ভবিষ্যতে একই শত্রু আবার আক্রমণ করলে ক্ষতি হওয়ার আগেই মূলোৎপাটন করা যায়।  

অপরাধী বিভিন্ন রকম হতে পারে। কারও শক্তি বেশী, কারও অর্থ বেশী, কারও আবার অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। কোন শত্রু শরীরে প্রবেশ করলে প্রথমে শরীরের বর্ডার-গার্ডরা তাকে ধরে এবং তার বিশেষ কোন চিহ্ন থাকলে খুঁজে বের করে । এরপর উক্ত চিহ্ন নিজস্ব কিছু চিহ্নের সাথে ট্যাগ করে উপরতলায় পৌঁছে দেয়। এরপর উপরতলার নিরাপত্তারক্ষীরা উক্ত চিহ্ন ও আভ্যন্তরীণ ট্যাগ দেখে শত্রুকে চিহ্নিত করে।  

এই যে নিজস্ব ট্যাগ বা সাইনের কথা বললাম একে বলে MHC অণু। ‘টি’-সেল সাধারণত তার ঝিল্লীতে থাকা টি-সেল রিসেপ্টর (TCR) নামক এক রাডার দিয়ে MHC অণুকে চিনে নেয়। শরীরে যখন কোন জীবাণু ঢুকে,  প্রথমে বর্ডার-গার্ড কোষেরা তাকে ধরে এবং তার যন্ত্রাংশ ভেঙ্গেচুরে তাকে চিহ্নিত করা যায় এরকম একটা অণু বের করে নিয়ে আসে এবং ঐ অণুটাকে MHC-নামক হাতের সাহায্যে টি-সেল-এর কাছে এগিয়ে দেয়। টি-সেলও হাত (TCR) বাড়িয়ে অণুটিকে চিনে নিয়ে বাহিনীর অন্যদের কাছে বিভিন্ন রকম সংকেত পাঠাতে থাকে যেন তারা একটিভ হয় এবং জীবাণুটিকে মারার ব্যবস্থা শুরু করে।  কোষগুলো চোখ না থাকায় তাদের হাত দিয়ে স্পর্শ করে চিনে নিতে হয়। এ কারণে বর্ডারে কোষেরাও যেমন দুই হাত বাড়ায়, ঠিক তেমনি টি-সেলও দুই-হাত বাড়িয়ে দেয়। এক হাত দিয়ে স্পর্শ করে চিনে নেয় বর্ডারের হাতকে এবং আরেক হাতে চিনে নেয় শত্রুর পরিচায়ক অণুকে।

বুঝতেই পারছেন বিভিন্ন রকম শত্রুকে চিনতে বিভিন্ন রকম হাতের প্রয়োজন হয়। মানব শরীরের যে অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, কৃমি প্রবেশ করে তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য সুনির্দিষ্ট  পদ্ধতিতে শরীরের নিরাপত্তা-কর্মীরা কাজ চালিয়ে যায়। প্রাথমিক নিরাপত্তা প্রহরী কোষ যখন বিভিন্ন ধরনের জীবাণুকে আভ্যন্তরীণ বাহিনীর কাছে উপস্থাপন করে তখন সাধারণত সংশ্লিষ্ট জীবাণুর বহিরাবরণের কিছু অণুকে পরিচায়ক হিসেবে নিয়ে আসে।

কিন্তু, শত্রু যদি দেশের ভিতর থেকে মাথা চারা দিয়ে উঠে তাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? বলছিলাম টিউমার বা ক্যান্সারের কথা। টিউমার বা ক্যান্সার হল শরীরের অবস্থিত কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন। যখন কোথাও ক্যান্সার হয় ক্যান্সার কোষগুলো কিছু বিশেষ চিহ্ন প্রকাশ করে। আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা বাহিনী তখন চিহ্নগুলো চিনে নিয়ে আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, প্রতিরক্ষা বাহিনীর লক্ষ্য রাখতে হয় যেন নিজের শরীরের নিরপরাধ কোষগুলো নিরাপদে থাকে। এই করতে গিয়ে একটা সমস্যা হয়ে যায়। টিউমার যেহেতু নিজের দেহের কোষ থেকেই হচ্ছে প্রতিরক্ষা বাহিনী অনেক সময় টিউমার কোষকে নিজের কোষ মনে করে এড়িয়ে যায়। ফলে টিউমার লুকিয়ে লুকিয়ে মহীরুহে পরিণত হয়।   

সাধারণত টি-সেল বাহিনী নির্দিষ্ট চিহ্নের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট টিউমারকে আক্রমণ করতে পারে। যেমন: স্তন ক্যান্সারের সময় নির্দিষ্ট কিছু চিহ্ন বা মার্কার ক্যান্সার কোষের বহিরাবরণে প্রকাশ পায়। স্তন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে যে টি-সেল বাহিনী তৈরি হয় তা কেবল উক্ত ক্যান্সার কোষের বিপরীতেই কাজ করতে পারে। তবে সম্প্রতি একদল গবেষক ক্যান্সারের বিরুদ্ধে শরীরের নিরাপত্তা (ইমিউনিটি) নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন ‘টি-সেল’-এর এমন কিছু হাত (TCR) যা সব ধরনের ক্যান্সার কোষকে চিনতে পারে। কিন্তু, কিভাবে? তারা আবিষ্কার করলেন যে প্রতিটি ক্যান্সার কোষ MR1 নামক MHC-জাতীয় এক প্রকার অণু তাদের বহিরাবরণে বাড়িয়ে দেয় যা MHC-এর মত ক্যান্সারের আভ্যন্তরীণ কোন অণুকে পরিচায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে।  এই MR1-সংশ্লিষ্ট অণুকে নতুন TCR নির্ণয় করতে পারে। আশার বিষয় হল এই কাজ করতে গিয়ে টি-সেলগুলো শরীরের সাধারণ কোষের কোন ক্ষতি সাধন করে না।

যদিও গবেষণাটি প্রাথমিক পর্যায়ে তথাপি আশার কথা হল এটি প্যান-ক্যান্সার চিকিৎসা আবিষ্কারের সম্ভাবনার খুলে দিয়েছে। প্যান-ক্যান্সার বলতে বুঝচ্ছি এমন একটি চিকিৎসা যা সব ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে, তা-ও আবার শরীরের অন্যান্য কোষের কোন প্রকার ক্ষতি না করেই। আমরা সবাই জানি, ক্যান্সারের চিকিৎসায় এখন যে কেমোথেরাপি ব্যবহার হয় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশী। সে হিসেবে এটি আমাদের জন্য বড়ই আশা জাগানিয়া সংবাদ।

কে জানে হয়ত খুব শীঘ্রই আমরা ‘ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন’ ব্যবহার করে ক্যান্সারের যম আবিষ্কার করতে যাচ্ছি। ইন শা আল্লাহ।


বিবলিওগ্রাফি:

  • Crowther MD, Dolton G, Legut M, Caillaud ME, Lloyd A, Attaf M, et al. Genome-wide CRISPR-Cas9 screening reveals ubiquitous T cell cancer targeting via the monomorphic MHC class I-related protein MR1. Nat Immunol. 2020;

ডাক্তারদের পড়ালেখা, প্রেক্ষাপট: যুক্তরাস্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়া

আপনি কি জানেন- যুক্তরাস্ট্রে এম,বি,বি,এস বলে কোন ডিগ্রী নেই? যুক্তরাজ্যে জেনারেল প্র্যাকটিস করতে হলে আপনাকে ৫ বছরের স্নাতকত্তোর ট্রেইনিং শেষ করতে হবে? কানাডায় মেডিকেল স্টাডিস-এ প্রবেশ করতে হলে আপনাকে ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করতে হবে-  এই তথ্য কি আপনার জানা ছিল?

আমাদের মাঝে পাশ্চাত্যের মেডিকেল পড়াশোনা নিয়ে কৌতুহল থাকলেও বিষয়টি নিয়ে কখনও ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়নি। তাই ভাবলাম, বিষয়টি একটু পড়ি। পড়ে অনেক কিছুই জানা হল। চলুন দেখি, পাশ্চাত্যের ডাক্তারি পড়ালেখার ধরণ কেমন-

এই প্রবন্ধে মূলত যুক্তরাস্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার মেডিকেল এডুকেশন নিয়ে আলোচনা থাকবে। সাথে, বাংলাদেশ থেকে যে চিকিৎসকরা এসব দেশে যেতে আগ্রহী সংশ্লিষ্ট দেশে তাদের পথপরিক্রমা সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকবে। আমাদের দেশের মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের মধ্যে থেকে যারা দেশের বাইরে যেতে আগ্রহী, তারা সাধারাণত এই ইংলিশ স্পিকিং দেশগুলোতেই যাওয়ার চেষ্টা করেন। চিকিৎসাবিদ্যা যেহেতু মানুষের সাথে সম্পর্কিত সেহেতু বিভিন্ন দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা তাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেডিকেলে এডুকেশনকে সাজানোর চেষ্টা করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেশভেদে মেডিকেলে পড়াশোনার নিয়মের কিছুটা পার্থক্য আছে।

যুক্তরাস্ট্র

যুক্তরাস্ট্রে মেডিকেল আণ্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম চার বছরের। এটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুল দ্বারা পরিচালিত হয়। এ প্রোগ্রামে ঢোকার শর্ত হল- অন্য যে কোন বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করতে হবে। তবে, একজন মেডিকেল ভর্তিচ্ছু ছাত্রকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় বসতে হলে উক্ত বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করাকালীন এসোসিয়েশন অব অ্যামেরিকান মেডিকেল কলেজেস কতৃক নির্ধারিত কিছু কোর্স অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে আছে- রসায়ন দুই বছর (যার এক বছর জৈব রসায়ন), এক বছরের জীববিজ্ঞান এবং এক বছরের ফিজিক্স। রসায়ন ও জীববিজ্ঞান কোর্সে সেলুলার বায়োলজী, ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকিউলার বায়োলজি এবং জেনেটিক্স রাখার উপদেশ দেয়া হয়। এছাড়া স্কুল ভেদে সুনির্দিষ্ট ‘বিষয়ের’ শর্তাবলীর পার্থক্য আছে।

একজন ছাত্র এই প্রি-মেডিকেল শর্তাবলী পূরণ করলে মেডিকেল কলেজ এডমিশন টেস্ট (এম,সি,এ,টি) দিতে পারে। মেডিকেল স্কুলে চান্স পাওয়া নির্ভর করে ছাত্রের প্রি-মেডিকেল কোর্সের একাডেমিক রেকর্ড, এম,সি,এ,টি-র ফলাফল, অন্যান্য প্রি-মেডিকেল এক্সট্রা-কারিকুলার এক্টিভিটি(যা ছাত্রের মেডিসিন-এর প্রতি আগ্রহকে স্পষ্ট করে), বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে রিকমেন্ডেশন লেটার এবং ইন্টারভিউ-এর ফলাফল ইত্যাদির উপর।

মেডিকেল স্কুল থেকে যে ডিগ্রী দেয়া হয় তার নাম ডক্টর অব মেডিসিন (এম,ডি) অথবা ডক্টর অব অস্টিওপ্যাথিক মেডিসিন (ডি,ও)। মেডিকেল স্টাডিকে স্কুলভেদে  চার থেকে পাঁচ বছরের পড়াশোনায় ভাগ করা হয়। প্রথম দু’বছর বেসিক সায়েন্স এবং পরের তিন বছর ক্লিনিক্যাল ক্লার্কশিপ। প্রথম দুই থেকে তিন বছর যে বিষয়গুলো কাভার করতে হয় সেগুলো হল- এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, হিস্টোলজি, এমব্রায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথোলজি, প্যাথোফিজিওলজি, নিউরোসায়েন্স ইত্যাদি। তবে, কারিকুলাম আমাদের দেশের মত সাবজেক্টভিত্তিক সাজানো হয় না বরং সিস্টেম ভিত্তিক (যেমন: ব্রেইন এণ্ড বিহেভিওর, কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেম প্রভৃতি)সাজানো হয়। ফলে, একজন ছাত্রের প্রথম থেকেই রোগী ও রোগ ভিত্তিক প্রশিক্ষণ হয়। এগুলো পড়া শেষ হলে একজন ছাত্র ইউনাইটেড স্টেটস মেডিকেল লাইসেন্সিং এক্সাম তথা ইউ,এস,এম,এল,ই পার্ট ওয়ান দিতে পারে। এরপর কোন একটি টিচিং হসপিটালে তিন বছরের ক্লার্কশিপে প্রবেশ করতে হয়। এ সময় মেডিসিন, সার্জারী, পেডিয়াট্রিক্স, ফ্যামিলি মেডিসিন, গাইনোকোলজি ও অবস্টেট্রিক্স, নিউরোলজি এবং সাইকিয়েট্রি ওয়ার্ডে রোটেশন হয়। এর পাশাপাশি কিছু ইলেকটিভ সাব-স্পেশালিটিতেও ক্লার্কশিপ সম্পন্ন করতে হয়। (কোনো কোনো স্কুল জয়েন্ট পোগ্রাম পরিচালনা করে, যেখানে মেডিকেল সায়েন্সের পাশাপাশি রিলেটেড বিষয়ে পিএইচডি, মাস্টার্স ইত্যাদি করার সুযোগ থাকে) পড়াশোনার চতুর্থ বছরের শেষে মেডিকেল ছাত্ররা সাধারণত ইউ,এস,এম,এল,ই পার্ট টু পরীক্ষা দেয়।

ক্লিনিক্যাল ক্লার্কশিপ শেষে একজন ছাত্র এম,ডি বা ডি,ও ডিগ্রী অর্জন করেন, কিন্তু প্র্যাকটিস করতে পারেন না। প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স পেতে হলে তাকে কমপক্ষে এক বছরের ইন্টার্ণশিপ এবং নির্দিষ্ট স্পেশালিটিতে (তথা বিষয়ে) রেসিডেন্সি শেষ করে ইউ,এস,এম,এল,ই পার্ট ত্রি তথা লাইসেন্সিং পরীক্ষা দিতে হয়। এরপরই কেবল একজন প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করেন।(প্রসঙ্গত, যুক্তরাস্ট্রের অল্প কিছু প্রদেশে এক বছরের ইন্টার্ণশিপ শেষে মেডিসিন প্র্যাকটিস করার সুযোগ আছে।)

রেসিডেন্সি ট্রেইনিং-এ চান্স পাওয়া নির্ভর করে ন্যাশনাল রেসিডেন্সি ম্যাচিং প্রোগ্রামের উপর। এটি একটি কম্পিউটার চালিত প্রোগ্রাম যেখানে ইউ,এস,এম,এল,ই পার্ট টু পাশ করা ডাক্তারদের রেসিডেন্সিতে ঢুকার আবেদন ও টিচিং হাসপাতালের বিভিন্ন স্পেশালিটিতে শূণ্য রেসিডেন্সি পদের প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে ডাক্তারদের ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়। যেহেতু রেসিডেন্সি পদ কম এবং আবেদন অনেক বেশী থাকে, ফলে এই ম্যাচিং প্রোগ্রামটি অনেক শক্ত হয়। অনেক আবেদনকারীকেই তাদের ইচ্ছেকৃত স্পেশালিটিতে সুযোগ পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। আবার, অনেককে তাদের ইচ্ছে পরিবর্তন করতে হয়। রেসিডেন্সির ম্যাচিং-এর সময় যে প্রভাবকগুলো কাজ করে তা হল: আবেদনকারী ক্রমানুসারে যে প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে ইচ্ছুক তার লিস্ট, আবেদনকারীর ইউ,এস,এম,এল,ই পরীক্ষার নম্বর, আলফা-ওমেগা-আলফা (সংক্ষেপে এ,ও,এ) মেম্বারশিপ, ক্লিনিকাল ক্লার্কশিপের গ্রেড, রিকমেণ্ডেশন লেটার, ক্লাসে মেধাক্রম, রিসার্চের অভিজ্ঞতা, কোন স্কুল থেকে এম,ডি পাশ করেছে, আলাদা কোন যোগ্যতা (যেমন রিলেটেড বিষয়ে মাস্টার্স করা থাকলে তা) ইত্যাদি।

বিষয়ভেদে রেসিডেন্সি ট্রেইনিং-এর ডিউরেশন তিন বছর থেকে শুরু করে দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে। সংক্ষেপে বললে, ইন্টারনাল মেডিসিন-এ তিন বছর এবং জেনারেল সার্জারীতে পাঁচ বছর ট্রেইনিং করতে হয়। কেউ যদি মেডিসিনের সাবস্পেশালিটি এবং সার্জারীর সাবস্পেশালিটিতে ডিগ্রী করতে চান, তার সংশ্লিষ্ট বিভাগে অতিরিক্ত ৩ থেকে ৫ বছর ফেলোশিপ টেইনিং করতে হয়। ট্রেইনিং শেষে একজন ডাক্তার তার স্পেশালিটিতে বোর্ড সার্টিফিকেশন-এর জন্য আবেদন করতে পারেন। এরপর তাকে উক্ত বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়।(একে ইউ,এস,এম,এল,ই পার্ট ত্রি-ও বলা যায়) পরীক্ষা পাশ করলে উক্ত স্পেশালিটির বোর্ড সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।

যারা জেনারেল ফিজিশিয়ান হতে চান তারা কি করবেন? প্রদেশভেদে এই বিষয়টিতে পার্থক্য আছে। কোন কোন প্রদেশে একবছর ইন্টার্ণশিপ ট্রেইনিং-এর পর প্র্যাকটিস-এর সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।  তবে অধিকাংশ প্রদেশেই এখন জেনারেল প্র্যাকটিস করতে হলে ফ্যামিলি মেডিসিন বিভাগে তিন বছর রেসিডেন্সি ট্রেইনিং করতে হয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাস্ট্রে জেনারেল প্র্যাকটিশনার শব্দটি উঠে গেছে। তার পরিবর্তে এদেরকে বলা হচ্ছে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান।

যে সকল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল গ্রাজুয়েট যুক্তরাস্ট্রে স্যাটল হতে চান, তাদেরকে ইউ,এস,এম,এল,ই পার্ট ওয়ান এবং পার্ট টু(সি,কে ও সি,এস) পাশ করে রেসিডেন্সির জন্য এপ্লাই করতে হয়। সে হিসেবে, বাংলাদেশ থেকে যে সকল মেডিকেলে স্টুডেন্ট যুক্তরাস্ট্রে যেতে আগ্রহী তাদেরকেও একই পথে চলতে হবে। পার্ট ওয়ান পরীক্ষা মেডিকেলের চতুর্থ বছর শেষেই দেয়ার সুযোগ আছে। পার্ট ওয়ান এবং টু সি,কে দু’টো পরীক্ষাই বাংলাদেশে আমেরিকান এম্বেসিতে দেয়া যায়। পার্ট টু সি,এস যুক্তরাস্ট্রে গিয়ে দিতে হয়। পার্ট টু সি,এস পাশ করার পর রেসিডেন্সির জন্য এপ্লাই করার পর শুরু হয় ন্যাশনাল রেসিডেন্সি ম্যাচিং প্রোগ্রাম-এ নাম আসার জন্য অপেক্ষা করার পালা। নাম আসলে পড়ে ইন্টারভিউ দিতে হয়। এরপরই একজন ক্যানডিডেট রেসিডেন্সিতে ঢুকতে পারে। রেসিডেন্সিতে চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশী ছাত্রদের ই,ইউ,এস,এম,এলই-তে অনেক ভাল করা (অর্থাৎ প্রায় ৯৯ পারসেন্টাইলে থাকা) জরুরী । নইলে সাধারণত রেসিডেন্সি পাওয়া যায় না। কারণ, এটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রাম। তবে পরীক্ষার রেজাল্ট পারসেন্টাইলের দিকে দিয়ে সামান্য কম হলেও, যদি যুক্তরাস্ট্রের সিটিজেনশিপ থাকে(অথবা পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হয়) অথবা কোন সিটিজেন তাকে স্পন্সর করে(তথা অভিভাবক হওয়ার দায়িত্ব নেয়), তাহলে রেসিডেন্সি ম্যাচ করার সম্ভাবনা বাড়ে।

প্রসঙ্গত, রেসিডেন্সি ট্রেইনিং-এ সাপ্তাহিক কর্মঘন্টা সাধারণত ৮০ ঘন্টা বা তার বেশী। প্রত্যেক সপ্তাহে টানা ষোল ঘন্টার একটা ডিউটি থাকবেই (আগে প্রতি সপ্তাহে টানা ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত একটা ডিউটি থাকতো। কিন্তু তা ডাক্তারদের শরীরে প্রভাব ফেলে বলে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে)। বছরে তিন সপ্তাহের একটি ভ্যাকেশন বাদে পার্সনাল ছুটি ছয় দিন পর্যন্ত নেয়া যায় (ইন্সটিটিউশন ভেদে পার্থক্য থাকতে পারে)। প্রতিষ্ঠানভেদে বাৎসরিক স্যালারী ন্যূনতম ৪০০০০ ডলার থেকে শুরু। প্রতি বছর পর স্যালারী কিছুটা বাড়ে।

এশিয়ান ডাক্তাররা শুধু এশিয়ান রুগীদের চিকিৎসা দিতে পারে।

কানাডা

কানাডার মেডিকেল এডুকেশন প্রায় যুক্তরাস্ট্রের মেডিকেল এডুকেশন সিস্টেমের মত। কানাডার লাইসেন্সিং পরীক্ষার নাম মেডিকেল কাউন্সিল অব কানাডা কোয়ালিফাইং এক্সামিনেশন (এম,সি,সি,কিউ,ই)। পার্ট দু’টো। ইউ,এস,এম,এল,ই-র মত দ্বিতীয় পার্টের ক্লিনিকাল নলেজ(সি,কে) অংশটি নেই। কানাডাতেও মেডিকেল স্কুলে ঢোকার শর্ত হল একটি বিষয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করতে হবে। মেডিকেল কারিকুলাম চার বছরের। প্রথম দুই বছর প্রি-ক্লিনিকাল এবং পরের দুই বছর ক্লিনিকাল ক্লার্কশিপ। প্রি-ক্লিনিকাল শেষে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিতে হয়। ক্লার্কশিপ শেষে এক বছর ইন্টার্ণশিপ করার পর পার্ট টু পরীক্ষা দেয়া যায়। পার্ট টু পাশ করলে ডক্টর অব মেডিসিন (কানাডায় ডি,ও নেই) সার্টিফিকেশন দেয়া হয়। কিন্তু প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করতে হলে যুক্তরাস্ট্রের মতই রেসিডেন্সি ট্রেইনিং শেষে বোর্ড সার্টিফিকেশন এক্সাম দিতে হয়। এমনকি ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হতে হলেও দুই বছরের উক্ত বিভাগে রেসিডেন্সি ট্রেইনিং করতে হয়। অন্যান্য বিষয়ে রেসিডেন্সির সময়সীমা বিষয়ভেদে যুক্তরাস্ট্রের বিভিন্ন ভার্সিটির মতই।

একজন ছাত্র ইচ্ছে করলে রেসিডেন্সি প্লাস পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে, তাকে কিছু অতিরিক্ত শর্ত পূরণ করতে হয় (যেমন: রিসার্চ-এ অংশগ্রহন করার অভিজ্ঞতা)।

কানাডার ডাক্তারদের ৫ বছর পর পর রিসার্টিফিকেশন করতে হয়। এটি পরিচালিত হয় মেইনটেনেন্স অব সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম দ্বারা, যা কন্টিনিউইং মেডিকেল এডুকেশন প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত। রিসার্টিফিকেশনের জন্য একজন ফিজিশিয়ানের কার্যাবলী আপডেট রাখতে হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেডিট অর্জন করতে হয়। (উল্লেখ্য, এই প্রবন্ধে উল্লিখিত সবগুলো দেশেই এই নিয়ম বিভিন্ন মাত্রায় চালু আছে।)

যুক্তরাস্ট্র বাদে অন্যান্য দেশের ডাক্তারদের কানাডায় চিকিৎসক হতে হলে প্রথম শর্ত হল, কানাডার সিটিজেনশিপ থাকা বা পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হওয়া বা ওয়ার্ল্ড হেল্দ অর্গানাইজেশন রেফুজি হিসেবে কানাডায় থাকা। দ্বিতীয় শর্ত হল, যে দেশ থেকে মেডিকেল সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছে সে দেশে প্র্রাইমারী ল্যাঙ্গুয়েজ ইংলিশ হওয়া অথবা সেটা না হলে আইইএলটিএস-এর চারটি ধাপের প্রত্যেকটিতে স্কোর কমপক্ষে ৭ থাকা। এই শর্তগুলো পূরণ হলে একজন মেডিকেল গ্রাজুয়েট এম,সি,সি,ই,ই (তথা মেডিকেলে কলেজ অব কানাডা ইভ্যালুয়েটিং এক্সাম) পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারবে। পরীক্ষাটির সেন্টার ইণ্ডিয়ায় আছে, বাংলাদেশে কানাডা এমবেসি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষার সেন্টারও বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরীক্ষায় পাশ করলে ন্যাশনাল এসেসমেন্ট কোলেবোরেশন অবজেক্টিভ স্ট্রাকচারড ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন (সংক্ষেপে এন,এ,সি-ও,এস,সি,ই)পরীক্ষা দিতে হয়। এই পরীক্ষাটি ইন্টারন্যাশনাল গ্রাজুয়েটদের এসেস করার জন্যই আয়োজন করা হয়। এই পরীক্ষাটি দিতে হয় কানাডায়।

এরপর আসে রেসিডেন্সি ম্যাচিং-এর পালা। রেসিডেন্সি ম্যাচিং-এ আবেদন করার আগে ক্লিনিক্যাল এসেসমেন্ট প্রোগ্রাম-এ অংশ নিলে, ম্যাচ করার সম্ভাবনা বাড়ে। এই প্রোগ্রামে একজন ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল গ্রাজুয়েট (আইএমজি)-কে হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের তত্বাবধানে আট সপ্তাহের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় এবং তার কাজের উপর স্কোরিং করা হয়। অত:পর রেসিডেন্সির জন্য এপ্লাই করতে হয়। রেসিডেন্সি ম্যাচ হলেই কেবল রেসিডেন্সি ট্রেইনিং-এ প্রবেশ করা যায়।

যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যে মেডিকেল সায়েন্সের ডিগ্রী মূলত এম,বি,বি,এস । তবে ইনস্টিটিউট ভেদে এই ডিগ্রী বিভিন্ন নাম ধারণ করতে পারে, যেমন: এম,বি,সিএইচ,এস; এম,বি,বি,সিএইচ ইত্যাদি । এম,বি,বি,এস পাঁচ বছরের কোর্স। তবে কোন কোন মেডিকেল স্কুল এখন চার বছরের এম,ডি ডিগ্রীও দিয়ে থাকে। মান এবং কারিকুলাম একই। তবে চার বছরের কোর্সে স্বাভাবিকভাবেই চাপ বেশী। আমেরিকা-কানাডার মত মেডিকেলে ভর্তির জন্য গ্র্যাজুয়েশন থাকা জরুরী নয়। বরং, হাইয়ার সেকেণ্ডারী এডুকেশন পার করার পর পরই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা (ইউনাইটেড কিংডম ক্লিনিক্যাল এপটিচুড টেস্ট অথবা বায়োমেডিকেল এডমিশন টেস্ট)দেয়া যায়। এম,বি,বি,এস-এর পাঁচ বছর সময়কালকে আগে প্রি-ক্লিনিক্যাল এবং ক্লিনিক্যাল এই দু’ভাগে ভাগ করা হত। প্রি-ক্লিনিক্যাল ছিলো পুরোপুরি লেকচারভিত্তিক এবং সাবজেক্টভিত্তিক(অর্থাৎ এনাটমি, ফিজিওলজি.. এভাবে)। ক্লিনিক্যাল-এর সময় ছাত্রদের লেকচারভিত্তিক এবং রোগীভিত্তিক শিক্ষা দেয়া হতো। তবে, এখন প্রায় প্রতিটি স্কুলে এই পদ্ধতি পরিবর্তন করে, শরীরের বিভিন্ন তন্ত্র(সিস্টেম)-ভিত্তিক কারিকুলাম সেট করা হচ্ছে এবং সেই সাথে ‘প্রবলেম বেজড লার্নিং’ পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। এ কারণে বিভিন্ন ভার্সিটিতে পাঁচ বছর সময়কালকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়েছে। কোন স্কুলে এক-তিন-এক বছর, কোন স্কুলে দুই-দুই-এক বছর ইত্যাদি।

এম,বি,বি,এস শেষ করার পর একজন ছাত্রকে দুই বছর মেয়াদী ‘ফাউণ্ডেশন ইয়ার’-এ প্রবেশ করতে হয়। এক বছর ইন্টার্ণশিপ (যাকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ইয়ার এক বলে) এবং এক বছর রেসিডেন্সি (যাকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ইয়ার দুই বলে)। রেসিডেন্সি শেষ করার পর একজন যদি জেনারেল প্র্যাকটিশনার(জি,পি)হতে চায়, তাকে জেনারেল প্র্যাকটিস-এ আরও তিন বছরের পোস্টগ্রাজুয়েশন ট্রেইনিং নিতে হয়। আর যারা অন্য কোন স্পেশালিটিতে যাবে তাদের বিষয়ভেদে কমপক্ষে পাঁচ বছরের মত অতিরিক্ত ট্রেইনিং নিতে হয়। ট্রেইনিং প্রক্রিয়াটি সুনির্দিষ্ট নিরিক্ষাপদ্ধতির মধ্য দিয়ে যায়। ট্রেইনিং শেষে একজন কনসালটেন্ট হিসেবে গন্য হয় এবং তারপরেই কেবল স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস করার জন্য সার্টিফিকেট পেতে পারে।

ইউরোপিয়ান ওয়ার্কিং টাইম ডাইরেকটিভ (ই,ডাব্লিউ,টি,ডি) ইউরোপে একজন জুনিয়র ডাক্তারের কর্মঘন্টা নির্ধারণ করে দিয়েছে সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা। কিন্তু এটি নিয়ে হাসপাতাল কতৃপক্ষের আপত্তি আছে। পূর্বে জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল (জি,এম,সি) কর্তৃক নির্ধারিত ওয়ার্কিং আওয়ার ছিল ৫৬ ঘন্টা, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে ইণ্টার্ণদের ডিউটি আওয়ার সপ্তাহে ১০০ ঘন্টাও ছাড়িয়ে যেত। ই,ডাব্লিউ,টি,ডি নির্ধারণের পরে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মঘন্টা কমিয়ে ৪৮ ঘন্টা করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের যুক্তরাজ্যে লাইসেন্স পেতে হলে প্রথম ধাপ হল- প্রফেসনাল এণ্ড লিঙ্গুইস্টিক এসেসমেন্ট বোর্ড (সংক্ষেপে পি,এল,এ,বি বা প্ল্যাব) পরীক্ষা দিতে হবে। প্ল্যাব পরীক্ষার প্রথম পত্র বাংলাদেশ থেকে দেয়া যায় এবং দ্বিতীয় পত্রটি (প্র্যাকটিকেল এসেসমেন্ট)ইংল্যাণ্ডে গিয়ে দিতে হয়। ২০১৪ থেকে প্ল্যাব পরীক্ষায় বসার শর্ত হিসেবে  আই,ই,এল,টি,এস এর প্রতিটি ধাপে ৭ এবং মোট ৭.৫ থাকার শর্ত সংযুক্ত করা হয়েছে। প্ল্যাব-এ পরিবর্তে একজন যুক্তরাজ্যের সুনির্দিষ্ট কিছু পোস্টগ্রাজুয়েট ডিগ্রী অর্জন করলেও এপ্লাই করতে পারবে, যেমন:  এম. আর. সি. পি. (মেম্বার অব রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান)। তবে শর্ত হল, পাশ করার তিন বছরের মধ্যে লাইসেন্স এর জন্য এপ্লাই করতে হবে। এছাড়া, যুক্তরাজ্যের কিছু প্রতিষ্ঠান ডাক্তারদের স্পনসর করে তাদের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে পারে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কেউ চাকুরী করলে, সেও লাইসেন্স-এর জন্য আবেদন করতে পারে। (বিস্তারিত নিচের ১০ নম্বর লিংক-এ)

প্ল্যাব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একজন ট্রেইনিং-এর জন্য আবেদন করতে পারে। যুক্তরাজ্যে ম্যাচিং প্রোগ্রাম জাতীয় কোন প্রক্রিয়া নেই। স্বাভাবিক ভাবেই অতিরিক্ত যোগ্যতা থাকলে ট্রেইনিং-এ চান্স পাওয়া সহজ হয় (যেমন: যুক্তরাজ্যের পরিচিত ডাক্তার থেকে রিকমেণ্ডেশেন লেটার)।

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ার মেডিকেল ডিগ্রী প্রধানত এম,বি,বি,এস। তবে, কোন কোন মেডিকেল স্কুল এম,ডি ডিগ্রীও দেয়। স্কুল ভেদে মেয়াদকাল চার থেকে ছয় বছর। মেডিকেল স্কুলে চান্স পেতে হলে দুটো পথ আছে। কলেজ (অর্থাৎ সেকেণ্ডারী স্কুল) পেরিয়ে ঢুকতে হলে আন্ডারগ্রাজুয়েট মেডিকেল এডমিশন টেস্ট (ইউ,জি,এম,টি) এবং গ্রাজুয়েট হয়ে ঢুকতে গ্রাজুয়েট মেডিকেল এডমিশন টেস্ট (জি,এম,এ,টি) দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। মেডিকেল কারিকুলাম যুক্তরাজ্যের মতই। তবে অস্ট্রেলিয়ায় একটি সুবিধে হল অন্যান্য দেশের মত জেনারেল প্র্যাকটিশনার হতে হলে রেসিডেন্সি ট্রেইনিং জরুরী নয়। বরং এক বছর ইন্টার্ণশিপ শেষে স্বাধীনভাবে জেনারেল প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাওয়া যায়। কেউ যদি স্পেশালিটিতে ক্যারিয়ার করতে আগ্রহী হয়, তাকে রেসিডেন্সি ট্রেইনিং-এর জন্য এপ্লাই করতে হবে। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্যের মত এখানেও কোন রেসিডেন্সি ম্যাচিং প্রোগ্রাম নেই।    

বাংলাদেশের তরুণ ডাক্তারদের মধ্য থেকে যারা অস্ট্রেলিয়া যেতে আগ্রহী তাদেরকে প্রথমেই এ,এম,সি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে হবে।(উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ায় রেজিস্ট্রেশন পেতে কয়েকটি পাথওয়ে আছে। তন্মধ্যে, বাংলাদেশী তরুণ ডাক্তারদের জন্য কেবল স্ট্যাণ্ডার্ড পাথওয়ে প্রযোজ্য। এজন্য এখানে স্ট্যাণ্ডার্ড পাথওয়েটাই সংক্ষেপে বলা হল।)  এ,এম,সি তথা অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল দু’টো ভাগে পরীক্ষাটি নেয়। প্রথমটি মাল্টিপল চয়েজ কোয়েশ্চেন যার নাম সি,এ,টি এম,সি,কিউ এক্সামিনেশন। এটি পাশ করলে পরের পার্টটি দুই ভাবে দেয়া যায়- ‘এ,এম,সি ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন’ অথবা ‘ওয়ার্কপ্লেস বেজড এসেসমেন্ট’। প্রথম পার্টের সেন্টার ইণ্ডিয়ায় আছে (কোলকাতায় নেই)। দ্বিতীয় পার্ট অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েই দিতে হয়। যারা ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন দিবেন তাদের পরীক্ষা এক দিনে সম্পন্ন হয়। আর, যারা ওয়ার্কপ্লেস বেজড এসেসমেন্ট-এ অংশ নেবেন তাদেরকে এএমসি পার্ট ওয়ান পাশ করার পর মেডিকেল বোর্ড অব অস্ট্রেলিয়া থেকে লিমিটেড রেজিস্ট্রেসন অর্জন করতে হবে। এরপর নিজ দায়িত্বে (অর্থাৎ সিভি সাবমিট করে, সরাসরি যোগাযোগ করে বা অন্য কোন উপায়ে) অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল অনুমোদিত কোন হাসপাতালে জব নিতে পারলে, কাউন্সিল বরাবর এপ্লিকেশন করে ওয়ার্কপ্লেস বেজড এসেসমেন্টের সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।  

এএমসি পাশ করার পর টিচিং হাসপাতালে ইণ্টার্ণশিপের জন্য আবেদন করতে হবে। লক্ষ্যনীয় যে, বাইরের মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ইণ্টার্ণশিপের পজিশন আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে, পজিশনের জন্য প্রতিযোগীতা বেড়ে গেছে। ইণ্টার্ণশিপ শেষ হলে প্র্যাকটিস-এর লাইসেন্স পেতে আবেদন করতে হয়ে। কিন্তু, লাইসেন্স পাওয়ার অন্যতম আরেকটি শর্ত হল- পারমানেন্ট রেসিডেন্সি থাকা। অস্ট্রেলিয়ার স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার লিস্টে চিকিৎসক না থাকায়, রেসিডেন্সির পাওয়ার একমাত্র উপায় হল ইন্টার্ণশিপ শেষে আবেদন করা। লক্ষ্যনীয়, রেসিডেন্সির আবেদনের ক্ষেত্রে ভিসার রকমভেদে অতিরিক্ত শর্তাবলী আছে। সুতরাং, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বিয়ে করার চেয়ে সহজ কোন উপায় এ পথে নেই।

নিউজিল্যাণ্ডে আই,এম,জি-দের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া অস্ট্রেলিয়ার মতই। 

পরিশেষে

এ লেখার মধ্য দিয়ে যুক্তরাস্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মেডিকেল পড়াশোনা সম্পর্কে আমরা সংক্ষেপে জানতে পারলাম। তবে বেশ কিছু জিনিস এই আর্টিকেলে ওঠে আসেনি,  যেমন: মেডিকেল স্কুলে পড়ার বিশাল খরচ, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের প্রয়োজনীয় ধাপগুলোতে খরচ, ভিসা নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি। তারপরও, প্রবন্ধটি পাশ্চাত্যের মেডিকেল পড়ালেখা সম্পর্কে অনেকের কৌতুহল কিছুটা হলেও মেটাতে পারবে বলে আশা রাখছি।

লেখাটি তৈরী করতে যে ওয়েবসাইটগুলোর সাহায্য নেয়া হয়েছে:

১. http://en.wikipedia.org/wiki/Medical_education_in_the_United_States

২. http://en.wikipedia.org/wiki/Medical_school_in_Canada

৩. http://en.wikipedia.org/wiki/Medical_education_in_the_United_Kingdom

৪. http://en.wikipedia.org/wiki/Medical_education_in_Australia

৫. http://en.wikipedia.org/wiki/Medical_school_in_the_United_States

৬. http://en.wikipedia.org/wiki/Medical_school_in_the_United_Kingdom

৭. http://en.wikipedia.org/wiki/Residency_(medicine)

৮. http://www.usmle.org/

৯. http://imgbc.med.ubc.ca/path-to-residency/

১০. http://www.gmc-uk.org/

১১. http://www.amc.org.au/

১২. http://people.howstuffworks.com/becoming-a-doctor12.htm)

১৩. http://www.telegraph.co.uk/health/healthnews/10741905/EU-rules-on-doctors-working-hours-puts-patients-at-risk-report-finds.html

সর্বশেষ আপডেট: ০২/০৬/২০১৪ (সকাল ১০ টা ২৫ মিনিট)

ডিসেকটিং দ্য মিথ অফ ‘কসাই’ ডাক্তার

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের একটি সাধারণ অভিযোগ হল: ডাক্তাররা কসাইয়ের মত টাকা নেন। বিষয়টি নিয়ে ভাবলাম। মনে হল এই মিথটার ব্যবচ্ছেদ করা দরকার।

আমরা যারা তরুণ ‘সিম্পল এম.বি.বি.এস’ ডাক্তার তারা এ অভিযোগ শুনে অবাক হই। কারণ, ঢাকায় (মূল শহর থেকে একটু দূরে) আমরা প্রাইভেট চেম্বার দিয়ে বসলে প্রতি দুই দিনে গড়ে এক থেকে দুই জন এবং মাসে গড়ে বিশ থেকে পয়ত্রিশ জন রূগী পেতে পারি। ভিজিট দুশ, এলাকা ভেদে সর্বচ্চো তিনশ। আমাদের রূগী দেখার হারে কোন সাধারণ মানুষও কসাই বলবে না। তাহলে সাধারণ মানুষরা কিসের উপর ভিত্তি করে তাদের অভিযোগের জেনারালাইজেশন করছে?

চলুন একটু ঘেঁটে দেখি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একটি সমস্যা হলো ‘রেফারেল সিস্টেম’-এর বালাই নেই। রেফারেল সিস্টেম অনুযায়ী একজন ব্যক্তি অসুস্থ হলে তাকে প্রথমে দেখবে একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান অথবা জেনারেল প্র্যাকটিশনার। তিনি রোগটির সমাধান করতে না পারলে পাঠাবেন একজন বিশেষজ্ঞের কাছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেখানোর জন্য কোন ডাক্তারের রেফারেন্স প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র ফোন দিয়ে একটি সিরিয়াল নিয়ে নেয়া। আর ‘যেহেতু যে বিশেষজ্ঞ ইচ্ছে তার কাছেই যাওয়া যাচ্ছে সেহেতু প্রফেসরকেই দেখাই’-এই মানসিকতায় প্রফেসরদের কাছে রোগী যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। ফলে কোন কোন প্রফেসর গড়ে একশ রোগী দেখেন।

যেই প্রফেসর গড়ে একশ রোগী দেখেন তার পক্ষে কি প্রত্যেক রোগীকে ৫ মিনিট করেও দেয়া সম্ভব? ৫০০ মিনিটে হয় ৮ ঘন্টা ২০ মিনিট। ফলে উক্ত প্রফেসর সর্বোচ্চ এক থেকে তিন মিনিট সময় দিতে পারেন। এই এক থেকে তিন মিনিটে তার ভিজিট পাঁচশ থেকে একহাজার (ডাক্তার ভেদে)। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের অভিযোগ ডাক্তাররা কসাই-এর মত টাকা নেয়।

কিন্তু কয়েকটা ব্যপার লক্ষ্যনীয়। উপরের চিত্রটি মেডিসিন প্রফেসরদের (অল্পকিছু)। বিশেষজ্ঞ ও প্রফেসর সার্জনরা হয়ত দু তিন মিনিটে রূগী দেখেন না, কিন্তু তারা সার্জারী করে মেডিসিন ডাক্তারদের চেয়েও বেশী আয় করেন। কিন্তু তাদের কথা সাধারণ লোকের মুখে সাধারণত আসে না। আবার মেডিসিন প্রফেসরদের উপরোক্ত চিত্রটি কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসকের। অনেকটা ব্যবসায়ীদের মধ্যে শিল্পপতিদের সংখ্যাটা যেমন, ঠিক তেমন।এই যে শিল্পপতিরা এত টাকা আয় করছেন, রাজণীতিবিদরা দূর্ণীতি করে মানুষের কষ্টার্জিত টাকা মেরে খাচ্ছেন তাদের মানুষ ‘কসাই’ বলছে না কেন?

আমার ধারণা এর কারণ হল ‘Visibility’। মানুষের হাত থেকে যখন নগদ টাকা বেরিয়ে যায় তখন চোখে লাগে। বিশেষ করে তা যদি হয় দু-তিন মিনিটের এডভাইজের বিনিময়ে। প্রশ্ন হতে পারে, পণ্য কিনতে গিয়েও তো মানুষের হাত থেকে নগদ টাকা বেরোয়? পণ্য কিনলে মানুষ একটা ভিজিবল জিনিস কিনছে। কিন্তু ডাক্তারদের সেবাটা ভিজিবল না। আবার অন্য দিক দিয়ে, প্রফেসর ডাক্তারদের দু-তিন মিনিটে পাঁচশ টাকা ভিজিট নিয়ে নেয়াটাও মানুষের চোখে বেশ লাগে। অথচ, এই গুটি কয়েক প্রফেসরদের তাদের অবস্থানে যেতে কি পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা তারা বিবেচনায় আনতে পারেন না। তদুপরি, প্রফেসরকে দেখাতে হবে এমন কোন কথা আছে কি? এসোসিয়েট প্রফেসর, এসিসটেন্ট প্রফেসর, কনসালটেন্ট যার কাছেই যান না কেন তারা এত বেশী অযোগ্য না যে আপনার সমস্যা বুঝতে পারবে না। বরং তাদের রূগী কম হওয়ায় তারা আপনাকে সময় বেশী দিতে পারবেন। আপনার কথা ধৈর্য্য ধরে শুনতে পারবেন। অর্থাৎ, এখানে সমস্যাটা জানার সীমাবদ্ধতার, বিশ্বাসহীনতার, অসচেতনতার।

একজন প্রফেসর হওয়া কি এতই সহজ? যে কয়জন প্রফেসরকে আমরা দৈনিক গড়ে ৫০-এর উপরে রূগী দেখতে দেখী তাদের সংখ্যা প্রফেসরদের মধ্যেও সীমিত এবং এরা প্রায় সবাই সরকারী ডাক্তার। কিন্তু প্রফেসর হওয়াটাই সময়সাপেক্ষ ব্যপার, দীর্ঘসূত্রিতার ব্যপার। আমি গত দিনের পোস্টে বলেছিলাম যে একজন সরকারী ডাক্তারের এমডি, এমএস বা এফসিপিএস ডিগ্রী অর্জন করতে ন্যূনতম ১৪ বছর লেগে যায়(এটি একটি হিসেব, বাস্তবে নানাবিধ জটিলতার কারণে সময় লাগে আরও বেশী)। অথচ, এই ডিগ্রী অর্জন ছাড়া একজন ডাক্তার কনসালটেন্ট পদে প্রমোশন পায় না। এমনকি, কতবছর ধরে সরকারী চাকুরী করছে তার উপর ভিত্তি করে, অনেক স্নাতোকত্তোর ডিগ্রীধারী ডাক্তাররাও প্রমোশন পায় না। উদাহরণস্বরূপ, সাতাশ বিসিএস ক্যাডাররা জয়েন করেছেন ২০০৮-এ। আজ ছয় বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো অনেকেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ আটকে আছেন। ৫০% ক্যাডারের ডিগ্রী শেষ হলেও প্রমোশন হচ্ছে না জুনিয়র বিসিএস হওয়ার। এ ধরনের ঘটনা ডাক্তারদের জন্য বেশ ডিমোরালাইজিং। কনসালটেন্ট হওয়ার পর চাকুরীর অভিজ্ঞতার আলোকে এসিসটেন্ট প্রফেসর, এসোসিয়েট প্রফেসর ইত্যাদি পথ পেরিয়ে তারপর প্রফেসর হতে হয়। ফলে, প্রফেসর চিকিৎসক হতে গিয়ে বয়স কমপক্ষে ৫০ পেড়িয়ে যায়। তবে, অনেক ডাক্তার এত দূর যেতে পারেন না। তারপরও যে ডাক্তার এত পথ পাড়ি দিয়ে প্রফেসর হলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি তার যোগ্যতার বলেই হন। যোগ্যতা এবং মেধার বিনিময় নেয়ার অধিকার তার আছে।

সাধারণ মানুষদের আরেকটি অভিযোগ হল অনেক ডাক্তারের মনোভাব ব্যবসায়ী হয়ে পড়ে। আমার ধারণা এটা মনে হওয়ার অন্যতম কারণ অল্প সময়ে রূগী দেখা, রূগীর কথা না শোনা। কিন্তু ডাক্তারদের এই সময় সংকোচনের পেছনে মানুষেরও-তো দায় আছে। তাদের কি শুধু প্রফেসরদের কাছেই যেতে হবে। হ্যাঁ, কিছু ডাক্তার আক্ষরিক অর্থেই ‘পুরোপুরি ব্যবসায়ী’ হয়ে যায়, যেটা কখনই কাম্য নয়। এটাকে আমি জাস্টিফাই করছি না তবে এর কারণ হিসেবে ডাক্তারদের দীর্ঘ অপ্রাপ্তি, ফ্রাস্টেশনের দায় আছে বলে মনে করছি।

আরও কিছু অভিযোগ আছে ‘ক্লিনিক’, ‘কমিশন’ ইত্যাদি বিষয়ে। ক্লিনিকের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন করার সম্পূর্ণ সুযোগ আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্লিনিক ডাক্তারদের দেয়া না, এটা মাথায় রাখা দরকার। বরং ক্লিনিকে যেই ডিউটি ডাক্তাররা কাজ করেন তারা ক্লিনিক কতৃপক্ষের কাছে জিম্মী থাকেন। ক্লিনিকে রূগী পাঠান ‘গ্রাম্য ডাক্তাররা’, তারা এর বিনিময়ে ক্লিনিকের কাছ থেকে কমিশন পান। ক্লিনিকের মালিক মুনাফার জন্য ডাক্তারদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা দিতে বাধ্য করেন। ডাক্তাররাও জিম্মী। কারণ এখানে যাচ্ছে অবৈতনিক প্রশিক্ষনার্থী ডাক্তাররা তাদের জীবিকার জন্য। ক্লিনিক কতৃপক্ষের সাথে বাকবিতণ্ডায় গেলে তারা চাকুরী হারাবেন। আর কেউ একবার চাকুরী পেলে ছাড়তে চান না। কারণ অনেক তরুণ ডাক্তার এই অল্প বেতনের চাকুরীতে প্রবেশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।

‘কমিশন’ বিষয়টা চালুর পিছনে দায়ী প্রতিযোগীতামূলক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসায় এবং কিছু ডাক্তারদের লোভ ও ক্ষোভ। এ বিষয়টি এখন এত বেশী স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে তথা হেল্দ-সিস্টেমের সাথে মিশে গেছে যে, যারা কমিশন নিতে আগ্রহী নন তারাও অনেক সময় বাধ্য হয়ে পড়েন। তবে এর পেছনে একদল ডাক্তারের পুঁজিবাদী মন মানসিকতা, লোভ ও স্বার্থপরতা দায়ী তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এটাতো সব মানুষের ক্ষেত্রেই সাধারণ সমস্যা। কিছু মানুষের অতিরিক্ত লোভ পুঁজিবাদী অর্থণীতিতে অনেক মানুষকে ভোগায়। এই কিছুর মধ্যে ডাক্তারদের একটি অংশ আছে। ‘কমিশন’ সিস্টেম দূর করতে হলে লাগবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারকদের সদিচ্ছা। ডাক্তারদের উপযুক্ত সম্মানী দেয়া, উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারদের পেশাগত মর্যাদার উপযুক্ত স্বীকৃতি দেয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি উপায়ে। আর লোভ, স্বার্থপরতা দূর করে মানবিকতা তৈরী করতে হলে মূল্যবোধের শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলা বাহুল্য।

সুতরাং, ডাক্তারদের ‘কসাই’ উপাধীর ব্যবচ্ছেদ করে আমরা কয়েকটি পরস্পরজড়িত সমস্যা পেলাম। লক্ষ্যণীয়, স্বাস্থ্যনীতিতে শক্তিশালী রেফারেল সিস্টেম চালু থাকলে ডাক্তার-রূগী দু’দিক থেকেই অপ্রাপ্তি কমে আসতো। তারপরও একজন ডাক্তার হিসেবে সাধারণ মানুষদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনারা ডাক্তার বলতে শুধ প্রফেসরদের বুঝবেন না এবং ডাক্তারদের মেধা ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন করবেন, তাহলে দেখবেন তাদের ‘কসাই’ বলে উপাধি দেয়ার আগে আপনার জিহবাটা বেঁধে আসছে।

ডাক্তারের পড়ালেখা, প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশ

মেডিকেলের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীগুলো কেমন ধরনের? অধিকাংশ নন-মেডিকেল ব্যক্তিদের এ ব্যপারে কোন ধারনাই নেই। বিশেষ করে পরিবারে বা আত্মীয়দের মধ্যে একজন ডাক্তার না থাকলে ডাক্তারদের পড়াশোনা সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই জানেন না। অনেকেই জানে ডাক্তারদের পড়তে হয়, সারাজীবন পড়তে হয়। কিন্তু সেই পড়ালেখার এক্সটেন্ট কতটুকু। তাদের ডিগ্রী কখন শুরু হয়, কখন শেষ হয় সে সম্পর্কে জানা নেই।

তাই ভাবলাম এ বিষয়ে একটু লিখি। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে নেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডাক্তারদের পড়ালেখা পদ্ধতির একটু ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশে আমরা কিভাবে পড়ি? আমরা সকলেই জানি ডাক্তারদের স্নাতক ডিগ্রী পাঁচ বছরের। পাঁচ বছর পর একজন মেডিকেল ছাত্র নামের শেষে ডাক্তার শব্দটি লাগানোর যোগ্যতা অর্জন করেন। এই পাঁচটি বছরকে তিনটি প্রোফেশনাল পরীক্ষায় ভাগ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় বেসিক সাবজেক্টগুলো পড়তে হয়। যে-সে পড়া না, বিস্তারিত পড়া। প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি পড়তে হয়। দ্বিতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্যাথোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলোজি, ফরেনসিক মেডিসিন এবং কমিউনিটি মেডিসিন পড়তে হয়। এরপর তৃতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় পড়তে হয় মেডিসিন, সার্জারী এবং গাইনি ও অবস্টেট্রিকস (এই তিনটি সাবজেক্টের যতটুকু একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানের জানা প্রয়োজন ততটুকু)।

এম.বি.বি.এস. পরীক্ষায় পাশ করলেই একজন ছাত্র পৃথকভাবে চিকিৎসা দেয়ার লাইসেন্স পেয়ে যায় না। তাকে এক বছর ইন্টার্ণশিপ শেষ করতে হয় (মেডিসিনে, সার্জারি ও গাইনি প্রত্যেকটিতে চারমাস করে)। ইন্টার্ণশিপ শেষ করলে মূলত আসল পড়া শুরু হয়। অর্থাৎ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তে হয়। একজন ইচ্ছে করলে এম.বি.বি.এস ডিগ্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে। বর্তমানে ‘সিম্পল’ এম.বি.বি.এস বলে যে জনমুখে একটি ‘টার্ম’ চলে এসেছে। সেটি কি তা করতে দিবে? পাঠক লক্ষ্য করুন, একজন অনার্সের ছাত্রের চারবছরে স্নাতক শেষ হচ্ছে। আর একজন ডাক্তারের চিকিৎসা দেয়া লাইসেন্স পেতেই সময় লাগছে ছয় বছর।

যাই হোক, বাংলাদেশে ডাক্তাররা প্রধানত দুধরনের পোস্ট-গ্র্যাড ডিগ্রী নিতে পারেন। Fellow of College of Physicians and Surgeons (সংক্ষেপে এফসিপিএস), আরেকটি হলো Doctor of Medicine(এমডি) অথবা Master of Surgeon (এমএস)। তবে এর বাইরে কিছু কিছু বিষয়ে ডিপ্লোমা করার সুযোগ আছে এবং বেসিক সাবজেক্টগুলোতে এমফিল করার ও এপিডেমিওলজিতে এমপিএইচ করার সুযোগ আছে। স্নাতোকত্তোর পর্যায়ে এসেই একজন ডাক্তার কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন সেটি ঠিক করতে হয়।

এমডি বা এমএস ডিগ্রীদুটোর সময়সীমা পাঁচ বছর। তবে এই ডিগ্রীগুলোর সিট সংখ্যা সীমিত, সবগুলো মেডিকেল কলেজে হয় না। তাই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়। তবে ভর্তি পরীক্ষায় বসার শর্ত হলো ইন্টার্ণশিপের পর একবছর অতিবাহিত করতে হবে। যদিও ডিগ্রীগুলো করাকালীন একজন বেসরকারী ডাক্তারের হাসপাতালে সেবা দিতে হয়, সে এর বিনিময়ে কোন সম্মানী পায় না। বরং ভর্তির সময় ও পরীক্ষার সময় মোটা অংকের টাকা তাকেই দিতে হয়। সরকারী ডাক্তার এ সেবার বিনিময়ে বেতন পায়- যে বেতন সে একজন প্রথমশ্রেনীর কর্মচারী হিসেবে পেয়ে থাকে (প্রায় বিশ হাজার টাকা মাসে)। তবে সরকারী ডাক্তারদের উক্ত ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে বসতে পারে দুবছর উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স-এ কাটানোর পর। সুতরাং সে হিসেবে একবারে পাশ করতে পারলে একজন ডাক্তারের স্নাতক ও স্নাতকত্তোর ডিগ্রী অর্জন করতে লাগছে ১২ বছর(বেসরকারী) এবং ১৪ বছর (সরকারী)।এটা হলো ন্যূনতম হিসেব। (উল্লেখ্য এই ডিগ্রীতে ভর্তির আগে এবং ডিগ্রী করাকালীন একজন ডাক্তারকে তার এমবিবিএস-এর বেসিক সাবজেক্টগুলোর ছয়টি পুনরায় পড়তে হয়।)

এফসিপিএস ডিগ্রীর সময়সীমা চার বছর। কিন্তু এই ডিগ্রীটিতে এতই কঠিন পরীক্ষা হয় যে এক-দুবারে পাশ না করা্টাই নিয়ম। ফলে এই ডিগ্রী শেষ করতে পাঁচ থেকে দশ বছর লেগে যায়। ডিগ্রিটি দেয় বিসিপিএস নামক একটি প্রতিষ্ঠান। শর্ত হলো এফসিপিএস ফার্স্ট পার্ট করে ডিগ্রীতে প্রবেশ করতে হবে। এ সময় তাকে ফার্স্ট পার্ট করার জন্য বেসিক সাবজেক্ট এবং সে যে সাবজেক্টে এফসিপিএস করতে সেটি পড়তে হয়। তিন বছর একজন এফসিপিএস ডিগ্রীধারী ডাক্তারের সুপারভিশনে ট্রেইনিং করতে হবে, এক বছর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্লাস করতে হবে এবং সম্পূর্ণ নিজ খরচে ও নিজ দায়িত্বে একজন সুপারভাইজার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে একটি ডেসারটেশন করে সাবমিট করতে হবে। একবছর ক্লাসের স্থলে কেউ এক বছর একটি ‘পেইড’ পোস্টে ট্রেনিং করতে পারে। হ্যা, একজন এমবিবিএস ডাক্তার তার ইন্টার্ণশিপ শেষে মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ট্রেনিং-এ ঢুকতে পারবে। এই যে ট্রেনিং যারা করছে, এরাই সেই নটোরিয়াস ‘অনারারী’ মেডিকেল অফিসার তথা অবৈতনিক মেডিকেল অফিসার। ‘বৈতনিক’ ট্রেনিং তারাই করতে পারে যারা সরকারী চাকুরী করছে এবং উপজেলায় দু-বছর পার করে এসেছে। তবে এ ধরনের বৈতনিক বা পেইড পোস্টগুলোর সংখ্যা কম। ফলে ঘুষ দেয়ার যোগ্যতা, মামুর জোড় বা রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া এ পোস্ট পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে পোস্টগুলো যদি হয় ঢাকার কোন মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে, তাহলেতো কথাই নেই। যাই হোক, একজন এফসিপিএস পার্ট দুই পরীক্ষায় বসতে পারবে উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণে। সুতরাং, এভাবে একজন ডাক্তারের ভাগ্য ভালো থাকলে জীবনের ন্যূনতম ১০ বছর(বেসরকারী) অথবা ১২ বছর(সরকারী) পার হচ্ছে।

ডিপ্লোমা ডিগ্রীগুলোর ভ্যালুয়েশন কম।(তার মানে এই না যে ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারীরা একেবারে কম দক্ষ) এগুলো করতে সময় লাগে দুই বছর। ইন্টার্ণশিপের এক বছর পর পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়। এম ফিল ডিগ্রীগুলো তিন বছর। ডিগ্রী শেষে মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা মেডিকেল কলেজের টিচার হতে পারে। তবে বায়োকেমিস্ট, প্যাথোলজিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্টরা ল্যাবে কাজ করতে পারে।লক্ষ্যনীয় বাংলাদেশে পারতপক্ষে কোন রিসার্চ এক্টিভিটি নেই বিধায়, ডক্টরেট(পিএইচডি) ডিগ্রী করার সুযোগ নেই বললেই চলে। সুতরাং এমফিল বা ডিপ্লোমা করলেও লাগছে যথাক্রমে ১০ বছর বা ৯ বছর (বেসরকারী) এবং ১২ বছর  বা ১১ বছর (সরকারী)।

শুধুমাত্র মাস্টার ইন পাবলিক হেল্দ বা এমপিএইচ ডিগ্রীর সময় দেড় থেকে দুই বছর। ইন্টার্ণশিপের পরে একবছর পার করে পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়। এ ডাক্তাররাও সাধারনত সরাসরি চিকিৎসা সেবা দেন না। বরং নিপসম বা বিভিন্ন মেডিকেলে কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের টিচার হন। অথবা বিভিন্ন এনজিও-তে রিসার্চ ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করেন। এদেরও সময় লাগছে ৯ বছর (বেসরকারী) বা ১০ বছর (সরকারী)।

সুতরাং এই যে একজন ব্যক্তি যাকে অনেকে কসাই বলে উপাধি দিচ্ছেন, স্নাতক-লেভেলে প্রবেশের পর থেকে (আনুমানিক বিশ বছর বয়স)প্রায় ৯ থেকে ১৪ বছর ধরে তার শুধুমাত্র কর্মজীবনের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের সময় একজন বেসরকারী ডাক্তারকে (মনে রাখা দরকার অধিকাংশ ডাক্তারই বেসরকারী) ৩ থেকে ৬ বছর বিনা বেতনে খাঁটতে হয়। কিন্তু নিজের জীবনতো চালাতে হবে। সবার পারিবারিক ব্যকগ্রাউণ্ডতো তাকে এ সময়টিতে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতে পারে না। কারো আবার নিজের পরিবারকেই সাপোর্ট দিতে হয়। এ সময়ে অনেকেই হাসপাতালে সপ্তাহে ন্যূনতম ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় দেবার পাশাপাশি বাইরে কোন ক্লিনিকে বা হাসপাতালে ৪৮ ঘন্টা সময় দেন। অর্থাৎ এ সময় তার সপ্তাহে প্রায় ৯৬ ঘন্টা ঘরের বাইরে সেবা দিয়ে যেতে হয়। অথচ এ সময় তার বেতন সর্বনিম্ন ১২ হাজার থেকে সর্বচ্চো ৩০ হাজার (হাসপাতাল ও যোগ্যতা ভেদে)। গড়ে ২০ হাজার ধরলে তার বেতন ঘন্টা প্রতি ৫০ টাকার মত। সাথে যাচ্ছে প্রচণ্ড মানসিক ও শারিরীক পরিশ্রম।

লক্ষ্য করে দেখুন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন অনার্স বা মাস্টার্স করে বেরিয়ে বেসরকারী ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলে বেতন ৩৫০০০ থেকে ৪০০০০ হাজার টাকায় শুরু হয়।(আমি যতটুকু দেখেছি)অথচ একজন ডাক্তার অনার্স করে বেরিয়ে বেসরকারী মেডিকেলে গড়ে ২৫০০০ টাকার মত বেতনে টিচার হিসেবে জয়েন করতে পারে। এটাকি বৈষম্য নয়?

যাইহোক ডিগ্রীর কথা বলতে গিয়ে বেতনের কথা চলে এলো। হাজার হোক ডাক্তাররা হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। তাদেরও বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। উদ্ভিদের মত তাদের খাদ্য শরীরে সংশ্লেষ হয় না।

সর্বশেষ আপডেট: ২২/০৫/২০১৪